শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ভারতের দু’জন রাষ্ট্রপতির কথা শুনুন


আজকের নিবন্ধে ভারতের দু’জন রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে বলবো। একজন ‘মুসলমান’ এপিজে আবদুল কালাম, অন্যজন ‘বাঙালী’ প্রণব মুখার্জি। এই দু’জনকে বেছে নেয়ার কারণ সম্পর্কে পাঠকরা নিজেরাই বুঝতে পারবেন বলে আশা করি। প্রথমজন সম্প্রতি নিজে মারা গেছেন, অন্যদিকে দ্বিতীয়জনের স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। তিনি, শ্রীমতি শুভ্রা মুখার্জি আবার বাংলাদেশের নড়াইলের কন্যা ছিলেন। ফলে তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটু বেশিই হৈচৈ হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার ছোট বোন ও মেয়েকে নিয়ে দিল্লী ছুটে গেছেন। শুভ্রা মুখার্জির শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছেন। আরো অনেকের কথাও প্রকাশিত হয়েছে। বলা যায়, শোকের বন্যা না হলেও বৃষ্টি বইয়ে দিয়েছেন তারা। সেদিকে যাওয়ার পরিবর্তে ‘মিসাইলম্যান’ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠা এপিজে আবদুল কালাম প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। বাংলাদেশে ভারতের এই সাবেক রাষ্ট্রপতিকে নিয়েও মাঝখানে ক’দিন বেশ আলোচনা হয়েছে। কারণ ছিল তার মৃত্যু। দিল্লী থেকে এসে মেঘালয়ের শিলং শহরের এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময় মারা গেছেন তিনি। তার জীবন ও কীর্তি তথা অবদানকে নিয়ে আলোচনাও যথেষ্টই হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, ভারতকে তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী বানিয়ে গেছেন। মিসাইল নির্মাণের কারণে তার পরিচিতি ছিল ‘মিসাইলম্যান’ হিসেবে।
আমার নিজের অবশ্য এপিজে আবদুল কালামের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই। কারণ, সম্মান এমন কাউকেই করা যায়, যার কাছ থেকে মানুষ সভ্যতার বিকাশ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সুন্দর ও নিরাপদ জীবনের জন্য বিশেষ কিছু শিখতে এবং অনুপ্রাণিত হতে পারে। সেদিক থেকে এপিজে আবদুল কালামের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এর কারণ, তার ‘সাফল্য’ বা ‘কৃতিত্ব’ বলতে সাধারণত পারমাণবিক বোমা ও মিসাইল বানানোর কথাই উল্লেখ করা হয়। এটা এমন এক বোমা ও মিসাইল, যা দিয়ে একই সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকে হত্যা করা যায়। ধ্বংস করা যায় সভ্যতাকেও। কখন কোন দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সত্য হলো, ভারত কোনো না কোনো সময় এই বোমা ও মিসাইলের ব্যবহার করবে- এমন চিন্তা থেকেই এ দুটি মারণাস্ত্র বানিয়ে গেছেন এপিজে আবদুল কালাম। ভারতীয় হিসেবে এই ধ্বংসাত্মক ‘সাফল্য’ দেখানোর বাইরে তিনি মানবতার জন্য এবং সাধারণভাবে ভারতীয়দের জন্য সৃষ্টিশীল বা কল্যাণধর্মী তেমন অবদান রেখেছেন বলে জানা যায় না। তার মৃত্যুর পর ভারতীয় মুসলমানদের কথাও উঠে এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। ভারতে বছরের পর বছর ধরে দাঙ্গায় মুসলমানদের অসহায় মৃত্যু ঘটছে। মুসলমানদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে এপিজে আবদুল কালামকে কখনো সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ও গুজরাট ও মহারাষ্ট্রসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মিথ্যা অভিযোগে দাঙ্গা বাধিয়ে শয়ে শয়ে মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের রক্ষার জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে এপিজে আবদুল কালাম কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে শোনা যায়নি।
মুসলমান নাম নিয়ে রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি বরং ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের জন্য ‘যুক্তি’ দেখানোর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদীরা বিশ্বকে জোর গলায় বলতে পেরেছে, ভারত এতটাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘অসাম্প্রদায়িক’ রাষ্ট্র যে, এপিজে আবদুল কালামের মতো একজন মুসলমানও সেখানে রাষ্ট্রপতি হতে পারেন! এর ফলে কোনো দেশকেই একথা বিশ্বাস করানো সহজ হয়নি যে, যে দেশে একজন মুসলমান রাষ্ট্রপতি হতে পারেন সে দেশে মুসলমানদের হত্যা ও উচ্ছেদ করা সম্ভব। হত্যা ও উচ্ছেদ করা হয়েও থাকে। নামে মুসলমান হয়েও এভাবেই ভারতীয় মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতনের ‘ওপেন লাইসেন্স’ দিয়েছিলেন এপিজে আবদুল কালাম। হিন্দুত্ববাদীরাও সে লাইসেন্সের সদ্ব্যবহার করেছে যথেচ্ছভাবেই। এখনো মুসলমানরা সর্বাত্মকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন ভারতে। এজন্যই যতো বড় ‘বিজ্ঞানী’ হোন না কেন, লাখ লাখ মানুষ ও প্রাণীকে হত্যা এবং সম্পদ ও সভ্যতা ধ্বংসের জন্য পারমাণবিক বোমা ও মিসাইল বানিয়ে যিনি ভারতের মতো সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছেন, তেমন একজন ব্যক্তির কাছে বাংলাদেশীদের শিক্ষণীয় কিছু থাকতে পারে কি নাÑ সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। উঠেছেও। বলা হয়েছে, নীতি-নৈতিকতা, ধর্ম, মানবিকতা বা সভ্যতার উন্নয়নের মতো কোনো বিষয়ে তিনি বাংলাদেশীদের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হতে পারেন না।
এবার ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি প্রসঙ্গ। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বে তখনকার ক্ষমতাসীন ইউপিএ জোটের মনোনয়ন পেয়ে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। প্রথম ‘বাঙালী’ রাষ্ট্রপতি হওয়ায় বাংলাদেশে ভারতের ‘ছাতা ধরনেওয়ালারা’ আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলেন। অনেকে এমনকি একথা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ ভারতের রাজ্য হয়ে যায়নি। পত্রিকার কলামে ও টেলিভিশনের টক শোতে তারা প্রণব-বন্দনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। থৈ-থৈ অবস্থায় দেখা গেছে তাদের। তারা বলেছিলেন, প্রণব মুখার্জির এই ‘কৃতিত্বের’ জন্য বিশ্বের যেখানে যতো ‘বাঙালী’ আছে তাদের প্রত্যেকেরই গর্বিত ও আনন্দিত হওয়া উচিত! আসলেও কি তাই? অন্যদের কথা না হয় বাদই দেয়া গেলো, প্রণব মুখার্জির নিজের রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের সব ‘বাঙালী’কেও কিন্তু থৈ-থৈ করে উঠতে দেখা যায়নি। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং এদেশের কারো কারো ‘দিদিমনি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বরং শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও প্রণব মুখার্জিকে রশি দিয়ে বেঁধে নামিয়ে আনারই চেষ্টা চালিয়েছিলেন। মূলত তার ইন্ধনেই প্রণবের বিরুদ্ধে সাবেক স্পীকার পি এ সাংমাকে রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড় করানো হয়েছিল।
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য প্রণব মুখার্জিকে দীর্ঘ ৬৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কথা শুধু এটুকুই নয়। বাস্তবে রাষ্ট্রপতি বানানোর নামে প্রণব মুখার্জিকে প্রধানমন্ত্রিত্বের রেস বা দৌড় থেকে সুকৌশলে সরিয়ে দিয়েছিল কংগ্রেস। ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে গান্ধী পরিবারের অতি বিশ্বস্ত হিসেবে ভূমিকা পালন করে এলেও প্রণব মুখার্জি কংগ্রেসের জন্য ‘বার্ডেন’ তথা বোঝা হয়ে উঠেছিলেন। সোনিয়া গান্ধী না তাকে গিলতে পারছিলেন, না পারছিলেন উগলে ফেলতে। সুযোগ পেলেই প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আবদার জানিয়ে বসছিলেন। ওই সময়ে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে আরো একবার তৎপর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু যতো বিশ্বস্ত হোন না কেন, একদিকে তিনি ‘বাঙালী’ অন্যদিকে আবার চেষ্টা চলছিল রাজিব ও সোনিয়া গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য। সে কারণেই কংগ্রেসের ঘাড় থেকে প্রণব নামের ‘বোঝা’টিকে ঝেড়ে ফেলে দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। সেটাই করেছে কংগ্রেস। প্রণব মুখার্জি যাতে এদিক-সেদিক করতে না পারেন সেজন্য স্বয়ং সোনিয়া গান্ধী তার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি বানানোর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ভারতের রাজনীতি থেকেই প্রণব মুখার্জিকে বিদায় করেছেন সোনিয়া গান্ধী। সুতরাং আনন্দে ধেই ধেই করে নেচে ওঠার এবং বিশ্বের সব ‘বাঙালী’র প্রতি নৃত্য করার আহবান জানানোর আগে সংশ্লিষ্টদের উচিত ছিল একটু সংযম দেখানো এবং পুরো বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা।
প্রসঙ্গ যখন এসেছেই তখন বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রণব মুখার্জির ভূমিকার কথা স্মরণ করা যাক। দেখা যাক, ভারতের এই ‘বাঙালী’ রাজনীতিক বাংলাদেশের কোনো উপকার করেছেন কি না। মাঝখানে কিছুদিনের বিরতিসহ ১৯৭৭ সাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদে রয়েছেন তিনি। এ সময়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য থেকে সীমান্তে হত্যা ও পানি সমস্যাসহ কোনো একটি বিষয়েই বাংলাদেশ লাভবান হতে পারেনি। এর সহজ অর্থ, যাকে ‘বাঙালী’ হিসেবে ‘পূজনীয়’ করার চেষ্টা করা হয়েছে সেই প্রণব মুখার্জিও অন্য ভারতীয়দের মতোই ক্ষতি ছাড়া বাংলাদেশের কোনো উপকার করেননি। বিভিন্ন উপলক্ষে তাকে বরং বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা পালনেই বেশি তৎপর দেখা গেছে। উদাহরণ দেয়ার জন্য ২০০৭ সালের নভেম্বরে সিডরের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গে প্রণব মুখার্জির ভূমিকার কথা উল্লেখ করতেই হবে। তিনি তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সিডরের পর পর ঝটিকার বেগে উড়ে এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। মনে হয়েছিল যেন ‘উদার হস্তে’ সাহায্য দেয়াই তার উদ্দেশ্য! কিন্তু পরে দেখা গেলো, তিনি আসলে শুধু দেখতেই এসেছিলেন। কারণ, পাঁচ লাখ টন চাল রফতানির অঙ্গীকার ঘোষণা করলেও তারা এমনভাবেই নতুন নতুন শর্তের বেড়াজালে বেঁধে ফেলার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হয়েছিল। প্রণব মুখার্জির আশ্বাসে মইন-ফখরুদ্দিনদের অসাংবিধানিক সরকার সে সময় অন্য কোনো দেশ থেকে চাল আমদানির চেষ্টা করেনি। ফলে বাংলাদেশকে প্রচণ্ড খাদ্য ঘাটতিতে, প্রকৃতপক্ষে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে হয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘চাউল দাদা’ নামে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। প্রমাণিত হয়েছিল, নামে ‘বাঙালী’ হলেও বাংলাদেশের প্রতি সামান্য মমতাও নেই প্রণব মুখার্জির।
ভারতের এই রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে তথ্যের দ্বিতীয় কিস্তি জানা যাবে পিলখানা হত্যাকা- এবং তার আগের ও পরের কিছু কথা স্মরণ করলে। এ ব্যাপারে ২০১১ সালের ২৭ মার্চ ‘উইকিলিকস’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু খবর প্রকাশ করেছে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’ এবং ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’। উইকিলিকস এবং ভারতের উক্ত দু’টি দৈনিকের রিপোর্ট পাঠকদের অনেকেরই পড়া আছে নিশ্চয়। এই সাথে প্রণব মুখার্জির ২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এবং ২০১০ সালের ৭ আগস্টের সফরের কথাও সকলের মনে থাকার কথা।
এভাবে যে কোনো পর্যালোচনায় দেখা যাবে, প্রণব মুখার্জির ভূমিকা কোনো পর্যায়েই বাংলাদেশের পক্ষে আসেনি। এ সম্পর্কে জানার জন্য বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার পড়ে না। ড. মনমোহন সিং-এর সরকারের আমলেও প্রণব মুখার্জিই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে এসেছেন। বাংলাদেশ কি পেয়েছে বা আদৌ কিছু পেয়েছে কি না পাঠকরা তা ভেবে দেখতে পারেন। এজন্যই এমন আশাবাদ মোটেও ঠিক নয় যে, ‘বাঙালী’ রাষ্ট্রপতি হলেও প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের জন্য ‘স্বর্গের সিঁড়ি’ নির্মাণ করে দেবেন।
সবশেষে বলা দরকার, ‘মুসলমান’ এপিজে আবদুল কালাম যেমন মুসলমানদের জন্য এবং ‘বাঙালী’ প্রণব মুখার্জিও তেমনি ‘বাঙালী’ ও বাংলাদেশের কল্যাণের জন্য কোনো ভূমিকাই পালন করেননি। করবেন বলে আশা করাটাও বোকামীই হবে!
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads