মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০১৫

বিশ্বাস ভেঙে গেছে


অবিরাম বিশ্বাস ভঙ্গের ফলে সরকারের ও সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন-পুলিশের বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো কথাই আর আজকাল বিশ্বাস হতে চায় না। সরকার যা কিছু কথা বলে, প্রায় সকল ক্ষেত্রে তা খণ্ডিত, একপেশে এবং অগ্রহণযোগ্য। যেমন গত ৫ জানুয়ারির পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের সময় থেকে দেশে দু’ ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। এক হলো পেট্রোল বোমায় মানুষের প্রাণ গেছে, অনেকে পুড়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও বর্বর ঘটনা, এ বিষযে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় যে, এসব পেট্রোল বোমা হামলায় বিরোধী দলের কাউকে হাতেনাতে ধরা সম্ভব হয়নি। যাদের ধরা হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই সরকারদলীয় সদস্য। এদের কাউকেই আবার শাস্তির আওতায় পর্যন্ত আনা হয়নি।
আবার লক্ষ্য করা গেছে যে, ১৮ দলের অবরোধের সময় সামনে পেছনে পুলিশ-বিজিবির পাহারা দিয়ে কিছু পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেও ঐ ট্রাক বহরের মাঝখানের কোনো ট্রাকে পেট্রোল বোমা মেরে যারা পালিয়ে গেছে তাদের কাউকে পুলিশ বা বিজিবি গ্রেফতার করতে পারেনি। এটা কীভাবে সম্ভব? সে প্রশ্নের কোনো জবাব সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু  তারা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ঐ বোমা হামলার অভিযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
এর বিপরীতে আছে বাড়ি থেকে, রাস্তাঘাট থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুলী করে হত্যা বা পঙ্গু বানিয়ে ফেলা এবং তাদের আটক নিয়ে গ্রেফতার বাণিজ্য। সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের শত শত অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে মুশকিল হলো এই যে, শত শত লোকের সামনে থেকে আটক করে নিলেও পুলিশ কিছুক্ষণ পরেই তাদের গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করে বসেছে। সেখানে এক অসহায় অবস্থায় পড়ে সংশ্লিষ্টের পরিবার। তারা একবার থানায় যায়, একবার র‌্যাব দফতরে যায়। কোথায়ও তাদের স্বজনদের কোনো হদিস পায় না। কখনও বা কোনো পরিবার লাশ পায়, কখনও অনিঃশেষ দীর্ঘশ্বাসই হয় সম্বল, লাশও মেলে না।
এখন এক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিবি পুলিশ বা গোয়েন্দা পুলিশ। এই বাহিনীর গাড়ি আছে, তাতে বড় করে ‘ডিবি’ লেখা আছে,  দের হোলস্টারে গোঁজা আছে পিস্তল, কোমরে ঝোলানো আছে হ্যান্ডকাফ। চুল থাকে ছোট করে ছাঁটা। এরা ডিবি পুলিশ। কিন্তু এদের কাছে যা নেই, তা হলো আদালত থেকে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা। পাকিস্তান আমল থেকেই আমরা সাধারণ নাগরিকরা জানতাম, আদালতের পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। এখন আর সে বিধান নেই। র‌্যাব-পুলিশের পরিচয়ে যে কেউ যে কোনো সময় যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। আগের দিনে জানতাম, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে কোনো কর্তৃপক্ষই হোক না কেন, তারা কাউকে রাতের বেলা গ্রেফতার করতে পারবে না। এখন সে বিধানও রদ করা হয়েছে। ফলে পুলিশ বাহিনী গ্রেফতার বাণিজ্যের লক্ষ্যে একবারে গাড়ি পুলিশ বন্দুক নিয়ে কোনো গ্রামে হানা দিয়ে ডজন ডজন লোককে গ্রেফতার করে আনে। তারপর মুক্তিপণের জন্য চলে নানা দেনদরবার। এভাবে সর্বসান্ত¡ হয়ে যাচ্ছে গ্রামগঞ্জের হাজার হাজার পরিবার। সরকারের ন্যায়বিচারের ললিত বাণী কেবল বিদ্রুপই করছে সাধারণ মানুষকে।
এক সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই ছিল মানুষের বিপদে-আপদের আশ্রয়স্থল। এখন সাধারণ মানুষের কাছে তারা ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সরকার র‌্যাব-পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধী দলকে দমন করে তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে চাইছে। সরকারের দ্বারা যথেচ্ছ ব্যবহৃত হওয়ার ফলে তারা জেনে গেছে যে জবাবদিহিতা চাওয়ার মুরোদ আর এ সরকারের নেই। সে কারণে তারা নিজেরা নিজেদের আখের গোছানোর কাজে একেবারে কাছা দিয়ে নেমে পড়েছে। একের পর এক অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছে।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। মাত্র কয়েকটি ঘটনা আলোচনা করে আমরা পরিস্থিতির সামান্য বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। আলোচনা শুরু করা যায় নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত খুনের ঘটনা নিয়ে। গত বছর ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কমিশনার নূর হোসেনের কাছ থেকে বিপুল আর্থিক সুবিধা নিয়ে র‌্যাবের সিইও  ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা  লে. কর্নেল তারেক সাইদের নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য ও বেসরকারি ব্যক্তি সাতজনকে হত্যা করে তাদের পানিতে ফেলে দেয়। জনাব মায়া ১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত। দুদকের আইনজীবী বলেছেন, তার মন্ত্রিত্ব ও এমপি পদ উভয়ই খারিজ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি আছেন বহাল তবিয়তেই। যেখানে সন্দেহজনক মামলায় রাজনৈতিক বন্দীদের ডান্ডাবেরি পরিয়ে আদালতে আনা হয়, সেখানে দেখলাম মায়ার জামাতাকে একবারে জামাই আদরে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে কোনোরকম হ্যান্ডকাফ ছাড়াই আদালতে আনা হলো।
এক্ষেত্রেও ন্যায়বিচার সুদূর পরাহত বলেই মনে হয়। এই মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেন আওয়ামী লীগের এক বহুল নিন্দিত এমপির সহায়তায় ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। তার বিস্তারিত অডিও রিপোর্ট পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ঐ এমপিকে কেউ জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি। এ এক দারুণ খেলা। নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী বর্তমানে নিজেও নির্বাচিত কমিশনার সেলিনা ইসলাম এই মামলার চার্জশীটে নারাজি দিয়েছেন। তা নিয়েও নানা ঘটনার জন্ম হচ্ছে। এদিকে যেহেতু মূল আসামী অনুপস্থিত, তাই মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। নূর হোসেন কলকাতার কারাগারে আটক আছেন। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ, অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রা রাখা ও নাম গোপন করে বাড়িভাড়া গ্রহণের দায়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে ভারতে। কোনো চার্জশীট হয়নি। গত সপ্তাহে কলকাতার একটি আদালত নূর হোসেনের সহযোগীর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। সে পরোয়ানা কবে কার্যকর হবে, কেউ জানে না। সে সময় বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেছিলেন, নূর হোসেনকে এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরিয়ে আনা  সম্ভব। কিন্তু গত ১৫ মাসেও তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। আর বাংলাদেশে এখনও তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোনো চার্জশীট দাখিল করা হয়নি।
নূর হোসেন ভারতে আটক হওয়ার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বর্তমানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, শিগগিরই নূর হেসেনকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তারপর আমরা অনেক নাটক দেখেছি। সরকার লোক দেখাতে ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছিল ও রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল। এরপর ১৫ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে, নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সরকার।
এর সবকিছুই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। নূর হোসেনের সাক্ষ্য থেকে প্রমাণিত হতে পারে এর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের কোন কোন রাজনীতিক জড়িত আছেন। ভারতের সঙ্গে তো বাংলাদেশের বন্দীবিনিময় চুক্তি আছে। তাহলে নূর হোসেনকে কেন ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না- সে প্রশ্ন এখন সবার মনে। কেননা, ঐ চুক্তির অধীনে সরকার তো উলফা নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। তাহলে নূর  হোসেনকে কেন ফিরিয়ে আনা যাবে না? সে ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, সরকার সাত খুনের বিচার করতে সত্যি সত্যি নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনতে চায় কিনা।
প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে গত ৮ জুলাই সিলেটে। ঐ দিন ভোরে সৌদি প্রবাসী কামরুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা মিলে ১৩ বছরের শিশু সবজিবিক্রেতা রাজনকে ভ্যানচোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তার প্রায় ২৯ মিনিটের ভিডিও করেছে ঘাতকরা। সে ভিডিও তারা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েও দেয়। শিশুটি মারা গেলে তার তার লাশ গুম করার সময় স্থানীয় অধিবাসীরা খুনীদের আটক করে। এনিয়ে মামলা করতে গেলে রাজনের পিতাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে থানা থেকে বের করে দেয় পুলিশ। পরে তারা ঘাতকদের সঙ্গে বৈঠক করে খুনী কামরুলকে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে সৌদি আরব চলে যেতে সহযোগিতা করে। এখানে পুলিশ সরাসরি খুন করেনি বটে, তবে টাকার বিনিময়ে খুনীদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। আর নিজেদের দেয়া মামলায় শিশুটিকে বলেছে ‘অজ্ঞাত পুরুষ’। অর্থমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তিন মন্ত্রী সেখানে গেছেন। রাজনের পিতাকে আর্থিক সাহায্য করেছেন। মামলার দ্রুত বিচারের আশ্বাসও দিয়েছেন। আর তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
বলা হচ্ছে, রাজনের হত্যাকারীদের বিচারের জন্য কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের কোনো বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই। ফলে কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। কারণ সৌদি আরবে রয়েছে তাদের নিজস্ব আইন-কানুন। সেখানে কামরুল কোনো অপরাধও করেনি। সে ক্ষেত্রে কামরুলকে ফিরিয়ে আনতে কাঠখড় পোড়াতে হবে অনেক বেশি। তাছাড়া সরকারের অদূরদর্শী কূটনীতির কারণে বর্তমানে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ শীতল। ফলে কামরুলেরও নূর হেসেন কেস হবার আশঙ্কাই বেশি।
আরও একটি কথা এখানে আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সেটা হলো, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন ও বহু মন্ত্রীর জেলা সিলেটের রাজন হত্যা নিয়ে সমাজে সত্যি তোলপাড় উঠেছে। এ ক্ষেত্রে দোষীদের শাস্তি সুদূর পরাহত বলেই মনে হয়। তারপরও শোরগোল আছে। কিন্তু এমপি পুত্র রনির গুলীতে যে দুজন নিরীহ শ্রমজীবী মানুষের প্রাণ গেল, তাদের খোঁজ নিতে যাননি কোনো মন্ত্রী বা সরকারের কোনো প্রতিনিধি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তারা। এমন কি ঈদের দিনেও তাদের বাড়িতে চুলা জ্বলেনি। কেউ খবর রাখেনি।
পাদটীকা :
নোয়াখালির কোম্পানীগঞ্জে পুলিশ তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে যে কিশোর মিলনকে জনতার হাতে তুলে দিয়েছিল এবং জনতা তাকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছিল, গত ২৭ জুলাই তার চার বছর পূর্ণ হয়েছে। যেসব পুলিশ সদস্য কিশোর মিলনকে পুলিশ ভ্যান থেকে নামিয়ে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দিয়েছিল, ঘটনার বছর না পেরুতেই সেই পুলিশ সদস্যদের সাময়িক শাস্তি প্রত্যাহার করে নেয় কর্তৃপক্ষ। ঘটনার চার বছরের মাথায় এসে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবের অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ কিশোর মিলন হত্যা মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। এর ফলে অভিযুক্ত চার পুলিশ সদস্যসহ মামলার সব আসামীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এখন কিশোর মিলনের মা কোহিনুর বেগম ছেলে হত্যার বিচার আল্লাহর আদালতে ছেড়ে দিয়েছেন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads