শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ আসন্ন তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিরাট আশাবাদ পোষণ করেছেন। ইংরেজিতে যাকে বলে Robust Optimism; তিনি তাই করেছেন। তিনি বলেছেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে বিজয়ী করতে হবে। আর এই বিজয়ের ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটানো হবে। আমরা যদি তা করতে না পারি তাহলে সামনে আমাদেরকে আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। দৈনিক ‘আমার দেশ’-এর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক তিনি বলেছেন, তিন সিটি কর্পোরেশনের বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। এবার বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারলে ফ্যাসিবাদ নাৎসিবাদকে ধ্বংস করা অত্যন্ত সহজ হবে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, If you win this battle you win this war. তিনি নির্বাচনে অংশ নেয়া সব প্রার্থীর নির্বাচনী কাজে বাধা না দেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীদের জন্য সমান সুযোগ দিতে হবে। তিনি বলেন, প্রার্থী ভোট চাওয়ার জন্য ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাবেন। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন বাধা না দেয়। এবারের নির্বাচন যেন অতীতের মত কলঙ্কিত না হয় সেটি নিশ্চিত করার জন্য তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।
অধ্যাপক এমাজউদ্দিন যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সেটি পড়ে মনে হচ্ছে সেই আপ্ত বাক্যটি, ‘If wishes were horses.’ তাহলে পৃথিবীটা কতই না সুন্দর হতো। তাহলে বাংলাদেশ একটি ফুলেল শুভেচ্ছার দেশে পরিণত হতো। কিন্তু ইচ্ছের স্বপ্নগুলো বাংলাদেশের মত দেশে কঠোর বাস্তবের আঘাতে বার বার মার খায়। কল্পনার ফানুসগুলো বার বার মাঝ আকাশে ফেটে যায়। গত শনিবার অধ্যাপক সাহেবের আশাবাদ প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ‘দিনকাল’ এবং আমার দেশ’ অনলাইনে। অথচ সেই একই দিন, অর্থাৎ শনিবার দৈনিক দিনকালের প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান সংবাদের শিরোনাম, ‘বিরোধীদের দাঁড়াতেই দিচ্ছে না পুলিশ/ ইসি নির্বিকার’। খবরে বলা হয়েছে, “মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দাখিল এবং যাচাই বাছাই শেষ হলেও পুলিশি অভিযানের মুখে বিরোধী দল সমর্থক প্রার্থীরা এখনও নির্বাচনী মাঠেই নামতে পারছেন না। পুলিশের সাজানো মামলা দিয়েই প্রার্থীদের টার্গেট করে চলেছে যৌথ বাহিনীর কথিত অভিযান। গ্রেফতারের ভয়ে প্রার্থীরা না এসে স্ত্রী, পুত্র ও আইনজীবীর মাধ্যমে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও এখনও নির্বাচনী কাজে যেতে পারছে না প্রার্থীরা। খোদ রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে পুলিশ আটক করছে প্রার্থীদের। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সর্বমহল থেকে দাবি থাকলেও নির্বাচন কমিশন এখনও নির্বিকার। ফলে ভোটাররা পড়েছেন বিপুল শঙ্কায়। নির্বাচনে বিএনপি জোটের অংশগ্রহণের পর থেকেই পুলিশ সম্ভাব্য প্রার্থীদের আটক করার জন্য বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করছে। এসব পুলিশি হামলা এবং মামলার ভয়েই উত্তরের মেয়র প্রার্থী আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং দক্ষিণের মির্জা আব্বাস ও আব্দুস সালাম সশরীরে নমিনেশন পেপার দাখিল করতে পারেননি। ২৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী সাইদুর রহমানকে পুলিশ রিটার্নিং অফিসার শাহ আলমের অফিসের সামনে থেকে গ্রেফতার করে। সাইদুর রহমান বলেন যে, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তারপরেও রিটার্নিং অফিসার ছিলেন নির্বিকার। ডিএমপি সূত্রে জানানো হয়েছে, দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন উপলক্ষে ডিএমপির ৪৯টি থানার ৩০০ পুরাতন মামলা সচল করে ৫০ হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে টার্গেট করেছে পুলিশ।
॥ দুই ॥
ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয়, বৃহস্পতিবার বিকাল ৪ টায় মিরপুরের দারুস সালাম থানায় কাউন্সিলরদের বাসায় পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালায়। এ সময় অন্তত ৯ জন বিএনপি প্রার্থীর বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। এছাড়া রাজধানীর আরও অন্তত ১৬টি ওয়ার্ডে পুলিশি অভিযানের খবর পাওয়া গেছে। এইসব অভিযান শুরু হয়েছে ২৯ মার্চ মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর থেকেই। একই ধরনের রিপোর্ট প্রায় সব পত্র-পত্রিকাতেই ছাপা হচ্ছে। দৈনিক ‘আমাদের সময় ডট কমের’ খবরের শিরোনাম, ‘বিএনপির নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান।’ ঐ রিপোর্ট মোতাবেক ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের ডিসি মাসুদুর রহমান বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতির চেষ্টা এবং যেন কোনো নাশকতা না হয় সেজন্য এই পুলিশী অভিযান চলছে। অন্তত ৪ জন প্রার্থীর খবর জানা গেছে, যাদের অভিযানের সময় বাসায় না পেয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং একজন মহিলা প্রার্থীর স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড শব্দটি এদেশে নতুন নয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি জোট যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগ এই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের আওয়াজ তুলেছিল। সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দাবিকে সেদিন ভারত এবং পশ্চিমা দুনিয়াও জোর সমর্থন দিয়েছিল। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল ক্ষেত্র তৈরির দাবিই শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রূপান্তিরিত হয়েছিল। নির্বাচনে সমতল ক্ষেত্র সৃষ্টি বলতে কী বোঝায়, সেটি এখন সকলেই জানেন। এর অর্থ হলো, সভা-সমিতি থেকে শুরু করে নির্বাচনী সকল কর্মকান্ডে বড়-ছোট নির্বিশেষে সকল দলের সমান সুযোগ-সুবিধা থাকা। আওয়ামী লীগের খাসলত এবং চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, বিরোধী দলে থাকলে গণতন্ত্র, সমান অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, রেডিও এবং টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন, সভা-সমাবেশ এবং মিছিলের অবাধ সুযেগা এবং অধিকার দাবিতে সোচ্চার হওয়া। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারা গণতন্ত্র, সাম্য, জনগণের অধিকার ইত্যাদি সব নীতিকথা ভুলে যায়। শুধু তা-ই নয়, যেসব অধিকারের জন্য তারা বিরোধী দলে থাকতে সংগ্রাম করেছে, সরকারে গিয়ে সর্বপ্রথম তারা সেই সব অধিকার পদদলিত করে। বিরোধী দলে থাকার সময় তারা পাকিস্তান আমল থেকে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা সর্বাগ্রে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির একদলীয় বাকশাল কায়েম করে। বিরোধী দলে থাকার সময় তারা নির্বাচিত দলীয় সরকারের পরিবর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আওয়াজ তোলে এবং সহিংসতার মাধ্যমে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করে ছাড়ে। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারা সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে হত্যা করে এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দাবির তুখোড় প্রবক্তা ছিলেন শেখ হাসিনা। এখন ক্ষমতায় এসে সেই শেখ হাসিনাই গত বুধবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে বিএনপি নেত্রী আবার কী সুর তুলেছেন। এর মধ্যে নাকি ‘বেসুর’ আছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আওয়াজ তুলেছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী হাসান মাহমুদ। বিএনপি নাকি একটি সন্ত্রাসী দল। সবার জন্য সমতল ক্ষেত্র থাকবে। কিন্তু বিএনপির জন্য লেভেল ফিল্ড থাকবে না। বরং বিএনপির সন্ত্রাসী প্রার্থীদের পাকড়াও করে জেলে নিক্ষেপের জন্য সর্বাত্মক সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
॥ তিন ॥
আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিষ্কার। ২০ দলের লাগাতার অবরোধ এবং হরতালের আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য এই সরকার হঠাৎ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। তারা ভেবেছিল যে, বিএনপি তথা ২০ দরীয় জোট তাদের নির্বাচন বর্জনের ধারাবাহিকতায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি নির্বাচনও বয়কট করবে। কিন্তু যখন বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিন্ধান্ত গ্রহণ করে, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে আটকা পড়ে। তবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করে রাখতে হলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরী দুটি তাদের করায়ত্ব করতেই হবে। সুতরাং তারা তাদের ট্র্র্যাটেজি পরিবর্তন করেছে। এখন গ্রহণ করেছে ফ্যাসিস্ট এবং নাৎসীদের মতো বলপ্রয়োগ করে ইলেকশনে জয়লাভ করা। তাই আজ যখন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বিরুদ্ধে মন্ত্রী-সাস্ত্রি তো দূরের কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই কথা বলেন, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। কারণ জনগণের বিজয়কে ছিনিয়ে নিয়ে সেটিকে আওয়ামী লীগের বিজয়ে পরিণত করার জন্য এটি ছাড়া তাদের আর কোনো পথ নেই।
এটি এখন আর আমাদের কথা নয়, এটি এখন সব মহলের এবং একশ্রেণীর পত্রপত্রিকার কথা যে রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ দেবে না আওয়ামী সরকার। সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি যাতে প্রাণশক্তি ফিরে না পায়, সেজন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সব ধরনের পদক্ষেপই অব্যাহত রাখবে আওয়ামী সরকার। সরাসরি না বললেও ঠারেঠুরে সেই ইঙ্গিতই দিয়ে যাচ্ছে তারা। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-মিনিস্টাররাই নন, খোদ শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি আমলারাও। সে কথাটিই সেদিন স্পষ্ট বলেছেন পুলিশের আইজি বা মহাপরিদর্শক শহীদুল হক। হবিগঞ্জের এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন শুধুমাত্র বাংলাদেশের নেতাই নন, তিনি একজন বিশ্ব নেতা।
আমাদের কাছে যে বিষয়টি বিবেচ্য সেটি হলো, শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতার স্ট্যাটাস পেয়েছেন কিনা, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। দেশের একজন নাগরিক যে কোনো নেতাকে মূল্যায়ন করতে পারেন। সেটি সম্পূর্ণরূপেই তার ব্যক্তিগত মতামত। কিন্তু একজন সরকারি অফিসার হয়ে; বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হয়ে তিনি কি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন? সরকারি অফিসার হিসেবে তিনি বা তার বাহিনী সরকারের হুকুম তামিল করবে। (অবশ্য এখানেও কথা আছে। সরকারি আচরণবিধিমালায় বলা আছে যে, সরকারি কর্মচারীরা শুধুমাত্র সরকারের আইনগত নির্দেশই পালন করবেন)। কিন্তু নেতাকে পলিটিক্যাল সার্টিফিকেট কোনো সরকারি কর্মকর্তা দিতে পারেন না।
এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশটি অঘোষিতভাবে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অধীনে চলে যাচ্ছে। যাচ্ছে বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না; বরং বলা যায়, প্রায় চলেই গেছে। তাই র্যাব বা বিজিবি প্রধানও রাজনৈতিক নেতার মতোই কথা বলেন। এমন একটি অবস্থায় এমাজউদ্দীন সাহেবরা যদি ভাবেন যে, তাদের সিটি ইলেকশনসমূহে জিততে দেয়া হবে, তাহলে বলতেই হয় যে, আজও তারা আওয়ামী লীগকে ঠিকমতো চিনে ওঠতে পারেননি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটি বিশেষ শক্তিকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই শক্তি কতদূর যায়- সেটিই এখন দেখার বিষয়।
অধ্যাপক এমাজউদ্দিন যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সেটি পড়ে মনে হচ্ছে সেই আপ্ত বাক্যটি, ‘If wishes were horses.’ তাহলে পৃথিবীটা কতই না সুন্দর হতো। তাহলে বাংলাদেশ একটি ফুলেল শুভেচ্ছার দেশে পরিণত হতো। কিন্তু ইচ্ছের স্বপ্নগুলো বাংলাদেশের মত দেশে কঠোর বাস্তবের আঘাতে বার বার মার খায়। কল্পনার ফানুসগুলো বার বার মাঝ আকাশে ফেটে যায়। গত শনিবার অধ্যাপক সাহেবের আশাবাদ প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ‘দিনকাল’ এবং আমার দেশ’ অনলাইনে। অথচ সেই একই দিন, অর্থাৎ শনিবার দৈনিক দিনকালের প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান সংবাদের শিরোনাম, ‘বিরোধীদের দাঁড়াতেই দিচ্ছে না পুলিশ/ ইসি নির্বিকার’। খবরে বলা হয়েছে, “মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দাখিল এবং যাচাই বাছাই শেষ হলেও পুলিশি অভিযানের মুখে বিরোধী দল সমর্থক প্রার্থীরা এখনও নির্বাচনী মাঠেই নামতে পারছেন না। পুলিশের সাজানো মামলা দিয়েই প্রার্থীদের টার্গেট করে চলেছে যৌথ বাহিনীর কথিত অভিযান। গ্রেফতারের ভয়ে প্রার্থীরা না এসে স্ত্রী, পুত্র ও আইনজীবীর মাধ্যমে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও এখনও নির্বাচনী কাজে যেতে পারছে না প্রার্থীরা। খোদ রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে পুলিশ আটক করছে প্রার্থীদের। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সর্বমহল থেকে দাবি থাকলেও নির্বাচন কমিশন এখনও নির্বিকার। ফলে ভোটাররা পড়েছেন বিপুল শঙ্কায়। নির্বাচনে বিএনপি জোটের অংশগ্রহণের পর থেকেই পুলিশ সম্ভাব্য প্রার্থীদের আটক করার জন্য বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করছে। এসব পুলিশি হামলা এবং মামলার ভয়েই উত্তরের মেয়র প্রার্থী আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং দক্ষিণের মির্জা আব্বাস ও আব্দুস সালাম সশরীরে নমিনেশন পেপার দাখিল করতে পারেননি। ২৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী সাইদুর রহমানকে পুলিশ রিটার্নিং অফিসার শাহ আলমের অফিসের সামনে থেকে গ্রেফতার করে। সাইদুর রহমান বলেন যে, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তারপরেও রিটার্নিং অফিসার ছিলেন নির্বিকার। ডিএমপি সূত্রে জানানো হয়েছে, দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন উপলক্ষে ডিএমপির ৪৯টি থানার ৩০০ পুরাতন মামলা সচল করে ৫০ হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে টার্গেট করেছে পুলিশ।
॥ দুই ॥
ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয়, বৃহস্পতিবার বিকাল ৪ টায় মিরপুরের দারুস সালাম থানায় কাউন্সিলরদের বাসায় পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালায়। এ সময় অন্তত ৯ জন বিএনপি প্রার্থীর বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। এছাড়া রাজধানীর আরও অন্তত ১৬টি ওয়ার্ডে পুলিশি অভিযানের খবর পাওয়া গেছে। এইসব অভিযান শুরু হয়েছে ২৯ মার্চ মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর থেকেই। একই ধরনের রিপোর্ট প্রায় সব পত্র-পত্রিকাতেই ছাপা হচ্ছে। দৈনিক ‘আমাদের সময় ডট কমের’ খবরের শিরোনাম, ‘বিএনপির নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান।’ ঐ রিপোর্ট মোতাবেক ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের ডিসি মাসুদুর রহমান বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতির চেষ্টা এবং যেন কোনো নাশকতা না হয় সেজন্য এই পুলিশী অভিযান চলছে। অন্তত ৪ জন প্রার্থীর খবর জানা গেছে, যাদের অভিযানের সময় বাসায় না পেয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং একজন মহিলা প্রার্থীর স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড শব্দটি এদেশে নতুন নয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি জোট যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগ এই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের আওয়াজ তুলেছিল। সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দাবিকে সেদিন ভারত এবং পশ্চিমা দুনিয়াও জোর সমর্থন দিয়েছিল। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল ক্ষেত্র তৈরির দাবিই শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রূপান্তিরিত হয়েছিল। নির্বাচনে সমতল ক্ষেত্র সৃষ্টি বলতে কী বোঝায়, সেটি এখন সকলেই জানেন। এর অর্থ হলো, সভা-সমিতি থেকে শুরু করে নির্বাচনী সকল কর্মকান্ডে বড়-ছোট নির্বিশেষে সকল দলের সমান সুযোগ-সুবিধা থাকা। আওয়ামী লীগের খাসলত এবং চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, বিরোধী দলে থাকলে গণতন্ত্র, সমান অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, রেডিও এবং টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন, সভা-সমাবেশ এবং মিছিলের অবাধ সুযেগা এবং অধিকার দাবিতে সোচ্চার হওয়া। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারা গণতন্ত্র, সাম্য, জনগণের অধিকার ইত্যাদি সব নীতিকথা ভুলে যায়। শুধু তা-ই নয়, যেসব অধিকারের জন্য তারা বিরোধী দলে থাকতে সংগ্রাম করেছে, সরকারে গিয়ে সর্বপ্রথম তারা সেই সব অধিকার পদদলিত করে। বিরোধী দলে থাকার সময় তারা পাকিস্তান আমল থেকে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা সর্বাগ্রে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির একদলীয় বাকশাল কায়েম করে। বিরোধী দলে থাকার সময় তারা নির্বাচিত দলীয় সরকারের পরিবর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আওয়াজ তোলে এবং সহিংসতার মাধ্যমে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করে ছাড়ে। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারা সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে হত্যা করে এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দাবির তুখোড় প্রবক্তা ছিলেন শেখ হাসিনা। এখন ক্ষমতায় এসে সেই শেখ হাসিনাই গত বুধবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে বিএনপি নেত্রী আবার কী সুর তুলেছেন। এর মধ্যে নাকি ‘বেসুর’ আছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আওয়াজ তুলেছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী হাসান মাহমুদ। বিএনপি নাকি একটি সন্ত্রাসী দল। সবার জন্য সমতল ক্ষেত্র থাকবে। কিন্তু বিএনপির জন্য লেভেল ফিল্ড থাকবে না। বরং বিএনপির সন্ত্রাসী প্রার্থীদের পাকড়াও করে জেলে নিক্ষেপের জন্য সর্বাত্মক সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
॥ তিন ॥
আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিষ্কার। ২০ দলের লাগাতার অবরোধ এবং হরতালের আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য এই সরকার হঠাৎ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। তারা ভেবেছিল যে, বিএনপি তথা ২০ দরীয় জোট তাদের নির্বাচন বর্জনের ধারাবাহিকতায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি নির্বাচনও বয়কট করবে। কিন্তু যখন বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিন্ধান্ত গ্রহণ করে, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে আটকা পড়ে। তবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করে রাখতে হলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরী দুটি তাদের করায়ত্ব করতেই হবে। সুতরাং তারা তাদের ট্র্র্যাটেজি পরিবর্তন করেছে। এখন গ্রহণ করেছে ফ্যাসিস্ট এবং নাৎসীদের মতো বলপ্রয়োগ করে ইলেকশনে জয়লাভ করা। তাই আজ যখন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বিরুদ্ধে মন্ত্রী-সাস্ত্রি তো দূরের কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই কথা বলেন, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। কারণ জনগণের বিজয়কে ছিনিয়ে নিয়ে সেটিকে আওয়ামী লীগের বিজয়ে পরিণত করার জন্য এটি ছাড়া তাদের আর কোনো পথ নেই।
এটি এখন আর আমাদের কথা নয়, এটি এখন সব মহলের এবং একশ্রেণীর পত্রপত্রিকার কথা যে রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ দেবে না আওয়ামী সরকার। সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি যাতে প্রাণশক্তি ফিরে না পায়, সেজন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সব ধরনের পদক্ষেপই অব্যাহত রাখবে আওয়ামী সরকার। সরাসরি না বললেও ঠারেঠুরে সেই ইঙ্গিতই দিয়ে যাচ্ছে তারা। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-মিনিস্টাররাই নন, খোদ শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি আমলারাও। সে কথাটিই সেদিন স্পষ্ট বলেছেন পুলিশের আইজি বা মহাপরিদর্শক শহীদুল হক। হবিগঞ্জের এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন শুধুমাত্র বাংলাদেশের নেতাই নন, তিনি একজন বিশ্ব নেতা।
আমাদের কাছে যে বিষয়টি বিবেচ্য সেটি হলো, শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতার স্ট্যাটাস পেয়েছেন কিনা, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। দেশের একজন নাগরিক যে কোনো নেতাকে মূল্যায়ন করতে পারেন। সেটি সম্পূর্ণরূপেই তার ব্যক্তিগত মতামত। কিন্তু একজন সরকারি অফিসার হয়ে; বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হয়ে তিনি কি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন? সরকারি অফিসার হিসেবে তিনি বা তার বাহিনী সরকারের হুকুম তামিল করবে। (অবশ্য এখানেও কথা আছে। সরকারি আচরণবিধিমালায় বলা আছে যে, সরকারি কর্মচারীরা শুধুমাত্র সরকারের আইনগত নির্দেশই পালন করবেন)। কিন্তু নেতাকে পলিটিক্যাল সার্টিফিকেট কোনো সরকারি কর্মকর্তা দিতে পারেন না।
এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশটি অঘোষিতভাবে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অধীনে চলে যাচ্ছে। যাচ্ছে বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না; বরং বলা যায়, প্রায় চলেই গেছে। তাই র্যাব বা বিজিবি প্রধানও রাজনৈতিক নেতার মতোই কথা বলেন। এমন একটি অবস্থায় এমাজউদ্দীন সাহেবরা যদি ভাবেন যে, তাদের সিটি ইলেকশনসমূহে জিততে দেয়া হবে, তাহলে বলতেই হয় যে, আজও তারা আওয়ামী লীগকে ঠিকমতো চিনে ওঠতে পারেননি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটি বিশেষ শক্তিকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই শক্তি কতদূর যায়- সেটিই এখন দেখার বিষয়।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন