শ্রমিক তার রক্ত পানি করা বিন্দু বিন্দু ঘামে গড়ে তোলে এক একটি ইমারত। তাদের তৈরি করা বস্ত্রে আমরা হয়েছি সুসভ্য, উৎপাদিত ফসল করেছে পুষ্ট। পাড়ি দিচ্ছি পৃথিবীর সীমারেখা, ছুঁয়ে আসছি সপ্তম আসমান। আমাদের জীবনের প্রতিটি সেক্টরে আছে তাদের রক্ত মাখা অবদান। দেশ গঠনে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের পাশাপাশি এদেরও আছে সক্রিয় অংশগ্রহণ। শ্রমিকরাই দেশের কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। শ্রম ও উপার্জিত অর্থ ব্যয় করে তারা অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে, দেশের অগ্রগতিকে আরো একধাপ এগিয়ে নেয়। এত কিছুর পরও তারা আমাদের কাছে নিগ্রহ ছাড়া আর কিছুই পায় না। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্ক সবার কাছে অবহেলিত এই দেশ গড়ার কারিগররা। বড়রা যা করে, ছোটরা তা অবিকল অনুকরণ করে। ছোট থেকেই তাদের মাথায় প্রবেশ করানো হচ্ছে শ্রমিকরা অন্য জাতের মানুষ, আমাদের থেকে আলাদা। যে গৃহপরিচারিকা ছোট থেকে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করেছে সেই শিশুই তাকে এই বুয়া.... বলে সম্বোধন করছে। তাদের শ্রমকে অর্থের মাপকাঠিতে বিচার করা হচ্ছে। স্নেহ ভালবাসার কি মূল্য দেয়া সম্ভব? কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া তথাকথিত শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের কাছে এরা তো মানুষই না। অথচ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কুলি-মজুর প্রত্যেক শ্রমিকের অবদান রয়েছে। বড় বড় আমলারা তাদের অধীনস্ত কর্মচারীর সাথে অমানবিক আচরণ করে। যা খুবই দুঃখব্যঞ্জক। এতো গেল তাদের মর্যাদার দিক। কথায় আছে, ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’। সম্মান দূরে থাক এত অমানুষিক পরিশ্রম করেও তারা পায় না যথার্থ মজুরী। হিমশিম খেতে হয় সংসার চালাতে। তাই ছোট্ট সন্তানটিকেও নামিয়ে দেয় শ্রম বিক্রি করতে। শ্রমিকের সন্তান শ্রমিক হবে এটাই যেন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। কার্ল মার্কস বলেছেন-“মানব সমাজের ইতিহাস মূলত শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস”। পুঁজিবাদী সমাজ আস্তে আস্তে পুরো সমাজটাকে ভেঙে চুরে তাদের মনমতো সাজিয়ে নিয়েছে। সেখানে সর্বনিম্ন স্তরে আছে শ্রমিকরা।
বহুতল ভবনে উঠতে গেলে অনেকগুলো সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। যে সিঁড়িকে ভর করে উপরে উঠলেন, সে সিঁড়িকেই যদি ভেঙে ফেলেন তাহলে আর কি হলো? সেখান থেকে যদি একবার নিচে পড়ে যান, পরবর্তীতে সেখানে আবার কি করে উঠবেন ভেবে দেখেছেন? যারা কাউকে উপরে ওঠাতে পারে, নিচে নামানোর মন্ত্রটাও নিশ্চয় তাদের জানা আছে। শ্রমিকরা আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সিঁড়ি। তাদেরকে উপেক্ষা করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অসম্ভবই শুধু নয়, দুঃসাহসেরও ব্যাপার। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে। যে শ্রমিকরা শুধু দেশের নয়, হাজার হাজার বিদেশীদের বস্ত্রের সংস্থান করছে, বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় তারাই বস্ত্রহীন। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তাদের কল্পনাতীত। যে পারিশ্রমিক তাদের দেয়া হয় তাতে খাবার যোগাড় আর একটু মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করতেই টানাপোড়েন শুরু হয়। ভাল পোশাক তাদের কাছে আকাশ-কুসুম কল্পনা। পূর্বে শ্রমিকদের দিয়ে ১০/১২ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করিয়ে নেয়া হতো। এখনো আমরা এ অবস্থা থেকে বের হতে পেরেছি বলে মনে হয় না। বর্তমানে ৬-৮ ঘণ্টা কাজের প্রচলন থাকলেও কৌশলে তাদের দিয়ে করিয়ে নেয়া হয় এর চেয়ে অধিক কাজ। বিশ্ব যেখানে ছন্দের তালে এগিয়ে চলছে সামনের দিকে, আমরা সেখানে শ্রমিক বৈষম্য নিয়ে ব্যস্ত। রোড কনস্ট্রাকশন, গার্মেন্টস, কৃষি, চা, পরিবহন সেক্টরসহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। নারীর কোমল হাত পোশাক শিল্পে অপরিহার্য। অথচ মজুরীর বেলায় বৈষম্য। যে হাত দিয়ে সুস্বাদু খাবার পেতে চাইলেন, সেই হাতটাই অপরিষ্কার রাখলেন। লাভটা কি হলো? কোন না কোন দিন ডাইজেস্টের সমস্যা তো হতেই পারে। যেখানেই নারী শ্রমিক সেখানেই মজুরী বৈষম্য। দেশের উন্নয়নটা হবে কি করে? আমার বোধগম্য নয়। নারীই প্রথমে সবার অন্নের ব্যবস্থা করেছে। কৃষি কাজের সূচনা এই নারীদের হাতেই শুরু হয়েছিল। তখন অবশ্য শ্রম বৈষম্য ছিল না। শিল্প বিপ্লব থেকেই নারী-পুরুষ বৈষম্য তৈরি হয়েছে। আমরা যতই নিজেদের আধুনিক বলে পরিচয় দিচ্ছি- ততই নারী পুরুষের বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছি। আর এই বৈষম্যই এক সময় নারীকে ঘরে আবদ্ধ করতে/থাকতে অনুপ্রাণিত করেছে। ১৪ এপ্রিল’১৫ পাকিস্তনের নারী গৃহ পরিচারিকারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় “ট্রেড ইউনিয়ন” গঠন করেছে। যা সত্যিই আশাব্যঞ্জক। এই নারীদের আমাদের মত বিশ্বের লক্ষ কোটি নারীর পক্ষ থেকে স্যালুট জানাচ্ছি। “কার পেড়ে আনা আম, কে খায়”-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কথাটা যে কতটা বাস্তবসম্মত পর্যলোচনা না করলে কথাটার মর্ম সহজে অনুধাবন করা যাবে না। শ্রমিকদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে “ট্রেড ইউনিয়ন” বা “শ্রমিক সংঘ” গঠন করা হয়। এই সংঘগুলোর মাধ্যমে দাবিও পেশ করে তারা। দাবি আদায় আর হয়ে ওঠে না। কারণ ভক্ষক কোন দিনই রক্ষক হতে পারে না। খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে শ্রমিক সংঘগুলো শ্রমিকরা গঠন করে ঠিকই। তবে এর নেতৃত্ব থেকে যায় রাজনৈতিক নেতা, মালিকপক্ষ অথবা আমলাদের হাতে। তাই শ্রমিকের আহাজারি কর্তৃপক্ষের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। যে দুধ-ভাতে অভ্যস্ত সে কি করে বুঝবে না খেয়ে থাকার জ্বালা? যে শ্রমিকরা আমাদের জন্য তাদের সুখ শান্তি বিসর্জন দেয় তাদের বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত নেই। এত কিছুর পরও কর্মক্ষেত্রে নেই তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ। প্রত্যেকটা শিল্প কারখানা যেন এক একটা মৃত্যুফাঁদ। যেখানে প্রতিনিয়ত তাদের জন্য ওঁৎ পেতে আছে বিভীষিকাময় মৃত্যুর হাতছানি। রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সময়মতো মজুরী বুঝে পাওয়া শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (স) বলেছেন, “তোমরা শ্রমিককে তার ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।” শুধু ইসলাম নয় সকল ধর্মেই শ্রমিকের মজুরী প্রদান সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অথচ এখনো শ্রমিকের মজুরী যথাসময়ে পাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হয়। উৎসবগুলিতেও দেখা যায় শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের দাবিতে অনশন করতে হচ্ছে। বছরের হাতে গোনা কয়েকটি দিনও তারা অধিকার বঞ্চিত। অথচ মালিকপক্ষ কিভাবে উৎসবটাকে উপভোগ করবে, কোথায় বেড়াতে যাবে সে পরিকল্পনার কথা শ্রমিকদের সামনে বলতে ভুল করে না। এভাবে চলতে থাকলে এই নিরীহ শ্রমিকরাই আবার জেগে উঠবে। যেমন উঠেছিল ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে। সেদিন দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে তিন লক্ষাধিক জমায়েত শ্রমিকদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে ৬ জন শ্রমিক নির্মমভাবে নিহত ও শতাধিক আহত হয়। গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে গর্জে ওঠে শ্রমিকরা। তাদের অব্যাহত প্রতিবাদ ধর্মঘটের মুখে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় মালিকপক্ষ। যদি আবারো এমন হয় সেদিন তাদের পাশে থাকবে সর্বস্তরের মানুষ। শোষকরা হয়ে উঠবে কোণঠাসা। পালানোর জায়গা খুঁজে পাবে না। সুকান্তের ভাষায় শ্রমিকরা বলে উঠবে-
তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো,
অস্বীকার করো বশ্যতাকে।
চলো, শুকনো হাড়ের বদলে
সন্ধান করি তাজা রক্তের,
তৈরি হোক লাল আগুনে ঝলসানো আমাদের খাদ্য।
শিকলের দাগ ঢেকে গজিয়ে উঠুক
সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪, ১৫, ৩৪, ৩৭ ও ৩৮ অনুচ্ছেদে শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট করা হয়েছে। তবু আজ শ্রমিকরা তাদের অধিকার বঞ্চিত। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “কর্মের অধিকার বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার: যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার।” অন্যদিকে সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদ বলছে- “সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ: এবং এই বিধান কোনভাবে লংঘিত হইলে তাহা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে”। একইভাবে সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দন্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করেছে। যেমনিভাবে জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদে নির্যাতন নিষ্ঠুর অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দন্ড অপরাধ হিসেবে গণ্য করে সকল দেশকে এ সংক্রান্ত আইন তৈরি করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
আমরা প্রায়ই দেখি উচ্চবিত্ত শ্রেণী কিভাবে তাদের গৃহ পরিচারিকাসহ অধীনস্তদের নির্যাতন করছে। আজ পর্যন্ত কোন ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হয়েছে বলে দেখি না। আর সুষ্ঠু বিচার না হওয়ার ফলেই এ ধরনের ঘটনা একের পর এক বেড়েই চলেছে।
উপমহাদেশে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৮৮১ সাল থেকে কিছু আইন প্রণয়নের সূত্রপাত হয়। ফ্যাক্টরী আইন (১৮৮১) শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ আইন (১৯২৩) ট্রেড ইউনিয়ন আইন (১৯২৬) শ্রম বিরোধ আইন (১৯২৯) মজুরী প্রদান আইন (১৯৩৬) শিশু নিয়োগ আইন (১৯৩৮) ও মাতৃত্ব সুবিধা আইন (১৯৩৯)। ১৯৪৭ সালের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার এগুলি পরিমার্জন করে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭২ সালের প্রথমদিকে জারিকৃত এডপটেশন অব বাংলাদেশ ল’জ অর্ডার (রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৪৮) অনুসারে বাংলাদেশে এসব আইনের অধিকাংশই বহাল রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৬৫ সালের দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইনে পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিক প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য ১ দিন, কিশোরের ক্ষেত্রে ১৪ দিনের জন্য ১ দিন বেতনসহ ছুটি পওয়ার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া পূর্ণ বেতনে বার্ষিক ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি ও ১৪ দিন অসুস্থতাজনিত ছুটির বিধান রয়েছে। এ বিধানটি কেউ মানা তো দূরের কথা জানেন বলেও মনে হয় না।
২০১৩ সালে সংশোধিত শ্রম আইনে নারী শ্রমিকদের ৪ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরসরি ব্যাংক একাউন্টে দেয়া, কোম্পানীতে চাকরির মেয়াদ ৯ মাস হলেই ওই কর্মকর্তা কর্মচারী সেই প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী বলে বিবেচিত হওয়া, যে প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ১০০ জন শ্রমিক রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে বীমা বাধ্যতামূলক। এই বীমা দাবি শ্রমিকের মৃত্যুর ৯০ দিনের মধ্যে মালিক আদায় করবেন। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানে ৫ হাজার শ্রমিক আছে তাদের স্থায়ী স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা, ৫শ’ শ্রমিক থাকলে সে প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক কল্যাণ কর্মকর্তা নিয়োগ করা ছাড়াও প্রসূতি কল্যাণে বাধা দেয়া মালিকের জরিমানা ৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। আইন পাশের ২ বছর পার হতে চললেও আজ পর্যন্ত কোন মালিকের জরিমানা হতে শোনা যায় নি। তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করবে এমন সাধ্য ক’জন শ্রমিকের আছে? এক ঘাড়ে তো আর শ্রমিকদের দুই মাথা থাকে না! এ জন্যই দরকার ট্রেড ইউনিয়ন। সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ‘‘ট্রেড ইউনিয়ন’’ গঠন করতে গিয়ে মালিকপক্ষের কাছে শ্রমিকদের নিগৃহীত হতে হয় সবচেয়ে বেশি।
আমরা চাই এমন একটা দেশ গড়তে যেখানে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে অত্মমর্যাদার সাথে বসবাস করবে। সুন্দর নিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি পেলে শ্রমিকরা দিতে চাইবে তাদের সর্বোচ্চ মেধা-শ্রম। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে এগিয়ে যাবে দেশ। গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন সমাজ। আমরা হয়ে উঠব সমৃদ্ধশালী। এবারের মে দিবসে এটাই হোক আমাদের শপথ।
বহুতল ভবনে উঠতে গেলে অনেকগুলো সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। যে সিঁড়িকে ভর করে উপরে উঠলেন, সে সিঁড়িকেই যদি ভেঙে ফেলেন তাহলে আর কি হলো? সেখান থেকে যদি একবার নিচে পড়ে যান, পরবর্তীতে সেখানে আবার কি করে উঠবেন ভেবে দেখেছেন? যারা কাউকে উপরে ওঠাতে পারে, নিচে নামানোর মন্ত্রটাও নিশ্চয় তাদের জানা আছে। শ্রমিকরা আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সিঁড়ি। তাদেরকে উপেক্ষা করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অসম্ভবই শুধু নয়, দুঃসাহসেরও ব্যাপার। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে। যে শ্রমিকরা শুধু দেশের নয়, হাজার হাজার বিদেশীদের বস্ত্রের সংস্থান করছে, বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় তারাই বস্ত্রহীন। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তাদের কল্পনাতীত। যে পারিশ্রমিক তাদের দেয়া হয় তাতে খাবার যোগাড় আর একটু মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করতেই টানাপোড়েন শুরু হয়। ভাল পোশাক তাদের কাছে আকাশ-কুসুম কল্পনা। পূর্বে শ্রমিকদের দিয়ে ১০/১২ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করিয়ে নেয়া হতো। এখনো আমরা এ অবস্থা থেকে বের হতে পেরেছি বলে মনে হয় না। বর্তমানে ৬-৮ ঘণ্টা কাজের প্রচলন থাকলেও কৌশলে তাদের দিয়ে করিয়ে নেয়া হয় এর চেয়ে অধিক কাজ। বিশ্ব যেখানে ছন্দের তালে এগিয়ে চলছে সামনের দিকে, আমরা সেখানে শ্রমিক বৈষম্য নিয়ে ব্যস্ত। রোড কনস্ট্রাকশন, গার্মেন্টস, কৃষি, চা, পরিবহন সেক্টরসহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। নারীর কোমল হাত পোশাক শিল্পে অপরিহার্য। অথচ মজুরীর বেলায় বৈষম্য। যে হাত দিয়ে সুস্বাদু খাবার পেতে চাইলেন, সেই হাতটাই অপরিষ্কার রাখলেন। লাভটা কি হলো? কোন না কোন দিন ডাইজেস্টের সমস্যা তো হতেই পারে। যেখানেই নারী শ্রমিক সেখানেই মজুরী বৈষম্য। দেশের উন্নয়নটা হবে কি করে? আমার বোধগম্য নয়। নারীই প্রথমে সবার অন্নের ব্যবস্থা করেছে। কৃষি কাজের সূচনা এই নারীদের হাতেই শুরু হয়েছিল। তখন অবশ্য শ্রম বৈষম্য ছিল না। শিল্প বিপ্লব থেকেই নারী-পুরুষ বৈষম্য তৈরি হয়েছে। আমরা যতই নিজেদের আধুনিক বলে পরিচয় দিচ্ছি- ততই নারী পুরুষের বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছি। আর এই বৈষম্যই এক সময় নারীকে ঘরে আবদ্ধ করতে/থাকতে অনুপ্রাণিত করেছে। ১৪ এপ্রিল’১৫ পাকিস্তনের নারী গৃহ পরিচারিকারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় “ট্রেড ইউনিয়ন” গঠন করেছে। যা সত্যিই আশাব্যঞ্জক। এই নারীদের আমাদের মত বিশ্বের লক্ষ কোটি নারীর পক্ষ থেকে স্যালুট জানাচ্ছি। “কার পেড়ে আনা আম, কে খায়”-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কথাটা যে কতটা বাস্তবসম্মত পর্যলোচনা না করলে কথাটার মর্ম সহজে অনুধাবন করা যাবে না। শ্রমিকদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে “ট্রেড ইউনিয়ন” বা “শ্রমিক সংঘ” গঠন করা হয়। এই সংঘগুলোর মাধ্যমে দাবিও পেশ করে তারা। দাবি আদায় আর হয়ে ওঠে না। কারণ ভক্ষক কোন দিনই রক্ষক হতে পারে না। খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে শ্রমিক সংঘগুলো শ্রমিকরা গঠন করে ঠিকই। তবে এর নেতৃত্ব থেকে যায় রাজনৈতিক নেতা, মালিকপক্ষ অথবা আমলাদের হাতে। তাই শ্রমিকের আহাজারি কর্তৃপক্ষের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। যে দুধ-ভাতে অভ্যস্ত সে কি করে বুঝবে না খেয়ে থাকার জ্বালা? যে শ্রমিকরা আমাদের জন্য তাদের সুখ শান্তি বিসর্জন দেয় তাদের বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত নেই। এত কিছুর পরও কর্মক্ষেত্রে নেই তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ। প্রত্যেকটা শিল্প কারখানা যেন এক একটা মৃত্যুফাঁদ। যেখানে প্রতিনিয়ত তাদের জন্য ওঁৎ পেতে আছে বিভীষিকাময় মৃত্যুর হাতছানি। রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সময়মতো মজুরী বুঝে পাওয়া শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (স) বলেছেন, “তোমরা শ্রমিককে তার ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।” শুধু ইসলাম নয় সকল ধর্মেই শ্রমিকের মজুরী প্রদান সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অথচ এখনো শ্রমিকের মজুরী যথাসময়ে পাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হয়। উৎসবগুলিতেও দেখা যায় শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের দাবিতে অনশন করতে হচ্ছে। বছরের হাতে গোনা কয়েকটি দিনও তারা অধিকার বঞ্চিত। অথচ মালিকপক্ষ কিভাবে উৎসবটাকে উপভোগ করবে, কোথায় বেড়াতে যাবে সে পরিকল্পনার কথা শ্রমিকদের সামনে বলতে ভুল করে না। এভাবে চলতে থাকলে এই নিরীহ শ্রমিকরাই আবার জেগে উঠবে। যেমন উঠেছিল ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে। সেদিন দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে তিন লক্ষাধিক জমায়েত শ্রমিকদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে ৬ জন শ্রমিক নির্মমভাবে নিহত ও শতাধিক আহত হয়। গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে গর্জে ওঠে শ্রমিকরা। তাদের অব্যাহত প্রতিবাদ ধর্মঘটের মুখে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় মালিকপক্ষ। যদি আবারো এমন হয় সেদিন তাদের পাশে থাকবে সর্বস্তরের মানুষ। শোষকরা হয়ে উঠবে কোণঠাসা। পালানোর জায়গা খুঁজে পাবে না। সুকান্তের ভাষায় শ্রমিকরা বলে উঠবে-
তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো,
অস্বীকার করো বশ্যতাকে।
চলো, শুকনো হাড়ের বদলে
সন্ধান করি তাজা রক্তের,
তৈরি হোক লাল আগুনে ঝলসানো আমাদের খাদ্য।
শিকলের দাগ ঢেকে গজিয়ে উঠুক
সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪, ১৫, ৩৪, ৩৭ ও ৩৮ অনুচ্ছেদে শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট করা হয়েছে। তবু আজ শ্রমিকরা তাদের অধিকার বঞ্চিত। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “কর্মের অধিকার বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার: যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার।” অন্যদিকে সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদ বলছে- “সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ: এবং এই বিধান কোনভাবে লংঘিত হইলে তাহা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে”। একইভাবে সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দন্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করেছে। যেমনিভাবে জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদে নির্যাতন নিষ্ঠুর অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দন্ড অপরাধ হিসেবে গণ্য করে সকল দেশকে এ সংক্রান্ত আইন তৈরি করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
আমরা প্রায়ই দেখি উচ্চবিত্ত শ্রেণী কিভাবে তাদের গৃহ পরিচারিকাসহ অধীনস্তদের নির্যাতন করছে। আজ পর্যন্ত কোন ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হয়েছে বলে দেখি না। আর সুষ্ঠু বিচার না হওয়ার ফলেই এ ধরনের ঘটনা একের পর এক বেড়েই চলেছে।
উপমহাদেশে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৮৮১ সাল থেকে কিছু আইন প্রণয়নের সূত্রপাত হয়। ফ্যাক্টরী আইন (১৮৮১) শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ আইন (১৯২৩) ট্রেড ইউনিয়ন আইন (১৯২৬) শ্রম বিরোধ আইন (১৯২৯) মজুরী প্রদান আইন (১৯৩৬) শিশু নিয়োগ আইন (১৯৩৮) ও মাতৃত্ব সুবিধা আইন (১৯৩৯)। ১৯৪৭ সালের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার এগুলি পরিমার্জন করে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭২ সালের প্রথমদিকে জারিকৃত এডপটেশন অব বাংলাদেশ ল’জ অর্ডার (রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৪৮) অনুসারে বাংলাদেশে এসব আইনের অধিকাংশই বহাল রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৬৫ সালের দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইনে পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিক প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য ১ দিন, কিশোরের ক্ষেত্রে ১৪ দিনের জন্য ১ দিন বেতনসহ ছুটি পওয়ার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া পূর্ণ বেতনে বার্ষিক ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি ও ১৪ দিন অসুস্থতাজনিত ছুটির বিধান রয়েছে। এ বিধানটি কেউ মানা তো দূরের কথা জানেন বলেও মনে হয় না।
২০১৩ সালে সংশোধিত শ্রম আইনে নারী শ্রমিকদের ৪ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরসরি ব্যাংক একাউন্টে দেয়া, কোম্পানীতে চাকরির মেয়াদ ৯ মাস হলেই ওই কর্মকর্তা কর্মচারী সেই প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী বলে বিবেচিত হওয়া, যে প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ১০০ জন শ্রমিক রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে বীমা বাধ্যতামূলক। এই বীমা দাবি শ্রমিকের মৃত্যুর ৯০ দিনের মধ্যে মালিক আদায় করবেন। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানে ৫ হাজার শ্রমিক আছে তাদের স্থায়ী স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা, ৫শ’ শ্রমিক থাকলে সে প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক কল্যাণ কর্মকর্তা নিয়োগ করা ছাড়াও প্রসূতি কল্যাণে বাধা দেয়া মালিকের জরিমানা ৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। আইন পাশের ২ বছর পার হতে চললেও আজ পর্যন্ত কোন মালিকের জরিমানা হতে শোনা যায় নি। তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করবে এমন সাধ্য ক’জন শ্রমিকের আছে? এক ঘাড়ে তো আর শ্রমিকদের দুই মাথা থাকে না! এ জন্যই দরকার ট্রেড ইউনিয়ন। সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ‘‘ট্রেড ইউনিয়ন’’ গঠন করতে গিয়ে মালিকপক্ষের কাছে শ্রমিকদের নিগৃহীত হতে হয় সবচেয়ে বেশি।
আমরা চাই এমন একটা দেশ গড়তে যেখানে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে অত্মমর্যাদার সাথে বসবাস করবে। সুন্দর নিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি পেলে শ্রমিকরা দিতে চাইবে তাদের সর্বোচ্চ মেধা-শ্রম। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে এগিয়ে যাবে দেশ। গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন সমাজ। আমরা হয়ে উঠব সমৃদ্ধশালী। এবারের মে দিবসে এটাই হোক আমাদের শপথ।
সিনথিয়া পারভীন কাকলী