এক তরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারের অন্যতম মন্ত্রী ও শাসক আওয়ামী লীগ দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় থেকে আকস্মিকভাবে সরিয়ে দেয়ার ঘটনায় মিডিয়া এবং রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন হয়েছে। তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হলো এমনই এক সময়, যখন তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জ সফরে ছিলেন। এমনিতেই তিনি এলাকায় খুব একটা যাওয়া-আসা করেন না। আর অবশেষে যেদিন এলেন, সেদিনই মন্ত্রণালয় হারালেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এটা অজানা থাকার কথা নয় যে, তিনি এলাকায় আছেন। এমন অবস্থায় তাঁকে মন্ত্রণালয়হীন করে নির্বাচনী এলাকার জনগণকে কি বার্তা দেয়া হয়েছে? সেটাও দলের উচ্চ মহলের অজানা থাকার কথা নয়; বরং ঘটনাটি সব কিছু জেনে-শুনেই করা হয়েছে। এলাকা ও মন্ত্রণালয়ে অতি অল্প সময় ব্যয় করার ব্যাপারেও দলের অনেকে নানা কথা বলেছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সভায়ও তাঁর অনুপস্থিতি থাকার কথা নানা মহল থেকে উচ্চারিত হয়েছে। যুগান্তর পত্রিকায় রিপোর্ট বের হয়েছে, ‘সব অপকর্মের হোতা এপিএস সেলিম খান’। অনেকে আবার সোহেল তাজের প্রসঙ্গ টেনে মুজিব-তাজউদ্দিন দ্বন্দ্বের নিরিখে সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোর বিষয় নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন। মন্ত্রণালয় হারানোর বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হাজির করেছেন কেউ কেউ। মিডিয়ায় অনেকে এমনও বলেছেন, ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপোস না করায় তাঁকে পদ হারাতে হয়েছে।’ সৈয়দ আশরাফ নিজে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলে বার্তা সংস্থা বিডিনিউজ২৪-এ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমার রক্ত বেঈমানী করে না।’ তবে তাঁর এই বক্তব্যেই প্রসঙ্গের শেষ হয়নি; তাঁর মন্ত্রণালয় হারানোর নেপথ্যে কার্যকর সকল কথা ও কারণ জনগণ পুরোপুরি জানতে পারে নি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এমন একটি রাজনৈতিক ঘটনার পরম্পরায় বরং ‘অপকর্ম’, ‘দুর্নীতি’ ও ‘বেঈমানী’ শব্দ তিনটি ঘটনার প্রসঙ্গে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার ও প্রাধান্য পেয়েছে। উল্লেখ্য, সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বর্তেছে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের উপর। তিনি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও সামলাবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় এবং ফরিদপুরের লোক। বর্তমান সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্র বৃহত্তর ফরিদপুর/গোপালগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ/কিশোরগঞ্জের মধ্যে আবর্তিত রয়েছে। সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোজনিত ক্ষমতার রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির মেরুকরণেও নানামুখী প্রভাব পড়বে।
ঘটনার অন্য আরেকটি মাত্রাও বিবেচনা যোগ্য। যেমন, সাধারণত কোনো এলাকায় কোনো নেতা মন্ত্রীত্ব পেলে বা হারালে এলাকার জনগণ উল্লাস বা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আনন্দ মিছিল বা প্রতিবাদ মিছিল হয়। সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোয় দলের স্থানীয় পর্যায় থেকে সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য কোনো ক্ষোভ বা প্রতিবাদের খবর প্রকাশিত হয় নি, যদিও তিনি নিজে সে সময় এলাকায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘গুজবে কান না দেওয়াই ভাল।’ কিন্তু পরে যখন গুজব সত্যে পরিণত হলো, তখনো স্থানীয় পরিস্থিতির কোনো হেরফের হয় নি। ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় পর্যায়ের নানা নেতা ও কর্মী নিজস্ব মত দিয়েছেন। চাপা গুঞ্জন করেছেন। তবে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি বক্তব্য আমাদের নজরে এসেছে। সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোর দিনই করিমগঞ্জে আয়োজিত বঙ্গবন্ধু পরিষদের এক অনুষ্ঠানে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট শাহ আজিজুল হক প্রধান অতিথির বক্তব্যে ‘যে কোন পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত না হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গভীর আস্থা রাখার ও তাঁর হাতকে শক্তিশালী করার’ আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, ‘দলকে শক্তিশালী করুন, সম্মেলন করে কাউন্সিলরগণের মতামতের ভিত্তিতে সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও যুগের উপযোগী নেতৃত্ব নির্বাচিত করুন। জনগণ যাকে চায়, তাদেরকে আওয়ামী রাজনীতিতে এগিয়ে আনুন।’ উল্লেখ্য, দলের সাধারণ সম্পাদকের নিজের জেলায় বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয় নি। হাল নাগাদ কমিটিও করা সম্ভব হয় নি। অনেক ভারপ্রাপ্ত দিয়ে দলের কাজ চালানো হচ্ছে। এবং দলে সর্বজনগ্রাহ্য, নতুন, তরুণ, উদীয়মান, বিজ্ঞানমনস্ক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো যায় নি।
সরকার বা প্রশাসনে মন্ত্রী বা আমলার পদ বদল, হারানো বা প্রাপ্তি অতি সাধারণ ঘটনা। কেবিনেট সিস্টেমের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় কেউ মন্ত্রী থাকেন বা বিদায় নেন। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। সরকারের প্রধান যাকে দিয়ে কাজ হবে মনে করবেন, তাকেই রাখতে পারেন। যাকে দিয়ে কাজ হবে না মনে করেন, তাকে সরাতে পারেন। কারণ চূড়ান্তভাবে সফলতা বা ব্যর্থতার দায়-ভার বহন করতে হয় সরকারের প্রধান ব্যক্তি তথা প্রধানমন্ত্রীকে। অতএব, সৈয়দ আশরাফকে রাখা না রাখা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অতীতেও মন্ত্রীত্ব পাওয়া বা হারানো বহু ঘটনা হয়েছে। কিন্তু সেসব নিয়ে এতো নাটকীয়তা, ফিসফিসানি, রহস্যময়তা বা পানি ঘোলা হয় নি, যতটা হয়েছে বা হচ্ছে সৈয়দ আশরাফের ক্ষেত্রে। মনে হচ্ছে, দলের ভেতরে ও বাইরে তাঁর পক্ষ ও বিপক্ষে দুটি ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো একত্রে করা হলে, সাধারণ পাঠকের পক্ষে এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, ঘটনার পেছনে অনেক অব্যক্ত কথা আছে। মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত খবরগুলো পড়ে যে কোনো পাঠকের মনে হতেই পারে, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’
বস্তুত সৈয়দ আশরাফ এমনই এক সময় মন্ত্রণালয় হারালেন যখন দৃশ্যত দেশে বিরোধী দলীয় কোনো আন্দোলন বা চাপই নেই। সরকার একদলীয়ভাবে বিনা প্রতিবাদ ও বাধায় সব কিছু করতে পারছে। ফলে সৈয়দ আশরাফ সংক্রান্ত বিষয়াবলি যে বাইরের নয়, দলের ভেতরের নিজস্ব সঙ্কট, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর মাধ্যমে একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, সরকার যতই বিরোধী দল নিয়ন্ত্রণ করুক বা প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা রাখুক, নিজের ভেতরের সঙ্কট দূর করতে পারে নি। আর আওয়ামী লীগের মতো বড় ও শক্তিশালী দলের জন্য বাইরের সঙ্কটের চেয়ে ভেতরের সঙ্কট অনেক বেশি ক্ষতিকর ও ভয়াবহ বলে ইতিহাস জানাচ্ছে। (এ প্রসঙ্গে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ শীর্ষক প্রচলিত প্রবাদ বাক্যটি স্মর্তব্য।) কেননা, যতবারই আওয়ামী লীগের পতন বা বিপর্যয় হয়েছে, ততবারই সেটা হয়েছে ভেতরের সঙ্কট, ষড়যন্ত্র ও সমস্যার কারণে। অতএব এসব সঙ্কট আওয়ামী লীগেরই বিপদ ডেকে আনবে ভেতর থেকে। আর আওয়ামী লীগকেই সে সবের সমাধান বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা যেভাবে অবাধে বিরোধী দল, বিএনপি, জামায়াতকে নসিয়ত করেন, সেটা মনে হয় এখন বন্ধ হবে। অপরের সঙ্কট মোচনে উমেদারী না করে এখন তাদেরকে নিজস্ব সঙ্কট-সমস্যার তালাশ করতে হবে এবং সেটা সমাধানের পথ বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের জন্য সম্ভবত ‘নিজের চরকায় তেল’ দেয়ার সময় এসেছে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, বর্তমান আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আছে একটি অতি বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন নামের প্রহসনের মাধ্যমে। দেশে-বিদেশে এখনো এ ব্যাপারে কথা আছে; আপত্তি আছে। দেশে ও বিদেশে বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য আওয়ামী লীগের সামনে আগে বা পরে একটি অবাধ নির্বাচনের বিকল্প নেই। সেটা করতে হলে দলকে ভেতর ও বাইরে থেকে সঙ্কট মুক্ত করতে হবে। যোগ্য নেতাদের সামনে আনতে হবে। কাউন্সিল করতে হবে। গণতান্ত্রিক গতিশীলতা বাড়াতে হবে। বলা বাহুল্য, ক্ষমতায় বসে দলের এসব কাজ সম্পন্ন করা হয় নি। খোদ সাধারণ সম্পাদকের জেলাতেই কাউন্সিল হতে পারে নি বছরের পর বছর। এর ফলে মাঠে-ময়দানে তৎপর নতুন, উদীয়মান নেতারা কোনো জায়গা পাচ্ছেন না। এতে সাংগঠনিক গতিশীলতার বদলে এসেছে হতাশা ও কোন্দল। এসব বিষয়ে ভালো-মন্দের কিছু দায়-দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের উপরও বর্তায়। এখন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না থাকায় তাঁকে হয়ত পূর্ণরূপে সংগঠনের দায়িত্ব দেয়া হবে। তাহলে বুঝতে হবে, দলের সাংগঠনিক দায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনেই তাঁকে মন্ত্রণালয় থেকে সরানো হয়েছে। কিন্তু যদি সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা পূর্বের মতোই স্থবির থাকে, তাহলে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ ঘটবে। বুঝতে হবে বিষয়টির শিকড় অনেক গভীরে। হয়ত সেটা বিস্তারিতভাবে জানতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করারও দরকার হবে। তবে সামগ্রিক বিশ্লেষণে সৈয়দ আশরাফকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরের একটি সুপ্ত সঙ্কট প্রকাশ্যে এসেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এর বহুমাত্রিক প্রভাব দলের ভেতরে ও বাইরে যেমন পড়বে, তেমনি জাতীয় ও স্থানীয় স্তরের রাজনীতিতেও পড়বে। আওয়ামী লীগ এখন এই বিষয়টিকে ঘরে-বাইরে কিভাবে সামাল দেয়, সেটাই দেখার বিষয়।
মিয়া লুৎফে আলি মহব্বত
ঘটনার অন্য আরেকটি মাত্রাও বিবেচনা যোগ্য। যেমন, সাধারণত কোনো এলাকায় কোনো নেতা মন্ত্রীত্ব পেলে বা হারালে এলাকার জনগণ উল্লাস বা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আনন্দ মিছিল বা প্রতিবাদ মিছিল হয়। সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোয় দলের স্থানীয় পর্যায় থেকে সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য কোনো ক্ষোভ বা প্রতিবাদের খবর প্রকাশিত হয় নি, যদিও তিনি নিজে সে সময় এলাকায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘গুজবে কান না দেওয়াই ভাল।’ কিন্তু পরে যখন গুজব সত্যে পরিণত হলো, তখনো স্থানীয় পরিস্থিতির কোনো হেরফের হয় নি। ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় পর্যায়ের নানা নেতা ও কর্মী নিজস্ব মত দিয়েছেন। চাপা গুঞ্জন করেছেন। তবে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি বক্তব্য আমাদের নজরে এসেছে। সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোর দিনই করিমগঞ্জে আয়োজিত বঙ্গবন্ধু পরিষদের এক অনুষ্ঠানে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট শাহ আজিজুল হক প্রধান অতিথির বক্তব্যে ‘যে কোন পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত না হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গভীর আস্থা রাখার ও তাঁর হাতকে শক্তিশালী করার’ আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, ‘দলকে শক্তিশালী করুন, সম্মেলন করে কাউন্সিলরগণের মতামতের ভিত্তিতে সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও যুগের উপযোগী নেতৃত্ব নির্বাচিত করুন। জনগণ যাকে চায়, তাদেরকে আওয়ামী রাজনীতিতে এগিয়ে আনুন।’ উল্লেখ্য, দলের সাধারণ সম্পাদকের নিজের জেলায় বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয় নি। হাল নাগাদ কমিটিও করা সম্ভব হয় নি। অনেক ভারপ্রাপ্ত দিয়ে দলের কাজ চালানো হচ্ছে। এবং দলে সর্বজনগ্রাহ্য, নতুন, তরুণ, উদীয়মান, বিজ্ঞানমনস্ক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো যায় নি।
সরকার বা প্রশাসনে মন্ত্রী বা আমলার পদ বদল, হারানো বা প্রাপ্তি অতি সাধারণ ঘটনা। কেবিনেট সিস্টেমের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় কেউ মন্ত্রী থাকেন বা বিদায় নেন। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। সরকারের প্রধান যাকে দিয়ে কাজ হবে মনে করবেন, তাকেই রাখতে পারেন। যাকে দিয়ে কাজ হবে না মনে করেন, তাকে সরাতে পারেন। কারণ চূড়ান্তভাবে সফলতা বা ব্যর্থতার দায়-ভার বহন করতে হয় সরকারের প্রধান ব্যক্তি তথা প্রধানমন্ত্রীকে। অতএব, সৈয়দ আশরাফকে রাখা না রাখা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অতীতেও মন্ত্রীত্ব পাওয়া বা হারানো বহু ঘটনা হয়েছে। কিন্তু সেসব নিয়ে এতো নাটকীয়তা, ফিসফিসানি, রহস্যময়তা বা পানি ঘোলা হয় নি, যতটা হয়েছে বা হচ্ছে সৈয়দ আশরাফের ক্ষেত্রে। মনে হচ্ছে, দলের ভেতরে ও বাইরে তাঁর পক্ষ ও বিপক্ষে দুটি ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো একত্রে করা হলে, সাধারণ পাঠকের পক্ষে এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, ঘটনার পেছনে অনেক অব্যক্ত কথা আছে। মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত খবরগুলো পড়ে যে কোনো পাঠকের মনে হতেই পারে, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’
বস্তুত সৈয়দ আশরাফ এমনই এক সময় মন্ত্রণালয় হারালেন যখন দৃশ্যত দেশে বিরোধী দলীয় কোনো আন্দোলন বা চাপই নেই। সরকার একদলীয়ভাবে বিনা প্রতিবাদ ও বাধায় সব কিছু করতে পারছে। ফলে সৈয়দ আশরাফ সংক্রান্ত বিষয়াবলি যে বাইরের নয়, দলের ভেতরের নিজস্ব সঙ্কট, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর মাধ্যমে একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, সরকার যতই বিরোধী দল নিয়ন্ত্রণ করুক বা প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা রাখুক, নিজের ভেতরের সঙ্কট দূর করতে পারে নি। আর আওয়ামী লীগের মতো বড় ও শক্তিশালী দলের জন্য বাইরের সঙ্কটের চেয়ে ভেতরের সঙ্কট অনেক বেশি ক্ষতিকর ও ভয়াবহ বলে ইতিহাস জানাচ্ছে। (এ প্রসঙ্গে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ শীর্ষক প্রচলিত প্রবাদ বাক্যটি স্মর্তব্য।) কেননা, যতবারই আওয়ামী লীগের পতন বা বিপর্যয় হয়েছে, ততবারই সেটা হয়েছে ভেতরের সঙ্কট, ষড়যন্ত্র ও সমস্যার কারণে। অতএব এসব সঙ্কট আওয়ামী লীগেরই বিপদ ডেকে আনবে ভেতর থেকে। আর আওয়ামী লীগকেই সে সবের সমাধান বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা যেভাবে অবাধে বিরোধী দল, বিএনপি, জামায়াতকে নসিয়ত করেন, সেটা মনে হয় এখন বন্ধ হবে। অপরের সঙ্কট মোচনে উমেদারী না করে এখন তাদেরকে নিজস্ব সঙ্কট-সমস্যার তালাশ করতে হবে এবং সেটা সমাধানের পথ বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের জন্য সম্ভবত ‘নিজের চরকায় তেল’ দেয়ার সময় এসেছে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, বর্তমান আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আছে একটি অতি বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন নামের প্রহসনের মাধ্যমে। দেশে-বিদেশে এখনো এ ব্যাপারে কথা আছে; আপত্তি আছে। দেশে ও বিদেশে বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য আওয়ামী লীগের সামনে আগে বা পরে একটি অবাধ নির্বাচনের বিকল্প নেই। সেটা করতে হলে দলকে ভেতর ও বাইরে থেকে সঙ্কট মুক্ত করতে হবে। যোগ্য নেতাদের সামনে আনতে হবে। কাউন্সিল করতে হবে। গণতান্ত্রিক গতিশীলতা বাড়াতে হবে। বলা বাহুল্য, ক্ষমতায় বসে দলের এসব কাজ সম্পন্ন করা হয় নি। খোদ সাধারণ সম্পাদকের জেলাতেই কাউন্সিল হতে পারে নি বছরের পর বছর। এর ফলে মাঠে-ময়দানে তৎপর নতুন, উদীয়মান নেতারা কোনো জায়গা পাচ্ছেন না। এতে সাংগঠনিক গতিশীলতার বদলে এসেছে হতাশা ও কোন্দল। এসব বিষয়ে ভালো-মন্দের কিছু দায়-দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের উপরও বর্তায়। এখন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না থাকায় তাঁকে হয়ত পূর্ণরূপে সংগঠনের দায়িত্ব দেয়া হবে। তাহলে বুঝতে হবে, দলের সাংগঠনিক দায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনেই তাঁকে মন্ত্রণালয় থেকে সরানো হয়েছে। কিন্তু যদি সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা পূর্বের মতোই স্থবির থাকে, তাহলে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ ঘটবে। বুঝতে হবে বিষয়টির শিকড় অনেক গভীরে। হয়ত সেটা বিস্তারিতভাবে জানতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করারও দরকার হবে। তবে সামগ্রিক বিশ্লেষণে সৈয়দ আশরাফকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরের একটি সুপ্ত সঙ্কট প্রকাশ্যে এসেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এর বহুমাত্রিক প্রভাব দলের ভেতরে ও বাইরে যেমন পড়বে, তেমনি জাতীয় ও স্থানীয় স্তরের রাজনীতিতেও পড়বে। আওয়ামী লীগ এখন এই বিষয়টিকে ঘরে-বাইরে কিভাবে সামাল দেয়, সেটাই দেখার বিষয়।
মিয়া লুৎফে আলি মহব্বত
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন