নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে সে বিষয়ে গত ২৫ জুলাই বেগম খালেদা জিয়ার দেয়া প্রস্তাব নিয়ে এরই মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশের ভেতরে শুধু নয়, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও চলছে এই আলোচনা। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, ওই সরকারের ব্যাপারে একটি মাত্র শর্ত দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, সরকারকে ‘নিরপেক্ষ’ হতে হবে। সরকারের নাম ‘তত্ত্বাবধায়ক’ বা অন্য যা কিছুই হোক না কেন, খালেদা জিয়া এমন একটি সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন যে সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে। ২০ দলীয় জোটের নেত্রী একই সাথে আরো বলেছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে। এজন্যই তিনি নির্বাচনের সময় ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের দাবি জানিয়েছেন। স্মরণ করা দরকার, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক সম্ভাবনার কারণেই বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলনরত তৎকালীন ১৮ দলীয় জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ভোটারবিহীন ও একতরফা নির্বাচন বর্জন করেছিল এবং ভোট না দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। এর কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনার মাধ্যমে সংকটের শুরু করেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। বিরোধী দল প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করেছিল। তা সত্ত্বেও আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাড় দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং শেখ হাসিনা ওই সরকারের প্রধান হতে পারবেন না। জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ এবং গণচীনও সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছিল। এজন্য প্রধান দুটি দলকে সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছিল। অন্যদিকে সংলাপের নামে একের পর এক নাটক সাজিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করলেও তার পেছনের কূটিল ও নোংরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়ে পড়তে সময় লাগেনি। সর্বশেষ উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর প্রচেষ্টাকেও ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা।
এভাবে সব মিলিয়েই সরকারের পক্ষ থেকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল, সমঝোতার ধারেকাছে যাওয়ার পরিবর্তে একতরফা নির্বাচনের পথেই এগিয়ে যাবেন তারা। নির্বাচন কমিশনও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল। নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকটও তাই ঘনীভূত হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে পালিত অবরোধে অচল হয়ে পড়েছিল সারা দেশ। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের একদিন আগে অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত অবরোধ এবং নির্বাচন বাতিলের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনকে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার অন্তত ১২২ জনকে হত্যা করেছিল। দমন-নির্যাতন এবং হত্যা ও গ্রেফতারের অভিযান চালানোর পাশাপাশি সরকার বেগম খালেদা জিয়াকেও তার বাসভবনে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল। দলের নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন ওঠে না, পুলিশ এমনকি বিদেশি সাংবাদিকদের পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। খালেদা জিয়া নিজেও বাইরে আসতে পারেননি। ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ উপলক্ষে নয়া পল্টনস্থ বিএনপি অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে তাকে চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অসম্মানিত হতে হয়েছিল। বিএনপির সংসদীয় প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তারপরও নেত্রীকে বাইরে আসতে দেয়া হয়নি। এভাবে তাকে অবশ্য আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। ৩ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে বেগম খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট না দেয়ার এবং প্রহসনের নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৮ দলীয় জোট ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছিল। সে হরতালের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল দশম সংসদের নির্বাচন, যা গণতন্ত্রের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক অধ্যায় ও দৃষ্টান্তের সৃষ্টি করেছিল। ওই নির্বাচন পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। একটি মাত্র রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রের সরকারও প্রকাশ্যে একে গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়নি।
মূলত মাত্র সেদিনের এমন ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতেই বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ প্রস্তাব অত্যধিক গুরুত্ব অর্জন করেছে। দেশে-বিদেশে গণতন্ত্রকামী সকল মহলই তার এ প্রস্তাবকে ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় বলে আখ্যা দিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কথা অবশ্য আলাদা। কারণ, বেগম জিয়ার বক্তব্যের সবটুকু না শুনেই কিংবা অর্থ না বুঝেই ক্ষমতাসীনরা তার দাবি ও প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। ১৪ দলীয় আওয়ামী জোট তো বটেই, সরকার সমর্থক নাম সর্বস্ব ১০টি দলের জোটও একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা এর মধ্যে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের ‘পরাজয়’ও আবিষ্কার করে বসেছে! এক ধাপ এগিয়ে কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, সরকার পতনের আন্দোলনে লজ্জাকর ব্যর্থতার পর এতদিনে খালেদা জিয়া নাকি সংবিধানসম্মত পথে ফিরে এসেছেন! আর ফিরে যখন এসেছেনই তখন তার উচিত হবে নির্বাচনের জন্য ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা। কারণ জানাতে গিয়ে সংবিধানের দোহাই দিয়ে তারা আরো বলেছেন, দেশে কোনো আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায়নি, যাচ্ছেও না। উদাহরণ দেয়ার জন্য ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’র ২৮ জুলাই সংখ্যার সম্পাদকীয়র উল্লেখ করা যায়। ‘খালেদার নমনীয়তা অচলাবস্থা নিরসনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে দৈনিকটি এমন একাধিক মন্তব্য করেছে যেগুলোর কোনোটিই ক্ষমতাসীনদের জন্য উৎসাহজনক নয়। যেমন বাংলাদেশের চলমান সংকটের কারণ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে ‘দ্য হিন্দু’ লিখেছে, বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো বর্জন করায় গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি ‘এক ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতায়’ পরিণত হয়েছিল! পরবর্তীকালে সৃষ্ট সংকট ও সহিংসতার জন্যও দৈনিকটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অগণতান্ত্রিক অনমনীয়তাকে’ই দায়ী করেছে। বলেছে, প্রধান দুই দলের বৈরিতা ও অবিশ্বাসের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এমন এক অবস্থার মধ্যে যথেষ্ট ছাড় দিয়েছেন বলেই বেগম খালেদা জিয়ার নতুন প্রস্তাবকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে করেছে ‘দ্য হিন্দু’। বলেছে, খালেদা জিয়ার এই নমনীয়তা বাংলাদেশে বিদ্যমান সংকট ও অচলাবস্থা নিরসনের জন্য চমৎকার সুযোগের সৃষ্টি করেছে। ‘দ্য হিন্দু’র মতে শেখ হাসিনার সরকারের উচিত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অচলাবস্থার অবসান ঘটানো এবং নির্বাচনের আগে অধিক সমঝোতামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা। সরকার এবং বিরোধী দলের কার্যকর ঐকতান যে বাংলাদেশের মতো নবীন গণতন্ত্রের জন্য জরুরি সে কথাটাও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই উল্লেখ করেছে ‘দ্য হিন্দু’।
উদাহরণ হিসেবে ভারতের একটি মাত্র দৈনিকের সম্পাদকীয়র উদ্ধৃতি দেয়া হলেও বাস্তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন সকল দেশই একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। জাতিসংঘের রূপরেখাও এসেছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের পক্ষে। সে কারণেই ক্ষমতাসীনদের ব্যঙ্গাত্মক প্রতিক্রিয়া দেশে-বিদেশে কোনো সরকার বা মহলের সমর্থন পায়নি। কেউই এই প্রতিক্রিয়াকে গণতন্ত্রের জন্য শুভ মনে করেনি। সবাই বরং খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যের দিকটিকে প্রাধান্যে আনার পরামর্শ দিয়েছেন, যার মূল কথায় তিনি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করারই আহ্বান জানিয়েছেন। এজন্যই নির্বাচনকালীন সরকারের নাম প্রসঙ্গে ছাড় দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, নাম যা-ই হোক না কেন, ওই সরকারকে ‘নিরপেক্ষ’ হতে হবে। উল্লেখ্য, এবারই প্রথম নয়, এরও আগে ২০১৩ সালের অক্টোবরেও তিনি সরকারের নামের আগে তত্ত্বাবধায়ক না রাখার ব্যাপারে ছাড় দিয়েছিলেন। সেবার উপস্থাপিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখায় বেগম জিয়া বলেছিলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার মধ্য থেকে সরকারি দল পাঁচজনের এবং বিরোধী দল পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে। আর প্রধান উপদেষ্টা করা হবে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সম্মানিত একজন নাগরিককে। শুধু রূপরেখা পেশ করেই থেমে যাননি বেগম খালেদা জিয়া। সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়ে পরদিনই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সংসদেও তার সে রূপরেখা পেশ করা হয়েছিল। জাতীয় ঐক্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বেগম জিয়া সেবার বলেছিলেন, দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রথমে দরকার নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা এগিয়েছিলেন নিজেদের সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ‘সর্বদলীয়’ নামের এক বিচিত্র সরকার গঠন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দেশবাসীর পাশাপাশি বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে ‘সর্বদলীয়’ নাম দেয়া হলেও বাস্তবে সেটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারেরই সম্প্রসারিত সংস্করণ। উল্লেখ্য, নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবির পাশাপাশি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নটিকেও সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনে যাতে কারো সন্দেহ না থাকে সেটা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই তিনি ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চান। সে সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলেরও অংশ নেয়ার সুযোগ থাকবে। এজন্য বিরোধী দলের নেতার কাছে অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়ার কাছে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নাম পাঠানোর জন্য প্রস্তাব পাঠাবেন তিনি। তবে প্রধানমন্ত্রী জানাননি, পরিকল্পিত ওই ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রধান কে হবেন এবং কিভাবে তাকে বাছাই বা মনোননীত করা হবে। মন্ত্রিসভায় কোন মাপকাঠিতে কোন দলের কতজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং এতে বিরোধী দলকে সম্মানের সঙ্গে প্রতিনিধিত্বের কতটুকু সুযোগ দেয়া হবে এ সম্পর্কেও নীরব থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই সরকার কখন কিভাবে গঠন করা হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা থাকবে এবং সরকারের মেয়াদ কতদিন হবেÑ এসব বিষয়েও কোনো কথা পাওয়া যায়নি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে।
আপাতদৃষ্টিতে তখন মনে হয়েছিল, যেন প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছেন, প্রকাশ ঘটিয়েছেন সদিচ্ছারও। মনে হয়েছিল যেন সব দলকে নিয়ে সরকার গঠন ও নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী আসলেও উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে ভাষণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কিন্তু তেমন সদিচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ, রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণটিরই ধারেকাছে যাননি প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দল তখন আন্দোলন করছিল সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার দাবিতে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের নামের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে বলেছিলেন, যে কোনো নামেই গঠন করা হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে ‘নির্দলীয়’ হতে হবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ হাসিনাকে রাখা চলবে না। কিন্তু এ দুটি বিষয়েও ‘এক চুল’ পরিমাণ ছাড় দেননি প্রধানমন্ত্রী। তার পরিকল্পিত সরকারকে ‘সর্বদলীয়’ বলেছিলেন সত্য কিন্তু সে সরকারের মন্ত্রী হওয়ার জন্য এমনভাবেই বিরোধী দলের কাছে নাম চেয়েছিলেন যা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, সবই তার একার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। বড় কথা, প্রধানমন্ত্রী পদে তিনিই বহাল থাকবেন। অমন কোনো সরকারে বিরোধী দল যে অংশ নেবে না সে কথাটা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীও সুনির্দিষ্টভাবেই জানতেন। এজন্যই রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী আদৌ চান না যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলকে নিয়ে সত্যিই তেমন কোনো ‘সর্বদলীয়’ সরকার তাকে গঠন করতে হোক। একথাই বরং পরিষ্কার হয়েছিল, ‘সর্বদলীয়’ নামে যে সরকার তিনি গঠন করতে চাচ্ছেন সেটা আসলে হবে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারেরই অন্য রূপ- সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বসহ যার নেতৃত্বে থাকবেন শেখ হাাসিনা নিজেই। থেকেছিলেনও তিনিই।
অর্থাৎ রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আসলে ‘সর্বদলীয়’ নামে নিজেদেরই অন্য এক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। অমন একটি নির্বাচন করেও ছেড়েছেন তিনি। একই কারণে বিরোধী কোনো দলই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে স্বাগত জানায়নি। অনেকে সেই সাথে না বলে পারেননি যে, প্রধানমন্ত্রী আসলে সম্ভাবনার কফিনে শেষ পেরেকটিই ঠুকে দিয়েছেন। ঠিক সে পর্যায়েই আরো একবার দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে এসেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ২১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা পেশ করে বলেছিলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার মধ্য থেকে সরকারি দল পাঁচজনের এবং বিরোধী দল পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে। আর প্রধান উপদেষ্টা করা হবে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সম্মানিত একজন নাগরিককে। সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রস্তাবটিকেও নাকচ করেছিলেন।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শুধু বেগম খালেদা জিয়ার এ ফর্মুলাকেই প্রত্যাখ্যান করেননি, একই সঙ্গে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোটারবিহীন ও একতরফা এমন এক নির্বাচনও করেছিলেন ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ যাকে ‘এক ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। স্মরণ করা দরকার, নির্বাচন নামের ওই কর্মকান্ডে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেণ প্রধানমন্ত্রীর মনোনীতজনেরা। তারাই এখনো এমপি হিসেবে বহাল রয়েছেন! এত কিছুতেও অবশ্য কোনো লাভ হয়নি, দেশের রাজনৈতিক সংকট বরং ক্রমাগত আরো ভয়ংকর হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর এরই মধ্যে দীর্ঘ ১৯ মাস পার হয়ে গেলেও সংকট কাটিয়ে ওঠার শুভ কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। তারা বরং বিএনপি জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্মূল করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলেও পরিস্থিতির অবনতিই শুধু ঘটছে। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতেই বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ প্রস্তাবকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সম্ভাবনাময় মনে করা হচ্ছে। কারণ, মূল কথায় এবারও তিনি সমঝোতামুখী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এজন্যই দেশপ্রেমিকরা আশা করছেন, খালেদা জিয়ার এই গণতন্ত্রসম্মত প্রস্তাবটির যথোচিত মূল্যায়ন করা হবে এবং নাকচ করার পরিবর্তে এর ভিত্তিতেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা পদক্ষেপ নেবেন। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোর পাশাপাশি রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। তা সত্ত্বেও সরকার যে নীতি-কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে এবং যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে তার ফলে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এভাবে রাজনৈতিক সংকটই শুধু আরো ঘনীভূত হবে না, সারা দেশে সহিংসতাও ছড়িয়ে পড়বে- যে ধরনের পরিস্থিতি অবশ্যই আশংকাজনক এবং জনগণের আশা-আকাংক্ষার পরিপন্থী। এজন্যই সরকারের উচিত রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়া। সে প্রমাণ দিতে হলে ক্ষমতাসীনদের উচিত খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ ও ব্যবহার করা। বলা দরকার, সেটা না করে গণতন্ত্রের কফিনে আরো একবার আওয়ামী পেরেক ঠুকে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হলে জনগণ তো বটেই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তা প্রত্যাখ্যান করবে- যার পরিণতি সরকারের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
এভাবে সব মিলিয়েই সরকারের পক্ষ থেকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল, সমঝোতার ধারেকাছে যাওয়ার পরিবর্তে একতরফা নির্বাচনের পথেই এগিয়ে যাবেন তারা। নির্বাচন কমিশনও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল। নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকটও তাই ঘনীভূত হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে পালিত অবরোধে অচল হয়ে পড়েছিল সারা দেশ। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের একদিন আগে অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত অবরোধ এবং নির্বাচন বাতিলের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনকে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার অন্তত ১২২ জনকে হত্যা করেছিল। দমন-নির্যাতন এবং হত্যা ও গ্রেফতারের অভিযান চালানোর পাশাপাশি সরকার বেগম খালেদা জিয়াকেও তার বাসভবনে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল। দলের নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন ওঠে না, পুলিশ এমনকি বিদেশি সাংবাদিকদের পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। খালেদা জিয়া নিজেও বাইরে আসতে পারেননি। ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ উপলক্ষে নয়া পল্টনস্থ বিএনপি অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে তাকে চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অসম্মানিত হতে হয়েছিল। বিএনপির সংসদীয় প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তারপরও নেত্রীকে বাইরে আসতে দেয়া হয়নি। এভাবে তাকে অবশ্য আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। ৩ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে বেগম খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট না দেয়ার এবং প্রহসনের নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৮ দলীয় জোট ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছিল। সে হরতালের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল দশম সংসদের নির্বাচন, যা গণতন্ত্রের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক অধ্যায় ও দৃষ্টান্তের সৃষ্টি করেছিল। ওই নির্বাচন পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। একটি মাত্র রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রের সরকারও প্রকাশ্যে একে গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়নি।
মূলত মাত্র সেদিনের এমন ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতেই বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ প্রস্তাব অত্যধিক গুরুত্ব অর্জন করেছে। দেশে-বিদেশে গণতন্ত্রকামী সকল মহলই তার এ প্রস্তাবকে ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় বলে আখ্যা দিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কথা অবশ্য আলাদা। কারণ, বেগম জিয়ার বক্তব্যের সবটুকু না শুনেই কিংবা অর্থ না বুঝেই ক্ষমতাসীনরা তার দাবি ও প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। ১৪ দলীয় আওয়ামী জোট তো বটেই, সরকার সমর্থক নাম সর্বস্ব ১০টি দলের জোটও একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা এর মধ্যে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের ‘পরাজয়’ও আবিষ্কার করে বসেছে! এক ধাপ এগিয়ে কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, সরকার পতনের আন্দোলনে লজ্জাকর ব্যর্থতার পর এতদিনে খালেদা জিয়া নাকি সংবিধানসম্মত পথে ফিরে এসেছেন! আর ফিরে যখন এসেছেনই তখন তার উচিত হবে নির্বাচনের জন্য ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা। কারণ জানাতে গিয়ে সংবিধানের দোহাই দিয়ে তারা আরো বলেছেন, দেশে কোনো আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায়নি, যাচ্ছেও না। উদাহরণ দেয়ার জন্য ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’র ২৮ জুলাই সংখ্যার সম্পাদকীয়র উল্লেখ করা যায়। ‘খালেদার নমনীয়তা অচলাবস্থা নিরসনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে দৈনিকটি এমন একাধিক মন্তব্য করেছে যেগুলোর কোনোটিই ক্ষমতাসীনদের জন্য উৎসাহজনক নয়। যেমন বাংলাদেশের চলমান সংকটের কারণ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে ‘দ্য হিন্দু’ লিখেছে, বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো বর্জন করায় গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি ‘এক ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতায়’ পরিণত হয়েছিল! পরবর্তীকালে সৃষ্ট সংকট ও সহিংসতার জন্যও দৈনিকটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অগণতান্ত্রিক অনমনীয়তাকে’ই দায়ী করেছে। বলেছে, প্রধান দুই দলের বৈরিতা ও অবিশ্বাসের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এমন এক অবস্থার মধ্যে যথেষ্ট ছাড় দিয়েছেন বলেই বেগম খালেদা জিয়ার নতুন প্রস্তাবকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে করেছে ‘দ্য হিন্দু’। বলেছে, খালেদা জিয়ার এই নমনীয়তা বাংলাদেশে বিদ্যমান সংকট ও অচলাবস্থা নিরসনের জন্য চমৎকার সুযোগের সৃষ্টি করেছে। ‘দ্য হিন্দু’র মতে শেখ হাসিনার সরকারের উচিত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অচলাবস্থার অবসান ঘটানো এবং নির্বাচনের আগে অধিক সমঝোতামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা। সরকার এবং বিরোধী দলের কার্যকর ঐকতান যে বাংলাদেশের মতো নবীন গণতন্ত্রের জন্য জরুরি সে কথাটাও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই উল্লেখ করেছে ‘দ্য হিন্দু’।
উদাহরণ হিসেবে ভারতের একটি মাত্র দৈনিকের সম্পাদকীয়র উদ্ধৃতি দেয়া হলেও বাস্তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন সকল দেশই একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। জাতিসংঘের রূপরেখাও এসেছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের পক্ষে। সে কারণেই ক্ষমতাসীনদের ব্যঙ্গাত্মক প্রতিক্রিয়া দেশে-বিদেশে কোনো সরকার বা মহলের সমর্থন পায়নি। কেউই এই প্রতিক্রিয়াকে গণতন্ত্রের জন্য শুভ মনে করেনি। সবাই বরং খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যের দিকটিকে প্রাধান্যে আনার পরামর্শ দিয়েছেন, যার মূল কথায় তিনি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করারই আহ্বান জানিয়েছেন। এজন্যই নির্বাচনকালীন সরকারের নাম প্রসঙ্গে ছাড় দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, নাম যা-ই হোক না কেন, ওই সরকারকে ‘নিরপেক্ষ’ হতে হবে। উল্লেখ্য, এবারই প্রথম নয়, এরও আগে ২০১৩ সালের অক্টোবরেও তিনি সরকারের নামের আগে তত্ত্বাবধায়ক না রাখার ব্যাপারে ছাড় দিয়েছিলেন। সেবার উপস্থাপিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখায় বেগম জিয়া বলেছিলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার মধ্য থেকে সরকারি দল পাঁচজনের এবং বিরোধী দল পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে। আর প্রধান উপদেষ্টা করা হবে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সম্মানিত একজন নাগরিককে। শুধু রূপরেখা পেশ করেই থেমে যাননি বেগম খালেদা জিয়া। সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়ে পরদিনই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সংসদেও তার সে রূপরেখা পেশ করা হয়েছিল। জাতীয় ঐক্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বেগম জিয়া সেবার বলেছিলেন, দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রথমে দরকার নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা এগিয়েছিলেন নিজেদের সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ‘সর্বদলীয়’ নামের এক বিচিত্র সরকার গঠন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দেশবাসীর পাশাপাশি বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে ‘সর্বদলীয়’ নাম দেয়া হলেও বাস্তবে সেটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারেরই সম্প্রসারিত সংস্করণ। উল্লেখ্য, নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবির পাশাপাশি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নটিকেও সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনে যাতে কারো সন্দেহ না থাকে সেটা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই তিনি ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চান। সে সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলেরও অংশ নেয়ার সুযোগ থাকবে। এজন্য বিরোধী দলের নেতার কাছে অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়ার কাছে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নাম পাঠানোর জন্য প্রস্তাব পাঠাবেন তিনি। তবে প্রধানমন্ত্রী জানাননি, পরিকল্পিত ওই ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রধান কে হবেন এবং কিভাবে তাকে বাছাই বা মনোননীত করা হবে। মন্ত্রিসভায় কোন মাপকাঠিতে কোন দলের কতজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং এতে বিরোধী দলকে সম্মানের সঙ্গে প্রতিনিধিত্বের কতটুকু সুযোগ দেয়া হবে এ সম্পর্কেও নীরব থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই সরকার কখন কিভাবে গঠন করা হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা থাকবে এবং সরকারের মেয়াদ কতদিন হবেÑ এসব বিষয়েও কোনো কথা পাওয়া যায়নি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে।
আপাতদৃষ্টিতে তখন মনে হয়েছিল, যেন প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছেন, প্রকাশ ঘটিয়েছেন সদিচ্ছারও। মনে হয়েছিল যেন সব দলকে নিয়ে সরকার গঠন ও নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী আসলেও উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে ভাষণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কিন্তু তেমন সদিচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ, রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণটিরই ধারেকাছে যাননি প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দল তখন আন্দোলন করছিল সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার দাবিতে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের নামের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে বলেছিলেন, যে কোনো নামেই গঠন করা হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে ‘নির্দলীয়’ হতে হবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ হাসিনাকে রাখা চলবে না। কিন্তু এ দুটি বিষয়েও ‘এক চুল’ পরিমাণ ছাড় দেননি প্রধানমন্ত্রী। তার পরিকল্পিত সরকারকে ‘সর্বদলীয়’ বলেছিলেন সত্য কিন্তু সে সরকারের মন্ত্রী হওয়ার জন্য এমনভাবেই বিরোধী দলের কাছে নাম চেয়েছিলেন যা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, সবই তার একার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। বড় কথা, প্রধানমন্ত্রী পদে তিনিই বহাল থাকবেন। অমন কোনো সরকারে বিরোধী দল যে অংশ নেবে না সে কথাটা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীও সুনির্দিষ্টভাবেই জানতেন। এজন্যই রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী আদৌ চান না যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলকে নিয়ে সত্যিই তেমন কোনো ‘সর্বদলীয়’ সরকার তাকে গঠন করতে হোক। একথাই বরং পরিষ্কার হয়েছিল, ‘সর্বদলীয়’ নামে যে সরকার তিনি গঠন করতে চাচ্ছেন সেটা আসলে হবে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারেরই অন্য রূপ- সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বসহ যার নেতৃত্বে থাকবেন শেখ হাাসিনা নিজেই। থেকেছিলেনও তিনিই।
অর্থাৎ রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আসলে ‘সর্বদলীয়’ নামে নিজেদেরই অন্য এক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। অমন একটি নির্বাচন করেও ছেড়েছেন তিনি। একই কারণে বিরোধী কোনো দলই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে স্বাগত জানায়নি। অনেকে সেই সাথে না বলে পারেননি যে, প্রধানমন্ত্রী আসলে সম্ভাবনার কফিনে শেষ পেরেকটিই ঠুকে দিয়েছেন। ঠিক সে পর্যায়েই আরো একবার দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে এসেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ২১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা পেশ করে বলেছিলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার মধ্য থেকে সরকারি দল পাঁচজনের এবং বিরোধী দল পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে। আর প্রধান উপদেষ্টা করা হবে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সম্মানিত একজন নাগরিককে। সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রস্তাবটিকেও নাকচ করেছিলেন।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শুধু বেগম খালেদা জিয়ার এ ফর্মুলাকেই প্রত্যাখ্যান করেননি, একই সঙ্গে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোটারবিহীন ও একতরফা এমন এক নির্বাচনও করেছিলেন ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ যাকে ‘এক ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। স্মরণ করা দরকার, নির্বাচন নামের ওই কর্মকান্ডে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেণ প্রধানমন্ত্রীর মনোনীতজনেরা। তারাই এখনো এমপি হিসেবে বহাল রয়েছেন! এত কিছুতেও অবশ্য কোনো লাভ হয়নি, দেশের রাজনৈতিক সংকট বরং ক্রমাগত আরো ভয়ংকর হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর এরই মধ্যে দীর্ঘ ১৯ মাস পার হয়ে গেলেও সংকট কাটিয়ে ওঠার শুভ কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। তারা বরং বিএনপি জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্মূল করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলেও পরিস্থিতির অবনতিই শুধু ঘটছে। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতেই বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ প্রস্তাবকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সম্ভাবনাময় মনে করা হচ্ছে। কারণ, মূল কথায় এবারও তিনি সমঝোতামুখী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এজন্যই দেশপ্রেমিকরা আশা করছেন, খালেদা জিয়ার এই গণতন্ত্রসম্মত প্রস্তাবটির যথোচিত মূল্যায়ন করা হবে এবং নাকচ করার পরিবর্তে এর ভিত্তিতেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা পদক্ষেপ নেবেন। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোর পাশাপাশি রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। তা সত্ত্বেও সরকার যে নীতি-কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে এবং যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে তার ফলে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এভাবে রাজনৈতিক সংকটই শুধু আরো ঘনীভূত হবে না, সারা দেশে সহিংসতাও ছড়িয়ে পড়বে- যে ধরনের পরিস্থিতি অবশ্যই আশংকাজনক এবং জনগণের আশা-আকাংক্ষার পরিপন্থী। এজন্যই সরকারের উচিত রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়া। সে প্রমাণ দিতে হলে ক্ষমতাসীনদের উচিত খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ ও ব্যবহার করা। বলা দরকার, সেটা না করে গণতন্ত্রের কফিনে আরো একবার আওয়ামী পেরেক ঠুকে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হলে জনগণ তো বটেই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তা প্রত্যাখ্যান করবে- যার পরিণতি সরকারের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
আহমদ আশিকুল হামিদ