প্রায় এক দশক বা তারও আগে দেশের বরেণ্য কবি আল মাহমুদ একটি কবিতা লিখে দারুণ বিপাকে পড়েছিলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল আর বুয়েটের মাঝামাঝি এলাকায় প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি ছিনতাই ডাকাতি রাহাজানি হতো। ঐ পথে চলাচলকারী নারীরাও নিরাপদ ছিলেন না বিশেষ করে সন্ধ্যার পর। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হতো। সে খবরে ফুঁসে উঠেছিল সাধারণ মানুষও।
এর ওপর ভিত্তি করে কবি আল মাহমুদ লিখেছিলেন একটি কবিতা। তার শিরোনাম ছিলো- ‘কদর রাত্রির প্রার্থনা’। সেই কবিতায় লুণ্ঠিত লাঞ্ছিত নিগৃহীত মানবতা পুনরুদ্ধারের জন্য কদর রাত্রে মহান আল্লাহ তা’য়ালার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন কবি। তিনি লিখেছেন ‘হে আল্লাহ/হে সমস্ত উদয়দিগন্ত ও অস্তাচলগামী আলোকরশ্মির মালিক/আজকের এই পবিত্র মহাযামিনির সব রকম বরকত আমাকে দাও।/আমাকে দাও সেই উত্তেজক মুহূর্তে স্বর্গীয় পুলক যাতে/একটি সামান্য গুহার প্রস্তুরীভূত শিলাসহ কেঁপে উঠেছিলেন/মহানবী মোহাম্মদ (সাঃ)/না আমি তো পড়তে পারছি না এই অন্ধকারের অন্তস্তলে/বিদ্যুতের ঝলকানি কোন্ অক্ষর আর ইঙ্গিতময় বাণী ক্রমাগত লিখে যাচ্ছে/ শুধু আমার মাতৃভূমিকে পেঁচিয়ে আবর্তিত হচ্ছে এক কুটিল অন্ধকার।’
তারপর স্বদেশের জন্য তার অনেক আবেগময় তাড়িত প্রার্থনা। ‘আমরা বৃষ্টির প্রার্থনা করে তোমার কাছে পেলাম/আমাদেরই অনুতপ্ত অশ্রুবারী/তোমার বিন্দুমাত্র ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাসে দুমড়ে-মুচড়ে উড়ে গেলো/কত গ্রাম আর অসহায় মানুষের বাসস্থান/উহ্, গাছগুলোর দিকে তাকালে অন্তরাত্মার না না/ করে ওঠে। যেন যুদ্ধ শেষে/অসংখ্য বল্লম বিজয়ীরা মৃতের ময়দানে উলটো করে পুঁতে রেখেছে।’
কবিতায় তিনি আরও বলেছেন, ‘হে আল্লাহ্/পবিত্রতম মহাযামিনীর অধিপতি,/তুমি তো একের পাপ অন্যের ঘাড়ে বর্তাও না।/পিতার পাপ পুত্রকে স্পর্শ না করার, হে প্রতিশ্রুতিদানকারী/দ্যাখ সহস্রাধিক মানুষের লাশ নিয়ে আমরা কোরআন নজুলের/পুণ্য রজনীতে এখন সিজদারত/আমাদের রাজ-রাজড়াদের পাপে তুমি যেন আমাদের ধ্বংস করে দিও না।/কেন এক প্রাচীন তৈহীদবাদী জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার রজ্জু/তুমি পরাক্রান্ত পৌত্তলিকদের হাতে তলে দিতে চাও?/আমরা কি বংশানুক্রমে তোমার দাস নই?/আমরা তোমার নামের কোনো জেহাদেই অতীতে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিনি।/তোমার অনুগ্রহ থাকলে/আমাদের সিজদারত সন্ততিরাও রক্ত-বারুদের সমাধানই/শেষ পর্যন্ত বেছে নেবে/ এই পুণ্য রজনীতে আমাদের আবরিত স্ত্রীদের ও কন্যাদের গোনা প্রভু/মাফ করে দাও।/কদর রাত্রির প্রার্থনায় বলা হয়েছে, ‘হে অনুকম্পার মহান অধিপতি,/এই মহানগরীর ভদ্রবেশী বেশ্যা, লম্পট, হেরোইনসেবী ও ছিনতাইকারীর/প্রাত্যহিক পাপের দেনায় আমরা এমনিতেই অতিষ্ঠ,/এর সাথে যোগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান পন্ডিতেরা/শিক্ষার প্রতিটি প্রাঙ্গণ কিশোর হত্যার মহাপাপে এখন রক্তাক্ত, পঙ্কিল।/প্রকৃত পাপীদের বিনাশ তরান্বিত করতে তুমি কি বাংলাদেশের/প্রতিটি বিদ্যাপিঠকে বিরান করে ফেলবে?/এমনিতেই গ্রামে গ্রামে ধসে পড়া স্কুল, বাড়িগুলোর ভেতর থেকে/শেয়াল আর পেঁচার ডাকে প্রাইমারী স্কুলের আবু মাস্টারের ঘুম নেই/তার মধ্যে তারই একমাত্র শহুরে পড়ুয়া মেয়েটির গলার চেন ও হাতের বালা/জগন্নাথ হলের পাশের রাস্তা থেকে ছিনতাই হলো। বুকের উপর ছুরি রেখে/খুলে দে হারামজাদী, চুপ্’।
আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘আমরা তো চুপ করেই আছি, তবু হে পরোয়ারদিগার/জানতে সাধ জাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি ডাকাতদের গ্রাম?/বাল্যে যেমন কোনো গাঁয়ের পাশ দিয়ে নাও বেয়ে ফিরতে গেলে/মুরুব্বীরা বলতেন, ওপথে যেও না অমুকটা হলো ডাকাতের গ্রাম।/প্রভু/ডাকাত, ছিনতাইকারী, পন্ডিত ও বেশ্যাদের হাত থেকে তুমি ইল্মকে রক্ষা করবে না?-রাব্বি যিদনী ইল্মা-/প্রভু, আমাদের জ্ঞান দান করো।’
সেখানে গ্রাম জীবনের বর্ণনা ছিল। চোর-ডাকাতের গ্রামের পরিচিতি ছিল। তা নিয়ে ছেলেপেলেদের আগে থেকেই অভিভাবকরা শিখিয়েছেন, ও গ্রামের পাশ দিয়ে যেন আমরা কেউ না যাই। আমাদের গ্রামেও ডাকাতের বাড়ি ছিল। চোরের বাড়ি ছিল। আমরা সেসব বাড়ি এড়িয়ে চলেছি। তা নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত ছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য়ও আছে চোরের গ্রামের অসাধারণ বর্ণনা ও তাদের জীবনধারার বিবরণ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘পুল পার হইয়া কিছুদুর অবধি রাস্তার দু’পাশে শুধু চষা ক্ষেত। তারপর গ্রাম আরম্ভ হইয়াছে। এদিকে বসতি কম। রাস্তার দক্ষিণে ঝোপঝাপের বেষ্টনীর মধ্যে পৃথক কয়েকটা ভাঙাচোরা ঘর বৃষ্টিতে ঘরে-বাইরে ভিজিয়াছে। ওখানে সাত ঘর বাগদী বাস করে। গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ওরাই সবচেয়ে গরীব, সবচেয়ে ছোটলোক, সবচেয়ে চোর। দিনে ওরা যে গৃহস্থের চাল মেরামত করে রাত্রে সুযোগ পাইলে তাহারই ভিটায় সিঁদ দেয়। কেও না কেও ওদের মধ্যে ছয় মাস-এক বছর জেলেই পড়ে আছে। ছাড়া পাইবার পর গ্রামে ফিরিয়া বলে, শ্বশুর-ঘর থে ফিরলুম দাদা। বেশ ছিলাম গো!’
কবি আল মাহমুদের অনন্য সাধারণ কবিতাটি প্রকাশিত হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এখানকার-ওখানকার তথাকথিত পন্ডিতেরা মূর্খের মতো তারস্বরে চিৎকার আরম্ভ করলো। বললো, আল মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা একেবারে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন। এই নষ্ট লোকেরা আজকের দিনের মতোই মূর্খতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দিয়েছিলো। কেউ কেউ এমনও ইঙ্গিত করেছিলেন যে, আল মাহমুদ যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি তাই তার এতবড় ধৃষ্ঠতা। এমন অমার্জনীয় অপরাধের জন্য তাকে করজোড়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। যে কবি জাতির কল্যাণের জন্য, জাতির ইলমের জন্য শবেকদরের রাত্রে মহান আল্লাহ্ তা’য়ালার কাছে প্রার্থনা করছেন, সেই উন্নতশির কবি কতগুলো নাখান্দা লোকের কাছে একালের মেরুদ-হীন কথাসাহিত্যিক হাসনাত আব্দুল হাইয়ের মতো করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন? হাসনাত আব্দুল হাইয়ের একটি গল্পের প্রতিবাদ করেছিলো কিছু শাহবাগী লাফাঙ্গা। আর তিনি করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বসলেন। এমনকি ঘোষণা করলেন, ভবিষ্যতে তার লেখা এই ছোট গল্পটি তিনি তার কোনো বইয়ে ঠাই দেবেন না। আল মাহমুদ মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দাঁড়িয়ে আছেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত তার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র তৃতীয় সংস্করণে কবিতাটি সমুজ্জল হয়ে আছে। আত্মমর্যাদাবান মানুষের এমনই হতে হয়।
এখন কি জবাব দেবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বঘোষিত প-িতেরা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বিভিন্ন কলেজেও এবারের পহেলা বৈশাখে নারীদের ইজ্জতহানির যে মহোৎসব অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক-ছাত্ররা তার কি জাবাব দেবেন? আল মাহমুদের যে কাব্যগ্রন্থে এই কবিতাটি সন্নিবেশিত হয়েছে তার নাম ‘একচক্ষু হরিণ’। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। যদি সেদিন দরিদ্র স্কুল মাস্টার আবু মিয়ার ‘একমাত্র শহুরে পড়ুয়া মেয়েটির’ ছিনতাইয়ের বিচার হতো, আল মাহমুদের বিরুদ্ধে রাস্তায় রাস্তায় চিল্লাপাল্লা না করে ছিনতাইকারীদের ধরে শাস্তির বিধানের দাবি করা হতো, তাহলে আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণশ্লীলতাহানির ঘটনা কিছুতেই ঘটতো না। সেসব বুঝবার শক্তি এই ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের আছে বলে মনে হয় না। আর মহান আল্লাহ তা’য়ালা যাদের কলফ্ এ সিল মেরে দিয়েছেন, যোগ্যতার প্রশ্ন নেই, তারাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদ অলঙ্কৃত করছেন। আর সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নিগ্রহ এখন দৈনন্দিন ও স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ‘রাব্বি যিদনি ইল্মা/প্রভু, আমাদের জ্ঞান দান করো’। আর শাসকের পাপের জন্য আমাদের শাস্তি দিও না।
এখন ভিন্নচিত্র দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তরুণী-যুবতী, মা-কন্যা নির্বিশেষে যারা গণহারে দলিত, মথিত, লাঞ্ছিত হলেন, শ্লীলতাহানির শিকার হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলো না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা তো হবার কথা-উদার জ্ঞান, মুক্ত মন ও মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য। দুশ্চরিত্র শাসকেরা সেই মৌলিক মূল্যবোধগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। আর তাই একেবারেই আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগ চালু হয়েছে বাংলাদেশে।
কিন্তু তার ভেতরেও ‘সত্য’ সাধকের অভাব হয় না। কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেছেন, ‘সত্য কে আজ হত্যা করে অত্যাচার খাঁড়ায়?/ নাই কিরে কেউ সত্য সাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?’ দু’চারজন সত্য সাধক তো আছেন। এত গড্ডালিকা প্রবাহের মধ্যেও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দী ও তার সহযোগীরা। ছাত্রলীগের নির্যাতনে বস্ত্রহারা নারীরা যখন অধিকতর লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছিলেন, তখন এগিয়ে গিয়ে বাধা দিয়েছেন নিজের গায়ের শার্ট, পাঞ্জাবী খুলে তাদের আব্রু রক্ষার চেষ্টা করেছেন। পুলিশের দল মেয়েদের এই শ্লীলতাহানির দৃশ্য যেন উপভোগই করছিলো। লিটন যখন তাদের বলছিলেন, মেয়েটিকে বাঁচান, পুলিশ তাদের বলেছে-ওটা তাদের ডিউটির এলাকা নয়। আর্তচিৎকারকারী মেয়েদের বাঁচাতে আসেনি পুলিশ। দু’ঘণ্টা তান্ডবের পর জনতাই যখন ফুঁসে উঠেছিলো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো, তখন এগিয়ে এসেছিলো পুলিশ। সম্ভবত কৃতিত্বটুকু নেবার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আমজাদ আলীকে জানানো হয়েছিলো বহু আগেই। তিনি দেখছি বলে কম্পিউটারে দাবা খেলছিলেন। এগিয়ে আসেননি। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়? ধিক্কার দেই সেই সব কর্তৃপক্ষকে, যারা এইসব নষ্ট লোকদের শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন, যারা তাদের প্রক্টরের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করেছেন।
এই প্রক্টরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেননি। কবি আল মাহমুদও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না। মহাকবি সেক্সপীয়ার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম-এদের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন না। কিন্তু আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ বছর লেখাপড়া করেছি। এখান থেকেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছি। বেদনায় নীল হয়ে যাই। আমার ভালোবাসার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এখন ডাকাতদের গ্রামে পরিণত হয়েছে। পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মিলে এখন ঐ ধর্ষণকারীদের রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তারা যা বলছেন তার সঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, ভিডিও ফুটেজ বা স্টিল ক্যামেরার ছবি কোনোটাই মিলছে না। শ্লীলতাহানিকারীদের ছবি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লাঞ্ছনার শিকার নারীকে লাঞ্ছিত হতে দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ বলছে-তাদের চেনা যাচ্ছে না। এই গণদুশমনদের হাত থেকে জনগণকেই সম্মিলিতভাবে দেশ ও মানুষকে রক্ষা করতে হবে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সেই তওফিক দান করুন। আমীন।
এর ওপর ভিত্তি করে কবি আল মাহমুদ লিখেছিলেন একটি কবিতা। তার শিরোনাম ছিলো- ‘কদর রাত্রির প্রার্থনা’। সেই কবিতায় লুণ্ঠিত লাঞ্ছিত নিগৃহীত মানবতা পুনরুদ্ধারের জন্য কদর রাত্রে মহান আল্লাহ তা’য়ালার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন কবি। তিনি লিখেছেন ‘হে আল্লাহ/হে সমস্ত উদয়দিগন্ত ও অস্তাচলগামী আলোকরশ্মির মালিক/আজকের এই পবিত্র মহাযামিনির সব রকম বরকত আমাকে দাও।/আমাকে দাও সেই উত্তেজক মুহূর্তে স্বর্গীয় পুলক যাতে/একটি সামান্য গুহার প্রস্তুরীভূত শিলাসহ কেঁপে উঠেছিলেন/মহানবী মোহাম্মদ (সাঃ)/না আমি তো পড়তে পারছি না এই অন্ধকারের অন্তস্তলে/বিদ্যুতের ঝলকানি কোন্ অক্ষর আর ইঙ্গিতময় বাণী ক্রমাগত লিখে যাচ্ছে/ শুধু আমার মাতৃভূমিকে পেঁচিয়ে আবর্তিত হচ্ছে এক কুটিল অন্ধকার।’
তারপর স্বদেশের জন্য তার অনেক আবেগময় তাড়িত প্রার্থনা। ‘আমরা বৃষ্টির প্রার্থনা করে তোমার কাছে পেলাম/আমাদেরই অনুতপ্ত অশ্রুবারী/তোমার বিন্দুমাত্র ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাসে দুমড়ে-মুচড়ে উড়ে গেলো/কত গ্রাম আর অসহায় মানুষের বাসস্থান/উহ্, গাছগুলোর দিকে তাকালে অন্তরাত্মার না না/ করে ওঠে। যেন যুদ্ধ শেষে/অসংখ্য বল্লম বিজয়ীরা মৃতের ময়দানে উলটো করে পুঁতে রেখেছে।’
কবিতায় তিনি আরও বলেছেন, ‘হে আল্লাহ্/পবিত্রতম মহাযামিনীর অধিপতি,/তুমি তো একের পাপ অন্যের ঘাড়ে বর্তাও না।/পিতার পাপ পুত্রকে স্পর্শ না করার, হে প্রতিশ্রুতিদানকারী/দ্যাখ সহস্রাধিক মানুষের লাশ নিয়ে আমরা কোরআন নজুলের/পুণ্য রজনীতে এখন সিজদারত/আমাদের রাজ-রাজড়াদের পাপে তুমি যেন আমাদের ধ্বংস করে দিও না।/কেন এক প্রাচীন তৈহীদবাদী জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার রজ্জু/তুমি পরাক্রান্ত পৌত্তলিকদের হাতে তলে দিতে চাও?/আমরা কি বংশানুক্রমে তোমার দাস নই?/আমরা তোমার নামের কোনো জেহাদেই অতীতে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিনি।/তোমার অনুগ্রহ থাকলে/আমাদের সিজদারত সন্ততিরাও রক্ত-বারুদের সমাধানই/শেষ পর্যন্ত বেছে নেবে/ এই পুণ্য রজনীতে আমাদের আবরিত স্ত্রীদের ও কন্যাদের গোনা প্রভু/মাফ করে দাও।/কদর রাত্রির প্রার্থনায় বলা হয়েছে, ‘হে অনুকম্পার মহান অধিপতি,/এই মহানগরীর ভদ্রবেশী বেশ্যা, লম্পট, হেরোইনসেবী ও ছিনতাইকারীর/প্রাত্যহিক পাপের দেনায় আমরা এমনিতেই অতিষ্ঠ,/এর সাথে যোগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান পন্ডিতেরা/শিক্ষার প্রতিটি প্রাঙ্গণ কিশোর হত্যার মহাপাপে এখন রক্তাক্ত, পঙ্কিল।/প্রকৃত পাপীদের বিনাশ তরান্বিত করতে তুমি কি বাংলাদেশের/প্রতিটি বিদ্যাপিঠকে বিরান করে ফেলবে?/এমনিতেই গ্রামে গ্রামে ধসে পড়া স্কুল, বাড়িগুলোর ভেতর থেকে/শেয়াল আর পেঁচার ডাকে প্রাইমারী স্কুলের আবু মাস্টারের ঘুম নেই/তার মধ্যে তারই একমাত্র শহুরে পড়ুয়া মেয়েটির গলার চেন ও হাতের বালা/জগন্নাথ হলের পাশের রাস্তা থেকে ছিনতাই হলো। বুকের উপর ছুরি রেখে/খুলে দে হারামজাদী, চুপ্’।
আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘আমরা তো চুপ করেই আছি, তবু হে পরোয়ারদিগার/জানতে সাধ জাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি ডাকাতদের গ্রাম?/বাল্যে যেমন কোনো গাঁয়ের পাশ দিয়ে নাও বেয়ে ফিরতে গেলে/মুরুব্বীরা বলতেন, ওপথে যেও না অমুকটা হলো ডাকাতের গ্রাম।/প্রভু/ডাকাত, ছিনতাইকারী, পন্ডিত ও বেশ্যাদের হাত থেকে তুমি ইল্মকে রক্ষা করবে না?-রাব্বি যিদনী ইল্মা-/প্রভু, আমাদের জ্ঞান দান করো।’
সেখানে গ্রাম জীবনের বর্ণনা ছিল। চোর-ডাকাতের গ্রামের পরিচিতি ছিল। তা নিয়ে ছেলেপেলেদের আগে থেকেই অভিভাবকরা শিখিয়েছেন, ও গ্রামের পাশ দিয়ে যেন আমরা কেউ না যাই। আমাদের গ্রামেও ডাকাতের বাড়ি ছিল। চোরের বাড়ি ছিল। আমরা সেসব বাড়ি এড়িয়ে চলেছি। তা নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত ছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য়ও আছে চোরের গ্রামের অসাধারণ বর্ণনা ও তাদের জীবনধারার বিবরণ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘পুল পার হইয়া কিছুদুর অবধি রাস্তার দু’পাশে শুধু চষা ক্ষেত। তারপর গ্রাম আরম্ভ হইয়াছে। এদিকে বসতি কম। রাস্তার দক্ষিণে ঝোপঝাপের বেষ্টনীর মধ্যে পৃথক কয়েকটা ভাঙাচোরা ঘর বৃষ্টিতে ঘরে-বাইরে ভিজিয়াছে। ওখানে সাত ঘর বাগদী বাস করে। গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ওরাই সবচেয়ে গরীব, সবচেয়ে ছোটলোক, সবচেয়ে চোর। দিনে ওরা যে গৃহস্থের চাল মেরামত করে রাত্রে সুযোগ পাইলে তাহারই ভিটায় সিঁদ দেয়। কেও না কেও ওদের মধ্যে ছয় মাস-এক বছর জেলেই পড়ে আছে। ছাড়া পাইবার পর গ্রামে ফিরিয়া বলে, শ্বশুর-ঘর থে ফিরলুম দাদা। বেশ ছিলাম গো!’
কবি আল মাহমুদের অনন্য সাধারণ কবিতাটি প্রকাশিত হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এখানকার-ওখানকার তথাকথিত পন্ডিতেরা মূর্খের মতো তারস্বরে চিৎকার আরম্ভ করলো। বললো, আল মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা একেবারে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন। এই নষ্ট লোকেরা আজকের দিনের মতোই মূর্খতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দিয়েছিলো। কেউ কেউ এমনও ইঙ্গিত করেছিলেন যে, আল মাহমুদ যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি তাই তার এতবড় ধৃষ্ঠতা। এমন অমার্জনীয় অপরাধের জন্য তাকে করজোড়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। যে কবি জাতির কল্যাণের জন্য, জাতির ইলমের জন্য শবেকদরের রাত্রে মহান আল্লাহ্ তা’য়ালার কাছে প্রার্থনা করছেন, সেই উন্নতশির কবি কতগুলো নাখান্দা লোকের কাছে একালের মেরুদ-হীন কথাসাহিত্যিক হাসনাত আব্দুল হাইয়ের মতো করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন? হাসনাত আব্দুল হাইয়ের একটি গল্পের প্রতিবাদ করেছিলো কিছু শাহবাগী লাফাঙ্গা। আর তিনি করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বসলেন। এমনকি ঘোষণা করলেন, ভবিষ্যতে তার লেখা এই ছোট গল্পটি তিনি তার কোনো বইয়ে ঠাই দেবেন না। আল মাহমুদ মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দাঁড়িয়ে আছেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত তার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র তৃতীয় সংস্করণে কবিতাটি সমুজ্জল হয়ে আছে। আত্মমর্যাদাবান মানুষের এমনই হতে হয়।
এখন কি জবাব দেবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বঘোষিত প-িতেরা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বিভিন্ন কলেজেও এবারের পহেলা বৈশাখে নারীদের ইজ্জতহানির যে মহোৎসব অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক-ছাত্ররা তার কি জাবাব দেবেন? আল মাহমুদের যে কাব্যগ্রন্থে এই কবিতাটি সন্নিবেশিত হয়েছে তার নাম ‘একচক্ষু হরিণ’। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। যদি সেদিন দরিদ্র স্কুল মাস্টার আবু মিয়ার ‘একমাত্র শহুরে পড়ুয়া মেয়েটির’ ছিনতাইয়ের বিচার হতো, আল মাহমুদের বিরুদ্ধে রাস্তায় রাস্তায় চিল্লাপাল্লা না করে ছিনতাইকারীদের ধরে শাস্তির বিধানের দাবি করা হতো, তাহলে আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণশ্লীলতাহানির ঘটনা কিছুতেই ঘটতো না। সেসব বুঝবার শক্তি এই ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের আছে বলে মনে হয় না। আর মহান আল্লাহ তা’য়ালা যাদের কলফ্ এ সিল মেরে দিয়েছেন, যোগ্যতার প্রশ্ন নেই, তারাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদ অলঙ্কৃত করছেন। আর সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নিগ্রহ এখন দৈনন্দিন ও স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ‘রাব্বি যিদনি ইল্মা/প্রভু, আমাদের জ্ঞান দান করো’। আর শাসকের পাপের জন্য আমাদের শাস্তি দিও না।
এখন ভিন্নচিত্র দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তরুণী-যুবতী, মা-কন্যা নির্বিশেষে যারা গণহারে দলিত, মথিত, লাঞ্ছিত হলেন, শ্লীলতাহানির শিকার হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলো না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা তো হবার কথা-উদার জ্ঞান, মুক্ত মন ও মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য। দুশ্চরিত্র শাসকেরা সেই মৌলিক মূল্যবোধগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। আর তাই একেবারেই আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগ চালু হয়েছে বাংলাদেশে।
কিন্তু তার ভেতরেও ‘সত্য’ সাধকের অভাব হয় না। কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেছেন, ‘সত্য কে আজ হত্যা করে অত্যাচার খাঁড়ায়?/ নাই কিরে কেউ সত্য সাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?’ দু’চারজন সত্য সাধক তো আছেন। এত গড্ডালিকা প্রবাহের মধ্যেও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দী ও তার সহযোগীরা। ছাত্রলীগের নির্যাতনে বস্ত্রহারা নারীরা যখন অধিকতর লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছিলেন, তখন এগিয়ে গিয়ে বাধা দিয়েছেন নিজের গায়ের শার্ট, পাঞ্জাবী খুলে তাদের আব্রু রক্ষার চেষ্টা করেছেন। পুলিশের দল মেয়েদের এই শ্লীলতাহানির দৃশ্য যেন উপভোগই করছিলো। লিটন যখন তাদের বলছিলেন, মেয়েটিকে বাঁচান, পুলিশ তাদের বলেছে-ওটা তাদের ডিউটির এলাকা নয়। আর্তচিৎকারকারী মেয়েদের বাঁচাতে আসেনি পুলিশ। দু’ঘণ্টা তান্ডবের পর জনতাই যখন ফুঁসে উঠেছিলো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো, তখন এগিয়ে এসেছিলো পুলিশ। সম্ভবত কৃতিত্বটুকু নেবার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আমজাদ আলীকে জানানো হয়েছিলো বহু আগেই। তিনি দেখছি বলে কম্পিউটারে দাবা খেলছিলেন। এগিয়ে আসেননি। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়? ধিক্কার দেই সেই সব কর্তৃপক্ষকে, যারা এইসব নষ্ট লোকদের শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন, যারা তাদের প্রক্টরের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করেছেন।
এই প্রক্টরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেননি। কবি আল মাহমুদও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না। মহাকবি সেক্সপীয়ার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম-এদের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন না। কিন্তু আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ বছর লেখাপড়া করেছি। এখান থেকেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছি। বেদনায় নীল হয়ে যাই। আমার ভালোবাসার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এখন ডাকাতদের গ্রামে পরিণত হয়েছে। পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মিলে এখন ঐ ধর্ষণকারীদের রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তারা যা বলছেন তার সঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, ভিডিও ফুটেজ বা স্টিল ক্যামেরার ছবি কোনোটাই মিলছে না। শ্লীলতাহানিকারীদের ছবি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লাঞ্ছনার শিকার নারীকে লাঞ্ছিত হতে দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ বলছে-তাদের চেনা যাচ্ছে না। এই গণদুশমনদের হাত থেকে জনগণকেই সম্মিলিতভাবে দেশ ও মানুষকে রক্ষা করতে হবে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সেই তওফিক দান করুন। আমীন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন