বৃহস্পতিবার, ২৬ জুলাই, ২০১২

গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রীর যত ফুটানি



সৈয়দ আবদাল আহমদ
লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধন হচ্ছে আজ। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় আসর এই অলিম্পিক। অলিম্পিক মানে বিশ্বের নানা বর্ণ আর সংস্কৃতির মেলবন্ধন। অলিম্পিক এলে তাই সাড়া পড়ে যায় দেশে দেশে। অলিম্পিক আয়োজনের দায়িত্ব যে দেশের ওপর পড়ে, সে দেশের আনন্দের সীমা থাকে না। এবার অলিম্পিক হচ্ছে ব্রিটেনে। তাই ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনজুড়ে এখন প্রচণ্ড হৈ-হুল্লোড়। লন্ডনের স্ট্র্যাটফোর্ডে তৈরি হয়েছে অলিম্পিক ভিলেজ। এই লন্ডন অলিম্পিক পার্কে অংশ নেবেন সাড়ে ১০ হাজার ক্রীড়াবিদ। অলিম্পিক গেমস চলবে ১৭ দিনব্যাপী।
লন্ডন অলিম্পিকে বাংলাদেশ অংশ নিচ্ছে। এর আগেও বেইজিং অলিম্পিক, সিউল অলিম্পিকে বাংলাদেশ অংশ নিয়েছিল। তবে এবার অলিম্পিকে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ আলোচনার সৃষ্টি করেছে। এই আলোচনা অলিম্পিকের কোনো ইভেন্টে ক্রীড়াবিদদের অংশগ্রহণ নিয়ে নয়, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশগ্রহণ নিয়ে।
অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। না, শুধু শেখ হাসিনা একা নন—তার সফরসঙ্গী হয়েছেন ৫৫ জনের একটি বহর। আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ, অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ এম জিয়াউদ্দিন। অলিম্পিক অনুষ্ঠান দেখার জন্য সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরও যোগ দেবেন তার বোন শেখ রেহানা এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসবেন ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী ৫৫ জনের বহর নিয়ে লন্ডন গেছেন। সেখানে তিনি পাঁচদিন অবস্থান করবেন। ২৭ জুলাই বাকিংহাম প্রাসাদে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের দেয়া সংবর্ধনায়ও প্রধানমন্ত্রী যোগ দেবেন। ইতোমধ্যে লন্ডনে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাকে পদ্মা সেতুর দুর্নীতি এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি নিঃসঙ্কোচেই বলে দিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক নাকি পারসেন্টেজ চেয়েছিল। দুর্নীতির দায়ে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সৈয়দ আবুল হোসেন একজন দেশপ্রেমিক লোক। দেশপ্রেমিক না হলে নাকি তিনি পদত্যাগ করতেন না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ পেতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যখন নানামুখী দৌড়ঝাঁপ করছেন, ঠিক তখনই শেখ হাসিনার এই মন্তব্যে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।
অলিম্পিকে যোগদান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোষের কিছু নয়। রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা সাধারণত অলিম্পিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেই থাকেন। আয়োজক দেশের পক্ষ থেকে অলিম্পিকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো একটি রেওয়াজ। সেই রেওয়াজের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, তাকে অংশ নিতেই হবে। যদিও শেখ হাসিনা আমন্ত্রণ পেয়ে অপেক্ষা করেননি। তবে দোষের বিষয় যেটা তা হচ্ছে, শেখ হাসিনা কোনো ধনী দেশের প্রধানমন্ত্রী নন। গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ ধরনের সফরের আমন্ত্রণ পেয়েই সেখানে চলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। অনেক ধনী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা অলিম্পিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে লন্ডনে যাননি। ব্রিটেনের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট যোগ দিচ্ছেন না অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে বড়জোর ৪০ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান অংশ নিতে পারেন। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ, ইতালির প্রেসিডেন্ট ন্যাপালিয়াটানো, জাপানি প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিকো নোদা, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েব এরদোগান উপস্থিত থাকলেও আসছেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তার পরিবর্তে উপস্থিত থাকবেন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসেফ, আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট আলাসানে ওত্তারা, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কিবাকি, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিভেভ। থাকবেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রথম মেয়াদে একটি সফরে ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন। ওয়াশিংটন যাওয়ার পথে তিনি লন্ডনে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। তখন তিনি লন্ডনের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হোটেলগুলোর একটি ক্ল্যারিজেস হোটেলে উঠেছিলেন। হোটেলের যে ক’টি কামরা শেখ হাসিনা ও তার সফরসঙ্গীদের জন্য ভাড়া নেয়া হয়েছিল, একসময় সেটা সহচর-পার্শ্বচর, স্তাবক ও সাংবাদিকদের জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হয়নি। আরও কামরার প্রয়োজন ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সহোদরা জানালেন, পাশেই আরেকটি কামরা খালি আছে। তত্ক্ষণাত্ একজন স্তাবক আমলা বলে উঠলেন, ওই কামরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদার সঙ্গে মানানসই নয়। শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, ‘গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রীর আবার এত ফুটানি কিসের?’ এ খবরটি তখনকার লন্ডনের বাংলা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুর রহমান এ নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলেন। বেচারা গরিব দেশ! তার তো করার কিছু নেই। চোখ বুজে সবকিছুই সহ্য করতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি উপলব্ধিই করতেন গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রীর এত ফুটানি কিসের, তাহলে কি তিনি এভাবে ঢালাও বিদেশ সফরে যেতেন? আর বিদেশ সফরে তিনি একাও যাচ্ছেন না, বিশাল বিশাল লটবহর নিয়ে যাচ্ছেন। এটা সবাই জানেন যে, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে অবধারিতভাবে কিছু কর্মকর্তা কিংবা ব্যক্তি থাকবেনই। কিন্তু তার অর্থ তো এই নয় যে, সেটা বিশাল বহর হবে। প্রধানমন্ত্রী এমনও দেশ সফর করেছেন, যে সফরে আত্মীয়-পরিজন, মন্ত্রী, এমপি, কর্মকর্তা, দলীয় লোক মিলিয়ে ১১৯ জন পর্যন্ত গেছেন। এমনও গুরুত্বহীন সম্মেলনে তিনি যোগ দিয়েছেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর যাওয়ার আদৌ প্রয়োজন নেই। সেই সম্মেলনে একজন মন্ত্রী পাঠিয়ে দিলেই চলে; কিন্তু দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রী নিজে সেটাতে গেছেন। ন্যাম সম্মেলনের এখন কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গেছেন। ইউরোপীয় ডেভেলপমেন্ট ডে’তে তিনি গেছেন। এমনকি বাঘ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রতি বছর একটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান অংশ নেন, এমন নজির নেই। কিন্তু আমাদের গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রী গত তিন বছরে তিনবারই নিউইয়র্ক গেছেন। প্রতিবারই তার সফরসঙ্গী ছিলেন একশ’র উপরে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি একশ’জনের বহর নিয়ে নিউইয়র্ক যান।
চলতি বছর জানুয়ারি মাসে ডক্টরেট ডিগ্রি আনতে ১০৬ জনের বহর নিয়ে ত্রিপুরা যান প্রধানমন্ত্রী।
২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে ৫৩ জনের বহর নিয়ে ডেমোক্রেসি ফোরাম নামের গুরুত্বহীন এক সম্মেলনে যোগ দিতে ইন্দোনেশিয়া যান প্রধানমন্ত্রী।
২০১১ সালের অক্টোবর মাসে প্রায় একশ’জনের বিশাল বহর নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে যোগ দিতে জার্মানি যান প্রধানমন্ত্রী। এটা ছিল মূলত ডাক্তারদের একটি সম্মেলন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান ওই সম্মেলনে যাননি। এমনকি আয়োজক দেশ জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেলও ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। এভাবে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হচ্ছে।
এবার লন্ডন অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে অংশ নিচ্ছেন পাঁচজন ক্রীড়াবিদ। তবে তাদের সঙ্গে গেছেন অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ২২ জন কর্মকর্তা। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছেন ৫৫ জন। অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ৫০টি ব্লেজার তৈরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জানা গেছে, প্রতিটি ব্লেজারের দাম পড়েছে সাড়ে চার হাজার টাকা। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্যও একটি ব্লোজার বিশেষভাবে তৈরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। গরিব দেশের জন্য এসব কি ফুটানি নয়?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads