মানুষের মুখে মুখে এখন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, একদিকে বহুদিন জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি, অন্যদিকে বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার ওপর হামলার পর হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনরা তাদের উদ্দেশ্যের ন্যক্কারজনক প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন। ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের দোসররা অবশ্য বহুদিন কথাটার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলতে পারেন, দেড় বছরও হয়নি গত বছরের ৫ জানুয়ারি যেহেতু সংসদ নির্বাচন হয়েছে সেহেতু বহুদিন পর ভোট দেয়ার কথা উঠতে পারে না। এর যুৎসই, এমনকি দাঁতভাঙা জবাবও রয়েছে। কিন্তু সেদিকে যাওয়ার পরিবর্তে শুধু এটুকু স্মরণ করিয়ে দেয়াই এখানে যথেষ্ট যে, শতকরা পাঁচজন মানুষও ওই নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পাননি। ভোট দিতে যাননি তারা। যাবেনই বা কেন? তার আগেই তো ১৫৪ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষিত হয়েছিলেন! ‘ঐতিহাসিক’ সে সংসদ নির্বাচনের পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয়েছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো প্রধান দলগুলো যাতে নির্বাচনে অংশ না নেয় সেটা নিশ্চিত করতেই ক্ষমতাসীনরা বেশি ব্যস্ত থেকেছেন। এজন্য তারা এমনভাবেই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার অজুহাত দেখিয়েছেন যাতে দল দুটির পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব না হয়। অথচ বিএনপি ও জামায়াত সততার সঙ্গে এবং আন্তরিকভাবেই নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিল। দল দুটির দাবি ছিল, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ করা হোক এবং সংবিধানে নির্বাচনকালীন ওই সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিধান যুক্ত করা হোক। কিন্তু এটুকু করতেও সম্মত হননি ক্ষমতাসীনরা। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল যে কোনোভাবে বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। সে উদ্দেশ্য তারা অর্জনও করে ছেড়েছেনÑ যদিও পাঁচ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দিতে যায়নি। এতে অবশ্য তাদের কিছু যায়-আসে না। কারণ, তাদের লক্ষ্য ছিল ছলে-বলে-কৌশলে হলেও ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় গেছেনও তারা।
তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও ক্ষমতাসীনরা একই কৌশলের ভিত্তিতে এগিয়ে চলেছেন। পার্থক্য হলো, বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট সংসদ নির্বাচনের মতো এই নির্বাচন বর্জন করার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে যুৎসই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চেয়েছিল। অন্যদিকে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনরা এবারের নির্বাচনে ভরাডুবির আশংকা করেছেন। সে অনুযায়ী অনেক আগে থেকে ব্যবস্থাও নিয়েছেন তারা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেয়র, চেয়ারম্যান এবং কাউন্সিলরসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত, গ্রেফতার এবং হয়রানি করা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা, সদস্য বা সমর্থক হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের প্রায় সকলেই এখনও পুলিশের ধাওয়ার মুখে রয়েছেন। অনেকে গ্রেফতার ও বরখাস্ত হয়েছেন। একই অবস্থায় পড়েছেন আরো অনেক পৌরসভা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও। কারো কারো বিরুদ্ধে নাশকতা ও খুনের মামলাও দেয়া হয়েছে। খবর শুধু এটুকুই নয়। প্রতিটি স্থানে প্যানেল মেয়র হিসেবে বসিয়ে দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের লোকজনকে। এই প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে সিরিয়াল বা ক্রমিকও মানেনি সরকার। ফলে এক নম্বরে অবস্থানকারীরা বঞ্চিত হয়েছেন। এভাবে চলতে থাকায় দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। পরিণতিতে একদিকে উন্নয়ন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সেবা পাচ্ছেন না ওই সব এলাকার সাধারণ মানুষ। খবরে বলা হয়েছে, সরকার এ ব্যাপারে পৌরসভা আইন ২০০৯-এর ৩১ ও ৩২ ধারার সুযোগ নিচ্ছে। এ ধারা দুটির বলে কোনো মেয়রের বিরুদ্ধে কোনো মামলার চার্জশিট হলেই তাকে বরখাস্ত ও অপসারণ করার ক্ষমতা পেয়েছে সরকার। কিছুদিন ধরে ঢালাওভাবে সে ক্ষমতারই অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে।
এমন অবস্থার কারণ সম্পর্কে একটু আগেই বলা হয়েছে। সে কারণ ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবির আশংকা। এই আশংকা সত্যও বটে। আসলেও জিততে পারবেন না তাদের প্রার্থীরা। স্মরণ করা দরকার, ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের ক্ষমতায় আসতে পারলেও বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের প্রায় সব নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ হেরে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর পর ২০১০ সালের জুন মাসে প্রথম অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে জিতেছিল বিএনপি। এরপর পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছিলেন বিরাট ব্যবধানে। পরাজয়ের এই ধারা অব্যাহত থেকেছে শেষ পর্যন্তও। ২০১৩ সালের জুন ও জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ছিল শোচনীয়। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সব মিলিয়ে দেশের আটটি সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে একমাত্র রংপুর ছাড়া সবগুলোতেই মেয়রের আসনে জিতেছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা। কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল নারায়ণগঞ্জ। সেখানে বিএনপি প্রার্থী দেয়নি কিন্তু তা সত্ত্বেও দলগতভাবে আওয়ামী লীগ পরাজিতই হয়েছিল। কারণ, ডা. সেলিনা হায়াত আইভি জিতেছিলেন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে। প্রতিটি নির্বাচনেই বিরাট ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা, লজ্জাকর পরাজয় ঘটেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের।
মূলত তখন থেকেই ফন্দি এঁটে এসেছেন ক্ষমতাসীনরা, যার বাস্তবায়ন ঘটানো হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে শুরু হওয়া অবরোধ কেন্দ্রিক আন্দোলনকে অজুহাত বানিয়ে সরকার একদিকে প্রচন্ড দমন-নির্যাতন এমনকি হত্যাকান্ডের অভিযান পর্যন্ত চালিয়েছে, অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের এমনভাবেই ধাওয়ার মুখে রেখেছে যাতে তাদের কারো পক্ষে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সম্ভব না হয়। এখানে উদ্দেশ্যে কোনো রাখঢাক রাখছেন না ক্ষমতাসীনরা। একই কারণে তারা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, যাতে বিএনপি ও জামায়াতের মতো প্রধান দলগুলো নির্বাচনে অংশই না নিতে পারে। অংশ নিলেও তাদের প্রার্থীরা যাতে প্রচারণা চালাতে এবং জনগণের কাছে ভোট চাইতে না পারেন। এজন্যই মামলা, গ্রেফতার এবং গুম ও খুনের মাধ্যমে ভীতি-আতংক ছড়িয়ে দেয়ার ভয়ঙ্কর নীতি-কৌশল নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। তারা চাচ্ছেন, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে তিন মহানগরীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূলকেন্দ্র সিটি কর্পোরেশনকে নিজেদের দখলে নিতে। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিতে গেলে ঘেমে নেয়ে উঠতে হবে। তা সত্ত্বেও দু-একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। যেমন, ঢাকা উত্তরে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট শিল্পপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। অতি নগন্য একটি ভুলের অজুহাতে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। জনাব মিন্টু উচ্চ আদালতে পর্যন্ত গেছেন। এটুকু সবাই জানেন। এর সঙ্গে আবার অন্য একটি তথ্য জানিয়েছেন দেশের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারস্টার রফিক-উল হক। তথ্যটি হলো, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর জনাব মিন্টুকে দেয়া যমুনা রিসোর্টের ৩০ বছর মেয়াদী ইজারা বাতিল করেছে সরকার। এটা গত পহেলা এপ্রিলের ঘটনা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্যের নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে। কারণ, আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রার্থী না হতে পারলে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে ফাঁকা ময়দান পেয়ে যাবেন তারা। ওদিকে ঢাকা দক্ষিণে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে লুকিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তার পক্ষে উচ্চ আদালতে তিনটি মামলায় জামিনের আবেদন করা হয়েছে। দুটি মামলার জামিনের ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জামিন না পাওয়ায় মির্জা আব্বাস নির্বাচনী প্রচারণাই চালাতে পারছেন না। কারণ, গ্রেফতার করা হবে তাকে। এখানেই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব এসে যায়। অবিলম্বে সব মামলা প্রত্যাহার করে এবং বন্দী ও আত্মগোপনে থাকা নেতাদের মুক্ত পরিবেশে তৎপরতা চালানোর সুযোগ দিয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারকে বলাটা নির্বাচন কমিশনের কর্তব্যও বটে। কথা আরো আছে। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই বহুল আলোচিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে, প্রত্যেক প্রার্থী যাতে বাধাহীনভাবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারেন। সরকার যাতে মিথ্যা মামলা দায়ের করে গ্রেফতারের নামে প্রার্থী ও তার কর্মীদের ধাওয়ার মুখে না রাখতে পারে সে বিষয়েও কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। অন্যদিকে কমিশন কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগই নেয়নি। শুধু তাই নয়, একজন কমিশনার তো বলেই বসেছেন যে, পুলিশ তার কর্তব্য পালন তথা প্রার্থীদের গ্রেফতার করলে তাদের কিছুই করার নেই। আইনকে আইনের পথে যেতে দিতে হবে বলেও তিনি ঘোষণা করেছেন।
এজন্যই দিন ঘনিয়ে এলেও নির্বাচনকে নিয়ে তেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হতে পারেনি। এর বড় কারণ সরকারের পাশাপাশি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে আস্থাহীনতা। জনগণ বিশ্বাসই করে না যে, এই কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এমন অবস্থার কারণ সৃষ্টি করেছে সরকার নিজেই। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর এবং দল দুটির সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে তৎপরতাই চালাতে পারছেন না। মির্জা আব্বাসের মতো কয়েকজনকে নির্বাচনের মাঠেও থাকতে দেয়া হচ্ছে না। বিএনপি ও জামায়াতের সম্ভাবনাময় সব প্রার্থীর বিরুদ্ধেই একের পর এক সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এসব মামলায় অনেককে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের জন্য প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের বাসা-বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। সব মিলিয়ে এমন ত্রাসের রাজত্বই কায়েম করা হয়েছে যে, প্রার্থীরা নিজেদের বাঁচাতেই বেশি ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ গণতন্ত্রে সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে কোনো নির্বাচনের প্রধান পূর্বশর্ত। এই সুযোগ প্রত্যেক প্রার্থীরই সমানভাবে থাকা দরকার। অন্যদিকে তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে কোনো একটি স্থানেও বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছেন না।
এটুকুই সব নয়। সিটি নির্বাচনের তিনটিতেই বিজয়ী হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আবারও ‘এইচ টি ইমাম ফর্মুলা’ নিয়ে এগোতে শুরু করেছে বলে জোর অভিযোগ উঠেছে। সংবাদপত্রের রিপোর্টে জানা গেছে, প্রার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও আশংকা প্রকাশ করে বলেছে, ওই ফর্মুলার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের বাইরে আর কারো পক্ষেই জিতে আসা সম্ভব হবে না। স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর ২০১৪ সালের ১২ নবেম্বর ছাত্রলীগের এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাধর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের সময় পুলিশ ও প্রশাসনের কার্যক্রমের পেছনে ছিল তার নিজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। প্রতিটি উপজেলায় তিনি তাদের ‘রিক্রুটেড’ বা চাকরি দেয়া লোকজনকে দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার জোটের প্রার্থীদের জিতিয়ে এনেছিলেন। পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন যে তাদের অর্থাৎ সরকারের ‘পাশে দাঁড়িয়েছিলেন’ এবং ‘বুক পেতে দিয়েছিলেন’ সে কথাও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন এইচ টি ইমাম। এভাবে গোপন তথ্য ফাঁস করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা আসলে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ ও আশংকাকেই সত্য বলে প্রমাণ করেছিলেন। সেই থেকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘এইচ টি ইমাম ফর্মুলা’ বিশেষ ‘প্রসিদ্ধি’ অর্জন করেছে! এর মূল কথা হলো, নির্বাচনে যতো দল বা প্রার্থীই অংশ নিক না কেন, ক্ষমতাসীনরা যাকে চাইবেন তাকেই জিতিয়ে আনা হবে। এজন্য নিজেদের ‘রিক্রুটেড’ লোকজন তথা ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে নির্বাচন হচ্ছে এমন সব এলাকায় মোবাইল কোর্ট বসাবেন তারা এবং বিরোধী প্রার্থীদের হেনস্থা ও প্রয়োজনে গ্রেফতার করা হবে। ওদিকে ‘পাশে’ দাঁড়ানোর এবং ‘বুক পেতে’ দেয়ার জন্য পুলিশ ও প্রশাসন তো প্রস্তুত থাকবেই! ফলে জিতবেন শুধু সরকার সমর্থিতরাই। এই সময়ে বহুল আলোচিত ‘ফর্মুলা’টি নিয়ে কথা উঠেছে কিছু বিশেষ কারণে। দেখা যাচ্ছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের সমর্থিত প্রার্থীরা হয় সাজানো মামলায় কারাগারে রয়েছেন নয়তো পুলিশ ধাইয়ে বেড়াচ্ছে বলে আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। পুলিশ এমনকি ক্ষমতাসীনদের তৈরি করে দেয়া তালিকা অনুযায়ী প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের বাসা-বাড়িতে ব্লকরেইড পর্যন্ত করছে। সব মিলিয়েই এমন আয়োজন করা হয়েছে যাতে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা কোনো রকম তৎপরতাই চালাতে না পারেন। একযোগে অন্য সকল পন্থায়ও চলছে ওই ‘ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের কার্যক্রম। যেমন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত ৩১ মার্চ চট্টগ্রামের একটি হোটেলে আয়োজিত এক উচ্চ পর্যায়ের সভায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। দু’জন প্রতিমন্ত্রী শুধু নন, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক ও সিডিএর চেয়ারম্যানসহ প্রশাসনের অনেক বড় বড় কর্তা ব্যক্তিও মন্ত্রীর সঙ্গে সভায় অংশ নিয়েছেন। প্রার্থী নিজে উপস্থিত না থাকলেও খবরে বলা হয়েছে, বিধি লংঘন করে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা নির্বাচনী বৈঠক করেছেন। এতে মোবাইল কোর্ট বসানোর মতো অন্য নানা পন্থায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের সময়ের মতো তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও ‘এইচ টি ইমাম ফর্মুলা’ বাস্তবায়ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। বলা চলে, প্রস্তুতি সেরেও ফেলেছেন তারা। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা! বলা দরকার, দলের চরিত্র ও স্বভাব অনুযায়ী ক্ষমতাসীনদের জন্য স্বাভাবিক হলেও সংবিধান ও গণতান্ত্রিক বিধি-বিধানের দিক থেকে এ ধরনের কোনো প্রচেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কারণ, গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে কোনো নির্বাচনের প্রধান পূর্বশর্ত। প্রচার-প্রচারণা চালানো ও সভা-সমাবেশ করাসহ নির্বাচনী কর্মকান্ড পরিচালনায় সব প্রার্থীরই সমান সুযোগ থাকতে হবে। অন্যদিকে আসন্ন সিটি নির্বাচনে বিশেষ করে দেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছেন না। বড় কথা, অতীতের বিভিন্ন উপলক্ষের মতো সিটি নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনারা শুধু নিজেদের প্রার্থীদের ব্যাপারেই ব্যস্ত রয়েছেন। সেটাও গ্রহণযোগ্য হতো যদি গোপনে গোপনে এর সঙ্গে মোবাইল কোর্টের আড়ালে ম্যাজিস্ট্রেট তথা বিচার বিভাগ এবং পুলিশ ও প্রশাসনকে জড়িয়ে ফেলার আয়োজন না করতেন তারা। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই বলা হচ্ছে, নিজেদের অতি তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে ক্ষমতাসীনরা আসলে আবারও কুপোকাত হওয়ার লজ্জাকর পরিণতি এড়ানোর কৌশল নিয়েছেন। অমন কৌশল তারা নিতেই পারেন, অন্যদিকে জনগণের সচেতন অংশ মনে করেন, গণতন্ত্রের ব্যাপারে আদৌ সদিচ্ছা এবং নিজেদের ‘অবদানের’ ব্যাপারে সৎসাহস থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে ধাওয়ার মুখে রাখার পরিবর্তে প্রথমে দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার-মামলা ও গুম-খুন বন্ধ করা এবং তারপর যথেষ্ট সময় দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। তখন দেখা যাবে, ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা আসলে কতটুকু। তারও আগে সরকারকে অবশ্যই মেয়র ও চেয়ারম্যানসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক অভিযান বন্ধ করতে হবে এবং সুযোগ দিতে হবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে। অমন আশা যে অন্তত আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আশা করা যায় না সে কথা নিশ্চয় বলা বাহুল্য। কিন্তু যা না বললেই নয় সে কথাটা হলো, এভাবে চলতে থাকলে আর যা-ই হোক, তিন সিটি নির্বাচনের কোনো একটিতেও জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে না। ভোটাররা সম্ভবত ভোটকেন্দ্রেও যেতে পারবেন না। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনী বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারতো। কিন্তু সেনা মোতায়েন নিয়েও শেষ মুহূর্তে ঝামেলা পাকিয়েছে নির্বাচন কমিশন। একই কারণে সিটি নির্বাচনের সম্ভাবনা এবং ফলাফল সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করাই ভালো।
তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও ক্ষমতাসীনরা একই কৌশলের ভিত্তিতে এগিয়ে চলেছেন। পার্থক্য হলো, বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট সংসদ নির্বাচনের মতো এই নির্বাচন বর্জন করার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে যুৎসই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চেয়েছিল। অন্যদিকে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনরা এবারের নির্বাচনে ভরাডুবির আশংকা করেছেন। সে অনুযায়ী অনেক আগে থেকে ব্যবস্থাও নিয়েছেন তারা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেয়র, চেয়ারম্যান এবং কাউন্সিলরসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত, গ্রেফতার এবং হয়রানি করা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা, সদস্য বা সমর্থক হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের প্রায় সকলেই এখনও পুলিশের ধাওয়ার মুখে রয়েছেন। অনেকে গ্রেফতার ও বরখাস্ত হয়েছেন। একই অবস্থায় পড়েছেন আরো অনেক পৌরসভা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও। কারো কারো বিরুদ্ধে নাশকতা ও খুনের মামলাও দেয়া হয়েছে। খবর শুধু এটুকুই নয়। প্রতিটি স্থানে প্যানেল মেয়র হিসেবে বসিয়ে দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের লোকজনকে। এই প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে সিরিয়াল বা ক্রমিকও মানেনি সরকার। ফলে এক নম্বরে অবস্থানকারীরা বঞ্চিত হয়েছেন। এভাবে চলতে থাকায় দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। পরিণতিতে একদিকে উন্নয়ন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সেবা পাচ্ছেন না ওই সব এলাকার সাধারণ মানুষ। খবরে বলা হয়েছে, সরকার এ ব্যাপারে পৌরসভা আইন ২০০৯-এর ৩১ ও ৩২ ধারার সুযোগ নিচ্ছে। এ ধারা দুটির বলে কোনো মেয়রের বিরুদ্ধে কোনো মামলার চার্জশিট হলেই তাকে বরখাস্ত ও অপসারণ করার ক্ষমতা পেয়েছে সরকার। কিছুদিন ধরে ঢালাওভাবে সে ক্ষমতারই অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে।
এমন অবস্থার কারণ সম্পর্কে একটু আগেই বলা হয়েছে। সে কারণ ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবির আশংকা। এই আশংকা সত্যও বটে। আসলেও জিততে পারবেন না তাদের প্রার্থীরা। স্মরণ করা দরকার, ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের ক্ষমতায় আসতে পারলেও বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের প্রায় সব নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ হেরে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর পর ২০১০ সালের জুন মাসে প্রথম অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে জিতেছিল বিএনপি। এরপর পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছিলেন বিরাট ব্যবধানে। পরাজয়ের এই ধারা অব্যাহত থেকেছে শেষ পর্যন্তও। ২০১৩ সালের জুন ও জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ছিল শোচনীয়। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সব মিলিয়ে দেশের আটটি সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে একমাত্র রংপুর ছাড়া সবগুলোতেই মেয়রের আসনে জিতেছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা। কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল নারায়ণগঞ্জ। সেখানে বিএনপি প্রার্থী দেয়নি কিন্তু তা সত্ত্বেও দলগতভাবে আওয়ামী লীগ পরাজিতই হয়েছিল। কারণ, ডা. সেলিনা হায়াত আইভি জিতেছিলেন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে। প্রতিটি নির্বাচনেই বিরাট ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা, লজ্জাকর পরাজয় ঘটেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের।
মূলত তখন থেকেই ফন্দি এঁটে এসেছেন ক্ষমতাসীনরা, যার বাস্তবায়ন ঘটানো হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে শুরু হওয়া অবরোধ কেন্দ্রিক আন্দোলনকে অজুহাত বানিয়ে সরকার একদিকে প্রচন্ড দমন-নির্যাতন এমনকি হত্যাকান্ডের অভিযান পর্যন্ত চালিয়েছে, অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের এমনভাবেই ধাওয়ার মুখে রেখেছে যাতে তাদের কারো পক্ষে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সম্ভব না হয়। এখানে উদ্দেশ্যে কোনো রাখঢাক রাখছেন না ক্ষমতাসীনরা। একই কারণে তারা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, যাতে বিএনপি ও জামায়াতের মতো প্রধান দলগুলো নির্বাচনে অংশই না নিতে পারে। অংশ নিলেও তাদের প্রার্থীরা যাতে প্রচারণা চালাতে এবং জনগণের কাছে ভোট চাইতে না পারেন। এজন্যই মামলা, গ্রেফতার এবং গুম ও খুনের মাধ্যমে ভীতি-আতংক ছড়িয়ে দেয়ার ভয়ঙ্কর নীতি-কৌশল নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। তারা চাচ্ছেন, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে তিন মহানগরীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূলকেন্দ্র সিটি কর্পোরেশনকে নিজেদের দখলে নিতে। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিতে গেলে ঘেমে নেয়ে উঠতে হবে। তা সত্ত্বেও দু-একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। যেমন, ঢাকা উত্তরে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট শিল্পপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। অতি নগন্য একটি ভুলের অজুহাতে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। জনাব মিন্টু উচ্চ আদালতে পর্যন্ত গেছেন। এটুকু সবাই জানেন। এর সঙ্গে আবার অন্য একটি তথ্য জানিয়েছেন দেশের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারস্টার রফিক-উল হক। তথ্যটি হলো, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর জনাব মিন্টুকে দেয়া যমুনা রিসোর্টের ৩০ বছর মেয়াদী ইজারা বাতিল করেছে সরকার। এটা গত পহেলা এপ্রিলের ঘটনা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্যের নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে। কারণ, আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রার্থী না হতে পারলে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে ফাঁকা ময়দান পেয়ে যাবেন তারা। ওদিকে ঢাকা দক্ষিণে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে লুকিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তার পক্ষে উচ্চ আদালতে তিনটি মামলায় জামিনের আবেদন করা হয়েছে। দুটি মামলার জামিনের ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জামিন না পাওয়ায় মির্জা আব্বাস নির্বাচনী প্রচারণাই চালাতে পারছেন না। কারণ, গ্রেফতার করা হবে তাকে। এখানেই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব এসে যায়। অবিলম্বে সব মামলা প্রত্যাহার করে এবং বন্দী ও আত্মগোপনে থাকা নেতাদের মুক্ত পরিবেশে তৎপরতা চালানোর সুযোগ দিয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারকে বলাটা নির্বাচন কমিশনের কর্তব্যও বটে। কথা আরো আছে। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই বহুল আলোচিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে, প্রত্যেক প্রার্থী যাতে বাধাহীনভাবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারেন। সরকার যাতে মিথ্যা মামলা দায়ের করে গ্রেফতারের নামে প্রার্থী ও তার কর্মীদের ধাওয়ার মুখে না রাখতে পারে সে বিষয়েও কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। অন্যদিকে কমিশন কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগই নেয়নি। শুধু তাই নয়, একজন কমিশনার তো বলেই বসেছেন যে, পুলিশ তার কর্তব্য পালন তথা প্রার্থীদের গ্রেফতার করলে তাদের কিছুই করার নেই। আইনকে আইনের পথে যেতে দিতে হবে বলেও তিনি ঘোষণা করেছেন।
এজন্যই দিন ঘনিয়ে এলেও নির্বাচনকে নিয়ে তেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হতে পারেনি। এর বড় কারণ সরকারের পাশাপাশি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে আস্থাহীনতা। জনগণ বিশ্বাসই করে না যে, এই কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এমন অবস্থার কারণ সৃষ্টি করেছে সরকার নিজেই। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর এবং দল দুটির সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে তৎপরতাই চালাতে পারছেন না। মির্জা আব্বাসের মতো কয়েকজনকে নির্বাচনের মাঠেও থাকতে দেয়া হচ্ছে না। বিএনপি ও জামায়াতের সম্ভাবনাময় সব প্রার্থীর বিরুদ্ধেই একের পর এক সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এসব মামলায় অনেককে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের জন্য প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের বাসা-বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। সব মিলিয়ে এমন ত্রাসের রাজত্বই কায়েম করা হয়েছে যে, প্রার্থীরা নিজেদের বাঁচাতেই বেশি ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ গণতন্ত্রে সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে কোনো নির্বাচনের প্রধান পূর্বশর্ত। এই সুযোগ প্রত্যেক প্রার্থীরই সমানভাবে থাকা দরকার। অন্যদিকে তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে কোনো একটি স্থানেও বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছেন না।
এটুকুই সব নয়। সিটি নির্বাচনের তিনটিতেই বিজয়ী হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আবারও ‘এইচ টি ইমাম ফর্মুলা’ নিয়ে এগোতে শুরু করেছে বলে জোর অভিযোগ উঠেছে। সংবাদপত্রের রিপোর্টে জানা গেছে, প্রার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও আশংকা প্রকাশ করে বলেছে, ওই ফর্মুলার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের বাইরে আর কারো পক্ষেই জিতে আসা সম্ভব হবে না। স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর ২০১৪ সালের ১২ নবেম্বর ছাত্রলীগের এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাধর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের সময় পুলিশ ও প্রশাসনের কার্যক্রমের পেছনে ছিল তার নিজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। প্রতিটি উপজেলায় তিনি তাদের ‘রিক্রুটেড’ বা চাকরি দেয়া লোকজনকে দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার জোটের প্রার্থীদের জিতিয়ে এনেছিলেন। পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন যে তাদের অর্থাৎ সরকারের ‘পাশে দাঁড়িয়েছিলেন’ এবং ‘বুক পেতে দিয়েছিলেন’ সে কথাও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন এইচ টি ইমাম। এভাবে গোপন তথ্য ফাঁস করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা আসলে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ ও আশংকাকেই সত্য বলে প্রমাণ করেছিলেন। সেই থেকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘এইচ টি ইমাম ফর্মুলা’ বিশেষ ‘প্রসিদ্ধি’ অর্জন করেছে! এর মূল কথা হলো, নির্বাচনে যতো দল বা প্রার্থীই অংশ নিক না কেন, ক্ষমতাসীনরা যাকে চাইবেন তাকেই জিতিয়ে আনা হবে। এজন্য নিজেদের ‘রিক্রুটেড’ লোকজন তথা ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে নির্বাচন হচ্ছে এমন সব এলাকায় মোবাইল কোর্ট বসাবেন তারা এবং বিরোধী প্রার্থীদের হেনস্থা ও প্রয়োজনে গ্রেফতার করা হবে। ওদিকে ‘পাশে’ দাঁড়ানোর এবং ‘বুক পেতে’ দেয়ার জন্য পুলিশ ও প্রশাসন তো প্রস্তুত থাকবেই! ফলে জিতবেন শুধু সরকার সমর্থিতরাই। এই সময়ে বহুল আলোচিত ‘ফর্মুলা’টি নিয়ে কথা উঠেছে কিছু বিশেষ কারণে। দেখা যাচ্ছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের সমর্থিত প্রার্থীরা হয় সাজানো মামলায় কারাগারে রয়েছেন নয়তো পুলিশ ধাইয়ে বেড়াচ্ছে বলে আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। পুলিশ এমনকি ক্ষমতাসীনদের তৈরি করে দেয়া তালিকা অনুযায়ী প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের বাসা-বাড়িতে ব্লকরেইড পর্যন্ত করছে। সব মিলিয়েই এমন আয়োজন করা হয়েছে যাতে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা কোনো রকম তৎপরতাই চালাতে না পারেন। একযোগে অন্য সকল পন্থায়ও চলছে ওই ‘ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের কার্যক্রম। যেমন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত ৩১ মার্চ চট্টগ্রামের একটি হোটেলে আয়োজিত এক উচ্চ পর্যায়ের সভায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। দু’জন প্রতিমন্ত্রী শুধু নন, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক ও সিডিএর চেয়ারম্যানসহ প্রশাসনের অনেক বড় বড় কর্তা ব্যক্তিও মন্ত্রীর সঙ্গে সভায় অংশ নিয়েছেন। প্রার্থী নিজে উপস্থিত না থাকলেও খবরে বলা হয়েছে, বিধি লংঘন করে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা নির্বাচনী বৈঠক করেছেন। এতে মোবাইল কোর্ট বসানোর মতো অন্য নানা পন্থায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের সময়ের মতো তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও ‘এইচ টি ইমাম ফর্মুলা’ বাস্তবায়ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। বলা চলে, প্রস্তুতি সেরেও ফেলেছেন তারা। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা! বলা দরকার, দলের চরিত্র ও স্বভাব অনুযায়ী ক্ষমতাসীনদের জন্য স্বাভাবিক হলেও সংবিধান ও গণতান্ত্রিক বিধি-বিধানের দিক থেকে এ ধরনের কোনো প্রচেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কারণ, গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে কোনো নির্বাচনের প্রধান পূর্বশর্ত। প্রচার-প্রচারণা চালানো ও সভা-সমাবেশ করাসহ নির্বাচনী কর্মকান্ড পরিচালনায় সব প্রার্থীরই সমান সুযোগ থাকতে হবে। অন্যদিকে আসন্ন সিটি নির্বাচনে বিশেষ করে দেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছেন না। বড় কথা, অতীতের বিভিন্ন উপলক্ষের মতো সিটি নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনারা শুধু নিজেদের প্রার্থীদের ব্যাপারেই ব্যস্ত রয়েছেন। সেটাও গ্রহণযোগ্য হতো যদি গোপনে গোপনে এর সঙ্গে মোবাইল কোর্টের আড়ালে ম্যাজিস্ট্রেট তথা বিচার বিভাগ এবং পুলিশ ও প্রশাসনকে জড়িয়ে ফেলার আয়োজন না করতেন তারা। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই বলা হচ্ছে, নিজেদের অতি তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে ক্ষমতাসীনরা আসলে আবারও কুপোকাত হওয়ার লজ্জাকর পরিণতি এড়ানোর কৌশল নিয়েছেন। অমন কৌশল তারা নিতেই পারেন, অন্যদিকে জনগণের সচেতন অংশ মনে করেন, গণতন্ত্রের ব্যাপারে আদৌ সদিচ্ছা এবং নিজেদের ‘অবদানের’ ব্যাপারে সৎসাহস থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে ধাওয়ার মুখে রাখার পরিবর্তে প্রথমে দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার-মামলা ও গুম-খুন বন্ধ করা এবং তারপর যথেষ্ট সময় দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। তখন দেখা যাবে, ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা আসলে কতটুকু। তারও আগে সরকারকে অবশ্যই মেয়র ও চেয়ারম্যানসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক অভিযান বন্ধ করতে হবে এবং সুযোগ দিতে হবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে। অমন আশা যে অন্তত আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আশা করা যায় না সে কথা নিশ্চয় বলা বাহুল্য। কিন্তু যা না বললেই নয় সে কথাটা হলো, এভাবে চলতে থাকলে আর যা-ই হোক, তিন সিটি নির্বাচনের কোনো একটিতেও জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে না। ভোটাররা সম্ভবত ভোটকেন্দ্রেও যেতে পারবেন না। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনী বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারতো। কিন্তু সেনা মোতায়েন নিয়েও শেষ মুহূর্তে ঝামেলা পাকিয়েছে নির্বাচন কমিশন। একই কারণে সিটি নির্বাচনের সম্ভাবনা এবং ফলাফল সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করাই ভালো।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন