শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৫

১৭ এপ্রিল এবং ইতিহাসের এক উপেক্ষিত প্রধান পুরুষ


সময় আসলেও ‘বহিয়া যায়’! দেখতে দেখতে আরো একবার ১৭ এপ্রিল এসে গেলো। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবারও সরকার যথেষ্ট ধুমধামের সঙ্গে এবং সরকারিভাবে দিনটিকে ‘মুজিবনগর দিবস’ হিসেবে পালন করবে। বস্তুত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দিনটি বিশেষ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত ও ঘোষিত অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তাজউদ্দিন আহমদ না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এত সুসংগঠিত হতে এবং এত অল্প সময়ে বিজয় অর্জন করতে পারতো না। সরকার গঠন করা থেকে শুরু করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও ভারতের সহযোগিতা নিয়ে দেশকে স্বাধীন করা পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়ায় প্রধান এবং সফল নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। বিবদমান আওয়ামী লীগ নেতাদের ঐক্যবদ্ধ রাখার এবং অন্য সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা আদায়ের ক্ষেত্রেও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। মুক্তিযোদ্ধাদেরও সফলভাবে তিনিই পরিচালনা করেছিলেন। এসব কারণে মুজিবনগর দিবসে অন্য যে কারো চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের অবদানের কথা স্মরণ করা এবং নতুন প্রজন্মসহ জাতিকে জানানো উচিত।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দিবসটিকে এমনভাবে পালন করে যেন ‘মুজিবনগর’ নামে একটি এলাকা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই দিনটিকে বেছে নেয়া হয়েছিল! আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো ভাষণে-বিবৃতিতে তাই তাজউদ্দিন আহমদের তেমন স্থান মেলে না, ঘটনাক্রমে তার উল্লেখ থাকে মাত্র- যেন তিনিও অনেকের মধ্যে সাধারণ একজন ছিলেন! এজন্যই দেখা যায়, ১৭ এপ্রিল সকাল হতে না হতে সবাই পাল্লা দিয়ে ছুটে যান ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার সড়কে, নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে পুষ্পমাল্য পরিয়ে দেন তাদের ‘বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতিতে। বনানী কবরস্থানেও অনেকে গিয়ে থাকেন, কিন্তু তাজউদ্দিন আহমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নয়। তারা যান সেখানে শায়িত অন্য নেতাদের জন্য দোয়া করতে। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সত্যি সম্মান দেখানোর সদিচ্ছা থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত মন্ত্রিসভাসহ দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বনানী কবরস্থানে যাওয়া এবং বিশেষ করে তাজউদ্দিন আহমদের প্রতি সম্মান দেখানো। কবরস্থানে যাওয়ার বিষয় শুধু নয়, দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত সভা ও সেমিনারেও তাজউদ্দিন আহমদকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে উপস্থাপন করা হয় না। সবাই গুণগান করেন কেবল শেখ মুজিববুর রহমানের। ফলে দিবসটি কেন ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে, দিবসটির তাৎপর্য কী এবং ১৯৭১ সালের এই দিনে কার ঠিক কোন ধরনের ভূমিকা ছিল, নেতাদের কে তখন কেন কোথায় ছিলেন- এসবের কিছুই জানতে পারে না নতুন প্রজন্ম। অথচ তাদেরই সব কিছু সুনির্দিষ্টভাবে জানা দরকার।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ‘বিকৃত’ ইতিহাসের পরিবর্তে জাতিকে আরো একবার ‘সঠিক’ ইতিহাস শেখানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে বলেই এখানে ‘মুজিবনগর দিবসের’ পটভূমি এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা সম্পর্কে জানানো দরকার। বাস্তবে ‘মুজিবনগর’ হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে কম-বেশি সবারই জানা রয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের একেবারে শেষবাক্যে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পরও প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে অসততা না থাকলেও পাকিস্তানীরা আলোচনার ফাঁকে গণহত্যার জন্য সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। ২৫ মার্চ ছিল খুবই অস্বাভাবিক একটি দিন। শেখ মুজিবের সর্বশেষ প্রস্তাবের জবাবে ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য জানানোর কথা ছিল সেদিন। কথা ছিল ড. কামাল হোসেনকে ফোন করবেন জেনারেল পীরজাদা। শেখ মুজিবও অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু রাত দশটা পর্যন্তও তেমন কোনো ফোন পাননি কামাল হোসেন। তিনি এরপর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে। শেখ মুজিব তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন- যা দেখে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মনে হয়েছিল ‘লাস্ট সাপার’।
ফোন না আসার কথা জেনে বিমর্ষ হয়ে পড়া প্রধান নেতা শেখ মুজিব ড. কামাল হোসেনদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম অনুরোধ করলেও তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হননি শেখ মুজিব। এর পরের ঘটনাক্রম জানাতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম জানিয়েছেন, ২৫ মার্চ রাত দশটার পর শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি এবং ড. কামাল হোসেন গিয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদের ধানমন্ডির বাসভবনে। তারা যাওয়ার পরপর ইপিআরের একজন হাবিলদার এসে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশংকায় ইপিআরের সকল বাঙালী সদস্য পিলখানা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। এ কথা শোনার পরই তাজউদ্দিন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। পথে কামাল হোসেন ধানমন্ডির চার নাম্বার রোডের একটি বাসায় ঢুকেছিলেন দেয়াল টপকে। অন্যদিকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দিন আহমদ পা বাড়িয়েছিলেন ভারতের দিকে।
প্রধান নেতা শেখ মুজিবের দিক থেকে কোনো নির্দেশনা না থাকায় এর পরের প্রতিটি পদক্ষেপ তাজউদ্দিন আহমদ নিয়েছিলেন একক সিদ্ধান্তে। বিভিন্ন পর্যায়ে রীতিমতো ইন্টারভিউ দিয়ে তাকে ভারতীয়দের কাছে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, তিনিই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ। ভারতীয়রা তার পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ৩ এপ্রিল তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শেই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে তার একটি ভাষণও প্রচার করেছিল ভারত সরকার। ১০ এপ্রিল গঠিত সে সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিল। এখানে ব্যক্তির চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিষয়ের। আর বিষয়টি ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম সরকার গঠন ও সরকারের শপথবাক্য পাঠ। তা সত্ত্বেও ব্যক্তির মহিমা কীর্তনের অর্থ আসলে ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। কিন্তু চাটুকারিতার মাধ্যমে নিজেদের ফায়দা হাসিল করার জন্য একটি চিহ্নিত গোষ্ঠীর উদ্যোগে স্বাধীনতার পর বিষয়টিকে আড়াল করা হয়েছে। প্রাধান্যে আনা হয়েছে ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানকে। এজন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের ঐতিহাসিক দিনটি পরিণত হয়েছে মুজিবনগর দিবসে।
উল্লেখ্য, ইতিহাসের মূল্যায়নে সঠিক, সময়োচিত ও দিক-নির্ধারণী হিসেবে প্রমাণিত হলেও সরকার গঠন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেয়াটা তাজউদ্দিন আহমদের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। প্রতি পদক্ষেপে তাকে বাধাগ্রস্ত, সমালোচিত এবং বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একক সিদ্ধান্তে তিনি এমন এক সময়ে সরকার গঠন করেছিলেন যখন আওয়ামী লীগের প্রায় প্রত্যেক নেতাই ছিলেন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং পলায়নরত। শেখ মুজিবের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় তাজউদ্দিন আহমদের সিদ্ধান্তকে তখন চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অনেকেই। শেখ ফজলুল হক মনি, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান ও মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবি তুলেছিলেন। অন্য নেতারাও নানাভাবে তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে থেকেছেন উঠে-পড়ে। তাদের সঙ্গে উস্কানিদাতার ভূমিকায় নেমেছিলেন আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে পরিচিত সেকালের ‘মস্কোপন্থী’ কমিউনিস্টরা- ‘কমরেড’ মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ প্রমুখ। কিন্তু একদিকে তাজউদ্দিন আহমদের নিজের নিষ্ঠা, সততা ও নিখাদ দেশপ্রেম এবং অন্যদিকে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর সমর্থন তাকে রক্ষা করেছিল। এজন্যই তাজউদ্দিন আহমদের পক্ষে সাফল্যের সঙ্গে সরকার পরিচালনা করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছিল। স্মরণ করা দরকার, স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোতে সহকর্মীদের অনুরোধেও তাজউদ্দিন আহমদ তার স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা করেননি। তার প্রতিজ্ঞা ছিল, দেশকে স্বাধীন না করে তিনি পারিবারিক জীবনের স্বাদ নেবেন না।
স্বাধীনতার পর তাজউদ্দিন আহমদের পক্ষে অবশ্য জাতীয় নেতার এই অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসার পর নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাজউদ্দিন আহমদকে করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সংসদীয় গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা যথার্থই ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তাজউদ্দিন আহমদকে ক্রমাগত কোণঠাসা করা হয়েছে। সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভূমিকা নেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবও তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। এক পর্যায়ে, ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে তাজউদ্দিন আহমদ দুর্ভিক্ষের জন্য প্রকাশ্যে সরকারের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের সমালোচনা করেছিলেন (১৩ অক্টোবর)। তিনি সেই সাথে দুর্ভিক্ষের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে সর্বদলীয় ভিত্তিতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটাই তার জন্য ‘কাল’ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। এ সম্পর্কিত চিঠির সঙ্গে পদত্যাগপত্রও পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এতে শেখ মুজিব লিখেছিলেন, ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে আপনার মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকা সমীচীন নয় বলে আমি মনে করছি। তাই আপনাকে আমি মন্ত্রীপদে ইস্তফা দেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এই সাথে আপনার স্বাক্ষরের জন্য পদত্যাগপত্র পাঠানো হলো।’
১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর সকাল ১১টায় পাঠানো পদত্যাগপত্রে তাজউদ্দিন আহমদ স্বাক্ষর করেছিলেন ১২টা ২২ মিনিটে। সে মুহূর্তেই মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন দেশের প্রথম সফল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। শেষ দিনগুলোতে তাজউদ্দিন আহমদ সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব সম্পর্কে জানার জন্য শেখ ফজলুল হক মনির মালিকানাধীন দৈনিক বাংলার বাণীর একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। পদত্যাগের পরদিনই (১৯৭৪ সালের ২৭ অক্টোবর) দৈনিকটির সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, ‘অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।’ নিজের দল আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল তা বোঝার জন্য সম্পাদকীয়র ‘বের করে দেয়া হয়েছে’ কথাটুকুই সম্ভবত যথেষ্ট। বস্তুত এ সময় থেকেই তাজউদ্দিন আহমদ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন, রাজনীতি থেকেও তিনি বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ক্ষমতাসীনদের এই মনোভাব এবং শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ ও মাস তিনেকের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি গঠিত বাকশালের সঙ্গে কোনো সংস্পর্শ না থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে অন্য তিন বাকশাল নেতার সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদকেও কারাগারে অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।  
স্বাধীনতা যুদ্ধের অমন একজন প্রধান নেতাকে আওয়ামী লীগ পরবর্তীকালে কিভাবে সম্মান দেখিয়েছে তারও উল্লেখ করা দরকার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৮ সালের ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ দেয়া হয়েছিল তাজউদ্দিন আহমদকে। প্রধানমন্ত্রী এই পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ। তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন পুরস্কারপ্রাপ্ত আটজনের একজন। একই সঙ্গে মরণোত্তর পুরস্কার পেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাকশাল সরকারের প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান। এ চারজনই শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহকর্মী ছিলেন এবং চারজনকেই ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়েছিল। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, অন্য সাতজনের সঙ্গে ‘নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য’ তাজউদ্দিন অহমদকেও এমনভাবে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছিল যেন তিনি কবি-সাহিত্যিক, গায়ক, খেলোয়াড় বা বিজ্ঞানী ধরনের ব্যক্তি কিংবা সেনা অফিসার বা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! বিষয়টি নিয়ে তখনই প্রবল আপত্তি উঠেছিল। বলা হয়েছিল, কেউ কি শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়ার কথা কল্পনা করতে পারেন- তা তিনি যতো ‘অসামান্য অবদানই’ রেখে থাকুন না কেন?
উলে¬খ করা দরকার, এই চার জাতীয় রাজনীতিকের সঙ্গে সেবার অন্য চারজন ‘বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব’কেও ‘নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য’ স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের পরিচিতিও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তারা ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুর রব সেরনিয়াবত- যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মা, ভাই, ফুফাতো ভাই এবং ফুফা। চারজনের মধ্যে শেখ কামাল ছাড়া তিনজনকে পুরস্কার দেয়া হয়েছিল ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য’। অন্যদিকে শেখ কামালকে দেয়া হয়েছিল ক্রীড়া ও অ্যাথলেটিক্সের জন্য। চারজনের পক্ষে যারা পুরস্কার নিয়েছিলেন তাদের পরিচিতিও ছিল যথেষ্ট কৌত’হলোদ্দীপক। বেগম মুজিবের পক্ষে শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং শেখ কামালের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর জামাতা মাসরুর হোসেন পুরস্কার নিয়েছিলেন। বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছিল, বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের পক্ষে তার ‘নাতনী’ এবং শেখ কামালের পক্ষে তার ‘ভাগ্নি জামাই’ পুরস্কার নিয়েছেন!
সবশেষে বলা দরকার, সৎ, নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমদের ছিল দীর্ঘ ও গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি রাজনীতি করেছেন দেশ ও জাতির স্বার্থে। অন্য অনেকের মতো ব্যক্তি শেখ মুজিবের চাটুকারিতা করেননি। বাকশালে যোগ দেননি তিনি, মৃত্যুর সময় তিনি বাকশাল সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন না। সুতরাং তাজউদ্দিন আহমদকে ‘নিজেদের লোক’ হিসেবে সামনে আনারও সুযোগ নেই আওয়ামী লীগের। এটাই অবশ্য মুজিবনগর দিবসে তাজউদ্দিন আহমদকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে স্মরণ না করার একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ আওয়ামী লীগের ব্যক্তিকেন্দ্রিক চরমপন্থী মনোভাব যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কারো অবদানের স্বীকৃতি দেয়ার উপাদান নেই। কিন্তু ‘সঠিক’ ইতিহাস কারো ইচ্ছাধীন থাকতে পারে না। ১৭ এপ্রিলের দিনটি পালিত হওয়া উচিত স্বাধীন বাংলাদেশের ‘প্রথম সরকার গঠন দিবস’ হিসেবে। যারা মনে করেন, অন্য কোনো নামে পালন করা হলে শেখ মুজিবুর রহমান ‘খাটো’ হয়ে যাবেন তাদের জানা উচিত, তাজউদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন।  বৈদ্যনাথতলার নাম ‘মুজিবনগর’ও তাজউদ্দিন আহমদই রেখেছিলেন।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads