শনিবার, ২১ জুলাই, ২০১২

মার্কিন সিনেটে গুম-খুন নিয়ে শুনানি : শুধু পরামর্শ নয় সতর্ক বার্তাও



বাংলাদেশের গুম ও ক্রসফায়ারসহ গুপ্তহত্যা নিয়ে এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সোচ্চার হয়েছে। গত ১৯ জুলাই মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির শুনানিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গুমের সংখ্যা ভয়ানক হারে বেড়ে চলেছে। বিরোধী দলের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করছে। দেশটিতে শ্রমিকের অধিকারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। শুনানিতে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অ্যাডভোকেসির পরিচালক জন সিফটন দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছেন। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলে ধরে এবং র্যাবকে ‘কুখ্যাত’ ও ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেছেন, ক্রসফায়ারের নামে তারা লোকজনকে হত্যা করছে। শুনানিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার জন্য গঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং তার কার্যক্রম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের আসল ‘লেখক ও স্থপতি’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ছাড় দিয়ে যে বিচার কাজ চালানো হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ব্যক্তির জবানবন্দিকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার মতো বেশ কিছু তথ্যের উল্লেখ করেছেন তারা, যেগুলো আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যথার্থ নয়।
শুনানিতে অন্য কিছু বিষয় উত্থাপিত হলেও সবকিছুকে ছাড়িয়ে গুম ও গুপ্তহত্যার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এদিকে ওয়াশিংটনে যেদিন মার্কিন সিনেটে শুনানি হয়েছে, সেদিনই ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরাও গুম ও গুপ্তহত্যার ব্যাপারেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ডিক্যাবের ওই অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম এবং শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করে ইইউ’র রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হানা বলেছেন, এর ফলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কথাটা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা দরকার। কারণ, উন্নত ও ধনী দেশের ক্রেতারা কোনো পোশাক কেনার আগে রফতানিকারক দেশের শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর করেন। তারা আশা করেন, তাদের অর্থ শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাবে। সে একই ক্রেতারা যখন শোনেন, বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকরা ভালো অবস্থায় নেই এবং তাদের একজন নেতাকে গুম করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তখন তারা বাংলাদেশের পোশাক কেনার আগে দশ বার চিন্তা না করে পারেন না। এভাবে পিছিয়ে পড়তে পড়তে একসময় বাংলাদেশের পোশাকই তারা বর্জন করবেন। সত্যি তেমনটি হলে ইউরোপের দেশগুলোতে তৈরি পোশাকের রফতানি বন্ধ হয়ে যাবে। আর রফতানি বন্ধ হলে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ। কারণ, ইউরোপই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান ক্রেতা। এদিকে গার্মেন্ট যেহেতু রফতানি আয়ের প্রধান খাত, সেহেতু রফতানির প্রধান বাজার হারানোর পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চয়ই বাড়িয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে না।
আমরা মনে করি, মার্কিন সিনেটের শুনানির পাশাপাশি ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূতের মূলকথার মধ্যে সরকারের জন্য পরামর্শ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সতর্ক হওয়ার বার্তাও। কারণ উন্নত দেশগুলোতে গুম ও গুপ্তহত্যাকে খুবই বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। যেসব দেশের সরকার গুম-খুন ও গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত, সেসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিরোধিতা করেন ট্যাক্সদাতা জনগণ। ট্যাক্সদাতাদের কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে সব দেশের সরকারকেই এদেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কথা না শুনলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়েও পারবে না তারা। সুতরাং মহাজোট সরকারের উচিত অবিলম্বে অন্তত গুম ও গুপ্তহত্যার মতো কর্মকাণ্ড বন্ধ করা। র্যাবকে দিয়েও এমন কোনো কাজ করানো চলবে না, যার অজুহাতে এলিট এ বাহিনীকেই বিলুপ্ত করা দাবি উঠবে। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়ে মার্কিন সিনেটের শুনানিতে যে মন্তব্য করা হয়েছে, সেদিকেও সরকারের উচিত মনোযোগ দেয়া। কারণ ‘লেখক ও স্থপতি’ তথা প্রধান অপরাধী ছিল পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেই অপরাধীদের একেবারে ছাড় দিয়ে এদেশের বিরোধী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বলেই সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে শুধু নয়, বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এজন্যই মার্কিন সিনেটের শুনানিতেও কথা উঠেছে। আমরা মনে করি, এ ধরনের কোনো বিষয়ে পা বাড়ানো দরকার যুক্তি ও আইনের ভিত্তিতে। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের গঠন থেকে গোটা বিচার প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়েই সেটা করা হয়নি এবং এখনও হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের উচিত কেবলই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে এগোনোর পরিবর্তে এ কথাটাও মনে রাখা যে, ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তীক্ষষ্টভাবেই নজর রাখছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads