বুধবার, ২৫ জুলাই, ২০১২

গাঁজার নৌকা এখন পদ্মায়



এম এ নোমান
গত সাড়ে তিন বছরের মহাজোটীয় জামানায় দেশে আলোচিত- সমালোচিত শত শত ঘটনার জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতু দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রী আবুল হোসেনসহ সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনদের জড়িত থাকা, প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুত ঋণ প্রত্যাহার এবং শেষতক হোসেন সাহেবের পদত্যাগের ঘটনাই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। যদিও ‘ডিজিটাল সময়’-খ্যাত ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে আনা ও পিছিয়ে দেয়া, আড়িয়ল বিলে স্বপ্নের এয়ারপোর্ট, দ্বিখণ্ডিত ঢাকার অসহনীয় যানজট এবং ৮০ হাজার কোটি টাকা লুটের কারণে শেয়ারবাজার ধসের ঘটনা অনেকেরই পারিবারিক জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
পদ্মা সেতুতে বিপজ্জনক (মূলসহ খেয়ে ফেলা) দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল হওয়ার পর থেকে ১৫ মন্ত্রীর ৭০ ধরনের বক্তব্যের মাঝখানে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। এবার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করে আমরা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দেব।’ প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর দেশব্যাপী শুরু হয়েছে ধুন্ধুমার চাঁদাবাজি। বেপরোয়া ছাত্রলীগ চাঁদাবাজির অবাধ লাইসেন্স পেয়ে হামলে পড়েছে সর্বত্র। পরিবহন নেতারাও বসে নেই। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে ‘সাহসী’ উল্লেখ করে কেউ কেউ চাঁদাবাজির টাকায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামের আগে ও পরে ডজনখানেক উপাধি যোগ করে সড়ক-মহাসড়কে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, পোস্টার এবং ফেস্টুনও টানানো হয়েছে।
কোনো কোনো মন্ত্রী ও নেতা ঘোষণা করেছেন, চাঁদাবাজির টাকায় একটি নয়, দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। তাদের এ যুক্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারাকাত বলেছেন, দুটি নয়, চারটি পদ্মা সেতু সম্ভব নিজস্ব অর্থায়নে। অবশ্য আবুল বারাকাতকে দেশের ছাত্র-শিক্ষকরা ‘বারাকাতি ফরমুলা’র জন্য বেশ ভালোভাবে চেনেন ও জানেন। আগেও তিনি অর্থনীতি নিয়ে পৌনঃপুনিক ও ঐকিক নিয়ম অনুসরণ করে উদ্ভট কিছু তথ্য দিয়ে দেশব্যাপী হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিলেন।
বারাকাতি ফরমুলা এবং প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতাদের দিনরাতের মতো কথার পার্থক্য নিয়েও এখন ফেসবুক, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরস-বিরস ও কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য চলছে।
গত ১৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর বিষয়ে একটি ফরমুলা তুলে ধরেন জাতির সামনে। ওইদিন বিডিনিউজ এটি প্রকাশ করে। নিউজটির সঙ্গে পাঠকের মন্তব্যও প্রকাশ করা হয়। জনৈক রুবেল নতুন ফরমুলা দিয়ে লিখেছেন, শেয়ারবাজার থেকে ডাকাতি হওয়া টাকাগুলো উদ্ধার করলে একাধিক পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এছাড়া কুইক রেন্টালের মাধ্যম যে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে তা ফিরিয়ে আনলে, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে যে টাকা অপচয় করা হয়েছে তা যদি শেখ হাসিনার নিজস্ব তহবিল থেকে আদায় করা হয়, মন্ত্রী ও এমপিরা দুর্নীতি করে যে টাকা কামিয়েছে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে পারলে, আ’লীগের অঙ্গসংগঠন যে পরিমাণ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ইত্যাদি সব অপকর্ম করে টাকা ব্যাংকে রাখছে তা ফিরিয়ে আনতে পারলে, যারা ব্যাংক থেকে শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপি হয়েছে তাদের টাকা আদায় করতে পারলে একাধিক পদ্মা সেতু করা সম্ভব।
সোহেলী নামে এক পাঠক লিখেছেন, ‘গত সাড়ে তিন বছরে মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর মুখে কত-শত কথাই জাতি শুনল। এখন চাঁদাবাজি করে পদ্মা সেতু করার উদ্যোগ নেয়ার সঙ্গেসঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর সোনার ছাত্রলীগ দেশব্যাপী চাঁদাবাজির ভয়াবহ তাণ্ডব শুরু করেছে। শেয়ারবাজার, কুইক রেন্টাল ও ব্যাংক থেকে লুট করা টাকা দিয়েই হোক আর বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েই হোক—দ্রুত এ সেতুর কাজ করা উচিত। সেইসঙ্গে সেতুর নামও পাল্টানো উচিত। নতুন নাম হবে শহীদ সোহেল স্মৃতি সেতু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ মেধাবী ছাত্র পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদাবাজি করতে গিয়ে প্রথম শহীদ হলেন। পদ্মা সেতুর জন্য তার এ আত্মত্যাগ জাতি স্মরণে রাখবে। ছাত্রলীগ মানুষ হোক আর নাই হোক, স্বপ্নের এ সেতু হতে হবে। সামনে ইলেকশন। মুলা আর কত ঝুলবে?’ সোহেলী আরও লিখেছেন, ‘এর আগেও রাবিতে শিবির ও ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বে ফারুক নামে এক ছাত্র নিহত হওয়ার পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিব মহোদয় হেলিকপ্টার নিয়ে রাজশাহী গিয়ে হুংকার দিয়েছিলেন। জামায়াত ও শিবিরের সব কেন্দ্রীয় নেতাকে আসামি করে হত্যা মামলা হয়েছে। এ মামলায় সবাইকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। পরে অবশ্য এ মামলা ও হুংকার ভুয়াই প্রমাণিত হয়েছে। এবার পদ্মার নামে ওঠানো চাঁদা ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা গুলি করে তাদের এক নেতাকে হত্যা করল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনার এই ভাইয়ের বিষয়ে কিছু বলছেন না কেন? প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকেই তো পদ্মার নামে সারা দেশে ছাত্রলীগ চাঁদাবাজির মহোত্সবে নেমে পড়েছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে হুকুমের আসামি করে কবে মামলা করবেন?’
সেলিম লিখেছেন, আগে গ্রামে দেখতাম দান-খয়রাতের টাকা দিয়ে মক্তব তৈরি হতো। এখন পদ্মা সেতুর জন্যও নাকি রাস্তার মোড়ে মোড়ে দানবাক্স টাঙানো হয়েছে। হায়রে কপাল! দানের টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু হবে কীভাবে? তাছাড়া ছাত্রলীগই বা চাঁদা উঠিয়ে কতদিনে পদ্মা সেতুর টাকা জোগাড় করবে। কেউ কেউ চাঁদার টাকা দিয়ে চারটি পদ্মা সেতু তৈরির কথা বলছেন। সব কেন যেন তামাশা-তামাশা মনে হচ্ছে। অনেক সময় স্বপ্ন-স্বপ্নও লাগছে। মূলত আমরা ঘোরের মধ্যে আছি। গাঁজার নৌকা নাকি পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলত। এখন দেখছি গাঁজার নৌকা পদ্মা সেতু দিয়েও চলছে।
লেখক : সাংবাদিক

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads