বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১২

মুরাদনগর ইউপি নির্বাচনের শিক্ষা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়




সৈয়দ আবদাল আহমদ
গত ১৬ জুলাই কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার ধামঘর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদে একটি উপনির্বাচন হয়ে গেল। এই উপনির্বাচনে দশজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্থানীয় পরিষদের নির্বাচন দলীয়ভাবে না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী ছিলেন ছয়জন এবং বিএনপি সমর্থক একজন। বাকিরা ছিলেন স্বতন্ত্র। র্যাব, পুলিশ, আনসারসহ প্রশাসনের উপস্থিতিতে সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ইউনিয়নের ১১টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলে। নির্বাচনটি পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকা থেকে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দলও সেখানে যায়।
মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ভোটগ্রহণ শেষে স্ব-স্ব কেন্দ্রে ভোটগণনার কাজও চলে। কেন্দ্রগুলোতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের এজেন্ট ও প্রতিনিধিদের সামনে প্রিজাইডিং অফিসার ভোটগণনার পর ফলাফল ঘোষণা করেন এবং রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর করেন। এরপর প্রতিটি কেন্দ্রের ব্যালট বাক্স নিয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তারা উপজেলা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের দিকে রওনা দেন। কিন্তু ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রের ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার ভুবনঘর এলাকায় পৌঁছলে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী বশীর আহমেদের ক্যাডাররা অতর্কিত হামলা চালিয়ে ব্যালট বাক্সের বস্তা ছিনিয়ে নিয়ে গোমতী নদীতে ফেলে দেয়। রাত সোয়া আটটায় ১১টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করেন উপজেলা রিটার্নিং অফিসার। এতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবুল কালাম (মাইক প্রতীক) ভোট পান ৩ হাজার ৭২৬টি। অন্যদিকে তার নিকটতম আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বশীর আহমেদ (গরুর গাড়ি) ভোট পান ৩ হাজার ৩৭৭টি। একটি কেন্দ্রের ভোট ছিনতাই হওয়ায় ওই কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেননি রিটার্নিং অফিসার। স্থগিত কেন্দ্রের ১ হাজার ২৮০ ভোটের মধ্যে ৯৫৫ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। এর মধ্যে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবুল কালাম ৩৭৩ ভোট পান। তার নিকটতম প্রার্থী সাধন চন্দ্র পান ২৪৩ ভোট। যদিও সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে ওই ফল আগেই ঘোষণা হয়েছে এবং নির্বাচনী কর্মকর্তারা রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর করে স্ব-স্ব এজেন্টকে কপিও দিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীর ক্যাডাররা ব্যালট ছিনতাই করার কারণে রিটার্নিং অফিসার ইউপি চেয়ারম্যান পদের উপনির্বাচনের পুরো ফল ঘোষণাই স্থগিত রাখেন। অর্থাত্ বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অন্যসব প্রার্থীর চেয়ে কয়েকশ’ ভোটে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়নি। পুরো ফলই স্থগিত রাখা হয়েছে। এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তার ভাগ্য যে কী হয়, তা মুরাদনগর উপজেলার ১৬ নং ধামঘর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদের ওই উপনির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে একটি ইউনিয়ন পরিষদের উপনির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারল না এবং প্রশাসন ব্যর্থ হলো, সেখানে জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে তার অবস্থা কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
গত বছরের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কথা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এবং সেই নির্বাচনে দলীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই ঘটবে। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের পর সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে হুশিয়ারি দিয়েছিল যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবে বিএনপি। তারা এ কথাও বলে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার সরকারি সিদ্ধান্ত গণতন্ত্র ধ্বংস করার একটি মহাপরিকল্পনা। এটা জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে একদলীয় শাসন কায়েমের নীলনকশা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্যই এ কাজটি করছে। কিন্তু বিএনপির হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও গত বছরের ৩০ জুন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। ফলে বিএনপি আন্দোলনের পথে এগিয়ে যায়। এরই মধ্যে বিএনপি বেশ কয়েকটি হরতাল করেছে, গণমিছিল করেছে, গণঅনশন করেছে এবং ঢাকা চলো কর্মসূচি পালন করেছে। বিরোধী দলের এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার কঠোর অবস্থানে যায় এবং দমন-পীড়ন চালিয়ে বিরোধী দলকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালায়। শুধু তাই নয়, নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে সরকার পরিস্থিতিকে এমন ঘোলাটে করে তোলে যে, বিরোধী দলের পক্ষে কঠোর আন্দোলন ধরে রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। একপর্যায়ে বিরোধী দলের জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়। তিন মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেল। আজও জানা যায়নি কোথায় আছেন ইলিয়াস আলী। তার সন্ধানের দাবিতে বিরোধী দল যখন হরতাল করে, ঠিক তখনই একটি গাড়ি পোড়ানোর মামলার অজুহাত সৃষ্টি করে সরকার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধী জোটের ৪৫ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে তারা মুক্ত। বিএনপি ১৮ দলীয় জোট গঠন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন এখন তেমন জোরদার না হলেও বিরোধীদলীয় নেতা ও ১৮ দলীয় জোট নেতা বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, ঈদের পর সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করা হবে।
আওয়ামী লীগের এমপি সোহেল তাজ সম্প্রতি এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। অনেক নাটকের পর অবশেষে স্পিকার তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। গাজীপুরের কাপাসিয়া আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। এ আসনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি গত ১৬ জুলাই স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এ উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া বিএনপিসহ বিরোধী দল যে নির্বাচন করবে না, এ সিদ্ধান্ত তারই প্রমাণ।
দলীয় সরকার নয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই যে নির্বাচন হতে হবে, সে কথা আজ সর্বমহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং তার নেতৃত্বাধীন জোটের দু-একটি দল ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলেরই এখন একই দাবি— নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং রাষ্ট্রদূতরাও বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অপরিহার্যতার কথা তুলে ধরেছেন। গত ১১ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা ফের বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে আশা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি মেকানিজম হবে এবং তা হতেই হবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ধারণাটি এখন অন্যান্য দেশেও প্রয়োগ হচ্ছে। পাকিস্তানের আগামী নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফলেই দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, অসহযোগ আন্দোলনে দেশকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। সেই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর দেশে টানা তিনটি মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ভালো লাগছে না। কারণ এরই মধ্যে তারা দেশকে যে অবস্থায় নিয়ে গেছে, নিজেরাও অনুধাবন করছে পায়ের তলায় মাটি নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে অস্তিত্ব থাকবে না। তাই তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে এত ব্যস্ত। মুরাদনগরের ইউনিয়ন পরিষদের উপনির্বাচন আবারও সতর্ক করে দিয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কোনোভাবেই নয়। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। সেটা যে নামেই হোক, নিরপেক্ষ সরকার হতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads