মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১২

ফখরুলসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন : বিদেশে অবস্থানরত খোকা আমান ও আলমের নামে ওয়ারেন্ট


প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে নিজ হাতে গাড়ি পোড়ানোর কথিত অভিযোগ এনে সরকারের দায়ের করা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের ৪৬ জন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে আদালত। এ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গতকাল মামলাটির আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো। একই সঙ্গে আদালত আগামী ৭ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু করার আদেশ দিয়েছে।
অপর এক আদেশে আদালত বিদেশে চিকিত্সাধীন সাদেক হোসেন খোকা ও পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে অবস্থানরত অপর দুই নেতার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তারা তিনজনই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে চিকিত্সা ও ওমরা পালনের জন্য বিদেশে গেছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা অভিযোগ গঠন বিষয়ে কয়েক দিন সময় চেয়ে আদালতে বলেন, এটি আজগুবি অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ের করা একটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা। আমরা এ মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছি। বর্তমানে হাইকোর্টে এ রিট বিচারাধীন রয়েছে। এ অবস্থায় এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের এখতিয়ার এ আদালতের নেই। অপরদিকে সরকারপক্ষের আইনজীবী বলেন, আসামিরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সামনে গাড়িতে আগুন নিয়ে গুরুতর অপরাধ করেছেন। এটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। এ মামলার বিচার কাজ বিলম্বিত করার সুযোগ নেই। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য ও যুক্তি নাকচ করে ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত-৫ এর বিচারক হারুন-অর-রশিদ গতকাল ওই আদেশ দেন। আদালতের এ আদেশের পর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, সরকার মুলত আদালতকে ব্যবহার করে একটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলায় বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হয়রানির কৌশল নিয়েছে। আদালত কোনো তথ্য ও যুক্তিও গ্রহণ করতে চায় না।
আদালত অভিযোগ গঠনকালে মামলার আসামি সাদেক হোসেন খোকা, আমানউল্লাহ আমান ও নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। তবে সাদেক হোসেন খোকার আইনজীবী হাইকোর্টের অনুমতি নিয়ে চিকিত্সার জন্যে বিদেশে গেছেন। অপর ২ জন ওমরাহ পালন করতে গেছেন। তাদের পক্ষে আদালতে সময় চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, সরকারি বাহিনীর হাতে গুম হওয়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার দাবিতে বিএনপির ডাকে হরতালের সময় গত ২৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে একটি মিনিবাস আগুনে পুড়ে যায়। এ ঘটনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহামসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধী দলের ৪৬ নেতাকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে সরকার। এ মামলায় সরকার বিরোধী নেতাদের জামিন ঠেকাতেও নানা কৌশল গ্রহণ করে। নিম্ন আদালতে জামিন নামঞ্জুর হলে তাদের সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে উচ্চ আদালতের আদেশে তারা জামিনে মুক্ত হন।
গতকাল এ মামলায় তাদের অভিযোগ গঠনের তারিখ ছিল। ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত ৬-এর বিচারক মোহাম্মদ এরফান উল্লাহর আদালতে শুনানি শুরু হয়। শুরুতেই আসামিপক্ষের আইনজীবী সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এ মামলার বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট বিচারাধীন রয়েছে। এ অবস্থায় এই আদালতের শুনানির এখতিয়ার নেই। তিনি বিভিন্ন যুক্তি পেশ করে বলেন, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত এ আদালতে মামলার শুনানি মুলতবি করা হোক। আদালত তার যুক্তি নাকচ করে দিয়ে শুনানি শুরু করতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এ আদালতের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন। সকালে বিচারকের প্রতি আসামিপক্ষ অনাস্থা প্রকাশ করায় মামলার নথি সিএমএম আদালতে পাঠানো হয়। সিএমএম আদালত পরে দ্রুত বিচার আদালত ৫-এর বিচারক হারুন-অর-রশিদের আদালতে মামলা স্থানান্তর করে দেয়। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ শুনানি শুরু করে ওই আদালত।
শুনানির শুরুতেই অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা এ মামলা ও এই আদালতের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছি। এটি এখন বিচারাধীন রয়েছে। এ অবস্থায় রিটের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চার্জ শুনানি মুলতবি রাখা হোক। মামলার বিভিন্ন অসঙ্গতি উল্লেখ করে আসামিপক্ষের অপর আইনজীবীরা আদালতে বলেন, মামলাটি একটি মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও হাস্যকর মামলা। তারা মামলার এজাহার ও চার্জশিটের বিবরণ উল্লেখ করে বলেন, এতে বলা হয়েছে, মির্জা ফখরুল ইসলামসহ ১৮ দলীয় জোটের ৪৬ জন নেতা ৬-৭টি মাইক্রোবাসে করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে চলন্ত বাসটি থামিয়ে যাত্রীদের মারধর করে তাড়িয়ে দিয়ে তাতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। পুলিশ তাদের ধরতে গেলে তারা দৌড়ে পালিয়ে যান। আইনজীবীরা বলেন, মামলার অভিযোগগুলো হচ্ছে আষাঢ়ে গল্প। দেশের কোনো পাগলও বিশ্বাস করবে না যে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মতো একটি সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত এলাকায় সেনাবাহিনী ও এসএসএফ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শত শত সদস্যের উপস্থিতিতে বিএনপি নেতারা একযোগে গিয়ে বাসে আগুন দিয়েছেন। তারা বলেন, হরতালে বিএনপির তিনজন নেতাকেও পুলিশ একসঙ্গে হাঁটতে দেয়া হয় না। এর ভেতর দিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গিয়ে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন। এটা শুধু মিথ্যা অভিযোগই নয়, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হয়রানি করার নতুন কৌশল। তারা বলেন, বাসের চালক ও হেলপারের বক্তব্য হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে আসার পর বাসটির টায়ার ফেটে যায়। যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে তারা বাসটি মেরামত করছিলেন। এ সময় কে বা কারা বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, নাকি ইঞ্জিন থেকে আগুন লেগেছে, তা তারা বুঝতে পারেননি। বাসটিতে আগুন দিতে কাউকে তারা দেখেননি। ওই সময় ওই এলাকায় পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন ছাড়া অপর কোনো মানুষও ছিল না। আইনজীবীরা বলেন, এ মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। উচ্চ আদালতের রিটের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই আদালতে এ মামলার চার্জ গঠনের শুনানি হলে সেটা উচ্চ আদালতের প্রতি অবমাননা হবে।
আসামিপক্ষের আইনজীবীদের এ যুক্তির বিরোধিতা করে সরকারপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু বলেন, উচ্চ আদালতে এখনও কোনো আদেশ হয়নি। কাজেই এ আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম চলতে কোনো বাধা নেই।
উভয়পক্ষের এ বক্তব্যের পর আদালত চার্জ গঠনের শুনানি শুরু করতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে চলে আসেন। পরে আদালত একতরফা চার্জ গঠন করে ওই আদেশ দেন।
মামলার ৪৬ আসামির মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জামিনে থাকা ৩৬ জন সকালেই আদালতে হাজির হন। আসামিদের মধ্যে ৪ জন পলাতক ও ৩ জন কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া তিনজন সময় চেয়ে আবেদন করেছেন।
এ মামলায় মির্জা ফখরুল ছাড়া অন্য আসামিরা হচ্ছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খোন্দকার মোশারফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আ স ম হান্নান শাহ ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ছাত্রদলের সাবেক নেতা কামরুজ্জামান রতন, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, স্বনির্ভর সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম ফজলুল হক মিলন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম, সংসদ সদস্য ও ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিবুন-উন নবী খান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আমীরুল ইসলাম খান আলীম, সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান খোকন, ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার, ঢাকা মহানগর যুবদলের সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম মজনু, বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দল আহ্বায়ক ইয়াসিন আলী, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক আ. মতিন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশীদ হাবিব, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক কামাল আনোয়ার আহমেদ লিটু, বিএনপি নেতা ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার আবুল বাশার, বিএনপি নেতা ও ৪০নং ওয়ার্ড কমিশনার আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানা বিএনপি নেতা লুত্ফর রহমান ওরফে এল রহমান, বিএনপির সাবেক ধর্মবিষয়ক সম্পাদক নবী সোলায়মান, খিলগাঁও থানা বিএনপির সভাপতি সাবেক কমিশনার ইউনুস মৃধা, তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ইসমাইল খান শাহীন, স্বেচ্ছাসেবক দল মোহাম্মাদপুর থানা শাখার সভাপতি মান্নান হোসেন শাহীন, ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখার যুগ্ম সম্পাদক ওবায়দুল হক নাসির।
গত ১০ মে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে মামলাটিতে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। ২৭ মে ছাত্রশিবির সাধারণ সম্পাদক আবদুল জব্বারকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দেয়া হয়। এ মামলার বাদী ছাড়া কোনো সাক্ষীই আসামিদের গাড়িতে আগুন লাগাতে কিংবা দৌড়ে পালাতে দেখেননি। বাদী লে. কর্নেল অলি আহমেদকে গাড়িতে আগুন লাগাতে দেখলেও প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, তিনি ওই ঘটনার তিন দিন আগে থেকেই একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সপরিবারে কক্সবাজারে ছিলেন। ঘটনার তিন দিন পরে তিনি ঢাকায় এসেছেন। এ সংক্রান্ত নথিপত্রও আইনজীবীরা আদালতে পেশ করেছেন। তবে আদালত এসব নথিপত্র বিশ্বাস না করে সরকারপক্ষের দেয়া মিথ্যা ও আজগুবি তথ্যই আমলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আইনজীবীদের। গতকাল আসামিপক্ষে সুপ্রিমকোর্ট ও ঢাকা বারের কর্মকর্তারাসহ বিপুলসংখ্যক আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads