বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কূটনৈতিক পাড়ায় আতঙ্ক এবং বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা


গত সোমবার দুর্বৃত্তদের গুলিতে ইতালীর নাগরিক তাবেলা সিসারে নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীদের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি-আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশেষ করে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ তাদের কূটনীতিক এবং নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছে। চলাচল করার এবং অনুষ্ঠান ও সমাবেশে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আরোপ করেছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। বিষয়টি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জানাজানি হতে বেশি সময় লাগেনি। ফলে বাংলাদেশে কথিত জঙ্গিবাদের উত্থান ও হত্যাকাণ্ডের মতো জঙ্গিদের ভয়ংকর কর্মকাণ্ড নিয়েও দেশে দেশে আলোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর পর্যন্ত এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে। ওদিকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর তো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছেই। সব মিলিয়ে বলা চলে, গোটা বিশ্বেই বাংলাদেশ জঙ্গিদের আস্তানা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, কুখ্যাতি অর্জন করেছে। এমন অবস্থার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সঙ্গত কারণেই দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও মহলগুলো উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছেন না। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমদ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন, কথিত জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে সরকার ও তার সমর্থক এক শ্রেণীর মিডিয়া বিরামহীন প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়েছেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে। এভাবে এক শ্রেণীর মিডিয়ার সমর্থনে সরকারের পক্ষ থেকেই বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এ অবস্থার সুযোগ নিয়েই অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল বাংলাদেশে না আসার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। বিবৃতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য সরাসরি সরকারকে দায়ী করেছেন। জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিতে, ক্ষমতাসীনরা যাতে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচন দিতে এবং পদত্যাগ করে বিদায় নিতে বাধ্য হন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের অস্বীকৃতির পাশাপাশি রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা গুলশানে ইতালীয় নাগরিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কারণে তো বটেই, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী মিথ্যা ধারণা ছড়িয়ে পড়ার কারণেও বাংলাদেশকে এক কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে। বস্তুত জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর যথার্থই বলেছেন। আসলেও সবকিছুর পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার সমর্থক মিডিয়ার অনস্বীকার্য ভূমিকা। অন্য কারো প্রসঙ্গে যাওয়ার পরিবর্তে যদি কেবল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকেই লক্ষ্য করা যায় তাহলেও জানা যাবে, বাংলাদেশের বর্তমান কুখ্যাতির জন্য ঠিক কোন গোষ্ঠী দায়ী। উদাহরণ দেয়ার জন্য ২০১৩ সালে একই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ভাষণের কথা স্মরণ করা যায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সন-তারিখের উল্লেখ করে সে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মদতে ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে নাকি জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিস্তার ঘটেছিল! জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা নাকি জোট সরকারের মদতেই একের পর এক বোমা হামলা চালিয়েছিল! তার সরকারই যে জঙ্গিবাদকে নির্মূল করেছে সে তথ্যটিও প্রধানমন্ত্রী গলা উঁচিয়েই জানান দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। বিভিন্ন দলের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক সকল মহলও অভিন্ন সুরে বলেছিলেন, কথাগুলোর মধ্য দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আসলে তার নিজের দেশকেই ছোট করেছেন। কারণ, ওটা আওয়ামী লীগের সমাবেশ ছিল না। বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘে বিএনপি-জামায়াত ও চারদলীয় জোট সরকারের মতো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনো কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান নালিশ জানান না, এতটা চিৎকার করে তো বলেনই না। প্রধানমন্ত্রীর সম্ভবত খেয়ালই ছিল না যে, যাদের উদ্দেশে বলা তাদের প্রায় সবারই বাংলাদেশে দূতাবাস রয়েছে। রয়েছেন রাষ্ট্রদূতসহ অসংখ্য কূটনীতিক ও গোয়েন্দাও। তারা সকলেই বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকার সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন। কথিত জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে তো সুনির্দিষ্টভাবেই জানেন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর মনে রাখা উচিত ছিল, জঙ্গি নেতাদের ঠিক কোনজন ঠিক কোন দলের নেতাদের ভগ্নিপতি সে তথ্যের সঙ্গে বিদেশীরা একথাও জানেন, চারদলীয় জোট সরকারই শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইদের গ্রেফতার করেছিল। কথিত জঙ্গিবাদকে নির্মূল করার কার্যকর অভিযানও জোট সরকারের সময়ই শুরু হয়েছিল। সুতরাং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে জড়িয়ে ফায়দা হাসিল করার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না।
বলা দরকার, সর্বাত্মক প্রচারণা চালিয়েও সরকার যে কোনো ফায়দাই হাসিল করতে পারেনি সে-কথাটা এতদিনে বোঝা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, জঙ্গি জঙ্গি বলে শোরগোল তুলতে গিয়ে বাস্তবে সরকার নিজেই এখন নিজের ফাঁদে আটকে পড়েছে। এমন অবস্থা কৌতূহলোদ্দীপক সন্দেহ নেই কিন্তু বিষয়টির সঙ্গে যেহেতু জাতীয় স্বার্থ জড়িত রয়েছে সেহেতু আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারি না। আমরা একই সঙ্গে মনে করি, ক্ষমতায় টিকে থাকার সংকীর্ণ স্বার্থে রাষ্ট্র ও জাতি বিরোধী মিথ্যা ও ধ্বংসাত্মক প্রচারণা চালানোর জন্য সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা এবং আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। 

মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

টাঙ্গাইল হত্যাকাণ্ড মেয়রের পুত্রহত্যা ও চেয়ারম্যানের গালের চড়


এক.
গত ১৮ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর ওপর পুলিশের নির্বিচার গুলী বর্ষণে চারজন নিরস্ত্র গ্রামবাসী নিহতের ঘটনায় শোকে ক্ষোভে মুহ্যমান হয়ে পড়ে গোটা এলাকার মানুষ। স্তম্ভিত গোটা দেশের মানুষ। এক মা ও তার ছেলের ওপর এলাকার এক প্রভাবশালীর পৈশাচিক যৌন নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে পুলিশের কাছে কোনো প্রতিকার না পেয়ে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মহাসড়কে এক মানববন্ধনের আয়োজন করেছিল। নির্যাতনকারীর পক্ষ নিয়ে ক্ষুব্ধ সেই গ্রামবাসীদের ওপর নির্বিচার গুলী চালায় পুলিশ। তাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় তিনজন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরও একজন। আহত হয়েছেন প্রায় ৫০ জন গ্রামবাসী।
ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর কালিহাতির সাতুটিয়া গ্রামে এক মা ও তার ছেলেকে শ্লীলতাহানি ঘটায় সেখানকার প্রভাবশালী রফিকুল ইসলাম রোমা ও তার ভগ্নিপতি হাফিজুর রহমান। তারা প্রথমে ঘরে ঢুকিয়ে মায়ের শ্লীলতাহানি ঘটায়। তারপর জোর করে সেইঘরে তার কিশোর ছেলেকে নিয়ে গিয়ে নগ্ন করে তার মায়ের শ্লীলতাহানি করতে বাধ্য করে। ছেলের আর্ত চিৎকারে এলাকাবাসী এগিয়ে এসে ঐ দুজনকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করতে থাকে। ইতিমধ্যে গোটা এলাকায় এ ঘটনার খবর পৌঁছে যায়। ফুঁসে উঠতে শুরু করে কালিহাতি ও ঘাটাইল উপজেলার মানুষ। গ্রামবাসীর বারবার আবেদন সত্ত্বেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো মামলা করে না। বরং অভিযোগ আছে যে, টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেয়। এতে ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে।
এর প্রতিকারের দাবিতেই পাশাপাশি এই দুই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে কালিহাতি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সমবেত হতে থাকে। এর একপর্যায়ে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে কয়েকটি গাড়ি ভাংচুরও হয়। তখন পুলিশ এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করে। এতে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আরও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তারা থানার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। তখন পুলিশ সরাসরি বিক্ষোভকারীদের বুক বরাবর নির্বিচার গুলী চালালে ঐ চারজন খুন হয়।
এ ব্যাপাারে পুলিশের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তাই মিডিয়ার সামনে মুখ খুলতে রাজি হননি। আমরা টেলিভিশনের ভিডিও ফুটেজেও দেখেছি, তারা বলছেন, এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলা যাবে না। তদন্ত চলছে। এই বলে বলে তারা দ্রুত সরে গেছেন ক্যামেরার সামনে থেকে। তারপর পুলিশ তাদের কর্তব্যে বাধা দেয়ার অভিযোগে নয় শ’ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। এখন হয়রানির পালা শুরু হলো বলে। কিংবা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
এই গুলী চালানো নিয়ে সকল মহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। অনেকেই বলছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় গুলী করা জরুরি ছিল না। গুলী না চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। পুলিশ গুলী চালিয়েছে মাথা ও বুক বরাবর। পুলিশ প্রবিধানে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষা ও সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বিধান রয়েছে। ‘নাশকতাকারী’দের বারবার সতর্ক করে দেয়া সত্ত্বেও তারা ছত্রভঙ্গ না হলে পুলিশ গুলী বর্ষণ করতে পারে। তবে সাধারণ রীতি অনুযায়ী পুলিশ গুলী করে কোমরের নিচে। টাঙ্গাইলের ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের গুলী করা হয়েছে বুকে ও মাথায়। নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, বিনা কারণে তাদের গুলী করে হত্যা করা হয়েছে।
এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত সাতজন পুলিশকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাহার কোনো শাস্তি হতে পারে না। এটা লোক দেখানো কৌশল মাত্র। কিছুদিন পর এরা অন্য কোনো থানায় পোস্টিং পাবে। আবারও হয়তো আগের মতো নির্দ্বিধায় নাগরিকদের বুক বরাবর গুলী চালাবে। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, সংশ্লিষ্ট পুলিশদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। প্রত্যাহার বা ক্লোজ করা কোনো শাস্তি হতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, গুলী করেছে পুলিশ, বিচার করতে হবে পুলিশেরই। পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজিপি বলেছেন, এর পেছনে কারও ইন্ধন থাকতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত জয় হচ্ছে জনতার ওপর গুলীবর্ষণকারী পুলিশেরই। অথচ এলাকার জনগণ অকল্পনীয় আল্লাহর আরশ কাঁপানো এক পৈশাচিকতার বিচার দাবি করতে গিয়েছিল। বিচারের বাণী আর কতকাল নিভৃতে কাঁদতেই থাকবে?
দুই.
গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি আতাউর রহমানের নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে সাম্য (১৬) গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিকাল তিনটায় বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় পরও সে বাসায় ফিরে না এলে পরিবারের পক্ষ থেকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। এ সময় সাম্যের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় সাম্যের বাবা মেয়র আতাউর বিষয়টি থানার ওসিকে অবহিত করেন। তিনি জিডি করতে চাইলে ওসি তা গ্রহণ না করে তাকে ফিরিয়ে দেন। খোঁজাখুঁজি চলতে থাকে। এর এক পর্যায়ে মেয়রের লোকজন পৌর এলাকার তাজুল ইসলামের ছেলে হৃদয়কে ধরে থানায় নিয়ে আসে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে হৃদয় স্বীকার করে যে, মেয়রের ছেলে সাম্যকে হত্যা করে পৌরসভা কার্যালয়ের সামনের একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে রাখা হয়েছে।
হৃদয়ের স্বীকারোক্তির পরও পুলিশ রহস্যজনক কারণে লাশ উদ্ধারে নানা টালবাহানা শুরু করে। তখন সাম্যের আত্মীয়-স্বজনরা ঐ বাড়ির বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। এক পর্যায়ে ভবনটির ছাদের ওপর সাম্যের গেঞ্জি স্যান্ডেল ও কিছু রশি পড়ে থাকতে দেখে। এতে তাদের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হতে থাকে। আরও ব্যাপক তল্লাশি শুরু হয়। এর এক পর্যায়ে ঐ বাড়ির লেট্রিনের সেফটি ট্যাঙ্কের ভেতরে থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বস্তাবন্দী সাম্যের লাশ উদ্ধার করা হয়।
লাশ উদ্ধারেরও দীর্ঘ চার ঘণ্টা পর পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে লাশ থানায় নিয়ে যায়। লাশ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়লে শত শত বিক্ষুব্ধ মানুষ সমবেত হয়ে পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড কমিশনার আর এক আওয়ামী লীগার জয়নাল আবেদিনের বাসাসহ বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে আগুন দেয় ও ভাঙচুর করে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ শেষ পর্যন্ত হৃদয় ও তার মাসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। সাম্যের বাবা মেয়র আতাউর রহমান জয়নাল আবেদিনসহ ১১ জনকে আসামী করে গোবিন্দগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী এই জয়নালের ইন্ধন ও পরিকল্পনায়ই সাম্যকে হত্যা করা হয়েছে। ঈদের দিন দুটি জানাযার পর সাম্যের লাশ দাফন করা হয়।
এদিকে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি এবিএম জাহিদুল ইসলামের অপসারণ দাবিতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ নারী-পুরুষ পৌর শহরের চতুরঙ্গের মোড়ে অবস্থান নিয়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। রাতেই জনতার দাবি মেনে নিয়ে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে ওসি জাহিদুলকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কিন্তু তাতেও ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি সাধারণ মানুষের। শহরে এখনও টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় পৌর এলাকায় র‌্যাব, বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
তিন.
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ধামরাইয়ে ভিজিএফ-এর চাল বিতরণকে কেন্দ্র করে সহস্রাধিক লোকের সামনে ধামরাইয়ের চৌহাট ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত নারী ইউপি চেয়ারম্যানকে চড়-থাপ্পড় মেরেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার সময় ভিজিএফ-এর চাল নিতে আসা হতদরিদ্র মানুষেরা ভয়ে সেখান থেকে দৌড়ে চলে যান। খবরে বলা হয়েছে, ইউনিয়নের ১৫০৮ জন হতদরিদ্রকে চাল দেয়ার জন্য ভিজিএফ কার্ড বিতরণ করা হয়। ঈদের আগের দিন ২৪ সেপ্টেম্বর চাল নিতে কার্ডধারীরা ইউপি ভবনে আসেন। তখন হঠাৎ করেই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম কয়েকজন যুবককে নিয়ে মোটর সাইকেলে করে সেখানে আসেন এবং কোনো কথা না বলে সকলের সামনেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আনিচ্ছা হাশেম লাভলীকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। এতে চাল নিতে আসা লোকজন আতঙ্কে চাল না নিয়েই দৌড়ে বাড়ি চলে যান। সে সময় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবু তালেব খানসহ আওয়ামী লীগের স্থানীয় অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। জানা যায়, নজরুল আনিচ্ছার কাছে ৭০০ ভিজিএফ কার্ড চেয়েছিলেন। না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে চড়-থাপ্পড় মারেন। আর নজরুল সাংবাদিকদের বলেছেন যে, স্থানীয় এমপি এমএ মালেককে নিয়ে কটূক্তি করায় তাকে পরিষদে গিয়েই থাপ্পড় মেরেছি। সাবাস আওয়ামী বীর!
দেশে প্রতিদিন সংঘটিত হাজারো ঘটনার মধ্যে এই তিনটি ঘটনা তুলে ধরা হলো একথা বোঝাবার জন্য যে, সরকারের মদত ও প্রশ্রয়ে, নির্বিচার দায়মুক্তি ও পক্ষপাতিত্বে পুলিশ বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ত্রাস কোন মাত্রায় পৌঁছেছে। এরা আরও বেশি মাত্রায় ফ্রাঙ্কেস্টাইনের দানব হয়ে উঠেছে। এক সময় এরা প্রশ্রয়দাতাদের ঘাড়ও মটকে দিতে পারে। তার আলামত এখন আর অস্পষ্ট নেই।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ভারতে সালাহউদ্দিনের বিচার অমানবিক ও অবৈধ


ঢাকার  উত্তরা থেকে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী পরিচয়ে সাদা পোশাকধারীদের হাতে অপহৃত বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদ অপহৃত হবার দুঃখজনক ব্যাপারটি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সুবিধাভোগীরা বিভিন্ন ধরনের তাচ্ছিল্য ও টিটকারীমূলক মন্তব্য করলেও তাকে লুকিয়ে রাখার পেছনে যার হাত ছিল তার মুখোশ একদিন উন্মোচিত হবেই। সরকার টিটকারীর মধ্যে তার দায়িত্ব সীমিত রেখে তাকে উদ্ধার করার সামান্যতম আগ্রহ কিংবা সহানুভূতিমূলক তৎপরতাও চালায়নি। তিনি কি বেঁচে আছেন, না কি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে সে ব্যাপারে সরকারি মহলে সামান্যতম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয়নি। এ ব্যাপারে মনে হয়েছিল সরকারের যেন কোনো দায়-দায়িত্বই নেই। সরকারের এই আচরণ জনমনে নানাবিধ সন্দেহ ও প্রশ্নের অবতারণা করে, যা কোন প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের জন্য মোটেই কাম্য হতে পারে না।
এমন পটভূমিতে অপহৃত হবার ৬২ দিন পর বিস্ময়কর ও রহস্যজনকভাবে সালাহউদ্দিনকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত-সংলগ্ন মেঘালয়ের রাজধানী শিলং-এ ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। সালাহউদ্দিনের ভাষ্যমতে তিনি জানতেন না কারা তার চোখ বেঁধে গাড়িতে উঠিয়ে  সাত-আট ঘণ্টা যাবত গাড়ি চালিয়ে গাড়ির পর গাড়ি বদল করে তাকে  অজানা-অচেনা স্থানে ফেলে রেখেছিল। স্থানীয় জনগণ পুলিশে খবর দিলে বিশ্ববাসী জানতে পারেন বাংলাদেশের এই সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেঁচে আছেন।
৬২ দিন যাবত নির্যাতনের শিকার উদ্ভ্রান্ত অসুস্থ সালাহউদ্দিন বেঁচে থাকলেও তার সামনে যে আরো মারাত্মক দুর্দিন অপেক্ষা করছে, তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে ছিল। নির্যাতিতের প্রতি মানুষের সহানুভূতি এমনিতেই জাগরিত হয়। শেখ হাসিনা সরকারের মুরুব্বী ও প্রধান খুঁটি ভারত পুরোপুরি অসুস্থ সালাহউদ্দিনের প্রতি চরম অমানবিকতা দেখিয়ে তাকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় তোলার ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে।
৬২ দিন নিখোঁজ থেকে অপহৃত চোখবাঁধা অবস্থায় অজানা কোন অপশক্তির কারসাজির শিকার সালাহউদ্দিনকে ভারতীয় ভূখণ্ডে ফেলা যাওয়া তার ক্ষেত্রে কোনভাবেই অনুপ্রবেশের আওতায় পড়ে না। অনুপ্রবেশ হলো পরিকল্পিত এবং স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে কোন ভূখণ্ডে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া প্রবেশ করা। কিন্তু সালাহউদ্দিন স্বেচ্ছায় কিংবা পরিকল্পিতভাবে কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভারতে প্রবেশ করেন নি। তিনি জানতেনও না যে তিনি কোথায় আছেন, কোন দেশের ভূখণ্ডে আছেন। তিনি এটাও জানতেন না যে, কারা কেন তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছে। সুতরাং তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে বিচার করার কোন সুযোগ নেই। কোন মানবিক আইনেই এটা অপরাধের আওতায় পড়ে না। সালাহউদ্দিন স্বেচ্ছায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে যদি ভারতে প্রবেশ করতেন তাহলে তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিচার করার সুযোগ থাকতো।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো সালাহউদ্দিন যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীই হয়ে থাকেন তাহলে তিনি কিভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করলেন? অপহরণকারীরা তাকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ছেড়ে দিলে বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই তাকে পাওয়া যেত। অপহরণকারীরাই তাকে তার অজান্তে ভারতীয় ভূখণ্ডে ফেলে রাখে। সুতরাং তার ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ তার অজান্তে এবং অনিচ্ছায় হয়েছে। ভারতে প্রবেশের জন্য তিনি দায়ী নন। অপহরণ ও পাচারকারীদের চিহ্নিত না করে তাদেরকে পাকড়াও এবং বিচার না করে অপহরণের নির্মম শিকার সালাহউদ্দিনের বিচার কোনভাবে মানবিক ও গ্রহণযোগ্য নয়।
তৃতীয়ত গাড়িতে করেই সালাহউদ্দিনকে মেঘালয়ের মতো পর্বতাকীর্ণ এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কোন গাড়িই চোরাপথে মেঘালয়ে প্রবেশ করার সুযোগ নেই। মেঘালয়সহ পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে স্বাধীনতাকামী  গেরিলারা সক্রিয় থাকায় গাড়ি তল্লাশি আবশ্যিক। আর বাংলাদেশ থেকে প্রবেশকারী প্রতিটি গাড়ি, এমনকি যাত্রীর তল্লাশি অনিবার্র্য।  চোখবাঁধা অবস্থায় সালাহউদ্দিনকে বহনকারী গাড়ি কীভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে তাকে শিলং-এর রাস্তায় ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেল তা কেবল রহস্যময়ই নয়, প্রশ্নবিদ্ধও বটে। 
ভারতে কোন সুবিচার কিংবা স্বচ্ছতা থাকলে ভারত সরকার সাথে সাথে তদন্তের ব্যবস্থা করতো কিভাবে স্বদেশ থেকে অপহৃত একজন বিদেশী রাজনীতিক ভারতের মাটিতে প্রবেশ করলেন, কারা কখন কেন তাকে ভারতে নিয়ে যায়, সীমান্তের যে সড়ক এবং চৌকি দিয়ে ঐ গাড়ি ভারতে প্রবেশ করে তার নম্বর কতো, কারা কারা ঐ গাড়িতে ছিল, তাদের পাসপোর্ট নম্বর কতো ইত্যাদি তদন্ত করে প্রকৃত অনুপ্রবেশকারী তথা অপরাধীদের বের করা হতো, কিন্তু ভারত সরকার তেমন কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। উল্টা সালাহউদ্দিনকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলার ঘোষণা দিয়েছে।
মেঘালয়-বাংলাদেশ সীমান্তের পুরোটাই পাহাড়ী-পার্বত্যাঞ্চল, সমতল নয় যে, গাড়ি যেকোন ধানক্ষেত্র দিয়েও প্রবেশ করতে পারে। সুতরাং অপহরণকারীরা তাকে পাকাসড়ক বাদ দিয়ে কোন চোরাপথে মেঘালয়ে নিয়ে যায়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশ হতে গাড়িযোগে কেবল মেঘালয় নয় ভারতের যেকোন রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই সীমান্ত চৌকি অতিক্রম করতে হয়েছে এবং সীমান্তে সবারই পাসপোর্ট থেকে শুরু করে যাবতীয় তথ্য যাচাই-বাছাই করে গাড়ি বা পদব্রজে গমনকারীদের ভারতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। বিদেশীরা কোন দেশে প্রবেশ করার আগে সেই দেশের বিমানবন্দরে যে প্রক্রিয়ায় তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয় সীমান্ত চৌকিগুলোতেও একই কায়দা অনুসরণ করা হয়।
সালাহউদ্দিন বলেছেন, তার চোখ বেঁধে ৬/৭ ঘণ্টা গাড়ির পর গাড়ি বদলিয়ে শিলং-এর রাস্তায় কে বা কারা ফেলে যায়। তার এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় বাংলাদেশের কোন চক্র তাকে হয়তো সীমান্ত নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা অন্যকোন কর্তৃপক্ষীয় চক্রের কাছে হস্তান্তর করেছে কিংবা ভারতীয় গোয়েন্দারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে ভারতের নিয়ে গেছে। তবে ভারতীয় গোয়েন্দারা তাকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেলে গাড়ি না বদলিয়ে সরাসরি ভারতে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। যেভাবেই তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় চোখবাঁধা একজন মানুষকে গাড়িতে  বসে থাকতে দেখলে স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় পুলিশ কিংবা নিরাপত্তাকর্মীরাই নন, যেকোন সাধারণ মানুষও অতিমাত্রায় কৌতূহলী হবেন এবং গাড়ির প্রতিটি যাত্রীর ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিবেন। চোখবাঁধা লোকটা কে, কেন তার চোখ বাঁধা হয়েছে, সে কোন দেশের নাগরিক, তাকে কোথা কেন নেয়া হচ্ছে ইত্যাদি হাজারো রকমের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন। আর সাথে সাথে বিষয়টি ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হবে। এ নিয়ে তোলপাড় হবে। এ ধরনের একটি গাড়ি এবং গাড়ির সব যাত্রীকে সাথে সাথে আটক করা হবে।  কিন্তু তেমন কিছুই করা হয় নি। কেন করা হয়নি, তার একাধিক সহজ সম্ভাব্য এবং বাস্তব জবাব হবে: (১) এই ধরনের একটি গাড়ি যে বাংলাদেশ হতে ভারতে প্রবেশ করবে তা আগেই সীমান্ত চৌকির পাহারাদের ঊর্ধ্বতনমহল থেকে হয়তো জানিয়ে দেয়া হয়েছিল; (২) গাড়িতে এমন কেউ ছিলেন এবং তার কাছে এমন উঁচুমানের পরিচয়পত্র ছিল যে, চৌকির প্রহরীরা পরিচয়পত্র দেখামাত্র সালাম দিয়ে গাড়িকে ভারতে প্রবেশ করতে দেয়; (৩) বাংলাদেশের কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা সংস্থা সালাহউদ্দিনকে সীমান্তে নামিয়ে যথাযথ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যেখানে চৌকি প্রহরীদের কোন প্রশ্ন করার কিংবা তথ্যাদি সংগ্রহ করার প্রয়োজন ছিল না, যে কারণে অপহরণকারী কিংবা তাদের সহযোগীরা  নির্বিঘেœ সীমান্ত অতিক্রম করে সালাহউদ্দিনকে বাংলাদেশ সীমান্ত হতে প্রায় ৫০ মাইল দূরবর্তী শিলং নিয়ে ফেলে রাখতে কোন বাধার সম্মুখীন হয়নি।
ধরে নিলাম সালাহউদ্দিনের অপহরণের পিছনে বাংলাদেশ কিংবা ভারত সরকার কোনভাবেই জড়িত নয়। সরকারের কেউ কেউ যেমনটি বলে বেড়িয়েছেন বিএনপিই সালাহউদ্দিনকে লুকিয়ে রেখেছে। তাদের এই কল্পিত অভিযোগকে সত্যি হিসেবে মেনে নিলেও প্রশ্ন উঠে পাসপোর্টবিহীন চোখবাঁধা একজন ভিন্দেশী কিভাবে ভারতীয় সীমান্ত চৌকিতে পাহারারত বিএসএফ’এর চোখ এড়িয়ে নির্বিঘ্নে ভারতের ৫০ মাইল ভিতরে চলে গেলেন  এবং যারা তাকে ঐ সীমান্তে নিয়ে যায়, এমনকি গাড়িসহ ভারতের ৫০ মাইল প্রবেশ করে তারাও বা কোথায় গেল? ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময়ই আমি দেখেছি কীভাবে ভারতীয়দের প্রতিটি গাড়ি ভারতীয় সেনাবাহিনী তল্লাশি করে। বাংলাদেশ হতে মেঘালয়ে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে হলে চোরাই পথে প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। এমনকি সীমান্ত চৌকি না হয়ে সাধারণ সড়ক দিয়ে প্রবেশ করলেও অবশ্যই বিএসএফ এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঐ সাধারণ সীমান্ত সড়কে থাকবেই।
একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে। বাংলাদেশের হাজার হাজার চোর-ডাকাত, সামাজিক অপরাধী, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি, ব্যাংক ডাকাতরা অপরাধ করেই ভারতে পালিয়ে যায়। কালা জাহাঙ্গীর, সুব্রত বাইন, বিকাশদের মতো অসংখ্য সমাজদ্রোহী-চাঁদাবাজ-খুনি-ছিনতাইকারীরা ভারতে অবস্থান করে সেদেশে বিয়ে-শাদি করে ব্যবসা করছে। সেখান থেকে তারা বাংলাদেশে দুষ্কর্ম চালায়। এদের অনেকেই এখনো ভারতে আছে। প্রতিদিন অনেক  ভারতীয় এবং বাংলাদেশী বিনা পাসপোর্টে অবৈধ পন্থায় সীমান্ত অতিক্রম করে । ভারত কয়জনকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করেছে? ২০০১ সনে নির্বাচনে পরাজিত হবার পর আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী ভারতে পাড়ি জমায়। এমনকি কালিদাস বৈদ্য, সন্তু লারমাদের মতো নিরাপদ আশ্রয়দাতা হলো ভারত। ভারত তাদেরকে গ্রেফতার করে কখনোই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি।
সালাহউদ্দিনকে বিচাররের কাঠগড়ায় উঠানোর কোন নৈতিক এমনকি আইনগত ভিত্তি নেই। অপহৃত হবার পর ৬২ দিন পর অপহরণকারীরাই তাকে ভারতে রেখে আসে। এখানে সালাহউদ্দিনের অপরাধ কোথায়? অবৈধ অনুপ্রবেশের আইন কোনভাবেই সালাহউদ্দিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। ভারতের উচিত ছিল তাকে উদ্ধার করার সাথে সাথে তার ইচ্ছামাফিক তিনি যেখানে থাকতে চান কিংবা যেতে চান সেখানে থাকতে দেয়া কিংবা যেতে দেয়া। কিন্তু ভারত তা না করে তার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ভারতের এই আচরণ তথা দ্বৈত ভূমিকা প্রমাণ করে ভারত বিশেষ উদ্দেশ্যে সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে  অবৈধ অনুপ্রবেশের খড়গ ব্যবহার করছে। সুতরাং এ বিচার কোনভাবেই মানবিক ও  গ্রহণযোগ্য নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
এই বিচার হচ্ছে ভারতীয় আইনের অপপ্রয়োগ এবং বিচারের নামে প্রহসন। এ রকম আরো বহু ইলিয়াস আলী সালাহউদ্দিনরা ভবিষ্যতে অন্য কোন ভিন্নতর নির্মম নাটকের শিকার হবেন, নির্যাতিত হবেন, জীবন দিবেন। এমন আশংকা আর আতঙ্কের মধ্যেই আমাদেরকে সামনের দিনগুলো গুনতে হবে।
মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন 

রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজনৈতিক ঘৃণা ও হিংসার রাজনীতি


সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক পরিচয় ও আত্মীয়তা বন্ধনকে কখনওই অস্বীকার করা যায় না। সেই পরিচয়গুলোই মানুষের আসল রূপ; প্রধান পরিচিতি চিহ্ন। সেই পরিচয়ের বন্ধনই পরিবারে-পরিবারে এবং মানুষে-মানুষে মৈত্রী গড়েছে; মানব-জীবন-প্রবাহকে ছন্দে ও গতিতে বেঁধে রেখেছে। এর বাইরে রাজনৈতিক মতাদর্শগত পরিচয় বড় জোর মানুষের দ্বিতীয় পরিচয় হতে পারে। কিন্তু এই দ্বিতীয় পরিচয়কেই আজকাল বড় করে দেখা হচ্ছে। এরই ভিত্তিতে মানুষকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। (কম মেধার স্বপক্ষকে মাথায় আর বেশি মেধার প্রতিপক্ষকে পায়ের নিচে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।) ব্যক্তি স্রেফ কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক পার্টি করে বলেই ঘৃণিত, বঞ্চিত এবং পরিত্যাজ্য- এই আজব সূত্র সত্যিই মর্মান্তিক; অভিনব ও হিংস্রাত্মক। প্রয়োজনে কারও নীতি বা মতাদর্শকে অপছন্দ করা যেতেই পারে, অনেকেই সেটা করেও থাকেন, কেউ কেউ পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা করেন; কেউ কেউ সমাজতন্ত্রকে পছন্দ করেন না। তাই বলে ব্যক্তি মানুষের মৌলিক সত্তাকে তো অস্বীকার করা যায় না। এটাও তো ভুলে থাকা যায় না যে, পবিত্র বাইবেলই বলেছে যে, ‘পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা কর’।
অতএব ঘৃণা কোথায়, কতটুকু, কার বিরুদ্ধে করা হবে, সেটারও একটি মানদ- থাকা দরকার। অন্ধভাবে ঘৃণায় আকীর্ণ হওয়ার নাম মনুষ্যত্ব নয়। সবাইকে মনে রাখতে হয় যে, দলের কর্মী বা সমর্থকের খোলসটার ভেতরের একজন মানুষ কারও ছেলে বা মেয়ে বা পিতা বা স্বামী বা শিক্ষক বা প্রতিবেশি বা অন্য কিছু। রাজনৈতিক মোড়কে কোনও মানুষকে আগাগোড়া মুড়ে ফেলে তাকে বিবেচনা করা একদেশদর্শিতা। এমনটি করা হলে সেটা হবে মূঢ়তা ও মনুষ্যত্বের অপমান। রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে প্রতিপক্ষকে বয়কট করা হলে বা তার প্রতি ঘৃণা ছড়ালেই কি নিজেদের শক্তিশালী করা সম্ভব হবে? এতে সমাজজীবনের সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও সৌজন্য অতি নিচের তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। এমন সমাজে মুক্ত চিত্তে মানব বসবাস কি করে সম্ভব হবে?
হাল আমলে ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’- এই বিভাজন করে বাংলাদেশের সমাজ ও জনজীবনে যে ঘৃণা ও হিংসার বীজ বপন করা হচ্ছে, সেটা শুভতার লক্ষ্যণ নয়। ঘৃণা থেকে হিংসা থেকে ক্রমে ক্রমে সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি হতে সময় লাগে না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ সমাজের বৃষবৃক্ষ উৎপাটন; রোপণ নয়। একদা ‘শ্রেণীশত্রু’ খতমের নামে অতি-উগ্র কমিউনিস্টদের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ নিধনের যে রাজনৈতিক-সামাজিক রক্তলীলা শুরু হয়েছিল বিশ্বের কোথাও কোথাও, পরে প্রমাণ হয়েছে, সেই হিংসাদর্পী আচরণ ছিল আদর্শিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক দিক থেকে মহাভুল। এখন বিশ্বে সকলের জন্যে হিতকর গণতন্ত্র  দেশে দেশে নিজের স্থান করে নিয়েছে। গণতন্ত্রের কাঠামো ও বিধি-ব্যবস্থায় পরমত ও অন্যদলের প্রতি ঘৃণ্য অস্ত্র ও হিংস্র কার্যাবলির প্রয়োগ আরও আত্মঘাতী। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অমানবিক ও অসৌজন্যমূলক কোনও আচরণ করা হলে সেটা ক্ষুদ্রতা ও দুর্বলতাকেও প্রকাশ করে; শক্তি ও মহত্ত্ব প্রদর্শন করে না।
‘মুখে মধু হৃদে বিষ’ বড় নেতার চারিত্রধর্মও নয়। রাজনৈতিক বিশ্বাস বা আনুগত্যকে ভিত্তিতে মানুষকে বিভাজন বা বিভক্ত করা আরও বিষস্পর্শী অপকর্ম। ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ ভিত্তিক বিষাক্ত-বিভেদ তৈরি করা হলে, এরই ভিত্তিতে সুযোগ-সুবিধা বণ্টন ও শাস্তি বিধান করা হলে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার কোথায় থাকবে? কেবলমাত্র রাজনৈতিক তুল্যমূল্যের ভিত্তিতে মানুষের মূল্যায়ন করা হলে মানুষের মৌলিক সত্তা ও পরিচয় খণ্ডিত হবে; বহুমতের বিনাশ ঘটবে; মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব নিহত হবে; গণতন্ত্র, সুস্থতা ও সুশীল শাসন ভূলুণ্ঠিত হবে। এই অবস্থায় ঘৃণা ও হিংসা আরও বাড়বে এবং একদল অসৎ, দুর্নীতিবাজ বিদ্যমান পরিস্থিতি উৎতপ্ত ও উত্তেজক করে ফাঁক তালে সুবিধা লুটে নেবে।
ঘৃণা ও হিংসার আগুনকে  লেলিহান দাবানলে পরিণত করে প্রতিপক্ষকে দাবিয়ে রাখার পন্থাও আদিম, অবৈজ্ঞানিক ও অকার্যকর। হিটলারের কথা মনে করিয়ে আজকের ঘৃণা-বিস্তারী এবং হিংস্রতা-পিয়াসীদের সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতেই পারে। বলা বাহুল্য, এমনটি মনে করিয়ে দেয়ার সঙ্গত কারণ ঘটেছে। যাদের চোখ-কান খোলা, তারা চারপাশেই এমন অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছেন। এর ফলে সভ্যতা, মনুষ্যত্ব ও শুভতার বিনাশের কথাও আতঙ্কের সঙ্গে ভাবছেন বিবেকী মানুষজন। এমন অবস্থা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সমান্তরালে লাগসই নয়। ইতিহাসের মুখ চেপে সেই সত্যকথাটি দমিয়ে রাখা যাবে না।
প্রতিটি কাজের পিছনেই একটি দর্শন থাকে। থাকে নৈতিকতার একটি বিষয়। কিন্তু যে বা যেসব কাজ কেবল ঘৃণা ও হিংসার বশবর্তী হয়ে এবং ক্ষমতার দম্ভে করা হয়, তার পেছনে দার্শনিকতা বা নৈতিকতা নামে আসলেই কি কিছু থাকতে পারে? একদলীয় স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ ইত্যাদি মানববিরোধী মতবাদেরও একটি দর্শন বা প্রণোদনা রয়েছে। কিন্তু ঘৃণা আর হিংসার দর্শন কি? এটা তো ফ্যাসিবাদের চেয়েও নিকৃষ্ট।
ঘৃণা ও হিংসার মনস্তত্ত্ব লুকায়িত রয়েছে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকৃতিতে, হীনম্মন্যতায়, ক্ষুদ্রতায়, খলতায় এবং অসুস্থতায়। ঘৃণ্য ও হিংস্র রূপ কখনওই কোনও সুস্থতার পরিচায়ক নয়। এজন্যে প্রয়োজন শরীর-বৃত্তিয় পরিচর্যা। ব্যক্তিগত জীবনে কোনও নর বা নারীর এহেন সমস্যার সমাধান ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়ে সুরাহা করা যায়। কিন্তু সেই অসুস্থ নর বা নারী যদি ব্যক্তিগত আড়াল ছিঁড়ে সমাজে বের হয়ে এসে সমাজ ও রাজনীতিতে এহেন ঘৃণা উৎপাদনকারী ও হিংসা উদ্রেগকারীতে পরিণত হয়, তাহলে তার বা তাদের ব্যাপারে কি করা যায়?
সবারই জানা যে, সমাজের অধিকাংশ মানুষই শান্তিকামী এবং এরা ঘৃণা ও হিংসা চায় না। যখন ঘৃণা-হিংসার পূজারীরা সকলের মাথার উপরে বসে যায়, তখন সেটারও তো একটি প্রতিবিধান থাকা দরকার। সুনাগরিকদের মিলিত চিন্তায় প্রতিষেধক বের করাই কাম্য।
বাংলাদেশ বহু দীর্ঘ ইতিহাসের পথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। এতটুকু পথ অতিক্রম করতে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, রক্তপাতের বহু অধ্যায়কেও অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। এগুলো অতীতের কালো দাগ। এ রকম অনেক কালো অধ্যায়, দুঃশাসন, স্বৈরতন্ত্রের পর আজ যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সেটা এদেশবাসী প্রতিটি নাগরিকের সুস্থ, সুন্দর, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপনের গ্যারান্টি হওয়া বিধেয়। কোন ব্যক্তি, দল বা নেতা মানুষের এই মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পারেন না ঘৃণা ও হিংসার আশ্রয় নিয়ে। ব্যক্তি বা দলের হিংসা ও ঘৃণার কাছে জনমানুষ জিম্মি হতে পারে না। প্রতিপক্ষও অন্যায় আচরণের শিকার হতে পারে না। অতএব রাজনৈতিক ঘৃণা ও হিংসার চর্চাকারীদের ভাবতে হবে, পক্ষ বা প্রতিপক্ষের কেউই এ সমাজ এবং সমাজ সংহতির বাইরের কেউ নন। পারিবারিক-সামাজিক আত্মীয়তায় আবদ্ধ আমরা সকলেই। নানা মত ও পথের মাধ্যমে ভিন্নমত ও পার্থক্য সত্ত্বেও সবাইকে নিয়েই আমাদের বসবাস করতে হয় এবং সবাইকে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’ নামের কোনও বিভাজনের সুযোগ নেই।
মনে রাখা ভালো, তিনটি তীক্ষ্ণ আবেগ মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে- ভালোবাসার প্রত্যাশা, জ্ঞানুসন্ধান ও মানুষের প্রতি মমতা। সকলকেই ব্যক্তিমানুষ হিসাবে ভালোবাসার সন্ধান লাভের চেষ্টা করতে হয়; কারণ তা সুখ এনে দেয়। এই সুখ এত বড় যে, সুখের জন্যে জীবনের বৃহৎ অংশও জলাঞ্জলি দিতে হয়। জ্ঞানুসন্ধান করতে হয় সত্যে উপনীত হওয়ার প্রয়োজনে। আর মানুষের প্রতি মমতা লালন করতে হয় মানব জাতির সদস্য রূপে নিজ দায়িত্ব পালনের স্বার্থে। ধর্ম, দর্শন, নৈতিকতা এমন সুশিক্ষাই দেয়। কদাচ ঘৃণা ও হিংসার তালিম দেয় না। মহামানবগণের জীবনেও বিধৃত ইতিবাচক মহত্ত্ব; নেতিবাচকতা কদাপি নয়। স্বয়ং বার্টান্ড রাসেলে মতো পন্ডিত (১৮৭২-১৯১৪) আত্মজীবনীতে বলেছেন: ‘পরিশেষে আমি খুঁজেছি, ভালোবাসার সংযুক্তিতে আমি অতীন্দ্রিয় কল্পনায় স্বর্গের রূপরেখার ছবি এঁকেছি, যা দরবেশ ব্যক্তি ও কবিরা কল্পনা করেন।’ ফলে ভালোবাসা ও মানবপ্রেমের গুরুত্ব সহজেই প্রণিধানযোগ্য। কারণ মানুষই পারে ভালোবাসা জাগাতে-নিজের জন্যে এবং অপরের জন্যও। কিন্তু মানুষ নামে পরিচয় দেবো আর ঘৃণা ও হিংসার মাধ্যমে বিকৃত ও পাশবিক উল্লাসে মদমত্ত হয়ে নৃত্য করবো-মানব পরিচয়ের সঙ্গে এর চেয়ে অসঙ্গতি আর কি হতে পারে! সম্ভবত এখন সময় এসেছে মানুষকে নিজের মানব-সত্তার দিকে তাকিয়ে দেখার এবং নিজের মানবিক সত্তাকে পবিত্রতার সঙ্গে রক্ষা করার জন্য মানবচর্মে-আবৃত্ত ঘৃণাকামী ও হিংস্রাশ্রয়ীদের চরমভাবে পরিত্যাগ করার। ঘৃণায় প্রজ¦লিত ও হিংস্রায় উন্মত্ত পরিস্থিতিতে নিজের ঐতিহাসিক মানব-অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কিছুটা তৎপর তো প্রকৃত মানুষদের হতেই হবে? নইলে সব কিছু ঘৃণার আগুনে আর হিংসার বিষবাষ্পে ছারখার হয়ে যাবে। এমন আত্মঘাতী পথ কোনও বিবেকবান মানুষেরই কাম্য হতে পারে না।

মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কুরবানী নিয়ে কেন এই তামাশা


প্রায় আটচল্লিশ বছর ধরে এই ঢাকা শহরে আমার বসবাস। এই দীর্ঘ সময় ধরে নগরীর উৎসবগুলোতে আমি উপস্থিত থেকেছি। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, পহেলা বৈশাখ, পূজা-পার্বন সবই দেখে আসছি। কিন্তু কুরবানিবিরোধী এমন আজব কা- কোনোদিন দেখিনি। ঢাকায় কুরবানী হয়ে আসছে শত শত বছরের ঐতিহ্য অনুযায়ীই। কোনোদিন এর ব্যতিক্রম দেখিনি। উৎসবে আনন্দে উদ্বেলিত হতে দেখেছি শিশু কিশোর তরুণ-তরুণী ও প্রবীণ নাগরিকদের। এক একটা কুরবানী ঘিরে ছিল আনন্দ-উচ্ছ্বাস। শিশু-কিশোররা গরু কাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত গরু ঘিরেই কাটিয়ে দিত পুরো সময়। অনেকেই কুরবানীর পশু নিজ হাতে কাটাকুটি করতেন। তার ভেতরেও ছিল এক ধরনের আনন্দ। যারা ভাগে কুরবানী দিতেন, সে রকম গরু ঘিরে বসত বেশ কয়েকটি পরিবার। সারা শহর জুড়ে এক ধরনের আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। অঘটন একেবারে কিছু ঘটতো না এমন নয়। কখনও কখনও রাতে চুরি হয়ে যেত কুরবানীর পশু। বাকি সবটাই ছিল আনন্দ।
আবার কুরবানী নিয়ে সঙ্কট যে একবারে ছিল না, এমনও নয়। সে সমস্যা ছিল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার। ফলে কুরবানী হয়ে যাবার পর প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে ঢাকা শহর একেবারে দুর্গন্ধময় হয়ে যেত। তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হতে থাকতো। এক সময় সে সমস্যাও দূর হয়ে যেত। তখন মিউনিসিপালিটির লোকবলও কম ছিল। যানবাহনের সঙ্কট ছিল। আর তাই বর্জ্য সরাতে সময় লেগে যেত অনেক বেশি। কিন্তু গত এক যুগ ধরে সে সমস্যা আর নেই। সাদেক হোসেন খোকা ঢাকার মেয়র হবার পর পরিস্থিতি একবারে পাল্টে যায়। এক-দেড় দিনের মধ্যে সমস্ত বর্জ্য পরিষ্কার করে ঢাকাকে একেবারে সাফসুতরো করে ফেলা হয়।
মানুষের সচেতনতাও বহু গুণ বেড়েছে। আগের দিনে দেখেছি, বাড়ির আশেপাশে যে যেখানে কুরবানী দিচ্ছেন, সেখানেই বর্জ্য ফেলে রেখে মাংস নিয়ে ঘরে ফিরে যেতেন নাগরিকরা। ফলে তা সংগ্রহ করে পরিষ্কার করতে সময় লেগে যেত অনেক বেশি। এখন সেরকম অবস্থা কেউ আর কল্পনাও করেন না। নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এখন দেখি কুরবানী শেষে বর্জ্য তারা ফেলছেন নির্ধারিত জায়গায়। রক্ত যেটুকু পড়ছে, তা পানি ঢেলে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন নাগরিকরা নিজেরাই। তারপর ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দুর্গন্ধ দূর করে দিচ্ছেন। ফলে সিটি কর্পোরেশনের কাজও বহুলাংশে কমে গেছে। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গোটা শহর আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন।
এদিকে দীর্ঘকাল ধরে গরুর হাট বসেছে নির্দিষ্ট জায়গায়। গরুর হাট কোথায় বসে নাগরিকরা তা জেনে গেছেন। সিটি কর্পোরেশনের ভোট ডাকাতির মেয়ররা খবরের কাগজে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেসব স্থান পরিবর্তন করে ফেলেছেন। হুট করে তাদের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেন প্রয়োজন হলো, সেটা বোঝা ভারি দুষ্কর। অনেকেই বলাবলি করছেন যে, আসলে তাদের অবস্থা হয়েছে, ‘নেই কাজ তাই খই ভাজ’। আর এ কারণেই তারা নবনিযুক্ত তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী অভিনেত্রী তারানা হালিমের মতো কিছু একটা কাজ দেখাবার চেষ্টা করছেন। কাজ দেখাতে গিয়ে শুরুতেই ফেঁসে গেছেন তারানা। মন্ত্রী হয়েছেন। কিছু একটা কাজ তো দেখানোই চাই। এসেই বলে বসলেন যে, দেশে যে ১৩ কোটি মোবাইল সিম ব্যবহৃত হচ্ছে, তার সবই আবার নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে। নইলে বন্ধ করে দেয়া হবে সকল সিম। এ কেমন তোঘলোকি কাণ্ড! দেশের অধিকাংশ সচেতন মানুষ নিয়ম মেনে চলেন এবং তারা সিম কেনার সময় তা নিবন্ধন করেই কিনেছেন। ধারণা করি, তারানা হালিম নিজেও তাই করেছেন। তাছাড়া এক সময় দোকানে গিয়ে চাইলেই সিম কেনা যেত। সরকার এ বিষয়ে আইনের শর্ত আরোপ করায় অনেক দিন ধরে সিম কিনতে দোকানিরাও নিবন্ধন করতে বলেন। স্বীকার করি, তারপরও হাজার হাজার সিম অনিবন্ধিত আছে। সেগুলো নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক করলে কেউ নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। তা না করে এক বিরাট দুর্ভোগযজ্ঞের আয়োজন করে বসলেন তারানা। আর শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে তাকে পিছু হঠতেই হলো।
ভোট ডাকাতির দুই মেয়রও একই কাণ্ড করে বসলেন। খই ভেজে কাজ দেখাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে এদের দেখলাম, রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছেন। আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম। যাক অন্য কিছু না করতে পারুক, এরা বোধকরি ঢাকা মহানগরীকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পারবেন। কিন্তু কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে পুরো শহর ডুবে গিয়ে ঢাকার যে করুণ অবস্থা দাঁড়ালো, তাতে বোঝা গেল, এরা কতটা জনবিচ্ছিন্ন ও অথর্ব। এদের একজন আনিসুল হক আবার এক স্টান্টবাজি করে বললেন, ঢাকা এখন আইসিইউতে। তাই যদি হয়, তা হলে আপনারা বিনা ভোটে ফাল দিয়ে গিয়ে গদিতে বসে পড়লেন কেন? আপনাদের তো দায়িত্ব এই আইসিইউ থেকে ঢাকাকে বের করে এনে সুস্থ সবল করে তোলা। সে দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে এখন নাগরিকদের সঙ্গে মশকরা করছের এরা দুজন। মশকরা পর্যন্ত হয়তো ঠিকই ছিল। সমাজে সব সময় কিছু ফাজিল লোকও থাকে, যারা সব বিষয় নিয়ে মশকরা করতে পছন্দ করে।
কিন্তু এই দুই ভোট ডাকাতির মেয়র আমাদের ধর্মীয় উৎসব পণ্ড করার জন্য যখন বিবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তখন তা আর মশকরায় সীমাবদ্ধ থাকে না। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব কুরবানীকে নিরুৎসাহিত করার জন্য এই দুই ভোটডাকাতির মেয়র নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। প্রথমত কুরবানীর পশুর হাটগুলো নগরীর বরাবরের জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন একেবারে প্রান্তের দিকে। নাগরিকরা তা টেরও পাননি। হ্যাঁ, সিটি কর্পোরেশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেকথা জানিয়েও দিয়েছে। কিন্তু কোন নাগরিক সে বিজ্ঞপ্তি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে গেছে। ফলে বিভ্রান্তি বেঁধেছে সেখান থেকেই। গতকাল আগারগাঁওয়ে গিয়ে দেখলাম, বহু ক্রেতা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। এদের অনেকেই গত ১৫-২০ বছর ধরে আগারগাঁও পশুর হাট থেকে কুরবানীর পশু কিনে আসছেন। ওখানে গিয়ে শুনলেন, পশুর হাট আছে বসিলায়। গাবতলিতেও আছে। কিন্তু কাদায় কাদায় সয়লাব। বসিলায় গিয়ে দেখলেন, তার অবস্থা আরও খারাপ। সেখানেও গোড়ালি পর্যন্ত কাদা। ক্রেতা নেই। ঢাকা দক্ষিণের কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়র কুরবানী নিরুৎসাহিত করতে পশুর হাট বসিয়েছেন শনির আখড়ায়। সে হাট জুড়ে গতকাল পর্যন্ত হাঁটুর ওপরে পানি ছিল। তার মধ্যেই নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল কুরবানীর পশুগুলোকে। ক্রেতাদের সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই বৃষ্টির সময়ে ওখানে যে হাঁটু পানি হতে পারে, সে আক্কেল দক্ষিণের আনাড়ি মেয়রের আছে বলে মনে হল না। অর্থাৎ নাগরিকরা যাতে কুরবানীর জন্য পশু কিনতে না পারে, নির্বিঘ্নে কুরবানী দিতে না পারে, ভোট ডাকাতির এই দুই মেয়র সে ব্যবস্থা মোটামুটি পোক্ত করে তুলেছেন।
দ্বিতীয়ত কুরবানী কোথায় দেয়া যাবে, কোথায় দেয়া যাবে না, সে ব্যাপারে এক এলান জারি করে দিয়েছেন এই দুই ভোট ডাকাতির মেয়র। এসব স্থান কারও কারও বাড়ি থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে। সেখানে পশু নিয়ে যেতে হবে কুরবানীদাতাকেই। যেটা বহু ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। কোনো কারণে গরুটি দৌড় দিলে তার পক্ষে আটকানো একেবারেই অসম্ভব। সেখানে জবাই করার জন্য মওলানা পাওয়া যাবে তো! চামড়াটা ন্যায্য দামে বিক্রি করা যাবে তো? নাকি কেড়ে নেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগের মাস্তানরা? মাংস ঘরে নিয়ে আসা যাবে তো? নাকি তিন ভাগের এক ভাগ ‘দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টনের জন্য’ রেখে দেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ? সেখানে বাচ্চাদের কীভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে? আবার কুরবানীর জন্য এমন সব স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে ঈদের জামাতও অনুষ্ঠিত হবে। তাহলে কুরবানির প্রক্রিয়া শুরু করতেই কমপক্ষে সকাল ১০টা বেজে যাবে। সে এলাকায়, যতটা কুরবানী হবে, তা ধরবে না ঐ মাঠে। ফলে কুরবানী করতে হবে দুই শিফটে। অর্থাৎ অনেককেই কুরবানীর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে দুপুর দুইটার পর। মানুষের এই ভোগান্তি সৃষ্টি করার অধিকার ঐ মেয়রদের কেউ দেয়নি। এমনি হাজারো সংশয় আছে নাগরিকদের মনে। অথচ নিজ বাসাবাড়ির নিচতলায় অথবা রাস্তায় ছেলেপেলে দারোয়ান নিয়ে কুরবানী দেওয়া আমাদের রেওয়াজ। তাতে কুরবানীর আনন্দে অংশ নিতে পারেন বাড়ির সকলেই। সবাই মিলেঝিলে কেটেকুটে দ্রুত মাংস তুলে নিতে পারেন ঘরে। সিটি কর্পোরেশন সে আনন্দ মাটি করে দিতে চাইছে কোন অধিকারে?
এই ঢাকা মহানগরীতে আগে পাঁচ-দশটা পূজাম-প তৈরি হতো। এখন পাঁচ-দশ হাজার হয়। এর সকল প্রতিমাই বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয় না। ঢাকার খাল-লেকসহ বিভিন্ন জলাশয়েও বিসর্জন দেওয়া হয়। ফলে এসব জলাভূমির তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেটা পরিষ্কার করার দায়িত্বও সিটি কর্পোরেশনের। কই এ বিষয়ে তো সিটি কর্পোরেশন কোনো উচ্চবাচ্য করে না। সেটাই যৌক্তিক। যে যার ধর্ম নির্র্বিঘ্নে পালন করুক সেটাই কাম্য। তাহলে মুসলানদের ধর্মীয় উৎসব বিঘ্নিত করার এই প্রয়াস কেন। ক্ষোভটা কিন্তু অপ্রকাশিত থাকেনি। আওয়ামী ওলামা লীগের নেতৃবৃন্দ বলেছেন যে, সকল গুরুত্বপূর্ণ চাকরি-বাকরিতে হিন্দুদের কেন অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে? প্রত্রিকায় যাদের নাম নানা কারণে ছাপা হয়, তাদের প্রায় সবাই হিন্দু। ওলামা লীগ বলেছে, হিন্দু মানেই আওয়ামী বান্ধব নয়। যোগ্যতা অনুযায়ী যে যেখানে দরকার বসুক। কিন্তু তা মুসলমানদের বঞ্চিত করে নয়। বিষয়টা দুই মেয়রেরও ভাববার দরকার আছে। তাদের আচরণ যেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের মনোভাবের প্রতিফলন না হয় যে, বাংলাদেশের মানুষের গরু খাওয়া তিনি বন্ধ করে দেবেন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দাপুটে বাঘের নতমস্তকে ক্ষমা প্রার্থনা


সীমা লঙ্ঘনকারীকে দুনিয়ার মালিক আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এ মহান আল্লাহ্তায়ালা দুনিয়াবাসীর উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারীমূলক সীমা লঙ্ঘন বিষয়ে জানান দিয়েছেন। যাতে দুনিয়াবাসী সীমা লঙ্ঘন থেকে সতর্ক থাকে। এতেই সবার মঙ্গল নিহিত। এতসব পরও ক্ষমতার দাম্ভিকতায় যারা সীমা লঙ্ঘন করে অপহিম্মত দেখান, তারা যে কত হতভাগা তার হিসাব বড়ই জটিল।
ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, বংশ গৌরব আর ক্ষমতার অপহিম্মত সব তিরস্কারের অতীত। সীমাজ্ঞান যার না থাকে, শুধু তার নছিবেই যত তিরস্কার। সীমাজ্ঞান তার কখনও ছিল বলে সর্বশেষ ঘটনায় প্রতিয়মান হয় না। বিশুদ্ধ প্রবাদ রয়েছে, ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’। শেষ ভালো তিনি তার জীবননামায় যোগ করতে সক্ষম না হওয়ায় পূর্বে যে সীমাজ্ঞানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন আজ আর এমনটি অবিশ্বাসই বটে।
ক্ষমতার রাজ্যে আর রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় থাকতে অতিকথন আর আইন হস্তগতই যেনো তার একমাত্র নিবন্ধিত অস্ত্র। ইতোপূর্বেও তিনি নিজেকে একাধিকবার অতিকথন আর আইন হস্তগত করে ‘সমালোচনার তুঙ্গে’ গিয়ে নানাবিধ অপ্রত্যাশিত নাটক মঞ্চায়ন করেছে তার জীবন ভেলায়। এতে যদিও নাড়া দিয়েছেন বিশ্ব বিবেকে।
দলীয় পদের লোভে কিংবা দলনেত্রীকে খুশি করতে তিনি নির্লজভাবে ঘোষণা করেছিলেন তার সহোদর অনুজ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি আব্দুল কাদের সিদ্দিকী নাকি একাত্তরে মুক্তিয্দ্ধু দেশের জন্য করেনি। বিপরীতে কাদের সিদ্দিকী নিজের জন্য যুদ্ধ করেছে। অথচ মুক্তিয্দ্ধুকালীন স্বাধীনতার লক্ষ্যে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী নিজে গঠন করেন কাদেরিয়া বাহিনী। ওই বাহিনীর প্রধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান করায় ‘বঙ্গবীর’ ও ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন। কতটুকু মিথ্যাচারে লিপ্ত হলে এমন লির্লজ্জ মিথ্যাচার করতে পারে সহোদর ভাইয়ের বিরুদ্ধে। এমন প্রশ্ন আজ সহসাই হৃদয়পটে নাড়া দিয়ে জর্জরিত করছে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে। ভাবিয়ে তুলছে নতুন প্রজন্মকেও।
সর্বশেষ নিউ ইয়র্কে হজ আর তাবলিগ জামাত সম্বন্ধে যে উক্তি করেছিলেন, তা বংশ ঐতিহ্য আর সাংবিধানিক ক্ষমতার মাপকাঠিতেও অভূতপূর্ব। ওই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তিনি নাকি হজ আর তাবলিগ জামাত দুটোর ঘোরতর বিরোধী। তিনি জামায়াতে ইসলামীর যতটা বিরোধী, তার চেয়ে বেশি হজ আর তাবলিগের বিরোধী।
তবে, অপ্রত্যাশিত কি? তিনি অভিজ্ঞতায় শিখেছেন, তার দলে অশালীন উক্তি, ঔদ্ধত্য বা আইনলঙ্ঘন, কিছুরই শাস্তি হয় না। তিনি আইনপ্রণেতা হয়েও আইন অমান্য করলেও ইতোপূর্বে তার উপর শাস্তির খড়ক নামেনি। কাজেই, হজ আর তাবলিগ জামাত সম্বন্ধে উক্তি করবার সময় শালীনতার সব সীমা অতিক্রম করতে তিনি কোনো ধরনের ভয় পাননি। পুরস্কারের আশা করেছিলেন কি না, সেই প্রশ্নেই বরং জল্পনা-কল্পনা চলতে পারে। সরকারের প্রথমদিকের ভূমিকা, বিদেশ থেকে স্বদেশে পদার্পণ, আত্মগোপন আর থানায় নাটকীয় আত্মসর্মপণ ইত্যকার ঘটনাবলি পুরস্কার দেওয়া-নেওয়ার আলামতই পরিলক্ষিত হয়।
টাংগাইলের সিদ্দিকী পরিবারে এমন কা-জ্ঞানহীতার দায় যার উপর আজ বর্তায়, তিনি দাপুটে বাঘ খ্যাত সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুল লতফ সিদ্দিকী। তার চার বার সংসদ জীবনে দলীয় নিয়ম আর সামাজিক সভ্যতা ভংগের পরিসংখ্যান বলবার মতো নয়। বরং, বিভিন্ন সময় তিনি আইনপ্রণেতা হয়েও নিজেই আইন হস্তগত করেছেন। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে অভিযুক্তদের পক্ষে সাফাই গেয়ে তাদের আড়াল করার অভিযুগও বিস্তর। মন্ত্রিসভার সদস্য, দলের সিনিয়র ও জুনিয়র সহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের থোড়াই কেয়ার করতেন তিনি। কখনও সরকারি কর্মকর্তাদের মারধর ও গালিগালাজ ছিলো তার রোজকার অভ্যাস। কখনও দম্ভোক্তি দেখানোই ছিলো যেনো তার ফ্যাশন। নিজ মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কর্মকর্তাদেরও নানা অজুহাতে নাস্তানাবুদ করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এসব ছাড়াও ‘ছোট ছেলের ছোট ভুল’ বলেছেন, কারোরও মগজে অক্সিজেনের অভাবের তত্ত্ব খাড়া করেছেন।
আল-ইসলামই একমাত্র ব্যতিক্রম, যাঁর অবমাননাতে শাস্তি হয়েছে, তবে ওই শাস্তি অসভ্যতার কারণে কি-না, সেটা ভাববার বিষয়ও বটে। ইঙ্গিত বুঝতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমস্যা হয়নি। তাঁরা জানিয়েছেন, দলনেত্রী তাঁদের পার্শ্বে আছেন। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র পুত্রকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাটাও শাস্তির বিষয় বস্তু হতে পারে। লতিফ সিদ্দিকী স্বয়ং বাকসংযমে পটু নন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি নিজেও এমন সব কথা বলেছেন, যা তার সাংবিধানিক মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কাজেই, মুখে লাগাম দেওয়ার সংস্কৃতি তার দলে এবার হয়তো পায়ের নীচে মাটি পাওয়া হল না।
আজকের লেখার প্রতিপাদ্যের বিষয় হচ্ছে বিশেষ করে বাংলাদেশের নয়া ইতিহাসের বিররণ। তবে লেখার শিরোনামটি আমাদের ভাবতে শুধু অবাকই করে না। বরং লজ্জ্বায় মাথা নত হয়ে আসে। কারণ যিনি ‘দাপুটে বাঘ’ খ্যাত। তিনি আবার নতমস্তকে ক্ষমা চাইবেন কেনো। যিনি সারা জীবন দাপুটে বাঘের ন্যায় কর্ম সম্পাদন করেছেন। তিনি আবার হঠাৎ করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এমন কি-বা প্রয়োজনে আইনপ্রণেতার ক্ষমতা হস্তান্তর করে জাতীয় সংসদ থেকে নজিরবিহীন নীরব প্রস্তান করে নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করতে হলো তাকে। এমন নানাবিধ প্রশ্ন হৃদয়পটে আজ সহসাই ভিড় জমায়। কিন্তু প্রশ্ন অনেক থাকলেও জবাব পাওয়া বড়ই দুরূহ। কারণ প্রধানমন্ত্রীর পুত্রও তার তাচ্ছিলতায় জব্দ হয়েছেন।
গত ১ সেপ্টেম্বর দশম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের প্রথমদিনে যোগ দিয়ে লিখিত বক্তব্যে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছেন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত মন্ত্রিত্ব ও আওয়ামী লীগের সদস্যপদ হারানো আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে সংসদ অধিবেশন চলাকালে সরাসরি আমি নিজেও তা প্রত্যক্ষ করেছি। পরদিন ২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লতিফ সিদ্দিকীর নতমস্তকে ক্ষমা প্রার্থনার খবর নানাবিধ শিরোনামে ফলাও করে ছাপা হয়।
‘সংসদে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করলেন লতিফ সিদ্দিকী’ শিরোনামে খবর ছাপে সমকাল পত্রিকা। ‘নত মস্তকে ক্ষমা চাই সবার কাছে’ শিরোনাম ছিলো ইত্তেফাক পত্রিকার। ‘সংসদে ক্ষমা চেয়ে লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগ’ শিরোনামে খবর ছাপে আলোকিত বাংলাদেশ। ‘ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করলেন লতিফ সিদ্দিকী’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে আমাদের সময়। মানবজমিন শিরোনাম করে ‘অবশেষে পদত্যাগ’। নয়াদিগন্ত খবর ছাপে ‘লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগ’ শিরোনামে। ‘আমি নতমস্তকে ক্ষমা চাচ্ছি’ শিরোনামে খবর ছাপে যুগান্তর।
পত্রিকাগুলো যে যেভাবে খবর প্রকাশ করুক না কেনো সবগুলো খবরে দাপুটে বাঘের নতমস্তকে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি প্রকাশ পায়। সংসদ সচিবালয়ের খতিয়ানে এর আগে এভাবে কোনো এমপি’র পদত্যাগের নজির নেই। অধিবেশন শুরুর আগে তিনি দেখা করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে। সন্ধ্যা ৭টার পর লতিফ সিদ্দিকী সংসদে ঢোকার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন না। এ সময় তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর লবিতে। তার প্রবেশের সময় বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বক্তব্য রাখছিলেন। এদিকে সংসদে তাকে দেখে এমপিরা একে অপরের দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকান। তবে কেউই তার পাশে যাননি। আসনে বসেই লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের সামনের সারিতে বসে থাকা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে ইশারায় কথা বলেন।
প্রথমে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়ানোর জন্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সাড়া পাননি লতিফ সিদ্দিকী। তাকে উদ্দেশ্য করে স্পিকার বলেন, মাননীয় সদস্য, আপনি একটু পরে কথা বলেন। এর কিছুক্ষণ পর স্পিকারের অনুমতি মিললে বক্তব্য শুরু করেন তিনি। প্রায় ১৫ মিনিটের বক্তব্যে লতিফ সিদ্দিকী হজ নিয়ে নিজের অবস্থানের কথা জানান। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা তুলে ধরেন।
পাঠকদের সুবিধার্থে লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো-
বক্তব্যের শুরুতেই লতিফ সিদ্দিকী স্পিকারের উদ্দেশে বলেন, আমি এই সংসদে সাধারণ মৌখিক বক্তৃতা করেছি, আজ বিশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানাতে দাঁড়িয়েছি। এজন্য একটি লিখিত বক্তৃতা নিয়ে এসেছি। মাননীয় স্পিকার আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে বক্তক্যটি পড়বো। স্পিকারের অনুমতি মিললে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আমি অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েছি। আজকে আমার সমাপ্তি দিন। এই দিনে কারও বিরুদ্ধে কোনো বিদ্বেষ অভিমান অভিযোগ আনছি না। দেশবাসী আমার আচরণে যদি কোনো দুঃখ পেয়ে থাকেন আমি নতমস্তকে তাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি মানুষের ভালবাসাকে আমার শ্রেষ্ঠ মূলধন মনে করি। সেই ওয়াদা করে সর্বশেষে আমি বলছি, উপরন্তু অনুমিত হয়েছি আমার নেতার অভিপ্রায় আমি আর সংসদ সদস্য না থাকি। কর্মী হিসেবে নেতার একান্ত অনুগত ছিলাম। বহিষ্কৃত হওয়ার পর তার ব্যত্যয় কিংবা ব্যতিক্রম সমীচীন মনে করি না। এখন দ্বিধাহীন কণ্ঠে, ঘৃণা বিদ্বেষ উগরে না দিয়ে, কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না করে দৃঢ় চিত্তে বাংলাদেশ সংসদের আসন ১৩৩ টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করছি। একই সঙ্গে মাননীয় স্পিকার আপনার বরাবর পদত্যাগপত্রটি প্রেরণ করছি।’ তিনি পদত্যাগপত্রটি পড়ে শোনানোর জন্য স্পিকারের অনুমতি চাইলে স্পিকার বলেন, পড়ে শুনানোর প্রয়োজন নেই।
এরপর লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রথমে আমি বলে নেই, আমি মুসলমান আমি বাঙালি, আমি আওয়ামী লীগার। এই পরিচয় মুছে দেয়ার মতো শক্তি পৃথিবীর কারও নেই। কারণ, এই আমার চেতনা, আমার জীবনবেদ, প্রাণের রশদ, চলার সুনির্দিষ্ট পথ। যে যাই বলুন, প্রচার করুন, সিদ্ধান্ত নিন, এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে না। আমি মানুষ বলেই আমার ভুলভ্রান্তি আছে, ত্রুটি আছে। কিন্তু মনুষ্যত্বের স্খলন নেই, মানবতার প্রতি বিশ্বাস হারাই না, যত বড় আঘাতই আসুক ধৈর্যহারা হই না। আমি বিশ্বাস করি আঁধার মানেই আলোর হাতছানি, রাষ্ট্র নিপীড়ন করলেও আমি ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে মেনে নিয়েই তা মোকাবিলা করলাম। আমি অভিযোগের টুকরি নিয়ে সংসদে দাঁড়াইনি। ভালোবাসার মহিমা বিতরণ করতে সৌহার্দ্য আর প্রীতি ভালোবাসার মালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছি। আমি সব সময়ই অস্পষ্টতা ও ধূসরতা বিরোধী। অস্পষ্টতা, ধূসরতা, কপটতা স্বার্থপরতা সুযোগ-সুবিধার পথে হাঁটাকে অপছন্দ করি। জীবন উৎসর্গ করেছিলাম মানুষ সমাজ রাষ্ট্র মানবতার সেবায়। নিজের জন্য ভারী ভারী পদ-পদবী করায়ত্ত করতে নয়। আর পদপদবীর জন্য নিজের চরিত্র বৈশিষ্ট্য কালিমালিপ্ত করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ।’
‘অসাম্প্রদায়িক, ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা আমার মনন গঠিত ও বিকশিত এবং প্রতিনিয়ত এর চর্চা ও অনুশীলন করি। অমানুষ নই, ব্রতমান মানুষ। মনুষ্যত্ব ও মানবতার চর্চা অনুশীলন করতে গিয়ে নিজের ভিতরে অনেক কুঠুরি নির্মাণ করেছি। মানুষ ও মনুষ্যত্বের অনুশীলনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কুঠুরিতে প্রবেশ করি। সেই কুঠুুরির একটা আমার ধর্ম কুঠুরি। সেখানে আমি সাচ্চা মুসলমান। ধর্মীয় জীবন একান্তই আমার জীবন। এ জীবন ধারণে জনবাহবা বা নিন্দা কোনটাতেই আমি কুণ্ঠিত, বিব্রত ও ভীতসন্ত্রস্ত হই না। নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করেই সন্তুষ্ট। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার ধর্ম কুঠুরির ভাবজগৎ নিয়ে সমষ্টিতে আলোড়ন আন্দোলন দেখা দিয়েছে। সমষ্টি আমাকে ত্যাজ্য করেছে। যেভাবেই ভাবা যাক রাজনীতির সামষ্টিক কোনক্রমেই ব্যষ্টির বা স্বতন্ত্র অবস্থান স্বীকার করে না। কারণ, রাজনীতি মানব কল্যাণের একটি প্রকৃষ্ট উপায়, কোনো বিচ্ছিন্ন উপায় নয়। অন্যদিকে ব্যক্তিজীবন একান্তই ব্যক্তির। এখানে সমষ্টির প্রবেশ নিষিদ্ধ। ব্যক্তি এখানে সবকিছু।’
‘আমাকে ষড়যন্ত্রকারী, প্রতিশোধপরায়ণ ধর্মদ্রোহী গণদুশমন, শয়তানের রিপ্রেজেন্টেটিভসহ বিভিন্ন ঘৃণার পাত্র সাজাতে সবশেষে ধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি স্পষ্ট করে দৃঢ়চিত্তে বলতে চাই, আমি ধর্মবিরোধী নই, আমি ধর্ম অনুরাগী, একনিষ্ঠ সাচ্চা মুসলমান। আমি বলতে সাহস পাই, ধর্মীয় অনুশাসন মানে যেসব করন্ত কাজ ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী গোষ্ঠী স্বীয়স্বার্থ চরিতার্থ করতে তৎপর তাদের বিরুদ্ধে শান্তির ধর্ম ন্যায়ের ধর্ম সত্যের ধর্ম অন্ধকার থেকে আলোর দিশা ধর্ম ইসলামের সঠিক তাৎপর্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে অম্লান থাকবে আমার পথচলা।’
‘আমার এই মনভাবের প্রকাশ নিয়ে যতই ষড়যন্ত্র হোক, যত মিথ্যাচার হোক, যত আঘাত প্রতিঘাত আসুক, রাজনৈতিক সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আস্থা রেখে যেমন মোকাবিলা করেছি, বর্তমানেও এর ব্যত্যয় ঘটবে না। আমি মনে করি, হজ প্রতিপালন ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে অন্যতম ফরজ। এই ফরজ পালনেও আরও কতগুলো অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিপালন মাত্র একবারই করার কথা। যা নিজেও করেছি।’
‘ওয়াজিব, সুন্নাত পরিহার করে অবশ্য পালনীয় ফরজ তরক করে যারা এই ফরজটি পালনে প্রতিবছর ব্যস্ত তাদের মানসিকতা আর আমার বিবেচনায় ভিন্ন। হজ যে একটি বিরাট অর্থনীতিক কর্মকা- তা কিন্তু মানতে না চাইলে মিথ্যা হয়ে যায় না। রোজার মাসটি আমার প্রাত্যহিক জীবনের অবশ্য পালনীয় মাস। আমি এই ধর্মীয় আচারটি পালন করি। মহানবী (সাঃ) আল্লাহ্র প্রেরিত প্রতিনিধি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। শূন্য থেকে একক প্রচেষ্টায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনে দক্ষ ও সফল রাষ্ট্রনায়ক। আমার চলার পথের আলোকবর্তিকা। আদর ভালবাসা শ্রদ্ধা ও সম্মানে নিজের বুকে আগলে আব্দুল্লাহপুত্র মোহাম্মদ বলে আদর প্রকাশে কুণ্ঠিত ভীত বা শঙ্কিত নই। এই দুর্লভ মানব জীবন সামনে মহানবীর আদর্শিক জীবন চলার নির্দেশনা থাকার পরও কি সুন্দরের আরাধনা মনে জাগবে না যতবার বলতে বলা হবে ততবার বলবো, তাবলিগ প্রচারকারীরা যদি ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সমাজ রাষ্ট্র চেতনা বৃত্তির দিকে মনোযোগী হতেন তাহলে তাবলিগের যে প্রভাব আমাদের সমাজ জীবনে প্রতিফলিত তা আরও ফলবতী হতো, কার্যকর ভূমিকা রাখতো। নবী (সাঃ) কখনও জীবনকে অস্বীকার করে ধর্ম পালন করতে বলেননি। জীবনের জন্য ধর্ম অপরিহার্য।’
‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বিদায় হজের ভাষণে নিষেধ করে গেছেন। যারা অসাম্প্রদায়িক ও ইহজাগতিকতার কথা প্রচার করেও ধর্মানুগ নীতি নিয়ে শোরগোল তোলেন তাদের বিষয়ে নীরব থাকাই সমীচীন মনে করি। তিনি বলেন, এমন বহিষ্কারের খড়গ এবারই প্রথম নয়। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও চারবার বহিষ্কৃত হয়েছি। বাঙালির আত্মপচিয়ের সরব ঘোষণার কারণেই। দল থেকে দুইবার বহিষ্কার হয়েছি দলীয় কর্মকাণ্ডে দুর্বল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি বলে। এবারও কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ইহজাগতিক মনোভাব প্রকাশ করার কারণেই আমি দল থেকে বহিষ্কার, মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ, এমনকি আমার প্রেসিডিয়াম সদস্যপদ হরণ করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ কতখানি যৌক্তিক সে বিষয়ে বলতে চাই। নিকট অতীতে মোঃ হানিফ যখন আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র থেকে ধর্মনিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িক নীতি আদর্শ বাদ দিতে ওকালতি করেন তখন তার এ তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। তখন ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ উঠেনি। কারণ, দল তখন ক্ষমতায় ছিল না, দলের অবস্থা এমন রমরমা ছিল না।
‘আমার যত আপত্তি সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফা উল্লেখ করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে স্পিকারের চিঠি প্রসঙ্গে। ৬৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফার বর্ণিত নির্দেশনা হলো, ‘কোনো ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা এবং থাকার বিষয়ে। এক্ষেত্রে ৬৬ অনুচ্ছেদের দুই দফা কারণ সংসদের ৭০ অনুচ্ছেদের নির্দেশনার ব্যাপারটি স্পষ্ট। এ স্পষ্ট বিষয়টি আপনার বরাতে ধূসর হয়ে গেছে। আমি বিবেচনা করি, এই চিঠিতে সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন সংবিধানের অপব্যাখ্যা হয়েছে। বিনা শুনানিতে এভাবে একজন সংসদ সদস্যের আসন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয়া যথাযথ কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। আপনি আমাকে সময় দিয়েছেন। বিদায় বেলায় শুধু এ কথা বলতে চাই, আমি মানুষের জন্য রাজনীতি করেছি মানুষকে ভালবেসেছি। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আমি অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছি। আজকে আমার সমাপ্তি দিন। এই দিনে কারও বিরুদ্ধে কোনো বিদ্বেষ অভিমান অভিযোগ আনছি না।  জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা সফল হোন।’ (তথ্য সূত্র: মানবজমিন- ০২.০৯.২০১৫) বক্তৃতা শেষ করেই তিনি অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় কয়েক এমপি’র সঙ্গে বিদায়ী করমর্দন করেন। অনেক এমপি দাঁড়িয়ে তাকে বিদায় জানান।
টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী সিদ্দিকীদের বড় ভাই লতিফ ওই আসন থেকে একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকীও একবার সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তার ভাই আব্দুল কাদের সিদ্দিকীও সাবেক সংসদ সদস্য, যিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে এখন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করে সে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। টাঙ্গাইল-৪ আসনের চারবারের সংসদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ছিলেন পাঁচ বছর। চলতি সরকারে তাকে দেয়া হয়েছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় সভায় লতিফ সিদ্দিকী হজ, তাবলিগ জামাত, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সাংবাদিকদের সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। ওই সময়ে দেশের বিভিন্ন আদালতে তার নামে একাধিক মামলাও হয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ভারত হয়ে ওই বছরের ২৩ নভেম্বর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফেরেন সাবেক ওই মন্ত্রী। পরে ২৫ নভেম্বর ধানমন্ডি থানায় আত্মসমর্পণ করলে তাকে জেলহাজতে পাঠান আদালত। ওই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মামলায় ৯ মাস কারাগারে কাটাতে হয় তাকে। গত ২৯ জুন জামিনে মুক্তি পান তিনি। ১৩ জুলাই লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের জন্য জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের পক্ষে চিঠি দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। চিঠিতে বলা হয়, ২০১৪ সালের ২৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় গঠনতন্ত্র অনুসারে লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদও নেই, সেহেতু এই দলের মনোনয়নে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য পদেও তাকে বহাল রাখা সমীচীন হবে না। এরপর আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদকে চিঠি দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। ওই চিঠির সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের চিঠিটিও যুক্ত করেন স্পিকার। চিঠিটি পাওয়ার পর ইসি আওয়ামী লীগ ও লতিফ সিদ্দিকীর কাছে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা চান।
আমরা বলতে চাই, বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীরা যখন জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেননি তখন ওই অতিগুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে বসবার যোগ্যতা লতিফ সিদ্দিকীদের কখনও ছিল না। আজ সেটুকুও নেই লতিফ সিদ্দিকীর। বিনা বাক্যব্যয়ে লতিফ সিদ্দিকীকে জাতীয় সংসদ থেকে বরখাস্ত করাই ছিল উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটানো ডিজিটাল বাংলাদেশের দাবিদার মহাজোটনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত কর্তব্য। ক্ষমতার অপহিম্মতধারীর ন্যায় চরিত্ররা যাতে গণপরিসরে তথা জাতীয় সংসদে না আসতে পারেন, সেটুকু নিশ্চিত করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের একটি বড় উপকার করতে পারেন।
তবে, ক্ষমতার অপহিম্মতধারীরা এই সমাজেরই সন্তান। সেদিক থেকে লতিফ সিদ্দিকীও সমাজের বাইরে নন। তিনি যখন জনসভায় হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে মন্তব্যটি করেছিলেন, তখন কিন্তু সভায় উপস্থিত আওয়ামীবাদী নেতা-কর্মীরা বিস্ময়ে চুপসে যাননি। প্রতিবাদও করেননি। বরং, নীরব থেকে তারা পরাজিত সম্রাট লতিফ সিদ্দিকীকে প্রবল হাততালিতে উৎসাহ দেওয়ার মতই প্রেরণা যোগিয়েছেন। অর্থাৎ, নর্দমার যে পাঁক বেচিতে লতিফ সিদ্দিকী যে আসরে নেমেছিলেন, তার উৎসাহী ক্রেতাও বিস্তর আছে। ঘটনাটি লতিফ সিদ্দিকীকে যতখানি চিনিয়ে দেয়, সমাজকেও ততখানি ভাবিয়ে তুলে। এইখানেই নাগরিক সমাজের ভূমিকার প্রশ্নটি সহসাই উঠে। সোশ্যাল মিডিয়ায় লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ চলছে বলেও সিদ্দিকী পরিবারের অভিযোগ। কিন্তু, সিদ্দিকী পরিবারের অভিযোগ ওই ঘটনার গুরুত্বকে খাটো করে দেওয়া ভিন্ন আর কিছুই নেই। সমাজের ভিতর হতে স্পষ্ট স্বরে বলতে হবে, ওই অসভ্যতা রাজনীতির প্রশ্নই নয়, এটি সামাজিক পরিসরে ইতর ব্যবহারের দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক রং তথা আদর্শ নির্বিশেষে তার প্রতিবাদ করতে হবে। এই দফায় ক্ষমতার অপহিম্মতধারীদের রাজনৈতিক ঢালের আড়ালে লুকিয়ে রাখলে চলবে না। শাস্তি প্রয়োজন। একান্তই কঠিন শাস্তি। 
এম.কে. দোলন বিশ্বাস 

শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অনাদরে আর উপেক্ষায় অবসরে গেলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক


গত ১৭ই সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির চাকরি জীবন শেষ হলো Unceremoniously. আপিল বিভাগ তো দূরের কথা, হাইকোর্ট বিভাগেরও অনেক বিচারপতিকে অবসরে যাওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট বার থেকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়। আর আপিল বিভাগের বিচারপতিগণকে সুপ্রিম কোর্ট বার তো বটেই, এটর্নি জেনারেলের অফিস থেকেও ফেয়ার ওয়েল দেয়া হয়। কিন্তু আজকে যাকে নিয়ে আলোচনা করছি সেই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতি সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাকে ফেয়ার ওয়েল দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। পত্র পত্রিকায় বলা হয়েছে যে, বার সমিতি তাকে বিদায় সংবর্ধনা না দিলেও এটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে সেটি দেয়া হবে। কিন্তু ১৮ তারিখের পত্র পত্রিকায় দেখলাম, এটর্নি জেনারেলের অফিসও তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানায়নি। এটি আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। বার সমিতি বিরত থাকবে, সেটি তো জানা কথা। কারণগুলোও তারা গোপন করেনি। বরং কি কারণে তারা সংবর্ধনা দেবে না সেসব কারণ একটি প্রস্তাবে সন্নিবেশ করা হয়েছে।
আইনজীবীদের সাধারণ সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিভিন্ন কার্যকলাপ জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। তার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউ আহমেদ মৃত্যু বরণ করেন। তার কারণে ১৪ জন আইনজীবীকে কারাগারে যেতে হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে শপথ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা দুঃখজনক। আইনজীবীদের উন্নয়নমূলক কাজের বিরোধিতা করেছেন তিনি। এসব কারণে সাধারণ সভায় আইনজীবীরা তার সংবর্ধনা প্রদানের বিরোধিতা করেছেন।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেয়া হবে কি না এ বিষয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ওই বিচারপতিকে ছয়টি কারণে সংবর্ধনা না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে সরকারের এটর্নি জেনারেলের কার্যালয় সংবর্ধনা দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছিলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
সাধারণ সভায় গৃহীত ছয়টি সিদ্ধান্ত হলো:
১. বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এবং আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তার বিভিন্ন কার্যকলাপ জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ায় এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ায় এই সভা তার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে।
২. তার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউ আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। এডভোকেট মোজাম্মেলসহ অনেক আইনজীবীর সঙ্গে অসদাচরণ ও অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে সভায় উপস্থিত সাধারণ আইনজীবীরা তাকে সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়ার বিরোধিতা করেন।
৩. জনাব মানিক অতীত অসদাচরণের ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরাফসহ ১৪ জন আইনজীবীকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছিলেন। এজন্য সভা তার তীব্র নিন্দা জানায় এবং উপস্থিত সাধারণ আইনজীবীরা তাকে সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়ার বিরোধিতা করেন।
৪. পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেছেন যে বিচারপতি পদে শপথ নেয়ার সময় শামসুদ্দিন চৌধুরী ব্রিটিশ নাগরিকও ছিলেন। ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে শপথ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা দুঃখজনক। দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তার উক্তরূপ অনিয়মের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেতন, ভাতা ও পেনশন প্রদান না করতে প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ এবং দুদককে এ ব্যাপারে তদন্ত করার আহ্বান জানানো হয়।
৫. জনাব মানিক বিভিন্ন সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের সুযোগ-সুবিধা রক্ষা এবং উন্নয়নমূলক কাজের বিরোধিতা করেছেন। আইনজীবীদের কিউবিক্যালস ভবন নির্মাণে নগ্ন বিরোধিতা করেন যার ফলে বারের অনেক আইনজীবী সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
৬. এই বিতর্কিত বিচারপতি তথ্য গোপন করে দীর্ঘদিনের কার্যক্রম অনৈতিক ও বেআইনি মর্মে গোচরীভূত হওয়ায়, সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে বিদায় সংবর্ধনা না জানানোর জন্য সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
॥দুই॥
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতির অভিসংশন বা ইম্পচমেন্ট চেয়ে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠির অনুলিপি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, আইনমন্ত্রী এবং সমস্ত বিচারপতির কাছে। তার এই কাজের সমালোচনা করেছেন বার সমিতির সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার অভিসংশন চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর আবেদন করা শোভনীয় হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। হাইকোর্টে থাকাকালে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করেছেন সেটাও শামসুদ্দিন চৌধুরীর জন্য শোভনীয় নয়। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়া হবে না বলেও সাংবাদিকদের জানান তিনি।
একজন আপিল বিভাগের বিচারপতির পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির অপসারণ চেয়ে এই প্রথম আবেদন। কোনো দেশের কোনো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অপসারণের জন্য আবেদন শোভনীয় নয়।
সংবর্ধনা না দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বার বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেবে না সেটা মেজরিটির সিদ্ধান্ত তাই তার একার সিদ্ধান্তে কিছু হবে না। আমার মতামতও তাদের পক্ষে রয়েছে। এর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে আমরা সংবর্ধনা দেইনি। তিনি তা বুঝতে পেরে আগেই বলেছিলেন, বারের পক্ষ থেকে আমি সংবর্ধনা চাই না। আশা করি ভবিষ্যতে তার এই আচরণ থেকে অন্য সবাই শিক্ষা নেবেন। মনে রাখতে হবে ক্ষমতা জিনিসটা স্থায়ী না। ভয় রাখতে হয়। যে চেয়ারটায় তিনি আছেন সেই চেয়ারটা চিরদিনের জন্য নয়।
কোনো আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা ছাড়াই বিদায় নিয়েছেন আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এটাই ছিল আপিল বিভাগের প্রথম কোনো বিচারপতির সংবর্ধনাহীন বিদায়ের ঘটনা। প্রথা ও রীতি অনুযায়ী আপিল বিভাগের বিচারপতিরা অবসরে গেলে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন ও এটর্নি জেনারেল কার্যালয় সংবর্ধনা দিয়ে থাকে। তবে নানা বিতর্কিত ভূমিকার কথা উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট বার আগেই সাধারণ সভা ডেকে জানায় তারা বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেবে না। তবে এটর্নি জেনারেল কার্যালয় জানিয়েছিল বিদায়ী বিচারপতিকে সংবর্ধনা দেয়া হবে।
কিন্তু গত বৃহস্পতিবার এটর্নি জেনারেল বা সরকার সমর্থক আইনজীবীদের কেউই সংবর্ধনা দেয়নি। সরকার সমর্থকরা মিলনায়তনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এটর্নি জেনারেল কার্যালয়ও জানিয়েছিল, বিদায়ী বিচারপতিকে সংবর্ধনা জানানো হবে। তবে শেষ পর্যন্ত কেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো না সে বিষয়ে সরকার সমর্থক কোনো আইনজীবী বা এটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। অভিসংশন করার আবেদন জানিয়ে বিচারপতি চৌধুরী যে চিঠি দিয়েছিলেন সেটির প্রাপ্তি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী বা স্পীকার - কেউই স্বীকার করেননি। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, জনাব চৌধুরীর অভিসংশনের আবেদন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কেউই ভাল চোখে দেখেননি। তাই তারা তার চিঠিটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মনোভাব টের পেয়ে এটর্নি জেনারেলের অফিসও ফেয়ার ওয়েল দেয়ার জন্য এগিয়ে যাননি।
এই ব্যাপারে বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বিচারপতি মানিককে ‘এক্সট্রিমলি রং হেডেড’ বলে অভিহিত করেছেন। আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, গত কয়দিন আগে দেশের বিচারালয়ে খুব বড় মাপের প্রলয় বয়ে গেছে। যদিও গণমাধ্যমে খবরটি এসেছে খুব ছোট করে। 
বিএনপির এ নেতা বলেন, প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে বিচারপতি মানিকের যে অভিযোগ, তার চেয়েও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার (মানিক) বিরুদ্ধে। তিনি সব সময় ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। তিনি অতীতে সংসদের স্পীকারকে মূর্খ বলেছেন। দেশের সম্মানিত নাগরিকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। মানুষকে হেনস্থা করেছেন। বিচারপতির দায়িত্বে থেকে অযাচিতভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছেন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে মানিককে উচ্চ আদালতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। বিএনপি তাকে স্থায়ী করেনি। এটা বিএনপির সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ বিএনপি তার সম্পর্কে ভাল করেই জানতো তিনি টোটালি রং হেডেড।
॥তিন॥
দুই বিচারপতির মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত হয় বিচারপতি মানিকের অবসরকালীন পেনশন এবং অন্যান্য ভাতা নিয়ে। প্রধান বিচারপতির নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল তাকে জানিয়েছেন যে, জনাব মানিক সকল রায় লেখা শেষ না করা পর্যন্ত তার পেনশন সংক্রান্ত প্রক্রিয়া যেন শুরু করা না হয়। জবাবে জনাব মানিক প্রধান বিচারপতির কাছে প্রেরিত চিঠিতে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতির পেনশন তার কাজ শেষ করার ওপর নির্ভর করে বলে কোনো আইনি উপাদানের কথা যেমন আমার জানা নেই, তেমনই এটাও আমার জানা নেই যে রায় লেখা শেষ না করলে কোনো সহকর্মী বিচারপতির পেনশন আটকে রাখার জন্য প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিতে পারেন।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী তার চিঠিতে লিখেছেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতিরও পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে কয়েক মাস সময় লেগে যায় এবং আপনিও অবসরে যাওয়ার সময় পূর্ণাঙ্গ রায় অপেক্ষমাণ থাকবে। এটা খুবই স্বাভাবিক। শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশের জন্যই এটা স্বাভাবিক বিষয় কারণ রাতারাতি রায় লেখা সম্ভব নয়।
তিনি লিখেছেন, অতীতের সকল বিচারপতির ক্ষেত্রে এ রকম হয়েছে এবং এমন কোনো উদাহরণ নেই যেখানে মাননীয় প্রধান বিচারপতির নির্দেশে কোনো বিচারপতির অবসরকালীন ভাতার বিষয়টি রায় লেখা শেষ করার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কোনো বিচারপতির পক্ষেই সব রায় লেখা শেষ করে অবসরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার বক্তব্যের স্বপক্ষে তিনি প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকসহ ৯ জন বিচারপতির নাম উল্লেখ করেছেন যারা অবসরে যাওয়ার আগে রায় লেখা শেষ করতে পারেননি।
এর উত্তরে প্রধান বিচারপতির অফিস থেকে বলা হয় যে, তিনি যেহেতু ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী তাই রায় না লিখে বিদেশে চলে গেলে জটিলতা সৃষ্টি হবে। এতে জনগণের ভোগান্তি আরো বাড়বে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি।
এরপর বিরোধ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। বিচারপতি মানিক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার অভিসংশন দাবি করে প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি দেন।
॥চার॥
কোনো দেশের উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি তার প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিসংশন বা ইম্পিচমেন্টের দাবি তুলেছেন, এমন কথা অতীতে শোনা যায়নি। আমাদের পাশের দেশগুলো অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ প্রভৃতি দেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেদিক দিয়ে জনাব শামসুদ্দিন মানিক নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
এ ব্যাপারে কোনোরূপ মন্তব্য না করেও বলা যায় যে, যিনি এই দাবিটি তুলেছেন, অতীতে তাকে অভিসংশন করার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে একাধিকবার দাবি উত্থাপিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১২ সালের ১৮ জুন স্পীকার আব্দুল হামিদ সংসদে একটি রুলিং দেন। রুলিংয়ে তিনি বলেন, “হাইকোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেছেন, আমার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। আমার বক্তব্যের কোনটি রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে তা আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রদ্রোহীতা কি, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহীতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন, এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি তার বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।”
রুলিংয়ে ঐ বিচারপতিকে অপসারণে সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর যে প্রস্তাব করেন স্পীকার তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, “গত ৫ জুন ২০১২ সংসদ সদস্যরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশের এক পর্যায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন পূর্বক উক্ত বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে একটি রেজ্যুলেশন গ্রহণ করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রেরণের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। আপনাদের (সংসদ সদস্যদের) প্রস্তাবকে আমি সমর্থন করে বলতে চাই, একজন বিচারকের অশোভন আচরণ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে ব্যাহত করতে পারে না।”
পরবর্তীকালে বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োজিত হন। ভাগ্যের পরিহাস, সেই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আজ প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে অভিসংশনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদকে। দুই বিচারপতির এই লড়াই কোনখানে গিয়ে শেষ হয় সেটি দেখার জন্য দেশবাসী গভীর আগ্রহ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং বঙ্গ ভবনের দিকে তাকিয়ে আছে। লড়াই যেখানেই শেষ হোক না কেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মান মর্যাদা এবং ভাবমূর্তিকে যে হুমকির মুখে ফেলেছে সে ব্যাপারে সুধী এবং বোদ্ধা মহলের কোনো সন্দেহ নাই।

শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের তুলনা


আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-নির্যাতনের শিকার বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে প্রচণ্ড প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক অর্থে ধান্দাবাজ ও সুযোগসন্ধানীদের দৌরাত্ম্যও বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে তিক্ততা ও বিভেদ সৃষ্টি এবং ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ঘটানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর ধান্দাবাজ ও সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিএনপিকে ‘হেদায়েত’ করার কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বিএনপি কেন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না, সাংগঠনিকভাবে দলটি কেন পিছিয়ে ও দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং আবারও ঘুরে দাঁড়াতে হলে বিএনপিকে কিভাবে এগোতে হবে- এসব বিষয়ে উপদেশ ‘খয়রাত’ করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন অনেকেই। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, ‘খয়রাত’ যারা করছেন তারা বিএনপির শুভাকাংক্ষী হিসেবে পরিচিত। এ পরিচিতিরই সদ্ব্যবহার করছেন তারা।
এমন একজন কথিত শুভাকাংক্ষী সম্প্রতি একটি দৈনিকের নিবন্ধে বিএনপিকে যথেচ্ছভাবে উপদেশ ‘খয়রাত’ করেছেন (দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ সেপ্টেম্বর,২০১৫)। তা তিনি করতেই পারেন, কিন্তু আপত্তি উঠেছে তার যুক্তি ও কৌশলের কারণে। ইতিহাস টেনে আনার ক্ষেত্রেও ভুল করেছেন তিনি। এককালের বামপন্থী এই ছাত্রনেতা বিএনপির বর্তমান অবস্থাকে ১৯৬০-এর দশকে আওয়ামী লীগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ছয় দফা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের ওপরও “এক ধরনের ‘ক্র্যাকডাউন’ নেমে এসেছিল। শেখ হাসিনার লীগ সরকার বিএনপির ওপর যেভাবে ‘চড়াও’ হয়েছে, পঞ্চাশ বছর আগে আইউব খানের লীগ সরকারও একইভাবে ‘চড়াও’ হয়েছিল।...দলের সব নেতাকেই ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস- ডিপিআর নামক আইনের অপপ্রয়োগ করে কারারুদ্ধ করা হয়। একমাত্র আমেনা বেগম আওয়ামী লীগ অফিসে বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। সেই সময়টি ছিল আওয়ামী লীগের দুঃসময়। তখনো মুসলিম লীগের পা-ারা বলত, ‘আওয়ামী লীগ শেষ। বাতি জ্বালিয়েও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ কিন্তু বেশি দিন লাগল না, আওয়ামী লীগ আবার জনগণের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে জেগে উঠল এবং চিরতরে হারিয়ে গেল মুসলিম লীগ।” এরপর সাবেক এই বামপন্থী লিখেছেন, “আওয়ামী লীগের যারা ‘বিএনপি শেষ’, আহ, দেশে একটা বিরোধী দল নেই বলে কৌতুক করছেন, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন, তাদের অতীতের দিকে ফিরে তাকাতে বলি।... দেশি-বিদেশি এমন সব রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কাহিনী জানা থাকলে বিএনপি নিয়ে তাদের হাসি-তামাশা থেমে যেত।”
কথাগুলো শুনলে মনে হতে পারে, নিতান্ত নিরীহ একজন শুভাকাংক্ষীর মতো বলেছেন তিনি। টেনে এনেছেন বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসও। অন্যদিকে ইতিহাসের আলোকে পর্যালোচনায় কিন্তু দেখা যাবে, আওয়ামী লীগকে প্রাধান্যে আনার এবং বিএনপিকে আরো পেছনে ঠেলে দেয়ার সুচিন্তিত উদ্দেশ্য থেকে সুকৌশলে ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন তিনি। উদাহরণ দেয়ার জন্য ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখ করা দরকার। শুনতে কারো কারো খারাপ লাগতেই পারে কিন্তু সত্য হলো, এই গণঅভ্যুত্থানে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এবং নেতা হিসেবে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। এর কারণ, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছয় দফা ঘোষণার পরপর মে মাসে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছিলেন। ছয় দফা ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সেদিনের আওয়ামী লীগ কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কারণ, কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্রসহ মেহনতী মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো দাবি না থাকায় এবং মূলত সাংবিধানিক পরিবর্তনের কর্মসূচি হওয়ায় ছয় দফা জনগণের সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। এখানে তৎকালীন আওয়ামী লীগের অবস্থা সম্পর্কেও ধারণা দেয়া দরকার। প্রথমত, ছয় দফার প্রশ্নে ১৯৬৬ সালেই আওয়ামী লীগ দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ‘ছয় দফাপন্থী’ হিসেবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধুরন্ধর নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ‘পিডিএমপন্থী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি ছিল না। দলের অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে, ’৬৮ সালের জানুয়ারিতে দলের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী করার পরও দলটি সামান্য প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। ২১ জানুয়ারি অনেকটা গোপনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভার এক প্রস্তাবে অভিযুক্ত নেতাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার জন্য দাবি নয়, সরকারের কাছে ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল। ’৬৮ সাল জুড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি চলেছে, শুনানির বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই, যার ভিত্তিতে বলা যাবে যে, ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ মামলাটির বিরুদ্ধে এবং নেতার মুক্তির দাবিতে কোনো মিছিল বা সমাবেশ করেছিল। ঢাকায় তো বটেই, প্রদেশের অন্য কোথায়ও দলটির তৎপরতা দেখা যায়নি। অনেকস্থানে আওয়ামী লীগের নেতারা বরং দলীয় অফিসে যাতায়াত পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখানে কৌত’হলোদ্দীপক একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। তথ্যটি হলো, শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খানই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান কৌসুলী বা আইনজীবী হিসেবে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেনÑ যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা কখনো তার নামই মুখে নেন না।
‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা সম্পর্কিত দ্বিতীয় তথ্য হলো, দলটি ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে গঠিত ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি বা ড্যাক নামের আটদলীয় জোটে যোগ দিয়েছিল। তথ্যটি উল্লেখ করার কারণ, ড্যাক-এর প্রধান নেতা ছিলেন শেখ মুজিবের কঠোর সমালোচক ও প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান। ড্যাক-এর শরিক দলগুলোর নামও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ : কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, এনডিএফ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ওয়ালী) এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগ। প্রধান দলগুলোর মধ্যে একমাত্র মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী) ড্যাক-এ যোগ দেয়নি। উল্লেখ্য, ড্যাক-এর আট দফায় স্বায়ত্তশাসন শব্দটিও ছিল না। অথচ স্বায়ত্তশাসন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান দাবি। তাছাড়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উল্লেখ পর্যন্ত না করে পশ্চিম পাকিস্তানের দুই নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাশাপাশি শেখ মুজিবের মুক্তি চাওয়া হয়েছিল পঞ্চম দফায়। অমন একটি জোটে অংশ নেয়ার তথ্যও প্রমাণ করে, ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা আসলেও শোচনীয়ই ছিল। নাহলে স্বায়ত্তশাসন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উল্লেখবিহীন কর্মসূচির ভিত্তিতে দলটি ড্যাক-এ যোগ দিত না।
বাস্তবে শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রিয় নেতা হয়েছিলেন ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানে। এই অভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মহা ধুমধাম করে ১৯৬৮ সালে পালিত ‘উন্নয়ন দশক’-এর শেষ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকায় স্বায়ত্তশাসনের বিরোধিতাসহ উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছিলেন। এর প্রতিবাদে এ্ং ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ উপলক্ষে ৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে আয়োজিত বিরাট জনসভায় মওলানা ভাসানী প্রত্যক্ষ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং শেখ মুজিবসহ সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির দাবিতে জনসভার মানুষকে নিয়ে মওলানা ভাসানী গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করেছিলেন। ঘেরাওকারী জনতার ওপর পুলিশ নির্যাতন চালিয়েছিল। প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী ৭ ডিসেম্বর হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে দু’জন শহীদ এবং ১৬ জন আহত হলে মওলানা ভাসানীর ডাকে ৮ ডিসেম্বরও হরতাল পালিত হয়েছিল। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘ঘেরাও আন্দোলন’। সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র প্রদেশে, আজকের বাংলাদেশে।
মওলানা ভাসানীর ‘ঘেরাও আন্দোলনে’র সাফল্যই প্রদেশের ছাত্রসংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ঘোষিত হয়েছিল ১১ দফা। ছাত্র সংগঠন তিনটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ভাসানীপন্থী, ‘মেনন গ্রুপ’ নামে পরিচিত), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (রুশপন্থী, ‘মতিয়া গ্রুপ’ নামে পরিচিত)। ডাকসুও ১১ দফায় স্বাক্ষর করেছিল। স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের দাবি অন্তর্ভুক্ত থাকায় ১১ দফা ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল, মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায়। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ভাসানীপন্থী ছাত্র নেতা আসাদুজ্জামানের মৃত্যু ১১ দফার আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত করেছিল। এর পরপর ২৪ জানুয়ারি স্কুলছাত্র মতিউরের মৃত্যুতে গণঅভ্যুত্থান অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। সে গণঅভ্যুত্থানের চাপেই প্রথমবারের মতো নতিস্বীকার করেছিলেন ‘লৌহ মানব’ নামে পরিচিত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। রাজনীতিকদের তিনি গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবও বন্দি অবস্থাতেই গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে সম্মত হয়েছিলেন। ১৬ ফেবব্রুয়ারি থেকে বৈঠক শুরু হওয়ার কথা ছিল।
অন্যদিকে গোলটেবিল বৈঠকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। পল্টনের জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্টের জেলখানা ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনা হবে (এ ধরনের হুমকি দেয়ার কথা সেকালে কল্পনা করা যেতো না)। এই পর্যায়ে বেগম মুজিবের পীড়াপীড়িতে শেখ মুজিবও প্যারোলে যেতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। তার অস্বীকৃতি গোলটেবিল বৈঠককেই অনিশ্চিত করে তুলেছিল। ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিরা মুক্তি পেয়েছিলেন ’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সরকারের পতন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হলেও গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিব অংশ নেয়ায় আইয়ুব খান তখনকার মতো বেঁচে গিয়েছিলেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে, নিজেকে রক্ষার এবং গণঅভ্যুত্থানকে বিভ্রান্ত করার কৌশল হিসেবেই আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করেছিলেন। একই কারণে মওলানা ভাসানী নিজেই শুধু বর্জন করেননি, শেখ মুজিবকেও বৈঠকে অংশ না নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য যেহেতু কোনো গোলটেবিল বৈঠকের প্রয়োজন পড়েনি, সেহেতু স্বায়ত্তশাসনসহ ১১ দফার বাকি দাবিগুলোও আন্দোলনের মাধ্যমেই আদায় করা যাবে। অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর পরামর্শ উপেক্ষা করে শেখ মুজিব ২৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি তাই বলে প্রথম রাউন্ডেই ভাষণ দিতে পারেননি, তাকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল আরো পরেÑ ১০ মার্চ। এই প্রক্রিয়ায় আইয়ুব খানের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কৌশলই সফল হয়েছিল। ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবের দিকে আশায় তাকিয়ে থাকায় এবং মাঝখানে ঈদুল আযহার ছুটি পড়ে যাওয়ায় গণঅভ্যুত্থান স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে সরে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো প্রবর্তিত হয়েছিল সামরিক শাসন (২৫ মার্চ, ১৯৬৯)। সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
এভাবে তথ্যনির্ভর পর্যালোচনায় দেখা যাবে, ১১ দফাভিত্তিক যে গণঅভ্যুত্থানের সাফল্যে মুক্তি শুধু নয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার ভয়ংকর অভিযোগ থেকেও রেহাই পেয়েছিলেন, সে গণঅভ্যুত্থানকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে ইতিহাসের নামে গালগল্প তৈরি করা হলেও সত্য হলো, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের কোনো ভূমিকা ছিল না। ভূমিকা রাখার মতো অবস্থায় তিনি ছিলেনও না। ওদিকে দল হিসেবে ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থাও তখন ছিল শোচনীয়। দলটিকে এমনকি শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত জোট ড্যাক-এও যোগ দিতে হয়েছিল। শেখ মুজিবকে প্রধান নেতার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থান। মওলানা ভাসানীর পরামর্শ উপেক্ষা করে শেখ মুজিব গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেয়ায় একদিকে স্বায়ত্তশাসনের প্রধান দাবিসহ ১১ দফার বাকি দাবিগুলো আদায় করা যায়নি, অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানও স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। আইয়ুব খান তো বটেই, পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকরাও সেটাই চেয়েছিলেন। আন্দোলন এড়িয়ে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়ায় শেখ মুজিবকে তারা সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।
এখানেও শেষ নয়, ছাত্র সমাজের যে ১১ দফা তাকে মুক্ত করার পাশাপাশি প্রধান নেতার অবস্থান ও সম্মান এনে দিয়েছিল, জনপ্রিয়তার প্রভাব খাটিয়ে শেখ মুজিব সে ১১ দফাকেও পরিত্যাগ করেছিলেন। প্রথমে ‘১১ দফা ও ছয় দফা’ এবং তার পর কিছুদিন পর্যন্ত ‘ছয় দফা ও ১১ দফা’ বলার পর এক পর্যায়ে তিনি নিজের সেই ছয় দফাকে পুনর্বাসিত করেছিলেন, যে কর্মসূচি জনগণের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার প্রভাবে রাজনৈতিক প্রতারণাই সফল হয়েছে : বিশেষ করে আওয়ামী শিবিরের পক্ষ থেকে এখনো একথাই প্রচার করা হয় যেন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল ছয় দফার ভিত্তিতে! অন্যদিকে ইতিহাস কিন্তু দাবিটিকে সত্যায়িত করে না।
এখানে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কিছু বিশেষ দিক লক্ষ্য করা দরকার। প্রথমত, নিজেদের নয়, পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হয় জনগণের দাবি ও আকাংক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ থাকাটাই আবার যথেষ্ট নয়, দেখতে হয়, জনগণ আন্দোলনের জন্য তৈরি কি না, তারা আন্দোলনে অংশ নেবে কি না। দ্বিতীয়ত, দলের সাংগঠনিক অবস্থা আন্দোলনের বড় নির্ধারক নয়। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও ভাসানী ন্যাপসহ কোনো দলই সাংগঠনিক দিক থেকে শক্তিশালী ছিল না। উভয় দলের অনেক নেতা কারাগারে ছিলেন, ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহাসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। তাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী সাফল্যের সঙ্গে আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটে। তৃতীয়ত, দাবি আদায়সহ আন্দোলনের সফলতার জন্য শরিক বা সহযোগীরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৮-৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রে মওলানা ভাসানী একাকী হয়ে পড়েছিলেন। শেখ মুজিব ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়ায় ১১ দফার আর কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব হয়নি- যেমনটি ঘটেছিল ১৯৮০-র দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়। নির্বাচনে যারা অংশ নেবে তারা ‘জাতীয় বেঈমান’ বলে শেখ হাসিনা নিজে ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও ১৯৮৬ সালের মে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল বলেই স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটেনি। সুতরাং আন্দোলনে যাওয়ার আগে শরিক বা সহযোগীদের উদ্দেশ্য ও কৌশল সম্পর্কে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করা দরকার। মাঝপথে বিশ্বাসঘাতকতা করার কিংবা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা হাসিল করার মতো কোনো দলকে সঙ্গে রাখার পরিবর্তে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। চতুর্থত, শেখ হাসিনার মতো সরকারের পতন ঘটানোকে একমাত্র স্লোগান বানানোর পরিবর্তে জনগণের দুঃখ-কষ্ট দূর করা এবং তাদের অবস্থার উন্নয়নকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা দরকার। সব মিলিয়ে এমন এক সময়ে আন্দোলন শুরু করতে হয়, জনগণ যাতে নিজেদের তাগিদেই সে আন্দোলনে অংশ নেয়, আন্দালনের সাফল্যেও যাতে জনগণই বেশি উপকৃত হতে পারে।
বলা দরকার, তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের এ পর্যায়ে এসেই ধরা পড়ে গেছেন সাবেক সেই বামপন্থী ছাত্রনেতা। পাঠকরাও লক্ষ্য করলে দেখবেন, তিনি এমনভাবে ইতিহাসের উল্লেখ করেছেন যা পড়ে মনে হতে পারে যেন আইয়ুব খানের মুসলিম লীগ সরকার ‘চড়াও’ হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ‘শেষ’ হয়ে যায়নি বরং আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলের অবস্থান অর্জন করেছিল। অন্যদিকে ইতিহাস কিন্তু সে সাক্ষ্য দেয় না। একই কারণে বিএনপির জন্য দরদে উথলে ওঠার বিষয়টিকেও সন্দেহজনক না বলে উপায় থাকে না।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

৫০ বছরে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোতে গণতন্ত্র


গত ১৫ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ বিশ্বের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব পাস করে। ওই প্রস্তাবে বিশ্বের সরকার প্রধানদের উৎসাহিতকরণের পাশাপাশি ১৫ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৬০ সালের পর বিশ্বের বেশ কিছু দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এ বছরের বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য কয়েকটি দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হল।
কেনিয়া
সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ (কলোনি) কেনিয়া ১৯৬৩ সালের ১২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। ওইদিন ব্রিটিশ সরকার জুমো কেনিয়াত্তার নেতৃত্বাধীন কেনিয়া আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের (কেএএনইউ) কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এ জন্য কেনিয়াত্তাকে দেশটির জনক বলা হয়।
এর ঠিক এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৬৪ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশটিকে প্রজাতন্ত্র (রিপাবলিক অব কেনিয়া) হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং কেনিয়াত্তা দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট হন।
১৯৭৮ সালে কেনিয়াত্তার মৃত্যুর পর ডেনিয়েল এ্যারাপ মোই দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। তিনি ২০০২ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। যদিও এর মধ্যে ১৯৭৯, ১৯৮৩ ও ১৯৮৮ সালে নির্বাচন হয়। যাকে বলা হয় একদলীয় নির্বাচন। তা ছাড়া ১৯৮৩ সালের নির্বাচন হয় নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগে। কারণ ১৯৮২ সালের ২ আগস্ট দেশটিতে একটি ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান হয়।
১৯৮৮ সালের নির্বাচনে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। আর তা হলো গোপন ব্যালটে ভোটের পরিবর্তে প্রত্যেক প্রার্থীর সমর্থকদের লাইনে দাঁড়াতে হয়। এ নির্বাচনে জিতে যান মোই। কিন্তু তার এই নির্বাচন ব্যাপক সমালোচিত হয়। সংবিধান সংশোধনের দাবিতে দেশটিতে আন্দোলন দানা বাঁধে। এসব আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে ১৯৯২ ও ১৯৭৯৭ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতেও পুননির্বাচিত হন মোই।
সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০০২ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি মোই। ফলে এ বছর বিরোধীদলীয় জোট ন্যাশনাল রেইনবো কোয়ালিশন (এনএআরসি) থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাই কিবাকি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এটিকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এই নির্বাচনকেই কেনিয়ার গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের টার্নিং পয়েন্ট (সন্ধিক্ষণ) হিসেবে দেখা হয়। তা ছাড়া ২০০২ সালের নির্বাচনের মাধ্যমেই স্বাধীনতার পর প্রথম দেশটির ক্ষমতা বিরোধী দলের হাতে যায়।
দীর্ঘদিন পর বিরোধী দল ক্ষমতায় এসে দেশটিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন, শিক্ষা বিস্তার এবং সংবিধান সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রতিশ্রুতির কিছু অংশ বাস্তবায়ন করতেও সমর্থ হয় জোট সরকার। এরপর আসে ২০০৭ সালের নির্বাচন। ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রথমবারের মতো একইসঙ্গে প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট কিবাকি পার্টি অব ন্যাশনাল ইউনিটি দলের প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন। আর প্রধান বিরোধী জোট অরেঞ্জ ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (ওডিএম) প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন রাইলা ওদিঙ্গা। কিন্তু ২০০২ সালে অর্জিত গণতন্ত্র ২০০৭ সালে এসেই বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এ নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এ নির্বাচন হয়নি। অন্যদিকে, ভোট গণনার প্রথমদিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ওদিঙ্গা। কিন্তু এরপর আবার একটানা এগিয়ে যেতে থাকেন কিবাকি। এক পর্যায়ে নিজেকে ‘জনগণের প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে ঘোষণা দেন ওদিঙ্গা। সেইসঙ্গে পুনরায় ভোট গণনার দাবি জানান।
হোঁচট খায় আফ্রিকার এ দেশটির গণতন্ত্র। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গোষ্ঠীগত সহিংসতা। প্রায় এক হাজার লোক নিহত হয়। উদ্বাস্তু হয় ছয় লাখ লোক। এরপর আসে ২০১৩ সালের নির্বাচন। কিন্তু তার আগে জাতিসংঘের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কফি আনানের মধ্যস্থতায় দেশটিতে শান্তি আলোচনা চলতে থাকে। ২০০৮ সালে জাতীয় সংলাপ ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি কিবাকি ও ওদিঙ্গা এক চুক্তিতে সই করেন। চুক্তি অনুযায়ী দেশটির জাতীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন ওদিঙ্গা ও প্রেসিডেন্ট হন কিবাকি। ক্ষমতা ভাগাভাগির এ জোটকে বলা হয় গ্র্যান্ড কোয়ালিশন বা মহাজোট।
প্রধানমন্ত্রীর পদ অবলুপ্ত এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কমিয়ে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়িয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়। এ নিয়ে ২০১০ সালের ৪ আগস্ট গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সাংবিধানিক কারণে তৃতীয়বারের মতো প্রার্থী হতে পারেননি কিবাকি। ফলে উপ-প্রধানমন্ত্রী উহুরু কেনিয়াত্তা দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে উহুরু একটি নিরাপত্তা আইন সংশোধনী বিলে সই করেন। বিলটিতে সাংবাদিকদের কোনো কিছু প্রকাশ ও অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে, সন্দেহভাজন কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৩৬০ দিন আটক রাখা যাবে, এ রকম বেশ কিছু নতুন আইন করা হয়।
বিরোধী দল, মানবাধিকার সংগঠন এবং পশ্চিমা বিশ্ব ও ইউরোপীয় দেশগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর দেশটির পার্লামেন্টে বিলটি পাস হয়। এ নিয়ে কেনিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ করে চীনের হস্তক্ষেপ এবং শুরু হয় চীন-যুক্তরাষ্ট্র টানাপোড়েন।
মালদ্বীপ
দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপের গণতন্ত্র যেন অন্ধকারে আলোর ঝলকানির মতো। ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মালদ্বীপ। স্বাধীনতার পর সালতানাত এবং তা থেকে রাজতন্ত্রে উন্নীত হয় দেশটি। ১৯৬৮ সালের ১১ নবেম্বর মালদ্বীপকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। তখন প্রেসিডেন্ট হন ইব্রাহীম নাসির।
১৯৭০ সালের দিকে দেশটিতে রাজনৈতিক মতবিরোধ স্পষ্ট রূপ ধারণ করে। নাসিরপন্থী ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা তাদের স্বরূপ প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে তৎকালীন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাকি নির্বাসনে চলে যেতে বাধ্য হন। সর্বশেষ ১৯৭৮ সালে ইব্রাহীম নাসির রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান।
একই বছর দেশটির প্রেসিডেন্ট হন মামুন আব্দুল গাইয়ুম। পর পর ছয়টি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ৩০ বছর মালদ্বীপ শাসন করেন গাইয়ুম। মজার ব্যাপার হলো, ছয়টি নির্বাচনে কোনো বিরোধী দল ছিল না। মূলত, তার শাসন আমলেই স্বাধীন মালদ্বীপ সকল দিক থেকে একটি পরিপƒর্ণ রাষ্ট্রের আকার লাভ করে। কিন্তু অনেকেই তাকে স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
মামুন আব্দুল গাইয়ুমের শাসনামলে দেশটিতে তিনটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান (১৯৮০, ১৯৮৩ ও ১৯৮৮) হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের অভ্যুত্থানটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন ব্যবসায়ী মোহাম্মাদ ইব্রাহীম লুতফী। এ সময় তামিল বিদ্রোহীরা দেশটির বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিলে নিজ বাসভবন থেকে পালিয়ে যান গাইয়ুম। এই অবস্থায় দেশটিতে হস্তক্ষেপ করে ভারত।
গাইয়ুমকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা এবং দেশটিতে শান্তি ফেরাতে দেড় হাজারের বেশি ভারতীয় সেনা চলে যায় রাজধানী মালেতে। ‘অপারেশন ক্যাক্টাস’ নামের ওই অভিযানে ভারতীয় নৌ সেনারাও অংশ নেয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কোনো রক্তপাত ছাড়াই দেশটিতে আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক হয়।
গাইয়ুমের শাসনামলের শেষ দিকে দেশটিতে স্বাধীন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটে এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি জোরদার হয়। এতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গাইয়ুমের মালদিভিয়ান পিপলস পার্টি। ফলে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে দেশটিতে ২০০৮ সালে সংবিধান সংশোধন করা হয় এবং প্রথমবারের মতো সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন (গণতান্ত্রিক) অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনে মালদিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান মোহাম্মাদ নাশিদ দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু পূর্ববর্তী সরকারের ঋণ, দুর্নীতি এবং ২০০৪ সালের ভয়াবহ সুনামিতে বিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন নাশিদ।
২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিরোধী দল প্রায় ২০ হাজার লোক নিয়ে নাশিদবিরোধী একটি সিম্পোঞ্জিয়ামের আয়োজন করে। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি নাশিদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশটির অপরাধ আদালতের প্রধান বিচারপতি আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, একই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি নাশিদ পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে সরকারবিরোধীদের ওপর শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন।
ওই দিনই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন নাশিদ। প্রথমে জানান, মালদ্বীপের জনগণের ইচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন তিনি। কিন্তু পরে জানান, সেনাবাহিনী তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। নাশিদের পদত্যাগের পর সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ ওয়াহিদ হাসান প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ৮ অক্টোবর আদালতে হাজির না হওয়ায় নাশিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
২০১৩ সালের নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে জয়লাভ করেন নাশিদ। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে গিয়ে গাইয়ুমের সৎ ভাই আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের কাছে হেরে যান। ইয়ামিন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন গাইয়ুমের মেয়ে দুনিয়া। ফলে দেশটিতে আবার পরিবারতন্ত্র ফিরে আসে।
মোজাম্বিক
দ্য ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব মোজাম্বিক (এফআরইএলআইএমও/ ফ্রেলিমো)-এর আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মোজাম্বিক। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রেসিডেন্ট সামোরা মাচেল মার্কসপন্থী একদলীয় সরকার কায়েম করেন। কিউবা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন (সাবেক) থেকে কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা পায় সামোরা। স্বাধীনতার অল্প সময়ের মধ্যেই বিরোধীদের ওপর সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেন তিনি। ফলে সরকারপন্থী এবং এ্যান্টি-কমিউনিস্ট মোজাম্বিকান ন্যাশনাল রেজিজটেন্স (আরইএনএএমও/রেনামো) বা রেনামোপন্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধ। ১৯৭৭ থেকে ৯২ সাল পর্যন্ত চলা গৃহযুদ্ধে প্রায় এক কোটি লোক মারা যায়। এ ছাড়া অসংখ্য লোক উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়।
১৯৮৬ সালের ১৯ অক্টোবর সামোরা মাচেল বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় তার উত্তরসূরি হিসেবে ক্ষমতায় বসেন জোয়াকিম চিসানো।
ক্ষমতায় এসে তিনি মার্কসবাদ থেকে পুঁজিবাদের নীতি গ্রহণ করেন এবং রেনামোর সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ সালে দেশটিতে নতুন সংবিধান প্রণয়ন হয়। ১৯৯২ সালে রোম শান্তি চুক্তির মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং দেশটিতে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়।
১৯৯৪ সালে দেশটিতে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জোয়াকিমের নেতৃত্বে ফ্রেলিমো ক্ষমতায় আসে এবং আফনসো ধলাকামার নেতৃত্বে রেনামো আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। এরপর ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও ফ্রেলিমো জয়লাভ করে। এ নির্বাচনে ফ্রেলিমোর বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ আনে রেনামো। সেইসঙ্গে আবারও গৃহযুদ্ধে ফিরে যাওয়ার হুমকি দেয়। কিন্তু বিষয়টি উচ্চ আদালতে মীমাংসা হলে সে সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে দলটি।
এরপর ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফ্রেলিমো থেকে নির্বাচিত হন আর্মান্দো গুয়েবুজা। আর রেনামো থেকে নির্বাচন করে আবারও হেরে যান ধলাকামা। ২০০৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় বসেন গুয়েবুজা।
এ ছাড়া ২০০৯ সালের নির্বাচনে গুয়েবুজার কাছে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে ফ্রেলিমোর প্রার্থী ফিলিপ নিউসির কাছে হেরে যান ধলাকামা। কিন্তু দেশটিতে আর কোনো বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।
জিম্বাবুয়ে
১৯৮০ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করেন কানান বানানা। একই বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (জেডএএনইউ/জানু) বা জানু পার্টি বিজয় লাভ করে। ফলে দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার প্রধান হিসেবে ক্ষমতা নেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে। এরপর দেশটির মাটাবেলিল্যান্ড অঞ্চলে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ হিসাব মতে, ওই বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সহিংসতায় ৩০ হাজারের মতো লোক নিহত হয়েছেন।
১৯৮৭ সালে বিরোধী নেতা এনকোমোর সঙ্গে ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠায় একটি চুক্তিতে সই করেন মুগাবে। এরপরই ওই গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। এরপর থেকে ২০০৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে তার সবগুলোতে বিজয়ী হয়েছে জানু-পিএফ (প্যাট্রিওটিক ফ্রন্ট) জোট।
তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে বিজয়ী হন মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জ (এমডিসি) নেতা টিএসভাঙ্গিরাই। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে বিপুল বিজয় লাভ করেন মুগাবে। এরপর ২০১৩ সালের নির্বাচনেও বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় রয়েছেন মুগাবে। (দি রিপোর্ট ডেস্ক ফিচার)

মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

তারুণ্যের অপ্রতিরোধ্য জয়


অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের শত এলোমেলো কথাবার্তা আর জেদাজেদি সত্ত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন সফল হয়েছে। সরকার তাদের টিউশন ফি’র ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। সচেতন শিক্ষার্থী সমাজকে আন্তরিক অভিন্দন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের গুণের কোনো শেষ নেই। তিরাশি বছর বয়স্ক এই ভদ্রলোক আবার অতীব প্রভুভক্ত। যখন যে প্রভু, তার পায়ে হাজারো সালাম। তার জীবনে প্রভুর বদল হয়েছে বারবার। কিন্তু ভক্তির ঘাটতি কখনও দেখা যায়নি। দক্ষতার সঙ্গে সেবা করেছেন পাকিস্তান সরকারকে। আমলা হিসেবে সচিব ছিলেন অনেক দিন। তারপর থেকেই তার ডিগবাজির ইতিহাস শুরু। সেক্ষেত্রে তিনি স্বৈরাচারী গণতন্ত্রীতে কোনো ভেদ করেননি। সুবিধার দিকে সব সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আর তাই ১৯৮২ সালে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হঠিয়ে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন ক্ষমতা দখল করেন, তখন সঙ্গে সঙ্গেই তার মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন এই আবুল মাল মুহিত।
আসলে তার গোটা জীবনটাই গণবিরোধীদের সেবায় নিয়োজিত থেকেছে ও আছে। আসলে এরশাদের সঙ্গে যোগ দেওয়াটাও ছিল তার গণবিরোধী পথযাত্রার একটি সিঁড়ি। সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে তিনি কাজ করেছেন বিশ্বের দরিদ্র মানুষদের শোষণ লুণ্ঠনকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কর্মকর্তা হিসেবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো পৃথিবীর দরিদ্র মানুষদের গরীব করে রাখা আর সেভাবে তাদের শোষণ করে যাওয়া। মুহিত তাদের সহযোগী হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে দরিদ্র দেশগুলোর এই অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম প্রধান পথ হলো উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে তরুণ সমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা। মুহিত এবার তাই পুরানা অভ্যাসে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর হাত দিয়েছেন।
এক-এগারোর স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে যখন এদেশের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তখনও মুহিত ছিলেন নিরাপদ দূরত্বে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা সামরিক সরকারের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে যে সরকার গঠন করেন, তাতে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নাজেল হন আবুল মাল মুহিত। তারপর থেকেই আছেন। বেশ আছেন। জনগণকে শোষণ লুণ্ঠনের ধারাবাহিক কর্মকা- তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। তার চেয়ে গণবিরোধী আর কাউকে পাওয়া যায়নি বলেই সম্ভবত তিনি বহালও আছেন।
কিন্তু বছরখানেক ধরে তিনি ধারাবাহিকভাবে নানা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে তিনি বারবার নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে আসছেন। কখনও বলেন, তিনি আর মন্ত্রী থাকতে চান না। কখনও বলেন মন্ত্রিত্ব কি আর সহজে ছাড়া যায়। আর এখন তিনি তার সাবেক প্রভু এরশাদের মতো কথা বলতে শুরু করেছেন। সকালে যেকথা বলেন, বিকালে বলেন তার ঠিক উল্টো কথা। আজ যা বলেন, কাল বলেন তার বিপরীত কথা। কখনও বলেন, বুড়ো মানুষ, কখন কি বলি ঠিক নেই। যাদের উদ্দেশ্যে বাজে কথা বলেন, তারা যেন কিছু মনে না করেন। সব চেয়ে বিপদ হলো তিনি নিজেকে ছাড়া এই বাংলাদেশে আর কাউকে মানুষই মনে করেন না। বাংলাদেশে তার মতো ‘শিক্ষিত’ আর কোনো লোক আছে বলেও তিনি মনে করেন না। জানি না, দুনিয়ায় আছে বলে মনে করেন কিনা। ফলে যা কিছু তার মন মতো নয়, তার সব কিছুকেই তিনি ‘রাবিশ’ আর ‘স্টুপিড’ বলে গাল দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। ফলে কখনও কখনও তাকে অপ্রকৃতিস্থ উন্মাদ বলে মনে হয়।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ও টিউশন ফি’তে ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে তার বক্তব্যে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। ছাত্ররা এই ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন গত জুন থেকেই। সে সময়ই মুহিত ঘোষণা করেন যে, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের টিউশন ফি’র ওপর ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। তখন থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। তারা মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, স্মারকলিপি প্রদান প্রভৃতি কর্মসূচি পালন করে যেতে থাকেন। তাদের বক্তব্য ছিল, শিক্ষা কোনো পণ্য নয় যে, তার ওপর ভ্যাট বসাতে হবে। শিক্ষা অধিকার । অতএব এর ওপর কোনো ভ্যাট বসানো যাবে না।
কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার বা তার অর্থমন্ত্রী শ্রবণ প্রতিবন্ধীর মতো আচরণ শুরু করেন। দেশের শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী সমাজও এর প্রতিবাদ করতে থাকেন। কিন্তু মুহিত বলেন, যেখানেই ভ্যাট পাওয়া যাবে, সেখানেই খোঁচা দিতে হবে। এমন কি আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফও বলেন যে, ৬০ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী ছয় হাজার কোটি টাকার সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। এর কোনো কিছুই তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। সর্বশেষ সরকারি কর্মচারীদের পে-স্কেল চূড়ান্ত করতে গিয়ে মুহিত ঘোষণা করেন যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাড়ে সাত শতাংশ হারে ভ্যাট দিতেই হবে। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা হাতে লেখা নানা ধরনের প্লাকার্ড ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। ফলে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকা। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার বাইরেও। তখন অর্থমন্ত্রী প্রথমে ঘোষণা করেন যে, এই ভ্যাট ছাত্রদের দিতে হবে না। ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ছাত্ররা। কারণ, শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, কোনো না কোনো নামে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই আদায় করবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও জানায় যে, তারা এই টাকা বাড়ি থেকে এনে দেবে না। সুতরাং বিকল্প কোনো পথে তাদের এ টাকার সংস্থান করতে হবে। মানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই নেয়া হবে।
ইতিমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। পে স্কেলে বেতন তাদেরও বাড়ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের মর্যাদা নামিয়ে দেয়া হয়েছে আমলাদের চেয়ে দু’ ধাপ নিচে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে একটা ‘রাবিশ’ মন্তব্য করে বসলেন মুহিত। তিনি বললেন, ‘জ্ঞানের অভাবে’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। শিক্ষকগণ এটা মেনে নিতে পারেননি। তারা মুহিতকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমা চেয়ে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার আল্টিমেটাম দেন। মুহিত সম্ভবত পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে বিশ্ববিদালয় শিক্ষকদের সম্পর্কে তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ঐ বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। তবে সে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেন যে, টিউশন ফির ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট শিক্ষার্থীদেরই দিতে হবে।
তারপর তিনি পথের পাশের মুদি দোকানির মতো হিসাব কষে আমাদের বলে দিলেন যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ে তাদের দৈনিক খরচ হয় এক হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকার অতিরিক্ত দৈনিক মাত্র ৭৫ টাকা চায়, এটা এমন কিছু বেশি নয়। অর্থমন্ত্রী মুহিতের এই হিসাবের ভিত্তিও অজানা। তিনি বলে দিলেন হয়ে গেল। তাই যদি হয়, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েন, তারা মাসে বেতন দেন মাত্র ১৫ টাকা। তাদের কাছ থেকে মাসে ৭৫ টাকা ভ্যাট আদায় করে দেখান দেখি। অর্থাৎ অর্থমন্ত্রীর ধারণা হয়েছে যে, যাদের সন্তানরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের মাসিক উপার্জন লাখ লাখ টাকা। এটাও চরম অজ্ঞতা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এত আসন নেই যে, সকল শিক্ষার্থীকে সেখানে ভর্তি করা যাবে। অনেকেই জায়গা-জমি বিক্রি করে, ধারদেনা করে, চাকরি বাকরি বা প্রাইভেট পড়িয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ যোগাড় করেন ভবিষ্যতের আশায়। সেটা মুহিত সাহেবের ধারণার ভেতরেও নেই।
এর পরদিন আবার কথা ঘোরালেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বললেন, না, ভ্যাট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই দিতে হবে। আর ছাত্রছাত্রীরা যেন সতর্ক থাকে, যাতে তাদের কাছ থেকে কোনো অছিলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভ্যাটের টাকা আদায় করে নিতে না পারে। এর অর্থ দাঁড়ালো, এখানকার শিক্ষার্থীরা সারা বছর ধরে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে থাকবে। লেখাপড়া শিকায় উঠবে। আর মুহিতের লক্ষ্যও এটাই।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিতে অনড় থাকেন। তাদের বক্তব্য, শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। অতএব শিক্ষার ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। আন্দোলন চলতে থাকলো। দাবি একটাই। ভ্যাট দেব না, গুলী কর। অচল হয়ে পড়ল ঢাকাসহ সারা দেশ। এখানে বিস্ময়করভাবে একশ্রেণীর সরকারি তাঁবেদার মিডিয়ার গণবিরোধী ভূমিকা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। হ্যাঁ এই আন্দোলনে অচল হয়ে গেছে ঢাকা। বহু মানুষকে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। কোনো কোনো প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলনকে নয়, সেই দুর্ভোগকেই প্রধান করে দেখাবার প্রাণান্ত কোশেশ করে ব্যর্থ হলো। মিডিয়ায় সরকারের এমন বেহায়া দালালি অনেকদিন পর প্রাণভরে উপভোগ করলাম।
একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখলাম, পথের ওপর দাঁড়িয়ে খুব সাধারণ মানুষকে ধরে ধরে সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। নিম্নমধ্যবিত্ত এক বোরখা-পরা মাঝবয়সী মাকে আটকে রিপোর্টার জিজ্ঞেস করল, এই যে এতদূর থেকে এলেন, যানবাহন নেই। আপনার কষ্ট হচ্ছে না? কষ্ট তো হচ্ছেই। তবু আপনি কি ছাত্রদের এ আন্দোলন সমর্থন করেন? নিশ্চয়ই করি। ছেলেপেলে পড়াতে এমনিতেই যে খরচ, তার ওপর আরও টাকা কেন দিতে হবে? সন্তানদের জন্য এটুকু কষ্ট তো মেনে নিতেই হবে। কেউ কেউ বললেন, সরকারি কর্মচারিদের বেতন কিছু কমিয়ে সেখান থেকে এই টাকা নেয়া যেত। শিক্ষায় আবার ভ্যাট কেন? ছাত্রদের কাছ থেকে নিতে হবে কেন? একজন লোকও পাওয়া গেল না, যিনি বললেন, যেহেতু ছাত্রদের আন্দোলনে কষ্ট হচ্ছে, অতএব পিটিয়ে এদের রাস্তা থেকে তুলে দিয়ে রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক করে আনা হোক। ছাত্ররা করজোড়ে পথচারিদের কাছে মাফ চাচ্ছিলেন, কোনো কোনো প্রবীণ মানুষের বোঝা কিছু দূর বয়ে নিয়ে এগিয়ে দিচ্ছিলেন। শিশুদের স্কুলব্যাগ নিজের পিঠে তুলে নিয়ে আগায়ে দিচ্ছিলেন।
ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত এই আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত তারা জয়ী হয়েছে। সরকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তাদের প্রতিবাদী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আনন্দ মিছিলে রূপ নিয়েছিল। তারা আবার স্ব স্ব ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন। এই আন্দোলনে ছাত্রদের জয় থেকে আবারও একটা বিষয় প্রমাণিত হলো  যে, জনতার ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন কখনও বৃথা যায় না। বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপ প্রত্যাহার প্রসঙ্গ


গত কয়েকদিন ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ছাত্রছাত্রীদের মূসক (মূল্য সংযোজন কর) বিরোধী আন্দোলনে রাজধানীতে বিরাট অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। তাদের মিছিল স্লোগান ও বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধের ফলে সারা মহানগরীর রাস্তাঘাট প্রায় যানবাহনশূন্য হয়ে পড়ে। গণপরিবহন ছিল না বললেই চলে। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, সিএনজির সংখ্যাও স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় এক-চতুর্থাংশে নেমে আসেও বলে মনে হয়। এই আন্দোলনকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি আতঙ্ক যেমন কাজ করে তেমনি কেউ কেউ মনে করেছেন যে, এর ফলে প্রতিনিধিত্বহীন বর্তমান গণবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে নতুন আন্দোলনের একটি প্লাটফরমও সৃষ্টি হচ্ছে। অতি উৎসাহীদের অনেকে বলছেন যে লোহা লাল হয়েছে এখন বাড়ি দেয়ার উপযুক্ত সময়। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস হচ্ছে একটি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী তথা আমাদের ছেলেমেয়েরা মাঠে নেমেছে। সরকারের উচিত অবিলম্বে সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করে তাদের ক্লাস রুমে ফিরিয়ে নেয়া। সরকার অবশেষে গতকাল শিক্ষার উপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে।
সম্প্রতি সরকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজসমূহের টিউশন ফি-এর উপর সাড়ে সাত শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়। একটি জাতীয় দৈনিক হিসাব কষে দেখিয়েছেন যে, এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হতো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজে যারা পড়েন তাদের সকলেই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া ধনীর দুলাল নয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহের ব্যর্থতা ও অব্যাহত সেশন জটের প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা আর্থিক সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে বাধ্য হন। এই অবস্থায় ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বাবদ নতুন দায় তাদের অবস্থাকে আরো সঙ্কটাপন্ন করে তুলবে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। শিক্ষাবিদদের অনেকেই প্রশ্ন তুলে বলেছেন যে শিক্ষা আদৌ কোনোও পণ্য নয়; ভোগ্য বা শিল্পপণ্য প্রক্রিয়াজাত করার পর তার মানের যে অবস্থান্তরপ্রাপ্তির ঘটনা ঘটে তার অনেকেই মূল্য সংযোজন কর প্রযোজ্য হয়। শিক্ষা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার, পণ্য নয়। শিক্ষার Transition বা অবস্থান্তরপ্রাপ্তিও হয় না। এই অর্থে শিক্ষার উপর (যার সাথে নতুন কোনোও মূল্য সংযোজিত হয়নি) ভ্যাট আরোপ ছিল অযৌক্তিক এবং একটি জুলুম। এখানে টাকার অংকের চাইতে নীতির অংকটা বড়। যে ভ্যাট পণ্য ক্রেতার উপর চাপানো হয়, তা শিক্ষার উপর চাপানো ঠিক নয়। শিক্ষা পণ্য কোনোভাবেই নয়। এর অবসান ঘটায় শিক্ষার মান রক্ষা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি অদ্ভুত তথ্য দিয়েছিলেন। তার এই তথ্য অর্থনীতির কোনোও থিওরি প্রসূত নয়। তিনি বলেছিলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পকেট খরচ বাবদ দৈনিক এক হাজার টাকা তথা মাসিক ৩০ হাজার টাকা খরচ করে। তিনি তা থেকে মাত্র শতকরা সাড়ে সাত টাকা চেয়েছেন। অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের যুক্তি ও জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে আমি কোনোও মন্তব্য করতে চাই না। তিনি একজন প্রবীণ, জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তবে তিনি যে কাজটি করেছেন তা ভালো হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস। আমাদের দেশে একটি জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করা হয়।
জাতীয় সংসদ প্রতি বছর জুন মাসে তা অনুমোদন করে এবং জুলাই থেকে স্বাভাবিক নিয়মে তা কার্যকর করা হয়। ভ্যাট-ট্যাক্স ঐ সময়েই নির্ধারিত হয়। এ বছর জুন মাসে অনুমোদিত বাজেটে শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপের কোনো প্রস্তাব ছিল না। তা হলে বাজেট অনুমোদনের তিন মাস পর SRO’র মাধ্যমে শিক্ষার উপর কর আরোপের এই নতুন সিদ্ধান্তটি সরকার কেন নিতে গেলেন? কিছুদিন আগে সরকার সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কোনো কোনো অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এর ফলে সরকারের ২৪,০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচের আভাস দিয়েছেন। এই অর্থ কোথা থেকে আসবে? সম্ভবত সরকার এই অর্থ যোগানের জন্যই বিভিন্ন খাতে করারোপের নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের জাতীয় স্কেল ঘোষণার পর এবং তা বাস্তবায়নের আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এরপর কি হবে তা গভীর বিবেচনার দাবি রাখে। বর্ধিত মুদ্রা সরবরাহ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তোলে এবং এতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সরকার এই বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করেন বলে মনে হয়নি। সম্ভবত তাদের বিবেচ্য বিষয় ছিল সরকারি কর্মচারীদের সন্তুষ্ট রাখার মাধ্যমে অনুগত রাখা এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করা। এটি একটি কঠিন কাজ বলে মনে হয়। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১৮/২০ লাখ বাদে আর সবাইকে অসন্তুষ্ট রেখে ক্ষমতায় টিকে থাকা যে সম্ভব নয় ইতিহাসই তার সাক্ষী। আরেকটি কথা না বলে পারছি না। সরকারের দায়িত্বশীল অনেক মন্ত্রী অভিযোগ করছেন যে, ছাত্রদের এই আন্দোলনের জন্য বিএনপি-জামায়াত দায়ী। সরকারের একটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। এখানে বিএনপি, জামায়াত অথবা শিবিরের ভূমিকা কোথায়? জামায়াত-শিবির অথবা বিএনপি কি শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপে সরকারকে বাধ্য করেছিল? নিজের অপকর্ম ঢাকার জন্য অন্যদের দোষ দেয়ায় কোনো কল্যাণ নেই। এতে তাদের ইমেজ আরো নষ্ট হয়। কয়েকদিন আগে পুলিশ জামায়াতের দু’জন সাবেক এমপিসহ দলটির ৪১ জন নেতা-কর্মীকে একটি অনুষ্ঠান থেকে নাশকতার অভিযোগে গ্রেফতার করে কাউকে রিমান্ডে দিয়েছেন আবার কাউকে জেলে পাঠিয়েছেন। রাজশাহী থেকে একই ধরনের অভিযোগে ৬ জন বিএনপি নেতা-কর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশবাসী একে একটি অত্যাচার বলে মনে করেন এবং সরকারি ভাষ্যকে মিথ্যাচার বলে অভিহিত করেন। আমার বিশ্বাস সরকার অনেক করেছেন তাদের নিজেদের স্বার্থে আর কিছু না করাই ভাল। শোনা যাচ্ছে, বৈদেশিক চাপ হোক বা অন্য কোনো কারণে কোনো কোনো মহল অগ্রিম নির্বাচনের চিন্তা-ভাবনা করছেন এবং তার আগে দেশকে বিরোধী দলমুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। হামলা-মামলা জেল-জুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে এই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা চলছে। এই চেষ্টা যে সফল হয় না তার ভুরি ভুরি নজির আমাদের সামনে আছে। মানুষ যখন ক্ষেপে তখন বৈদেশিক শক্তি পালানোর দিশা পায় না।
পাকিস্তানের দোর্দ-প্রতাপ সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফকে অনেকেই ভুলেননি। তিনি ১৯৯৯ সালে সামরিক বিপ্লবের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। রাজনীতিকদের সীমাহীন দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্যাপক সংস্কার ও গুণগত পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার লক্ষ্যে পৌঁছবার কৌশল হিসেবে তিনি বহুল আলোচিত মাইনাস টু থিওরির প্রবর্তন করেন এবং পাকিস্তানের দুটি জনপ্রিয় দল যথাক্রমে নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ ও বেনজির ভুট্টোর পিপলস পার্টির সিনিয়র নেতাদের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে জেল জরিমানা দেন। তিনি বিরোধী রাজনীতিকদের জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং নওয়াজ শরীফ ও বেনজির ভুট্টোকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নির্বাসিত জীবন যাপনে বাধ্য করেন। তাদের সাথে তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও নির্বাসনে যান।
দীর্ঘ আট বছর ধরে জনাব মোশাররফ পাকিস্তানে একচ্ছত্র রাজত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য তিনি ‘সন্ত্রাস বিরোধী’ যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বুশের সহযোগী হন। অদৃশ্য লাদেনের খোঁজে বেছে বেছে পাকিস্তানের মাদরাসাগুলোর উপর বোমা বর্ষণ করে হাজার হাজার মাদরাসা ছাত্র ও শিক্ষক হত্যা করেন। বিচার ব্যবস্থাকে অনুগত রাখার জন্য তিনি বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন, তাদের ভয়-ভীতি ও সন্ত্রাসের মধ্যে নিক্ষেপ করেন। নিজের অনুকূলে বিচারের রায় না যাবার কারণে অথবা না যাবার আশঙ্কায় তিনি প্রধান বিচারপতিসহ বেশ কয়েকজন বিচারপতিকে বরখাস্ত করেন। এর বিরুদ্ধে সারা পাকিস্তান উত্তাল হয়ে ওঠে এবং একটি প্রাদেশিক রাজধানীতে প্রধান বিচারপতির সমর্থনে আয়োজিত একটি সভায় ৪৯ জন লোক নিহত হয়।
সামরিক পোশাক পরে সেনাবাহিনীর পদ ও পদবীকে ব্যবহার করে তিনি একাধিক প্রহসনের নির্বাচনে জয়ী হন, সেনা ছাউনিগুলো তার পক্ষে কাজ করে। যখন তখন তিনি জরুরি আইনের অস্ত্রকে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। দিল্লীর আশীর্বাদ পাবার জন্য তিনি তার দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে (এমনকি কাশ্মীরকে ভারতের হাতে ছেড়ে দিয়ে) ভারতের সাথে শান্তিচুক্তির চেষ্টা করেন, বাস ও ট্রেন সার্ভিস চালু করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। পরাশক্তিগুলোকে সন্তুষ্ট করার জন্যও তিনি একের পর এক দেশ ও মিল্লাতের স্বার্থের পরিপন্থী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকেন বলে অভিযোগ ওঠে। রাজনীতিকদের  গালি দিয়ে তিনি নিজেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দলে অন্তর্ভুক্ত নেতা-নেত্রীদের সততা ও চারিত্রিক সংহতি সম্পর্কে যদিও তার দেশবাসী সন্ধিহান ছিলেন। জনাব মোশাররফের ক্ষমতা লিপ্সায় তারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ২০০৭ সালের শেষের দিকে তা চরম আকার ধারণ করে। অবস্থা আঁচ করতে পেরে তিনি অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে বেনজির ভুট্টোর সাথে একটা সমঝোতা করে তাকে দেশে ফেরার সম্মতি দেন এবং পাশাপাশি নিজের ক্ষমতার মসনদও পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেন। ইতোমধ্যে সউদি আরবে নির্বাসিত আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এবং ফিরেও আসেন। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকেই আরেকটি বিমানে তাকে জনাব মোশাররফ ফেরত পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর বেনজির দেশে ফেরেন। পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠে। নওয়াজও ফিরে আসেন। বেনজির সমঝোতা থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন এবং নির্বাচনের আগেই তাকে দুনিয়া থেকে সরে যেতে হয়। তার হত্যার সাথে মোশাররফ জড়িত ছিলেন কি-না একমাত্র আল্লাহতায়ালাই তা জানেন। কিন্তু এত কিছু করেও তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। মোশাররফ ক্ষমতায় আসেন এবং তাকে বেইজ্জত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। আমাদের দেশেও কেউ যদি এই চেষ্টা করেন তার পরিণতিও ভিন্ন হবার কথা নয়। আসলে রাজনীতি একটি কঠিন ব্যাপার। আবার রাজনৈতিক নেতাদের কী কী গুণ থাকা দরকার এ নিয়ে সম্ভবত ঐক্যে পৌঁছা আরো কঠিন ব্যাপার। কেননা এক্ষেত্রে মানুষের প্রত্যাশার শেষ নেই। মহামানবদের জীবনের সফল সবল দিকগুলোই রাজনীতিকদের মধ্যে অনেকে কামনা করেন। অনেকের দৃষ্টিতে রাজনীতিকদের কাজকর্ম কতটুকু জনপ্রিয় হবে, তার চেয়ে কতটুকু স্বীকৃতি পাবে তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে নেতৃত্বই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।
নেতার সংজ্ঞা খুবই ছোট, যেমন- One who leads is called a leader. এখানে Leading এর কাজটি অত্যন্ত কঠিন এবং সবাই তা পারেন না। জবরদস্তি কারোর ঘাড়ে নিজের নেতৃত্ব চাপিয়েও দেয়া যায় না। নেতার কাজ নিয়ে অনেক গল্প আছে। নেতৃত্বকে means of direction বলা হয়। ল্যাটিন আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটা গল্প প্রচলিত আছে। এই গল্পটি আমি আগে একাধিকবার বলেছি। একটি বিশাল দ্বীপকে নিয়ে গল্পটি তৈরি। এই দ্বীপে প্রায় ৫ লাখ লোকের বাস। দ্বীপটির নিরাপত্তা ঝুঁকি প্রকট। এশবার আকাশ থেকে এতে একজন ফেরেশতা নেমে আসলেন। দ্বীপবাসীরা দেখলো উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নেমে আসছেন। তারা তাকে অনুসরণ করলো এবং একটি কলেজের মাঠে এসে তা থামলো। আলোকবর্তিকাটি একজন ফেরশতার রূপ নিলো। চারদিকে হাজার হাজার মানুষ জমা হয়ে গেল এবং তার সাথে কথা বলতে চাইলো। ফেরেশতা বললেন, তোমাদের এতো লোকের সাথে কথা বলাতো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং তোমরা তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে দাও, আমি তাদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবো এবং তাদের সাথে কথা বলবো। যেমন বলা, তেমন করা। তারা তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচন করলেন। একজন বৃদ্ধ শতায়ু, আরেকজন অত্যাধুনিক ফিটফাট কেতাদুরস্ত এক ব্যক্তি এবং তৃতীয় জন সাদাসিধে এক লোক দেখতে বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেই মনে হয়। ফেরেশতা তাদের আলাদা আলাদাভাবে তার খাস কামরায় ডাকলেন। প্রথমে আসলো বৃদ্ধ ব্যক্তি। ফেরেশতা তার সাথে কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করলেন, এখন থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর তোমাদের এই দ্বীপে জলোচ্ছ্বাস হবে এবং বাড়িঘর, সহায়-সম্পদসহ তোমাদের সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তুমি এখন কি করবে? বৃদ্ধ ব্যক্তি বললেন, ‘আমি জীবনে অনেক পাপ করেছি, এখন বয়স হয়েছে, আর বেশি দিন বাঁচবো না। যে ৪৮ ঘণ্টা সময় পাবো তাকে আমি কাজে লাগাবো এবং খোদার দরবারে কান্নাকাটি করে মাফ চেয়ে নেবো যাতে পরকালে বেহেশতে যেতে পারি। ফেরেশতা তাকে বিদায় দিয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ডাকলেন এবং একই প্রশ্ন করলেন। তিনি উত্তর দিলেন এবং বললেন, জীবনকে আমি অনেক ভোগ করেছি। যা কিছু অবশিষ্ট আছে খাওয়া-দাওয়া, ফুর্তি করা, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমি তা সেরে নেবো। মৃত্যুর পরে কি পাবো না পাবো তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। ফেরেশতা তাকেও বিদায় করে তৃতীয় ব্যক্তিকে ডেকে একই প্রশ্ন করলেন, ৪৮ ঘণ্টা পর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তোমরা সবাই মরে যাবে, এখন তোমার করণীয় কী? দ্বীপবাসীর এই প্রতিনিধি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। ৪৮ ঘণ্টাকে মিনিট এবং মিনিটকে সেকেন্ডে রূপান্তর করে বললেন যে, আমার হাতে এখন ১,৭২,৮০০ সেকেন্ড সময় আছে। আমি আমার দ্বীপের পাঁচ লাখ লোককে সংগঠিত করে তাদের দশ লাখ হাতকে কাজে লাগাবো এবং জলোচ্ছ্বাস আসার আগেই দ্বীপের চারদিকে এমন বাঁধ নির্মাণ করবো যাতে জলোচ্ছ্বাসের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে না পারে এবং একটি লোকেরও জানমালের কোনও ক্ষতি না হয়। ফেরেশতা তার কথা শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোমার সাথে আছি।
মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মধ্যে রাজনীতিকের সাফল্য। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব-অনটন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বিরোধী যে জলোচ্ছ্বাস তার মোকাবিলার জন্য বাঁধ তৈরিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা ও কাজে লাগানোও হচ্ছে রাজনীতিকের কাজ। এই দায়িত্ব পালনে কেউ বেশি সফল হন কেউ কম। তবে আমি নিশ্চিত যে কোনও ব্যক্তি বা প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কোনও কর্মচারীর এটা কাজ নয়, এটা তার দেশপ্রেমও নয়। তার দেশপ্রেম তার জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
লর্ড মন্টোগোমারীর নাম হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন। একজন সার্থক রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্টারিয়ান এবং লেখক হিসেবে তার সুনাম ছিলো এবং আছে। তিনি তার Path to Leadership পুস্তকে একজন রাজনৈতিক নেতাকে এভাবে বর্ণনা করেন-
One who can be looked upto, whose personal judgement is trusted, who can inspire and warm the hearts of those he leads gaining their trust and confidence and explaining what is needed in language which can be understood.
জনাব মন্টোগোমারীর এই সংজ্ঞাটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক বিশ্বে ব্যবসায়িক জগতেও টীমকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে এই সংজ্ঞায় বর্ণিত নেতার বৈশিষ্ট্যকে অনুসরণ করার চেষ্টা করা হয়। বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা এবং জামায়াত নেতারা লাখ লাখ মানুষের অন্তর জয় করেছেন। তাদের বিচার-বিবেচনা, যোগ্যতার ওপর তাদের আস্থা আছে। তারা লাখ লাখ লোককে উজ্জীবিত করতে এবং অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের প্রাণ রক্ষার জন্য লাখ লাখ লোক প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়। এটা অবৈধ কোনও সুবিধা পাবার কারণে নয় বরং আত্মিক ও আদর্শিক সম্পর্কের কারণে। আমি, আপনি বা বেতনভুক্ত কোনও আমলার পক্ষে কি এটা সম্ভব? আমি মনে করি না। আমরা মারতে পারি কিন্তু আমাদের জন্য মরতে কাউকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি না।
ভারতের একজন প্রধানমন্ত্রী নিজের পেশাব খেতেন। প্রতিদিন সকাল বেলা খালি পেটে এক গ্লাস করে। আমরাও তাই খাবো? খাওয়া উচিত? যদি না হয় তাহলে অন্যকে অনুকরণ না করে সংযমী হলে কি ভালো হয় না?
আমি রাজনীতিকদের দুর্দিনের কথা বলছিলাম। এই দুর্দিনের জন্যই কি বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল? অনেকেই শাসকদলের চরিত্র উদ্ধৃত করে বলছেন, সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমি জানি না কোনটি ঠিক। তবে যে ঘটনাকে উপলক্ষ করে ওয়ান ইলেভেন এসেছে, রাস্তায় পিটিয়ে মানুষ হত্যা, তার বিচার প্রক্রিয়া কিন্তু থমকে আছে। যদি বিচার হতো, যেমন দ্রুত বিচারে অনেক মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে তাহলে মানুষের ধারণা অন্য রকম হতে পারতো। আমি ওদিকে যাচ্ছি না তবে রাজনীতিকদের এই দুর্দিন যে বেশি দিন থাকবে না সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। তবে সংঘাতের পরিবর্তে সমঝোতা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে এডভেঞ্চারিস্ট হয়ে কোনও লাভ নেই।
একটি ফারসী রুবাইয়াত দিয়েই আমি আজকের আলোচনা শেষ করতে চাই, রুবাইয়াতটি হচ্ছে, “ইউসুম গুস গশতে বা’জ আরত কিনান
গম ম-খুর
কুল বয়ে ইহজান সওদ রোজী গুলিস্তা রোজী
গম ম-খুর
কবি নজরুল এর তরজমা করেছেন এভাবে
“দুঃখ করো না, হারানো ইউসুফ
কেনানে আবার আসিবে ফিরে
দলিত পুষ্প এ মরু পুনঃ
হয়ে গুলিস্তা হাসিবে ধীরে”
ড. মোঃ নূরুল আমিন

Ads