বাজারে গোলআলু দেখে সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘এগুলো কি মুরগির ডিম নাকি ফজলি আম?’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল। শিশু ছেলেটা হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ব্যাটা তিনটার একটাও চেনে না।’ সবার হাসি থেমে গেল। তাই তো, তিনটা বস্তুর একটাও তো লোকটা চেনে না! এমন ঘটনা বাজারে অবশ্য সচরাচর ঘটে না; কিন্তু ইদানীং ‘মুক্তচিন্তা’র অমুক্ত বাজারে প্রায়ই ঘটে থাকে। বাজারটির নাম মুক্তচিন্তা, কিন্তু স্বভাবে অমুক্ত, শুধু ধর্মের কুৎসার কাঁটাতারেই সে ঘেরা।
তসলিমা নাসরীন তার নারীর কোন দেশ নাই বইটির এক জায়গায় আমাদের খবর দিয়েছেন যে, ইসলামি শরিয়া মতে ধর্ষিতা নারীটি নাকি ধর্ষকের স্ত্রী হয়ে যায়, যাতে ধর্ষকের ... পূজাটা ভালো করে হয়। কোথায় যেন একটি ছোট ছেলে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল। ছেলেটি জানে যে, ইসলামি শরিয়ায় এমন বিধান নেই, ওখানে বরং ধর্ষকের শাস্তি অপমানজনক মৃত্যুদণ্ড। বোঝাই যাচ্ছে যে, ওই শিশু ছেলেটার সমান জ্ঞানও তসলিমার নেই। আপামণির জ্ঞানের চাবুক খেয়ে অবশ্য আমাদের মিডিয়াজগৎ বেহুঁশ। কোনো কোনো পত্রিকা তার আর্টিকেল ছাপতে পারলে জাতে উঠে যেতে পারবে বলে এখনো মনে করছে।
কয়েক দিন আগে প্রচণ্ড কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আবার আল্লাহ্র ৯৯ শেফাতি নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে মুশরিকদের দেবদেবীর নামকে আশ্রয় করেছেন। আবার সেই হাততালি, আবার সেই হাসি। ছেলেটিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সে বুঝে ফেলেছে যে, চৌধুরী সাহেব মাশরেক হতে মাগরেব পর্যন্ত বিস্তৃত এই ভূ-পৃষ্ঠের কোনো অঞ্চলের দেবদেবী সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। ইসলামের কোনো ব্যাপারে যে সাহেব ধারণা রাখেন না সেটা, তার কাছে আরো বেশি পরিষ্কার। পৃথিবীর কোনো এলাকার কোনো দেবদেবীর নামের সাথেই আল্লাহ্র ৯৯ নামের কোনো সাজুয্য আসলে নেই, ছিল না কখনো। যদি থাকেও তাহলে প্রশ্ন উঠবে যে, আসলে কে কারটা অ্যাডপ্ট করেছে? ইসলাম ওদেরটা অ্যাডপ্ট করেছে নাকি ওরা ইসলামেরটা। অথবা কোনো পক্ষে অ্যাডপ্ট করার কোনো প্রয়োজন আদৌ ছিল কি না! ইসলামের ইতিহাস যার জানা আছে তিনিই জানেন যে, সবচেয়ে পুরাতন ধর্ম ইসলাম, যা হজরত আদম আ:-এরও ধর্ম।
অন্যান্য ধর্ম ইসলামের পরে সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই অ্যাডপশনতত্ত্ব ইসলামের বেলায় চলবে না। যারা হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর আবির্ভাবের পরে ইসলামের শুরু হয়েছে বলে মনে করেন, তাদের জানা থাকা উচিত যে, হজরত মুহাম্মাদ সা: ইসলামের শেষ নবী এবং আল-কুরআন ইসলামের শেষ গ্রন্থ। অর্থাৎ শেষটাই প্রথম নয়। ইসলামের কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, যুদ্ধ, হারাম, হালাল ইত্যাদি আগে থেকেই ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামান্য যোগ-বিয়োগ হয়েছে মাত্র, বিশেষ কোনো পরিবর্তন তাতে আসেনি। পরিবর্তনবাদীরা বারবার পরিবর্তন করে নিত্যনতুন ধর্মের আবিষ্কার করার কারণে পৃথিবীতে প্রায় হাজার তিনেক সম্প্রদায় ছিল বা আছে। এই দুনিয়ায় এমন কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠী নেই যাদের মাঝে আল্লাহ্ পাক কখনো কোনো নবী-রাসূল বা পথপ্রদর্শক পাঠাননি। অনেক সম্প্রদায়ই তাদের নবী-রাসূল বা বুজুর্গ ব্যক্তিদের প্রতি অতিরিক্ত ভক্তিশ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে তাদের তিরোধানের বা মৃত্যুর পর মূর্তি গড়ে পূজায় লিপ্ত হয়েছে। ওইসব সম্প্রদায়ের কাছে তারা আর নবী-রাসূল থাকেননি, হয়ে গেছেন দেবতা। পৃথিবীতে প্রথম পূজা হয়েছে মেহলাইলের, যিনি ছিলেন হজরত আদম আ:-এর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ, একজন বুজুর্গ ইসলাম প্রচারক। দ্বিতীয় পূজা হয়েছে হজরত ইদ্রিস আ:-এর, যিনি এখনো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পূজিত হচ্ছেন, স্বর্গের দেবরাজ বিবেচনায়। মূর্তি সংহারী হজরত ইবরাহিম আ:-এরও মূর্তি বসিয়েছিল মুশরিকরা, খোদ কাবা শরিফে। মূর্তিপূজকরা চিরকালই এমনি লোমহর্ষক কাণ্ডকীর্তি ঘটিয়েছে, ধর্মের দোহাই দিয়েই। ওই সব কুপরিবর্তনের কারণেই ইসলামকে বারবার ফিরে আসতে হয়েছে, নতুন রূপে নয়, একই রূপে, অতি পুরাতন রূপে। আল্লাহ্ পাক বারবার পরিবর্তিত গ্রন্থগুলো বাতিল করেছেন, ওগুলোর ভাষাও বিলুপ্ত করেছেন, নতুন ভাষায় নতুন গ্রন্থ নাজিল করে ইসলামকে বারবার পুনরুজ্জীবিত করেছেন। এটাই ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস।
মানুষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, দুনিয়ার অনেক জাতি আবার তাদের রাজা-রানীকে দেবদেবী হিসেবে পূজা করেছে, আজো করে। এসব রাজা-রানী নিজেদের কখনো সূর্যের পুত্র-কন্যা, কখনো চন্দ্রের পুত্র-কন্যা, কখনো পাহাড়-পর্বত বা নদ-নদীর সন্তান বলে দাবি করেছে এবং মানুষের পূজা আদায় করেছে, ভোগ-সম্ভোগ হাসিল করেছে। নিজেদের অমর-অজ্বর দাবি করে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, অস্থি-পঞ্জর ধুলায় মিশে গেছে, কিন্তু অতিভক্ত পূজারির কাছে তারা আজো দেবতাই রয়ে গেছেন। এশিয়া, ইউরোপ বা আফ্রিকার কোনো দেশই এই জুলুমবাজির ঊর্ধ্বে ছিল না। অনেক দেশেই রাজা-রানীকে পূজা না করার অপরাধে মুসলমানদের প্রাণদণ্ড হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, পুত্রসন্তান হত্যা করে নারীদের জীবিত রেখে ‘ব্যবহার’ করা হয়েছে। এসব সম্প্রদায়ের নাম ধরে ধরে দেবদেবীর উল্লেখ করা যেত যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা না থাকত। ভালো করে চোখ খুলে দেখলেই পরিষ্কার হবে যে, ওইসব দেবদেবীর নামের সাথে আল্লাহ্র ৯৯ নামের কোনো মিল নেই। গ্রিক মিথোলজি, ভারত-পুরাণ, মিসরীয় পুরাণ, মেসোপটেমীয় পুরাণ, নর্স-মিথোলজি, রোমান মিথোলজি বা সিরীয় মিথোলজি ঘেঁটে কথিত কোনো দেবদেবীর নামের সাথে আল্লাহ্র ৯৯ নামের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। চৌধুরী সাহেব কি অ্যাডপশনতত্ত্ব আবিষ্কারের আগে এসব মিথলোজির ওপর একটু-আধটু পড়াশোনা করে নিলে ভালো হতো না? একটি নদী, একটি পাহাড় অথবা একটি বড় গাছের পূজায় যারা লিপ্ত হতে পারে, আল্লাহ্র নামের সাথে তাদের পরিচয় হবে কিভাবে? সাপ, বিড়াল, গরু, শূকর, শকুন, কুমির, কুর্ম্ম, লিঙ্গ, যোনিÑ মুশরিকদের এসব আরাধ্য দেবতার সাথে আল্লাহ্র নামের সম্পর্ক কী? এমন সব জাতির কাছ থেকে ইসলামের ধার নেয়ার মতো কী থাকতে পারে?
সুমেরীয় মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’ গ্রিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডেসি’, রোমান মহাকাব্য ‘ঈনিড’, ভারতীয় মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ আর ‘মহাভারত’ এবং বাংলার মঙ্গল কাব্যগুলো মানুষের পৃথিবী থেকে কোনোক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গেলে শতকরা ৯৯ ভাগ দেবদেবীর নাম-নিশানা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কাব্য-মহাকাব্যের মাঝেই ওদের সৃষ্টি, ওখানেই ওদের বিলয়। আল্লাহ্র নামের সাথে ওদের নাম মিলবে কী করে ? আল্লাহ্ কি এতই অক্ষম যে, নিজের নামের পবিত্রতা কবিদের মর্জির ওপর ছেড়ে দেবেন? আল্লাহ্ মানুষের মনের নিয়ন্তা। দেবদেবী সৃষ্টির সময় আল্লাহ্র নাম ব্যবহার করার মানসিকতা কবিদের কোনোকালেই হয়নি। ‘গিলগামেশে’র রচয়িতার মতো দু’একজন কবি চেষ্টা অবশ্য করেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি, আল্লাহ্র কোনো নামই তাদের হাতে ঠিকমতো আসেনি। এলাই, এলি, এনলিলÑ এ জাতীয় নামাদি গিলগামেশে ব্যবহৃত হয়েছে, ওসব দিয়ে ইউরোপের মহাপণ্ডিতদের কেউ কেউ ‘আল্লাহ্’ শব্দটি নির্দেশ করার খামাখা চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু সঠিক নামটি সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে মুশরিক কবিরা কখনো পারেননি। দেবদেবীর নামের সাথে আল্লাহ্র নাম মিলবে কিভাবে? পৃথিবীর বেশির ভাগ পূজারির আরাধ্য দেবী; দেবতা নয়, দেবী। সে ক্ষেত্রে আল্লাহ্র নামের সাথে তাদের নামের মিল আসবে কোত্থেকে, তার সব নামই তো পুরুষবাচক? আরব উপদ্বীপের অধিবাসীরা এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস করলেও ফেরেশতাদের আল্লাহ্র কন্যাজ্ঞানে তাদের পূজায় লিপ্ত হয়েছে। সেখানেও আল্লাহ্র শিফাতি নামে কোনো সংযোগ ঘটেনি। একটা বিষয় ভুললে চলবে না, পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি কখনো ছিল না, এখনো নেই, যারা আল্লাহ্কে দেবতার সাথে একাকার করে ফেলেছে। সব জাতিই আল্লাহ্র একত্বে স্বীকার করে, সাথে কিছু সুযোগ-সুবিধা হাসিলের আশায় কিছু দেবদেবীর পূজা করে। দেবদেবী যার যার নিজস্ব, কিন্তু স্রষ্টা সবার এক ও অদ্বিতীয়। এমনকি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর পূজারিরাও স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে ‘একমে বা দ্বিতীয়ম’ হিসেবে, ওখানেও স্রষ্টাকে তারা বিভিন্ন নামে ডাকে, কিন্তু স্রষ্টার কোনো নামের অনুকূলে তারা কোনো দেবমূর্তি বানিয়েছে এমন নজির আছে বলে মনে হয় না। স্বয়ং স্রষ্টাকে কেউ কখনো দেবতার পর্যায়ে নামিয়ে আনেনি; না, বিশ্বের কোনো জাতিই এ অপকর্মটি করেনি। কারণ বিশ্বের সবাই স্রষ্টাকে নিরাকার, নিরঞ্জন এবং সর্বত্র বিরাজমান বলে জানে ও মানে। কী করে স্রষ্টার নামের সাথে দেবতার নাম মিলবে? যেকোনো জাতির পুরাণাদি ঘাঁটলেই পরিষ্কার হবে যে, দেবতারা কেউ নিরাকার নয়, নিরঞ্জনও নয়, সর্বত্র বিরাজমানও নয় এবং কোনো দেবতাকেই কোনো জাতি স্রষ্টার সমান মর্যাদা দেয়নি। প্রত্যেক দেবতার জন্য তারা একটা নির্দিষ্ট বিষয় ঠিক করে দিয়েছে, স্রষ্টার মতো সব বিষয়ের ওপর কর্তৃত্ব তারা কাউকেই দেয়নি। মুসলমানরা এই স্রষ্টারই ইবাদত করে, কোনো দেবদেবীর ইবাদত তারা করে না, দেবদেবী আছে বলে স্বীকারও করে না, যদিও জিন ও ফেরেশেতায় তারা বিশ্বাসী। স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলার বা লেখার আগে এসব তথ্য জেনে নেয়া ভালো ছিল। ধর্ম সম্পর্কে কিছু বলা বা লেখার ইচ্ছা থাকলে আগে ধর্মকে জানতে হবে।
‘আমি তো মুক্তচিন্তা করছি’Ñ এই অথর্ব অজুহাতে মিথ্যাচারের অধিকার কারো জন্মায় না। মুক্তচিন্তার অর্থ সত্যের অনুসন্ধান, মিথ্যাচার নয়। টি পি হিউয়েজের মতো কোনো কোনো ইংরেজ লেখক ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসে অনেক আজগুবি কথা লিখেছেন, যার সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। রাজনৈতিকভাবে ইংরেজ শাসনমুক্ত দেশের নাগরিকেরা যদি এখনো নিজেদের মগজগুলোকে ইংরেজি ভাষাভাষী লেখকদের কলোনির মতো ব্যবহার করেন, তাহলে তা অবশ্যই দুঃখজনক। ওরা যা বলে তার সব সত্য নয়, সব অকাট্য বলে মেনে নেয়ারও কোনো কারণ নেই। উপায়ও নেই; কারণ সত্য তো সামনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে হাসছে, আমাদের লেখকদের বোকামিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু চৌধুরী সাহেবরা কি এসব দেখেন? মনে হয় না।
মোহাম্মদ মফিদুল ইসলাম
তসলিমা নাসরীন তার নারীর কোন দেশ নাই বইটির এক জায়গায় আমাদের খবর দিয়েছেন যে, ইসলামি শরিয়া মতে ধর্ষিতা নারীটি নাকি ধর্ষকের স্ত্রী হয়ে যায়, যাতে ধর্ষকের ... পূজাটা ভালো করে হয়। কোথায় যেন একটি ছোট ছেলে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল। ছেলেটি জানে যে, ইসলামি শরিয়ায় এমন বিধান নেই, ওখানে বরং ধর্ষকের শাস্তি অপমানজনক মৃত্যুদণ্ড। বোঝাই যাচ্ছে যে, ওই শিশু ছেলেটার সমান জ্ঞানও তসলিমার নেই। আপামণির জ্ঞানের চাবুক খেয়ে অবশ্য আমাদের মিডিয়াজগৎ বেহুঁশ। কোনো কোনো পত্রিকা তার আর্টিকেল ছাপতে পারলে জাতে উঠে যেতে পারবে বলে এখনো মনে করছে।
কয়েক দিন আগে প্রচণ্ড কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আবার আল্লাহ্র ৯৯ শেফাতি নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে মুশরিকদের দেবদেবীর নামকে আশ্রয় করেছেন। আবার সেই হাততালি, আবার সেই হাসি। ছেলেটিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সে বুঝে ফেলেছে যে, চৌধুরী সাহেব মাশরেক হতে মাগরেব পর্যন্ত বিস্তৃত এই ভূ-পৃষ্ঠের কোনো অঞ্চলের দেবদেবী সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। ইসলামের কোনো ব্যাপারে যে সাহেব ধারণা রাখেন না সেটা, তার কাছে আরো বেশি পরিষ্কার। পৃথিবীর কোনো এলাকার কোনো দেবদেবীর নামের সাথেই আল্লাহ্র ৯৯ নামের কোনো সাজুয্য আসলে নেই, ছিল না কখনো। যদি থাকেও তাহলে প্রশ্ন উঠবে যে, আসলে কে কারটা অ্যাডপ্ট করেছে? ইসলাম ওদেরটা অ্যাডপ্ট করেছে নাকি ওরা ইসলামেরটা। অথবা কোনো পক্ষে অ্যাডপ্ট করার কোনো প্রয়োজন আদৌ ছিল কি না! ইসলামের ইতিহাস যার জানা আছে তিনিই জানেন যে, সবচেয়ে পুরাতন ধর্ম ইসলাম, যা হজরত আদম আ:-এরও ধর্ম।
অন্যান্য ধর্ম ইসলামের পরে সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই অ্যাডপশনতত্ত্ব ইসলামের বেলায় চলবে না। যারা হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর আবির্ভাবের পরে ইসলামের শুরু হয়েছে বলে মনে করেন, তাদের জানা থাকা উচিত যে, হজরত মুহাম্মাদ সা: ইসলামের শেষ নবী এবং আল-কুরআন ইসলামের শেষ গ্রন্থ। অর্থাৎ শেষটাই প্রথম নয়। ইসলামের কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, যুদ্ধ, হারাম, হালাল ইত্যাদি আগে থেকেই ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামান্য যোগ-বিয়োগ হয়েছে মাত্র, বিশেষ কোনো পরিবর্তন তাতে আসেনি। পরিবর্তনবাদীরা বারবার পরিবর্তন করে নিত্যনতুন ধর্মের আবিষ্কার করার কারণে পৃথিবীতে প্রায় হাজার তিনেক সম্প্রদায় ছিল বা আছে। এই দুনিয়ায় এমন কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠী নেই যাদের মাঝে আল্লাহ্ পাক কখনো কোনো নবী-রাসূল বা পথপ্রদর্শক পাঠাননি। অনেক সম্প্রদায়ই তাদের নবী-রাসূল বা বুজুর্গ ব্যক্তিদের প্রতি অতিরিক্ত ভক্তিশ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে তাদের তিরোধানের বা মৃত্যুর পর মূর্তি গড়ে পূজায় লিপ্ত হয়েছে। ওইসব সম্প্রদায়ের কাছে তারা আর নবী-রাসূল থাকেননি, হয়ে গেছেন দেবতা। পৃথিবীতে প্রথম পূজা হয়েছে মেহলাইলের, যিনি ছিলেন হজরত আদম আ:-এর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ, একজন বুজুর্গ ইসলাম প্রচারক। দ্বিতীয় পূজা হয়েছে হজরত ইদ্রিস আ:-এর, যিনি এখনো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পূজিত হচ্ছেন, স্বর্গের দেবরাজ বিবেচনায়। মূর্তি সংহারী হজরত ইবরাহিম আ:-এরও মূর্তি বসিয়েছিল মুশরিকরা, খোদ কাবা শরিফে। মূর্তিপূজকরা চিরকালই এমনি লোমহর্ষক কাণ্ডকীর্তি ঘটিয়েছে, ধর্মের দোহাই দিয়েই। ওই সব কুপরিবর্তনের কারণেই ইসলামকে বারবার ফিরে আসতে হয়েছে, নতুন রূপে নয়, একই রূপে, অতি পুরাতন রূপে। আল্লাহ্ পাক বারবার পরিবর্তিত গ্রন্থগুলো বাতিল করেছেন, ওগুলোর ভাষাও বিলুপ্ত করেছেন, নতুন ভাষায় নতুন গ্রন্থ নাজিল করে ইসলামকে বারবার পুনরুজ্জীবিত করেছেন। এটাই ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস।
মানুষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, দুনিয়ার অনেক জাতি আবার তাদের রাজা-রানীকে দেবদেবী হিসেবে পূজা করেছে, আজো করে। এসব রাজা-রানী নিজেদের কখনো সূর্যের পুত্র-কন্যা, কখনো চন্দ্রের পুত্র-কন্যা, কখনো পাহাড়-পর্বত বা নদ-নদীর সন্তান বলে দাবি করেছে এবং মানুষের পূজা আদায় করেছে, ভোগ-সম্ভোগ হাসিল করেছে। নিজেদের অমর-অজ্বর দাবি করে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, অস্থি-পঞ্জর ধুলায় মিশে গেছে, কিন্তু অতিভক্ত পূজারির কাছে তারা আজো দেবতাই রয়ে গেছেন। এশিয়া, ইউরোপ বা আফ্রিকার কোনো দেশই এই জুলুমবাজির ঊর্ধ্বে ছিল না। অনেক দেশেই রাজা-রানীকে পূজা না করার অপরাধে মুসলমানদের প্রাণদণ্ড হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, পুত্রসন্তান হত্যা করে নারীদের জীবিত রেখে ‘ব্যবহার’ করা হয়েছে। এসব সম্প্রদায়ের নাম ধরে ধরে দেবদেবীর উল্লেখ করা যেত যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা না থাকত। ভালো করে চোখ খুলে দেখলেই পরিষ্কার হবে যে, ওইসব দেবদেবীর নামের সাথে আল্লাহ্র ৯৯ নামের কোনো মিল নেই। গ্রিক মিথোলজি, ভারত-পুরাণ, মিসরীয় পুরাণ, মেসোপটেমীয় পুরাণ, নর্স-মিথোলজি, রোমান মিথোলজি বা সিরীয় মিথোলজি ঘেঁটে কথিত কোনো দেবদেবীর নামের সাথে আল্লাহ্র ৯৯ নামের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। চৌধুরী সাহেব কি অ্যাডপশনতত্ত্ব আবিষ্কারের আগে এসব মিথলোজির ওপর একটু-আধটু পড়াশোনা করে নিলে ভালো হতো না? একটি নদী, একটি পাহাড় অথবা একটি বড় গাছের পূজায় যারা লিপ্ত হতে পারে, আল্লাহ্র নামের সাথে তাদের পরিচয় হবে কিভাবে? সাপ, বিড়াল, গরু, শূকর, শকুন, কুমির, কুর্ম্ম, লিঙ্গ, যোনিÑ মুশরিকদের এসব আরাধ্য দেবতার সাথে আল্লাহ্র নামের সম্পর্ক কী? এমন সব জাতির কাছ থেকে ইসলামের ধার নেয়ার মতো কী থাকতে পারে?
সুমেরীয় মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’ গ্রিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডেসি’, রোমান মহাকাব্য ‘ঈনিড’, ভারতীয় মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ আর ‘মহাভারত’ এবং বাংলার মঙ্গল কাব্যগুলো মানুষের পৃথিবী থেকে কোনোক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গেলে শতকরা ৯৯ ভাগ দেবদেবীর নাম-নিশানা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কাব্য-মহাকাব্যের মাঝেই ওদের সৃষ্টি, ওখানেই ওদের বিলয়। আল্লাহ্র নামের সাথে ওদের নাম মিলবে কী করে ? আল্লাহ্ কি এতই অক্ষম যে, নিজের নামের পবিত্রতা কবিদের মর্জির ওপর ছেড়ে দেবেন? আল্লাহ্ মানুষের মনের নিয়ন্তা। দেবদেবী সৃষ্টির সময় আল্লাহ্র নাম ব্যবহার করার মানসিকতা কবিদের কোনোকালেই হয়নি। ‘গিলগামেশে’র রচয়িতার মতো দু’একজন কবি চেষ্টা অবশ্য করেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি, আল্লাহ্র কোনো নামই তাদের হাতে ঠিকমতো আসেনি। এলাই, এলি, এনলিলÑ এ জাতীয় নামাদি গিলগামেশে ব্যবহৃত হয়েছে, ওসব দিয়ে ইউরোপের মহাপণ্ডিতদের কেউ কেউ ‘আল্লাহ্’ শব্দটি নির্দেশ করার খামাখা চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু সঠিক নামটি সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে মুশরিক কবিরা কখনো পারেননি। দেবদেবীর নামের সাথে আল্লাহ্র নাম মিলবে কিভাবে? পৃথিবীর বেশির ভাগ পূজারির আরাধ্য দেবী; দেবতা নয়, দেবী। সে ক্ষেত্রে আল্লাহ্র নামের সাথে তাদের নামের মিল আসবে কোত্থেকে, তার সব নামই তো পুরুষবাচক? আরব উপদ্বীপের অধিবাসীরা এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস করলেও ফেরেশতাদের আল্লাহ্র কন্যাজ্ঞানে তাদের পূজায় লিপ্ত হয়েছে। সেখানেও আল্লাহ্র শিফাতি নামে কোনো সংযোগ ঘটেনি। একটা বিষয় ভুললে চলবে না, পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি কখনো ছিল না, এখনো নেই, যারা আল্লাহ্কে দেবতার সাথে একাকার করে ফেলেছে। সব জাতিই আল্লাহ্র একত্বে স্বীকার করে, সাথে কিছু সুযোগ-সুবিধা হাসিলের আশায় কিছু দেবদেবীর পূজা করে। দেবদেবী যার যার নিজস্ব, কিন্তু স্রষ্টা সবার এক ও অদ্বিতীয়। এমনকি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর পূজারিরাও স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে ‘একমে বা দ্বিতীয়ম’ হিসেবে, ওখানেও স্রষ্টাকে তারা বিভিন্ন নামে ডাকে, কিন্তু স্রষ্টার কোনো নামের অনুকূলে তারা কোনো দেবমূর্তি বানিয়েছে এমন নজির আছে বলে মনে হয় না। স্বয়ং স্রষ্টাকে কেউ কখনো দেবতার পর্যায়ে নামিয়ে আনেনি; না, বিশ্বের কোনো জাতিই এ অপকর্মটি করেনি। কারণ বিশ্বের সবাই স্রষ্টাকে নিরাকার, নিরঞ্জন এবং সর্বত্র বিরাজমান বলে জানে ও মানে। কী করে স্রষ্টার নামের সাথে দেবতার নাম মিলবে? যেকোনো জাতির পুরাণাদি ঘাঁটলেই পরিষ্কার হবে যে, দেবতারা কেউ নিরাকার নয়, নিরঞ্জনও নয়, সর্বত্র বিরাজমানও নয় এবং কোনো দেবতাকেই কোনো জাতি স্রষ্টার সমান মর্যাদা দেয়নি। প্রত্যেক দেবতার জন্য তারা একটা নির্দিষ্ট বিষয় ঠিক করে দিয়েছে, স্রষ্টার মতো সব বিষয়ের ওপর কর্তৃত্ব তারা কাউকেই দেয়নি। মুসলমানরা এই স্রষ্টারই ইবাদত করে, কোনো দেবদেবীর ইবাদত তারা করে না, দেবদেবী আছে বলে স্বীকারও করে না, যদিও জিন ও ফেরেশেতায় তারা বিশ্বাসী। স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলার বা লেখার আগে এসব তথ্য জেনে নেয়া ভালো ছিল। ধর্ম সম্পর্কে কিছু বলা বা লেখার ইচ্ছা থাকলে আগে ধর্মকে জানতে হবে।
‘আমি তো মুক্তচিন্তা করছি’Ñ এই অথর্ব অজুহাতে মিথ্যাচারের অধিকার কারো জন্মায় না। মুক্তচিন্তার অর্থ সত্যের অনুসন্ধান, মিথ্যাচার নয়। টি পি হিউয়েজের মতো কোনো কোনো ইংরেজ লেখক ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসে অনেক আজগুবি কথা লিখেছেন, যার সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। রাজনৈতিকভাবে ইংরেজ শাসনমুক্ত দেশের নাগরিকেরা যদি এখনো নিজেদের মগজগুলোকে ইংরেজি ভাষাভাষী লেখকদের কলোনির মতো ব্যবহার করেন, তাহলে তা অবশ্যই দুঃখজনক। ওরা যা বলে তার সব সত্য নয়, সব অকাট্য বলে মেনে নেয়ারও কোনো কারণ নেই। উপায়ও নেই; কারণ সত্য তো সামনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে হাসছে, আমাদের লেখকদের বোকামিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু চৌধুরী সাহেবরা কি এসব দেখেন? মনে হয় না।
মোহাম্মদ মফিদুল ইসলাম
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন