সীমা লঙ্ঘনকারীকে দুনিয়ার মালিক আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এ মহান আল্লাহ্তায়ালা দুনিয়াবাসীর উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারীমূলক সীমা লঙ্ঘন বিষয়ে জানান দিয়েছেন। যাতে দুনিয়াবাসী সীমা লঙ্ঘন থেকে সতর্ক থাকে। এতেই সবার মঙ্গল নিহিত। এতসব পরও ক্ষমতার দাম্ভিকতায় যারা সীমা লঙ্ঘন করে অপহিম্মত দেখান, তারা যে কত হতভাগা তার হিসাব বড়ই জটিল।
ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, বংশ গৌরব আর ক্ষমতার অপহিম্মত সব তিরস্কারের অতীত। সীমাজ্ঞান যার না থাকে, শুধু তার নছিবেই যত তিরস্কার। সীমাজ্ঞান তার কখনও ছিল বলে সর্বশেষ ঘটনায় প্রতিয়মান হয় না। বিশুদ্ধ প্রবাদ রয়েছে, ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’। শেষ ভালো তিনি তার জীবননামায় যোগ করতে সক্ষম না হওয়ায় পূর্বে যে সীমাজ্ঞানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন আজ আর এমনটি অবিশ্বাসই বটে।
ক্ষমতার রাজ্যে আর রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় থাকতে অতিকথন আর আইন হস্তগতই যেনো তার একমাত্র নিবন্ধিত অস্ত্র। ইতোপূর্বেও তিনি নিজেকে একাধিকবার অতিকথন আর আইন হস্তগত করে ‘সমালোচনার তুঙ্গে’ গিয়ে নানাবিধ অপ্রত্যাশিত নাটক মঞ্চায়ন করেছে তার জীবন ভেলায়। এতে যদিও নাড়া দিয়েছেন বিশ্ব বিবেকে।
দলীয় পদের লোভে কিংবা দলনেত্রীকে খুশি করতে তিনি নির্লজভাবে ঘোষণা করেছিলেন তার সহোদর অনুজ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি আব্দুল কাদের সিদ্দিকী নাকি একাত্তরে মুক্তিয্দ্ধু দেশের জন্য করেনি। বিপরীতে কাদের সিদ্দিকী নিজের জন্য যুদ্ধ করেছে। অথচ মুক্তিয্দ্ধুকালীন স্বাধীনতার লক্ষ্যে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী নিজে গঠন করেন কাদেরিয়া বাহিনী। ওই বাহিনীর প্রধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান করায় ‘বঙ্গবীর’ ও ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন। কতটুকু মিথ্যাচারে লিপ্ত হলে এমন লির্লজ্জ মিথ্যাচার করতে পারে সহোদর ভাইয়ের বিরুদ্ধে। এমন প্রশ্ন আজ সহসাই হৃদয়পটে নাড়া দিয়ে জর্জরিত করছে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে। ভাবিয়ে তুলছে নতুন প্রজন্মকেও।
সর্বশেষ নিউ ইয়র্কে হজ আর তাবলিগ জামাত সম্বন্ধে যে উক্তি করেছিলেন, তা বংশ ঐতিহ্য আর সাংবিধানিক ক্ষমতার মাপকাঠিতেও অভূতপূর্ব। ওই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তিনি নাকি হজ আর তাবলিগ জামাত দুটোর ঘোরতর বিরোধী। তিনি জামায়াতে ইসলামীর যতটা বিরোধী, তার চেয়ে বেশি হজ আর তাবলিগের বিরোধী।
তবে, অপ্রত্যাশিত কি? তিনি অভিজ্ঞতায় শিখেছেন, তার দলে অশালীন উক্তি, ঔদ্ধত্য বা আইনলঙ্ঘন, কিছুরই শাস্তি হয় না। তিনি আইনপ্রণেতা হয়েও আইন অমান্য করলেও ইতোপূর্বে তার উপর শাস্তির খড়ক নামেনি। কাজেই, হজ আর তাবলিগ জামাত সম্বন্ধে উক্তি করবার সময় শালীনতার সব সীমা অতিক্রম করতে তিনি কোনো ধরনের ভয় পাননি। পুরস্কারের আশা করেছিলেন কি না, সেই প্রশ্নেই বরং জল্পনা-কল্পনা চলতে পারে। সরকারের প্রথমদিকের ভূমিকা, বিদেশ থেকে স্বদেশে পদার্পণ, আত্মগোপন আর থানায় নাটকীয় আত্মসর্মপণ ইত্যকার ঘটনাবলি পুরস্কার দেওয়া-নেওয়ার আলামতই পরিলক্ষিত হয়।
টাংগাইলের সিদ্দিকী পরিবারে এমন কা-জ্ঞানহীতার দায় যার উপর আজ বর্তায়, তিনি দাপুটে বাঘ খ্যাত সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুল লতফ সিদ্দিকী। তার চার বার সংসদ জীবনে দলীয় নিয়ম আর সামাজিক সভ্যতা ভংগের পরিসংখ্যান বলবার মতো নয়। বরং, বিভিন্ন সময় তিনি আইনপ্রণেতা হয়েও নিজেই আইন হস্তগত করেছেন। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে অভিযুক্তদের পক্ষে সাফাই গেয়ে তাদের আড়াল করার অভিযুগও বিস্তর। মন্ত্রিসভার সদস্য, দলের সিনিয়র ও জুনিয়র সহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের থোড়াই কেয়ার করতেন তিনি। কখনও সরকারি কর্মকর্তাদের মারধর ও গালিগালাজ ছিলো তার রোজকার অভ্যাস। কখনও দম্ভোক্তি দেখানোই ছিলো যেনো তার ফ্যাশন। নিজ মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কর্মকর্তাদেরও নানা অজুহাতে নাস্তানাবুদ করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এসব ছাড়াও ‘ছোট ছেলের ছোট ভুল’ বলেছেন, কারোরও মগজে অক্সিজেনের অভাবের তত্ত্ব খাড়া করেছেন।
আল-ইসলামই একমাত্র ব্যতিক্রম, যাঁর অবমাননাতে শাস্তি হয়েছে, তবে ওই শাস্তি অসভ্যতার কারণে কি-না, সেটা ভাববার বিষয়ও বটে। ইঙ্গিত বুঝতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমস্যা হয়নি। তাঁরা জানিয়েছেন, দলনেত্রী তাঁদের পার্শ্বে আছেন। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র পুত্রকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাটাও শাস্তির বিষয় বস্তু হতে পারে। লতিফ সিদ্দিকী স্বয়ং বাকসংযমে পটু নন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি নিজেও এমন সব কথা বলেছেন, যা তার সাংবিধানিক মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কাজেই, মুখে লাগাম দেওয়ার সংস্কৃতি তার দলে এবার হয়তো পায়ের নীচে মাটি পাওয়া হল না।
আজকের লেখার প্রতিপাদ্যের বিষয় হচ্ছে বিশেষ করে বাংলাদেশের নয়া ইতিহাসের বিররণ। তবে লেখার শিরোনামটি আমাদের ভাবতে শুধু অবাকই করে না। বরং লজ্জ্বায় মাথা নত হয়ে আসে। কারণ যিনি ‘দাপুটে বাঘ’ খ্যাত। তিনি আবার নতমস্তকে ক্ষমা চাইবেন কেনো। যিনি সারা জীবন দাপুটে বাঘের ন্যায় কর্ম সম্পাদন করেছেন। তিনি আবার হঠাৎ করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এমন কি-বা প্রয়োজনে আইনপ্রণেতার ক্ষমতা হস্তান্তর করে জাতীয় সংসদ থেকে নজিরবিহীন নীরব প্রস্তান করে নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করতে হলো তাকে। এমন নানাবিধ প্রশ্ন হৃদয়পটে আজ সহসাই ভিড় জমায়। কিন্তু প্রশ্ন অনেক থাকলেও জবাব পাওয়া বড়ই দুরূহ। কারণ প্রধানমন্ত্রীর পুত্রও তার তাচ্ছিলতায় জব্দ হয়েছেন।
গত ১ সেপ্টেম্বর দশম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের প্রথমদিনে যোগ দিয়ে লিখিত বক্তব্যে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছেন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত মন্ত্রিত্ব ও আওয়ামী লীগের সদস্যপদ হারানো আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে সংসদ অধিবেশন চলাকালে সরাসরি আমি নিজেও তা প্রত্যক্ষ করেছি। পরদিন ২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লতিফ সিদ্দিকীর নতমস্তকে ক্ষমা প্রার্থনার খবর নানাবিধ শিরোনামে ফলাও করে ছাপা হয়।
‘সংসদে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করলেন লতিফ সিদ্দিকী’ শিরোনামে খবর ছাপে সমকাল পত্রিকা। ‘নত মস্তকে ক্ষমা চাই সবার কাছে’ শিরোনাম ছিলো ইত্তেফাক পত্রিকার। ‘সংসদে ক্ষমা চেয়ে লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগ’ শিরোনামে খবর ছাপে আলোকিত বাংলাদেশ। ‘ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করলেন লতিফ সিদ্দিকী’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে আমাদের সময়। মানবজমিন শিরোনাম করে ‘অবশেষে পদত্যাগ’। নয়াদিগন্ত খবর ছাপে ‘লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগ’ শিরোনামে। ‘আমি নতমস্তকে ক্ষমা চাচ্ছি’ শিরোনামে খবর ছাপে যুগান্তর।
পত্রিকাগুলো যে যেভাবে খবর প্রকাশ করুক না কেনো সবগুলো খবরে দাপুটে বাঘের নতমস্তকে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি প্রকাশ পায়। সংসদ সচিবালয়ের খতিয়ানে এর আগে এভাবে কোনো এমপি’র পদত্যাগের নজির নেই। অধিবেশন শুরুর আগে তিনি দেখা করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে। সন্ধ্যা ৭টার পর লতিফ সিদ্দিকী সংসদে ঢোকার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন না। এ সময় তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর লবিতে। তার প্রবেশের সময় বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বক্তব্য রাখছিলেন। এদিকে সংসদে তাকে দেখে এমপিরা একে অপরের দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকান। তবে কেউই তার পাশে যাননি। আসনে বসেই লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের সামনের সারিতে বসে থাকা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে ইশারায় কথা বলেন।
প্রথমে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়ানোর জন্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সাড়া পাননি লতিফ সিদ্দিকী। তাকে উদ্দেশ্য করে স্পিকার বলেন, মাননীয় সদস্য, আপনি একটু পরে কথা বলেন। এর কিছুক্ষণ পর স্পিকারের অনুমতি মিললে বক্তব্য শুরু করেন তিনি। প্রায় ১৫ মিনিটের বক্তব্যে লতিফ সিদ্দিকী হজ নিয়ে নিজের অবস্থানের কথা জানান। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা তুলে ধরেন।
পাঠকদের সুবিধার্থে লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো-
বক্তব্যের শুরুতেই লতিফ সিদ্দিকী স্পিকারের উদ্দেশে বলেন, আমি এই সংসদে সাধারণ মৌখিক বক্তৃতা করেছি, আজ বিশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানাতে দাঁড়িয়েছি। এজন্য একটি লিখিত বক্তৃতা নিয়ে এসেছি। মাননীয় স্পিকার আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে বক্তক্যটি পড়বো। স্পিকারের অনুমতি মিললে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আমি অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েছি। আজকে আমার সমাপ্তি দিন। এই দিনে কারও বিরুদ্ধে কোনো বিদ্বেষ অভিমান অভিযোগ আনছি না। দেশবাসী আমার আচরণে যদি কোনো দুঃখ পেয়ে থাকেন আমি নতমস্তকে তাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি মানুষের ভালবাসাকে আমার শ্রেষ্ঠ মূলধন মনে করি। সেই ওয়াদা করে সর্বশেষে আমি বলছি, উপরন্তু অনুমিত হয়েছি আমার নেতার অভিপ্রায় আমি আর সংসদ সদস্য না থাকি। কর্মী হিসেবে নেতার একান্ত অনুগত ছিলাম। বহিষ্কৃত হওয়ার পর তার ব্যত্যয় কিংবা ব্যতিক্রম সমীচীন মনে করি না। এখন দ্বিধাহীন কণ্ঠে, ঘৃণা বিদ্বেষ উগরে না দিয়ে, কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না করে দৃঢ় চিত্তে বাংলাদেশ সংসদের আসন ১৩৩ টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করছি। একই সঙ্গে মাননীয় স্পিকার আপনার বরাবর পদত্যাগপত্রটি প্রেরণ করছি।’ তিনি পদত্যাগপত্রটি পড়ে শোনানোর জন্য স্পিকারের অনুমতি চাইলে স্পিকার বলেন, পড়ে শুনানোর প্রয়োজন নেই।
এরপর লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রথমে আমি বলে নেই, আমি মুসলমান আমি বাঙালি, আমি আওয়ামী লীগার। এই পরিচয় মুছে দেয়ার মতো শক্তি পৃথিবীর কারও নেই। কারণ, এই আমার চেতনা, আমার জীবনবেদ, প্রাণের রশদ, চলার সুনির্দিষ্ট পথ। যে যাই বলুন, প্রচার করুন, সিদ্ধান্ত নিন, এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে না। আমি মানুষ বলেই আমার ভুলভ্রান্তি আছে, ত্রুটি আছে। কিন্তু মনুষ্যত্বের স্খলন নেই, মানবতার প্রতি বিশ্বাস হারাই না, যত বড় আঘাতই আসুক ধৈর্যহারা হই না। আমি বিশ্বাস করি আঁধার মানেই আলোর হাতছানি, রাষ্ট্র নিপীড়ন করলেও আমি ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে মেনে নিয়েই তা মোকাবিলা করলাম। আমি অভিযোগের টুকরি নিয়ে সংসদে দাঁড়াইনি। ভালোবাসার মহিমা বিতরণ করতে সৌহার্দ্য আর প্রীতি ভালোবাসার মালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছি। আমি সব সময়ই অস্পষ্টতা ও ধূসরতা বিরোধী। অস্পষ্টতা, ধূসরতা, কপটতা স্বার্থপরতা সুযোগ-সুবিধার পথে হাঁটাকে অপছন্দ করি। জীবন উৎসর্গ করেছিলাম মানুষ সমাজ রাষ্ট্র মানবতার সেবায়। নিজের জন্য ভারী ভারী পদ-পদবী করায়ত্ত করতে নয়। আর পদপদবীর জন্য নিজের চরিত্র বৈশিষ্ট্য কালিমালিপ্ত করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ।’
‘অসাম্প্রদায়িক, ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা আমার মনন গঠিত ও বিকশিত এবং প্রতিনিয়ত এর চর্চা ও অনুশীলন করি। অমানুষ নই, ব্রতমান মানুষ। মনুষ্যত্ব ও মানবতার চর্চা অনুশীলন করতে গিয়ে নিজের ভিতরে অনেক কুঠুরি নির্মাণ করেছি। মানুষ ও মনুষ্যত্বের অনুশীলনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কুঠুরিতে প্রবেশ করি। সেই কুঠুুরির একটা আমার ধর্ম কুঠুরি। সেখানে আমি সাচ্চা মুসলমান। ধর্মীয় জীবন একান্তই আমার জীবন। এ জীবন ধারণে জনবাহবা বা নিন্দা কোনটাতেই আমি কুণ্ঠিত, বিব্রত ও ভীতসন্ত্রস্ত হই না। নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করেই সন্তুষ্ট। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার ধর্ম কুঠুরির ভাবজগৎ নিয়ে সমষ্টিতে আলোড়ন আন্দোলন দেখা দিয়েছে। সমষ্টি আমাকে ত্যাজ্য করেছে। যেভাবেই ভাবা যাক রাজনীতির সামষ্টিক কোনক্রমেই ব্যষ্টির বা স্বতন্ত্র অবস্থান স্বীকার করে না। কারণ, রাজনীতি মানব কল্যাণের একটি প্রকৃষ্ট উপায়, কোনো বিচ্ছিন্ন উপায় নয়। অন্যদিকে ব্যক্তিজীবন একান্তই ব্যক্তির। এখানে সমষ্টির প্রবেশ নিষিদ্ধ। ব্যক্তি এখানে সবকিছু।’
‘আমাকে ষড়যন্ত্রকারী, প্রতিশোধপরায়ণ ধর্মদ্রোহী গণদুশমন, শয়তানের রিপ্রেজেন্টেটিভসহ বিভিন্ন ঘৃণার পাত্র সাজাতে সবশেষে ধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি স্পষ্ট করে দৃঢ়চিত্তে বলতে চাই, আমি ধর্মবিরোধী নই, আমি ধর্ম অনুরাগী, একনিষ্ঠ সাচ্চা মুসলমান। আমি বলতে সাহস পাই, ধর্মীয় অনুশাসন মানে যেসব করন্ত কাজ ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী গোষ্ঠী স্বীয়স্বার্থ চরিতার্থ করতে তৎপর তাদের বিরুদ্ধে শান্তির ধর্ম ন্যায়ের ধর্ম সত্যের ধর্ম অন্ধকার থেকে আলোর দিশা ধর্ম ইসলামের সঠিক তাৎপর্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে অম্লান থাকবে আমার পথচলা।’
‘আমার এই মনভাবের প্রকাশ নিয়ে যতই ষড়যন্ত্র হোক, যত মিথ্যাচার হোক, যত আঘাত প্রতিঘাত আসুক, রাজনৈতিক সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আস্থা রেখে যেমন মোকাবিলা করেছি, বর্তমানেও এর ব্যত্যয় ঘটবে না। আমি মনে করি, হজ প্রতিপালন ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে অন্যতম ফরজ। এই ফরজ পালনেও আরও কতগুলো অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিপালন মাত্র একবারই করার কথা। যা নিজেও করেছি।’
‘ওয়াজিব, সুন্নাত পরিহার করে অবশ্য পালনীয় ফরজ তরক করে যারা এই ফরজটি পালনে প্রতিবছর ব্যস্ত তাদের মানসিকতা আর আমার বিবেচনায় ভিন্ন। হজ যে একটি বিরাট অর্থনীতিক কর্মকা- তা কিন্তু মানতে না চাইলে মিথ্যা হয়ে যায় না। রোজার মাসটি আমার প্রাত্যহিক জীবনের অবশ্য পালনীয় মাস। আমি এই ধর্মীয় আচারটি পালন করি। মহানবী (সাঃ) আল্লাহ্র প্রেরিত প্রতিনিধি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। শূন্য থেকে একক প্রচেষ্টায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনে দক্ষ ও সফল রাষ্ট্রনায়ক। আমার চলার পথের আলোকবর্তিকা। আদর ভালবাসা শ্রদ্ধা ও সম্মানে নিজের বুকে আগলে আব্দুল্লাহপুত্র মোহাম্মদ বলে আদর প্রকাশে কুণ্ঠিত ভীত বা শঙ্কিত নই। এই দুর্লভ মানব জীবন সামনে মহানবীর আদর্শিক জীবন চলার নির্দেশনা থাকার পরও কি সুন্দরের আরাধনা মনে জাগবে না যতবার বলতে বলা হবে ততবার বলবো, তাবলিগ প্রচারকারীরা যদি ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সমাজ রাষ্ট্র চেতনা বৃত্তির দিকে মনোযোগী হতেন তাহলে তাবলিগের যে প্রভাব আমাদের সমাজ জীবনে প্রতিফলিত তা আরও ফলবতী হতো, কার্যকর ভূমিকা রাখতো। নবী (সাঃ) কখনও জীবনকে অস্বীকার করে ধর্ম পালন করতে বলেননি। জীবনের জন্য ধর্ম অপরিহার্য।’
‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বিদায় হজের ভাষণে নিষেধ করে গেছেন। যারা অসাম্প্রদায়িক ও ইহজাগতিকতার কথা প্রচার করেও ধর্মানুগ নীতি নিয়ে শোরগোল তোলেন তাদের বিষয়ে নীরব থাকাই সমীচীন মনে করি। তিনি বলেন, এমন বহিষ্কারের খড়গ এবারই প্রথম নয়। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও চারবার বহিষ্কৃত হয়েছি। বাঙালির আত্মপচিয়ের সরব ঘোষণার কারণেই। দল থেকে দুইবার বহিষ্কার হয়েছি দলীয় কর্মকাণ্ডে দুর্বল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি বলে। এবারও কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ইহজাগতিক মনোভাব প্রকাশ করার কারণেই আমি দল থেকে বহিষ্কার, মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ, এমনকি আমার প্রেসিডিয়াম সদস্যপদ হরণ করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ কতখানি যৌক্তিক সে বিষয়ে বলতে চাই। নিকট অতীতে মোঃ হানিফ যখন আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র থেকে ধর্মনিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িক নীতি আদর্শ বাদ দিতে ওকালতি করেন তখন তার এ তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। তখন ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ উঠেনি। কারণ, দল তখন ক্ষমতায় ছিল না, দলের অবস্থা এমন রমরমা ছিল না।
‘আমার যত আপত্তি সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফা উল্লেখ করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে স্পিকারের চিঠি প্রসঙ্গে। ৬৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফার বর্ণিত নির্দেশনা হলো, ‘কোনো ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা এবং থাকার বিষয়ে। এক্ষেত্রে ৬৬ অনুচ্ছেদের দুই দফা কারণ সংসদের ৭০ অনুচ্ছেদের নির্দেশনার ব্যাপারটি স্পষ্ট। এ স্পষ্ট বিষয়টি আপনার বরাতে ধূসর হয়ে গেছে। আমি বিবেচনা করি, এই চিঠিতে সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন সংবিধানের অপব্যাখ্যা হয়েছে। বিনা শুনানিতে এভাবে একজন সংসদ সদস্যের আসন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয়া যথাযথ কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। আপনি আমাকে সময় দিয়েছেন। বিদায় বেলায় শুধু এ কথা বলতে চাই, আমি মানুষের জন্য রাজনীতি করেছি মানুষকে ভালবেসেছি। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আমি অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছি। আজকে আমার সমাপ্তি দিন। এই দিনে কারও বিরুদ্ধে কোনো বিদ্বেষ অভিমান অভিযোগ আনছি না। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা সফল হোন।’ (তথ্য সূত্র: মানবজমিন- ০২.০৯.২০১৫) বক্তৃতা শেষ করেই তিনি অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় কয়েক এমপি’র সঙ্গে বিদায়ী করমর্দন করেন। অনেক এমপি দাঁড়িয়ে তাকে বিদায় জানান।
টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী সিদ্দিকীদের বড় ভাই লতিফ ওই আসন থেকে একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকীও একবার সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তার ভাই আব্দুল কাদের সিদ্দিকীও সাবেক সংসদ সদস্য, যিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে এখন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করে সে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। টাঙ্গাইল-৪ আসনের চারবারের সংসদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ছিলেন পাঁচ বছর। চলতি সরকারে তাকে দেয়া হয়েছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় সভায় লতিফ সিদ্দিকী হজ, তাবলিগ জামাত, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সাংবাদিকদের সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। ওই সময়ে দেশের বিভিন্ন আদালতে তার নামে একাধিক মামলাও হয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ভারত হয়ে ওই বছরের ২৩ নভেম্বর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফেরেন সাবেক ওই মন্ত্রী। পরে ২৫ নভেম্বর ধানমন্ডি থানায় আত্মসমর্পণ করলে তাকে জেলহাজতে পাঠান আদালত। ওই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মামলায় ৯ মাস কারাগারে কাটাতে হয় তাকে। গত ২৯ জুন জামিনে মুক্তি পান তিনি। ১৩ জুলাই লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের জন্য জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের পক্ষে চিঠি দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। চিঠিতে বলা হয়, ২০১৪ সালের ২৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় গঠনতন্ত্র অনুসারে লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদও নেই, সেহেতু এই দলের মনোনয়নে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য পদেও তাকে বহাল রাখা সমীচীন হবে না। এরপর আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদকে চিঠি দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। ওই চিঠির সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের চিঠিটিও যুক্ত করেন স্পিকার। চিঠিটি পাওয়ার পর ইসি আওয়ামী লীগ ও লতিফ সিদ্দিকীর কাছে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা চান।
আমরা বলতে চাই, বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীরা যখন জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেননি তখন ওই অতিগুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে বসবার যোগ্যতা লতিফ সিদ্দিকীদের কখনও ছিল না। আজ সেটুকুও নেই লতিফ সিদ্দিকীর। বিনা বাক্যব্যয়ে লতিফ সিদ্দিকীকে জাতীয় সংসদ থেকে বরখাস্ত করাই ছিল উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটানো ডিজিটাল বাংলাদেশের দাবিদার মহাজোটনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত কর্তব্য। ক্ষমতার অপহিম্মতধারীর ন্যায় চরিত্ররা যাতে গণপরিসরে তথা জাতীয় সংসদে না আসতে পারেন, সেটুকু নিশ্চিত করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের একটি বড় উপকার করতে পারেন।
তবে, ক্ষমতার অপহিম্মতধারীরা এই সমাজেরই সন্তান। সেদিক থেকে লতিফ সিদ্দিকীও সমাজের বাইরে নন। তিনি যখন জনসভায় হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে মন্তব্যটি করেছিলেন, তখন কিন্তু সভায় উপস্থিত আওয়ামীবাদী নেতা-কর্মীরা বিস্ময়ে চুপসে যাননি। প্রতিবাদও করেননি। বরং, নীরব থেকে তারা পরাজিত সম্রাট লতিফ সিদ্দিকীকে প্রবল হাততালিতে উৎসাহ দেওয়ার মতই প্রেরণা যোগিয়েছেন। অর্থাৎ, নর্দমার যে পাঁক বেচিতে লতিফ সিদ্দিকী যে আসরে নেমেছিলেন, তার উৎসাহী ক্রেতাও বিস্তর আছে। ঘটনাটি লতিফ সিদ্দিকীকে যতখানি চিনিয়ে দেয়, সমাজকেও ততখানি ভাবিয়ে তুলে। এইখানেই নাগরিক সমাজের ভূমিকার প্রশ্নটি সহসাই উঠে। সোশ্যাল মিডিয়ায় লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ চলছে বলেও সিদ্দিকী পরিবারের অভিযোগ। কিন্তু, সিদ্দিকী পরিবারের অভিযোগ ওই ঘটনার গুরুত্বকে খাটো করে দেওয়া ভিন্ন আর কিছুই নেই। সমাজের ভিতর হতে স্পষ্ট স্বরে বলতে হবে, ওই অসভ্যতা রাজনীতির প্রশ্নই নয়, এটি সামাজিক পরিসরে ইতর ব্যবহারের দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক রং তথা আদর্শ নির্বিশেষে তার প্রতিবাদ করতে হবে। এই দফায় ক্ষমতার অপহিম্মতধারীদের রাজনৈতিক ঢালের আড়ালে লুকিয়ে রাখলে চলবে না। শাস্তি প্রয়োজন। একান্তই কঠিন শাস্তি।
এম.কে. দোলন বিশ্বাস