রবিবার, ১৫ জুলাই, ২০১২

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ক্ষমতাসীনদের ভয় কোথায়?



ড. হারুনর রশীদ খান
গণতন্ত্র বা Democracy শব্দটির উত্পত্তি হয়েছিল গ্রিক ‘Demokratia’ শব্দ থেকে, যার মানে হলো ‘Rule of the People’, অর্থাত্ ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’। আজ এ মুহূর্তে বাংলাদেশে কাগজে-কলমে যে গণতন্ত্র বিদ্যমান তা কি আদৌ গণতন্ত্র শব্দের এই অর্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এক কথায় এর উত্তর হলো ‘না’। শুধু বাংলাদেশ নয়, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই এ রকম গণতন্ত্র বিদ্যমান, যেখানে ক্ষমতা জনগণের হাতে না থেকে একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, তথা ক্ষমতাসীন দলের হাতে চলে যায়। উদাহরণস্বরূপ ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারতে জওহরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একটানা ১৬ বছর। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন শেখ মুজিব। মৃত্যু না হলে হয়তো তারা আরও অনেক বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতেন।
গণতন্ত্র ধ্বংস করে এমন দুটি ভীতিকর পদ্ধতি হলো ‘স্বৈরাচারী’ এবং ‘স্বেচ্ছাচারী’ সরকার ব্যবস্থা। এ দুটোর মধ্যে কিছু পোশাকি পার্থক্য আছে। ‘স্বৈরাচার’ উলঙ্গ, তার গায়ে কোনো পোশাক থাকে না, তার কাজে-কর্মে এবং পদ্ধতিগত প্রয়োগে জনগণ সরাসরি বুঝতে পারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে এর তফাত্ কোথায়। আর ‘স্বেচ্ছাচার’ হলো গণতন্ত্রের পোশাক পরে তার আড়ালে স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশে এখন যে শাসন ব্যবস্থা চলছে তা গণতন্ত্রের নামে স্বেচ্ছাচারী শাসন। ক্ষমতাসীনদের এই স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের অসংখ্য উদাহরণ আছে। তার একটি ছোট উদাহরণ হলো—বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট গত ১২ মার্চ এবং ১১ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে যে মহাসমাবেশ ডাকে, তা নগ্নভাবে বানচালের চেষ্টা করা। সরকার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই মহাসমাবেশ বানচাল করার জন্য সারাদেশে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার শুরু করে, বাস চলাচল একরকম বন্ধই করে দেয় এবং পুলিশ আবহাওয়াবিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে খারাপ আবহাওয়া ঘোষণা দেয়, যাতে কোনো লঞ্চ বা স্টিমার চলাচল না করে। ক্ষমতাসীনরা এসব করেও নেতাকর্মীদের সমাবেশে আসা আটকাতে পারেনি, বরং এতে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা, একগুঁয়েমি, দেউলিয়াত্ব এবং জনবিচ্ছিন্নতাই প্রকাশ পেয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে জনগণের ওপর সরকারের কোনো আস্থা নেই। সরকার জানে না, বাস-লঞ্চ বন্ধ করে দেশের সর্বময় ক্ষমতার মালিক জনগণকে কষ্ট দেয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই। দেশের সাধারণ মানুষকে সমাবেশে আসতে বাধা দেয়া এবং সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়াই কি প্রমাণ করে না যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’—সে পথও একইভাবে বন্ধ হয়ে যাবে?
তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, প্রাণহানি এবং সন্ত্রাসের সৃষ্টি হয়। এসব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র এবং পেশিশক্তি তাদের পক্ষে ব্যবহার করে নির্বাচনের ফলাফলকে পরিবর্তন করে তাদের পক্ষে রায় নেয়ার চেষ্টা করে। ফলে জনমত হয় ভূলুণ্ঠিত এবং ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ। ভোট নামের প্রহসনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসে, তারা গণতন্ত্রের আদলে কায়েম করে স্বৈরতন্ত্র। অনেক ক্ষেত্রে এসব সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে আসে সামরিক জান্তা, আর তখন সম্পূর্ণরূপে বলি হয়ে যায় গণতন্ত্র। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা তথা রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমতের প্রতিফলন গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। অতি ক্ষুদ্র, দরিদ্র এবং জনবহুল আমাদের এই বাংলাদেশে গণতন্ত্র উত্তরণের ইতিহাস খুবই দুর্গম। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন ছিল বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার। কিন্তু স্বাধীনতার পর সে সময় ক্ষমতাসীন সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে গণতন্ত্রকে পুরোপুরি ধ্বংস করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে। ১৯৭৫-পরবর্তী সময় নানা চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে দেশ অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে। এ অবস্থায় জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে অতি দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তিনি দেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন। সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়া গণতন্ত্রকে নতুন রূপ দেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর বাংলাদেশের জনগণের ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্র আবারও হারিয়ে যায় পুরো এক দশকের জন্য। সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ নানা টালবাহানায় সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে দেশ পরিচালনা করেন প্রায় নয় বছর। সে সময় বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়, যার ফলে এরশাদ সরকারের স্বৈরাচারী শাসন আরও প্রলম্বিত হয়। অবশেষে ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে প্রবল গণরোষ ও গণআন্দোলনে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধমে এরশাদকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করা হয়। এরশাদের পতনের পর সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, যার অধীনে ১৯৯১-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশে ৫ম সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে। এই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৪ সালে মাগুরার একটি উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেন এবং সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। তত্কালীন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত না থাকায় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়, যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেনি। ওই নির্বাচনের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার ষষ্ঠ সংসদের প্রথম অধিবেশন ডেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে এবং একইসঙ্গে ষষ্ঠ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এরপর ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে পরপর দুটি নির্বাচন তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গণতন্ত্র মোটামুটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এ অবস্থায় নবম সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষহীনতার অভিযোগ এনে দেশে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তত্কালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। দেশ এগুতে থাকে এক অনিশ্চয়তার দিকে এবং ফলে আবির্ভাব ঘটে এক-এগারোর ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের। এই সরকার গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করে দেশের মানুষকে উপহার দেয় দুই বছরের এক দুঃসহ শাসন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তখন ঘোষণা দেন, ক্ষমতায় গেলে তারা এই অসাংবিধানিক সরকারের সব কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেবেন, যা এই অবৈধ সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে আরও উত্সাহিত করে।
ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। এ সরকার এরই মধ্যে ক্ষমতার সাড়ে তিন বছর পার করেছে। এই সাড়ে তিন বছরে তারা তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির খুব সামান্যই বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, মন্ত্রীদের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা এবং অসংলগ্ন বক্তব্য, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, শেয়ারবাজার লুটপাট, নজিরবিহীন দলীয়করণ, বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধকরণ, অগণিত গুম, খুন ও গুপ্তহত্যার কূলকিনারা করতে না পারা, ট্রানজিটের নামে ভারতকে একতরফা সুযোগ প্রদান, কুইক রেন্টালের নামে বিদ্যুত্খাতে অরাজকতা সৃষ্টি, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকিং খাত ধ্বংসসহ অজস্র ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। দেশের এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের আবার ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা যে প্রশ্নবিদ্ধ, সেটা তারা বুঝতে পেরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে টালবাহানা শুরু করে। বস্তাভর্তি টাকা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত (দুদকের বিচারে নির্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত!) মন্ত্রী সুরঞ্জিত বাবু সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে মুখ খোলেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফাঁদে পা দেবে না।’ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাজনীতি থেকে লাজ-লজ্জা একেবারেই উঠে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন মানে মুক্ত পরিবেশে জনগণের মুখোমুখি হওয়া। কোনো রাজনৈতিক দল যদি নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের মুখোমুখি হতে ভয় পায়, তাদের তো রাজনীতি করারই আর কোনো অধিকার থাকে না। ক্ষমতাসীন দলের ভাষ্য মোতাবেক তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় খুবই সফল এবং তারা ডিজিটাল উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে গেছে। অধিকন্তু তারা ২০২১ সালের মধ্যে (তারা কি তাহলে ধরেই নিয়েছেন জনগণ চাক বা না চাক ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকবেন?) দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিবর্তন করবে। সরকার যদি এতই ভালো কাজ করে থাকে তাহলে তাদের এত ভয় কিসের? কেন তারা নিজেদের অধীনে নির্বাচন করার জন্য গোঁ ধরে বসে আছে?
১৯৯৮ সালে সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন, যা ২০০৪ সালে খারিজ হয়ে যায়। ২০০৫ সালে এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়, যার জের ধরে গত বছর ১০ মে তত্কালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চে বিভক্ত আদেশে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের খুবই অস্পষ্ট রায় দেন। আর তখনই বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ছুতো পেয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার ওপর আদালত যে বিভক্ত রায় দেয়, তার পূর্ণ রূপ আজও প্রকাশিত হয়নি। সরকারকে ক্ষমতায় রাখা, না রাখা যে জনগণের ওপর বর্তায়, নির্বাচনের প্রাণ যে জনগণ, তাদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তড়িঘড়ি করে ২০১১ সালের ২৫ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদে সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেশকে এক অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। এহেন পরিস্থিতিতে এই বিভক্ত রায় প্রদানকারী সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সম্প্রতি মুখ খোলেন। তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলেন, ‘আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার যে কথা আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছিল, সেটা সুপ্রিমকোর্টের আদেশ। এটি কোনো পর্যবেক্ষণ নয়। জনগণের প্রত্যাশার কথা বিবেচনা করেই পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছে।’ সরকার পূর্ণ রায় বের হওয়ার আগেই রায়ের এই অংশটিকে ‘পর্যবেক্ষণ’ হিসাবে প্রচার করে অপব্যাখ্যা দিয়ে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে নানাভাবে অপব্যাখ্যা দিয়ে দেশের জনগণকে বোঝাতে চাইছে, এ ব্যবস্থা অসাংবিধানিক। অথচ ১৯৯৬ সালে তারাই আন্দোলন করেছিলেন এই ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।
ইউনিয়ন কাউন্সিলসহ বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অতি সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন দাবি তুলে ক্ষমতাসীনরা জাহির করতে চাচ্ছেন, তাদের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। তারা বোঝাতে চাচ্ছেন, কোনোভাবেই কোনো অনির্বাচিত সরকারের হাতে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। অথচ তারাই আবার দেশের ৬৪টি জেলায় ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন অনির্বাচিত প্রশাসক দিয়েই চালাচ্ছেন। তারা ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের অসাংবিধানিক সরকারকে নিজেদের আন্দোলনের ফসল বলে দাবি করেছিলেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী এখন ওই সরকারকে ‘দানব’ বলে অভিহিত করছেন। অসাংবিধানিক এ সরকার যদি আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল হয়ে থাকে, তাহলে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের সব অপকর্মের দায়ভার কি আওয়ামী লীগের ওপরই বর্তায় না? এ ছাড়া আনুমানিক বছর দুই আগে হঠাত্ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রচার করেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকার জেলখানায় খাবারের সঙ্গে স্বল্প মাত্রায় বিষ প্রয়োগ করতেন। এরকম একটি ভয়াবহ অভিযোগের পরও প্রধানমন্ত্রী এখনও কেন ওই অসাংবিধানিক সরকারকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করালেন না? এতে কি প্রমাণিত হয় না যে শুরু থেকেই ওই সরকারের সঙ্গে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের একটি অশুভ আঁতাত ছিল?
একটি দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আর আমাদের মতো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সারা দেশের বেশিরভাগ মানুষ, এমনকি জোট সরকারের প্রায় সব শরিক দলও যেখানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে, সেখানে সরকার কেন আদালতের রায়ের খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে রাতারাতি এ ব্যবস্থা বাতিল করছে, তা বোধকরি এদেশের সব মানুষই কম-বেশি বুঝে গেছেন। সরকার যদি ঠিকই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী হতো, দেশের মানুষকে যদি নাদান না মনে করে বিন্দুমাত্র মানুষ মনে করত, তাহলে অন্তত এই ব্যবস্থা বাতিলের আগে অবশ্যই জনমত যাচাই করত। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য যা যা দরকার তার প্রথম শর্ত দলীয় সরকার তথা এমপি, মন্ত্রী ও আমলাদের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং গ্রহণযোগ্যতা। দ্বিতীয় শর্ত শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং তৃতীয় শর্ত সরকারি দল এবং বিরোধী দলের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস। সরকার তথা সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ কার কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা, স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা আছে, তা যারা নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়েন বা যারা দেশের এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে ভাবেন তাদের কাছে দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। আর নির্বাচন কমিশন যেহেতু সরকারের পছন্দের লোক দিয়েই নির্মিত, সুতরাং তাদের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের যে লোকবল এবং লজিস্টিক আছে, তা দিয়ে সারাদেশে দলীয় সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করা বাতুলতা মাত্র। উদাহরণস্বরূপ গত বছর স্থানীয় সরকার ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের প্রভাব বিস্তারের যে অভিযোগ উঠছিল সেখানে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে কার্যত অসহায় দেখা গেছে। ক্ষমতাসীনরা পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনে যেভাবে নজীরবিহীন দলীয়করণ করছেন তাতে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তো দূরের কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও এদের ব্যবহার করায় অনেক শঙ্কা থেকে যাবে। সর্বোপরি বিরোধী দলের ওপর সরকারি দলের যে নজিরবিহীন অত্যাচার এবং উভয় দলে নিয়মিত যে বাকযুদ্ধ চলে, তাতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ শূন্যের বহু নিচে নেমে নেগেটিভে অবস্থান করছে। এহেন পরিস্থিতিতে কারও বিশ্বাস করার কি কোনো কারণ আছে যে, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব?
যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের মতে : ‘Democracy is the government of the people, by the people, for the people.’ আমাদের বাংলাদেশের এখনকার গণতন্ত্রের কথা আব্রাহাম লিংকন তখন ভাবলে হয়তো লিখতেন : ‘Democracy is the government of the ruling party, by the ruling party, for the ruling party!’ গায়ের জোরে সরকারি দল সৃষ্ট এই অরাজক পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধারের দায়িত্বও সরকারেরই। বিরোধী দল বারবার বলছে, তারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। আর সরকারি দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রহিত হয়ে গেছে, সেটা নিয়ে আর আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। আমরা জানি, ক্ষমতাসীনদের এই অনমনীয় মনোভাব গণতন্ত্রের বিকাশ, কিংবা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নয়—এই অবস্থান জেদের, অহংয়ের এবং বিরোধী দলকে শিক্ষা দেয়ার কূট কৌশলের। সরকারি দল আর বিরোধী দলের এই মুখোমুখি অবস্থানের অবসান ঘটাতে হবে একমাত্র আলোচনার মাধ্যমেই। সংলাপ রাজনীতিরই ভাষা। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সংলাপ নয়, সংঘাতই আমাদের কপালের লিখন। সরকারি দল সংলাপ আহ্বান করলে তাতে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে বৈ কমবে না। তাদের উদারতা দেশ তথা মানুষের জানমাল ও সম্পদ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। অন্যথায় দেশ যেদিকে এগুচ্ছে তাতে রাজপথে শক্তি পরীক্ষার মাধ্যমেই এ অবস্থার অবসান ঘটবে। সংঘাত কোনো সভ্য সমাধান নয়, গণতান্ত্রিক সমাধান তো নয়ই। রাজপথে শক্তি পরীক্ষা করতে গেলে কোনোদিন কোনো দেশেই ক্ষমতাসীনরা জিততে পারেনি। জিতটা কিন্তু বিরোধী দলেরই হয়ে থাকে। এদেশে ১৯৭১, ১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালের ইতিহাসও তাই বলে। ইতিহাস কখনও তামাদি হয় না। ২০১২ বা ২০১৩-তেও যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুখ দিয়ে বিষোদ্গার নয়, গালাগাল নয়, পরস্পরকে অপছন্দ করা নয়, বরং যুক্তি এবং সুতর্ক দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে—এমন প্রত্যাশা কি আমরা করতে পারি না? আমাদের গণতন্ত্র রক্ষায়, জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় সংলাপ অপরিহার্য। নয়তো ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন কিংবা এরশাদের মতো সরকার আবারও উঁকি দেবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবুও আমরা সাধারণ জনগণ এতটুকু আশা করি যে, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, আলোচনার পথ ধরে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, আমরা পাব একটি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
লেখক : ডিন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads