রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

হঠাৎ বৃদ্ধি পেল মৃত্যুর মিছিল!


থানার সামনেই ঘটছে বড় বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা। খুন, গুম, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আতঙ্কগ্রস্ত সাধারণ মানুষ। শুধু বাইরে নয়, বেডরুমেও মানুষ ভুগছে চরম নিরাপত্তাহীনতায়। বাসায় ঢুকে গুলী এবং গলা কেটে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া দিনমজুরও রেহাই পাচ্ছে না দুর্বৃত্তদের কবল থেকে। থানার সামনেই ঘটছে গুলী করে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা।
রাজধানীসহ দেশের প্রায় প্রত্যেকটি পুলিশ স্টেশনেই অবস্থানরত এক শ্রেণীর পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসততার অভিযোগ রয়েছে। তেমনি সিআইডি, এসবি এবং ডিবি পুলিশের অনেকের বিরুদ্ধে অসততার অভিযোগ আছে। থানায় মামলা করতে গেলে বাদী-বিবাদী উভয়কে হয়রানি হতে হয়। বাদী কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এনে থানায় মামলা দিলে থানার কর্তব্য প্রথমে অকুস্থলে গিয়ে সরেজমিনে স্থানীয় লোকদের সাথে যোগাযোগের ভিত্তিতে মামলার মূল পটভূমি দেখা। কারণ অনেক সময় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য মিথ্যা মামলাও দেয়া হয়, যেখানে হয়তো অভিযুক্ত ব্যক্তিটি সৎ। আবার অনেক সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি যথার্থ দাগী অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ তাকে ধরে না কিংবা তার থেকে অর্থ খেয়ে আগেভাগেই তাকে বাড়ি থেকে সরে থাকার জন্য মোবাইলে জানিয়ে দিয়ে থাকে।
একের পর এক অথবা একটার পর একটা যেভাবেই বলা হোক না কেন, এমন খুনের ঘটনা ঘটলেও কোনটারই কূল-কিনারা করতে পারেনি আইন-শৃংখলাবাহিনীর সদস্যরা। খুনের বাইরে ঘটে যাওয়া ছোট বড় কোন অপরাধেরই সামাল দিতে পারছে না তারা। তারা বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছেন। তাদের ব্যর্থ হওয়ার পেছনেও রয়েছে নানা কারণ। যার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ‘আইন-শৃংখলা বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহার ।’
এ ছাড়া, ক্রাইম ম্যাপিং হট স্পট চিহ্নিত না করা, খুনি বা অপরাধীকে ভয় দেখানোয় ব্যর্থতা, দুর্বল মামলা ও তদন্ত রিপোর্ট এবং দৃষ্টান্তমূলক সাজার অভাবে নৃশংস খুনের ঘটনা বাড়ছে। অপরাধ, সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক, বিচারপতি, আইনজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতে, মূলত চার কারণে বাড়ছে এ ধরনের অপরাধ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবের জোরে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি। ফলে প্রথমত অপরাধীদের গায়ে হাত দেয়া যাচ্ছে না। এরা গ্রেফতার হলেও টেলিফোনের দাপটে আটকে রাখা যায় না।
রাষ্ট্র, সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী এবং আইনজ্ঞদের মতে, নৃশংস হত্যাকা-সহ অপরাধ কমাতে হলে চিহ্নিত কারণগুলো নিরসন করতে হবে। অন্যথায় অপরাধ কমবে না। উল্টো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হবে। তাদের মতে, যে কোনো ঘটনায় তদন্তের মাধ্যমে মূল অপরাধীকে চিহ্নিত করে তাকে আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচারের ক্ষেত্রে দু-একটি ঘটনায় নজির স্থাপন করা গেলে নৃশংস, বীভৎস হত্যাকা-সহ সামাজিক অপরাধগুলো কমে আসবে। কিন্তু বেশির ভাগ হত্যার ঘটনায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তারা নতুন করে খুনসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এটাই বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪)
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি আলোচিত খুনের ঘটনা ঘটেছে। এগুলো নিয়ে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ-র‌্যাবসহ সংশ্লিষ্টরা। পুলিশ সদর দফতরের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাস হতে চলতি ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে খুন হয়েছেন ২১ হাজার ১৪০ জন। শুধুমাত্র চলতি বছরের তিন মাসেই খুন হয়েছেন ১১০০ জন ।
রাজধানীতে ২৭ আগস্ট ২০১৪ রাতে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন চ্যানেল আই’র উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকী। দুর্বৃত্তরা তার নিজ বাসায় ঢুকে গলা কেটে হত্যা করে তাকে। ঘটনার সময় পরিবারের সদস্যদের বাসার ভেতরেই আটকে রাখা হয়। মাওলানা ফারুকীর খুনের ঘটনায় এক নারীসহ দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
২৮ আগস্ট ২০১৪ রাতে খুন হন সোনালীবাগে তিনজন। জমিসংক্রান্ত বিরোধ এবং চাঁদার টাকা না পেয়ে দুর্বৃত্তরা এই হত্যাকা- ঘটিয়ে শত শত লোকের সামনে দিয়ে নির্বিঘেœ চলে যায়। স্থানীয় সন্ত্রাসী কালাবাবু দীর্ঘদিন এই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে রেখেছিল। পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের কাছে এ তথ্য থাকার পরও কালাবাবু ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। সবশেষে তিনজনকে হত্যা করার পর টনক নড়ে পুলিশ গোয়েন্দাদের। এই দুর্বৃত্ত নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের লোক বলে পরিচয় দিয়ে আসছিল। সোনালীবাগের ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতারের পর তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে ।
এর আগে মিরপুর পল্লবীর কালশীতে খুন হন ১০ বিহারী। তার আগে গোপীবাগে খুন হন কথিত এক পীরসহ ৬ জন। এছাড়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকা-টি ছিল রাজধানীর আলোচিত খুনের ঘটনা ।
শুধু তা-ই নয়, খোদ পুলিশ হেফাজতে থেকেও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। নতুন বছরের শুরুতেই ৪১ দিনে ৪৪ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। এই হিসাব মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনা আগের যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে যাবে। এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপির আমলে। তখন ‘ক্রসফায়ার’ নামে পরিচিত এ হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ পাঁচ বছরে এবং ৫ জানুয়ারিতে রিনিইউ করা শাসনে এ হত্যাকা- বন্ধ করতে পারেনি।
 আসকের হিসাবে ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৬ জন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা অপহরণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৭ জনের লাশ পাওয়া গেছে। আর এই ১৬ জনের মধ্যে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ৬ জন, জামায়াত-শিবিরের ৩ জন, ছাত্রলীগের ৩ জন এবং ৪ জন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। আর ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৩৪ জন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ৩ জন নিহত হয়েছেন। এসব অভিযোগ পুলিশ, র‌্যাবসহ যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে।
এখন যে হত্যা ও গুমের অভিযোগ উঠছে, তার সঙ্গে গত বছরের রাজনৈতিক সহিংসতার যোগসূত্র রয়েছে। ব্যাপক সহিংসতা সামাল দিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কঠোর অবস্থানে যেতে বলা হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতেও ‘কিছু’ ঘটনা ঘটেছে।
তবে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, এ রকম ঢালাও অভিযোগ ঠিক নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন আইন মেনেই। কেউ আইন লঙ্ঘন করলে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আইনেই আছে। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)
বিরোধী দলকে সামাল দিতে সরকার অতি তৎপর। যার ফলে একই সঙ্গে বেড়েছে ঘোষিত (ক্রসফায়ার) ও অঘোষিত (গুপ্ত হত্যা-গুম) বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-। আসকের হিসাবে দেখা যায়, বিএনপির আমলে ২০০৪ সালে ২১০ জন, ২০০৫ সালে ৩৭৭, ২০০৬ সালে ৩৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ সংখ্যা কমে আসে। ২০০৭ সালে ১৮০, ২০০৮ সালে ১৭৫ জন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন।
এরপর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ওই বছর এই সংখ্যা বেড়ে হয় ২২৯। এর পরের বছরগুলোতে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো কমলেও বেড়ে যায় গুম-গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো অভিযোগ করে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাদের স্বজনদের ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করে দেয়া হচ্ছে বা লাশ ফেলে রাখা হচ্ছে।
আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালে ১৩৩ জন ‘ক্রসফায়ার’, গুলী ও হেফাজতে নিহত হন। একই বছর ৪৪ জন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা অপহরণের শিকার হন। এদের মধ্যে পরে ৬ জনের লাশ মেলে, ৭ জনকে থানায় হস্তান্তর করা হয়। অন্যরা এখনো নিখোঁজ। ২০১১ সালে ১০০ জন ক্রসফায়ার ও হেফাজতে নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে ৫৯ জনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। পরে ১৬ জনের লাশ পাওয়া যায়, চারজনকে থানা হেফাজতে দেয়া হয়। অন্যরা এখনো নিখোঁজ। ২০১২ সালে ক্রসফায়ার ও পুলিশ-র‌্যাবের হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসে ৯১-এ। এ সময় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ৫৬ জনকে, যাদের মধ্যে ৪ জনের লাশ পরে পাওয়া গেছে।
 আসকের হিসাবে ২০১৩ সালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ২০৮ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময় গুলীতে ১৩৭ জন মারা গেছেন। অন্যরা নিহত হয়েছেন ক্রসফায়ার ও পুলিশ-র‌্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায়। এই সময়ে ৫৮ জনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। এদের মধ্যে পরে ৫ জনের লাশ পাওয়া যায়। আর ৫ জনকে পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ও পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। অন্যরা এখনো নিখোঁজ।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর রাস্তা থেকে বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ধরে নিয়ে যায়। পরিত্যক্ত অবস্থায় গাড়িটি উদ্ধার করে পুলিশ। এর পর থেকেই তারা নিখোঁজ। ২০১০ সালের ২৫ জুন একই কায়দায় ফার্মগেট এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিএনপি নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে। তিনি এখনো নিখোঁজ। তদন্ত হচ্ছে-চলছে বলে সময় পার করা হয়েছে।
২০১৩ সালের ২৭ নবেম্বর রাতে ঢাকায় যাওয়ার পথে লাকসাম-কুমিল্লা সড়কে লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি এবং সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম (৫৯), বিএনপির লাকসাম পৌরসভার সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ (৪০) এবং বিএনপির আরেক নেতা জসিম উদ্দিনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে জসিমকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে র‌্যাব। এখন তিনি কারাগারে। অন্য দু’জনের খোঁজ মেলেনি।
১৪ ডিসেম্বর ২০১৩ আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলা করে ৫ জনকে হত্যা করা হয়। অভিযোগ আছে, বিএনপি-জামায়াত এ হামলা চালায়। এ ঘটনার প্রধান আসামী লক্ষ্মীছাপ ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম রব্বানীর লাশ মেলে গত ১৭ জানুয়ারি ২০১৪। রব্বানীর মামা আবদুল কাদের অভিযোগ করেন, চারদিন আগে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে রব্বানীকে ধরেছিল র‌্যাব। তবে র‌্যাব এ কথা স্বীকার করেনি। একই ঘটনার আরেক আসামী টুপামারি ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক আতিকুর রহমানের লাশ পাওয়া যায় ২০ জানুয়ারি সৈয়দপুর এলাকার মহাসড়কের পাশ থেকে। তার ভাই আমিনুল ইসলামের অভিযোগ, টাঙ্গাইলে পালিয়ে থাকা অবস্থায় ১৪ জানুয়ারি ২০১৪ তাকে ডিবি পরিচয়ে একদল লোক ধরে আনেন। পরে তার লাশ পাওয়া যায়।
১২ ডিসেম্বর ২০১৩ লক্ষ্মীপুরে মিছিল থেকে জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ গুম হন। স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের বাড়িতে র‌্যাবের অভিযানের খবর শুনে তারা মিছিল নিয়ে ওই বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় র‌্যাব মিছিলে গুলী করলে ইকবাল মাথায় গুলীবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে লাশটি র‌্যাবের সঙ্গে থাকা একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া যায়। ঘটনাস্থলে ইকবালের রক্ত, মগজ, স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখা গেলেও ইকবালের লাশ মেলেনি এখনো।
স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী এবং পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্যে মানুষ চরম হতাশ হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি কয়েকটি খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। এ দিকে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার যথেষ্ট প্রমাণ থাকার পরও গ্রেফতার করা হচ্ছে না অনেক অপরাধীকে। এতে মানুষের উদ্বেগ আরো বাড়ছে। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, এভাবে অপরাধীরা আইনের ঊর্ধ্বে থেকে গেলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, চলতি বছরের গত সাত মাসে খুন হয়েছে ২৬৬৯ জন। (সূত্রঃ দৈনিক নয়া দিগন্ত ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪)
২৮ আগস্ট ২০১৪ রাতে মগবাজারে ট্রিপল মার্ডারের ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দাবি করেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেনি। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। প্রায় একই কথা বলেছিলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের দু-একটি ঘটনাকে ধরে পুরো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিচার-বিবেচনা করা যাবে না। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অবশ্যই এ ঘটনাগুলো বড় ধরনের অপরাধ। অনভিপ্রেত-অনাকাক্সিক্ষত। পুলিশ এসব ঘটনার পর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। সার্বিকভাবে হিসাব করলে বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো আছে। (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ৩০ আগস্ট ২০১৪)
নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। হারানো স্বজনরা ফিরে আসবে এ প্রতীক্ষায় থাকেন। দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর যায় কিন্তু হারানো স্বজনরা ফিরে আসে না। কথায় আছে-‘যার যায় সে বোঝে’। যাদের বাবা-ভাই-স্বামী নিখোঁজ হয়েছেন তারা বুঝছেন স্বজন হারানোর বেদনা।
৩০ আগস্ট ২০১৪ আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস-২০১৪ উপলক্ষে ‘স্বজনদের ব্যথা-গুম, খুন ও নির্যাতন আর না’ শিরোনামে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে সম্মেলনের আয়োজন করে ‘মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি’ নামের একটি সংগঠন। বাংলাদেশে এ ধরনের অনুষ্ঠান এটাই প্রথম। আইনজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিক, মানবাধিকারকর্মীসহ সুশীল সমাজের কিছু মানুষের প্রতিবাদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম এই সুরক্ষা কমিটি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খানের সঞ্চালনায় সম্মেলনে গুম ও কথিত ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার ২৪ জনের স্বজন বক্তব্য দেন। একেক জন মঞ্চে বক্তব্য দিতে উঠে হু হু করে কাঁদছিলেন। আর তা সংক্রমিত হচ্ছিল উপস্থিত সবার মধ্যে।
স্বজনহারারা নিজেদের প্রতীক্ষা আর হৃদয়ের রক্তক্ষরণের চিত্র তুলে ধরে নিজেরা কেঁদেছেন; ড. কামাল হোসেন. ড. শাহ দীন মালিক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, জাফরউল্লাহ চৌধুরী, আসিফ নজরুল, খুশী কবির, শিরীন হক, বাসদের খালেকুজ্জামান, সিপিবির মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ দেশের বরেণ্য লোকদেরও কাঁদিয়েছেন। সম্মেলনে এসেছিলেন আরিয়ান, রায়তা, মাশরুফা, শাহনাজ, মাওলানা আবদুল হামিদ, সাজজিদাসহ ৯৭টি নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা। তাদের পিতা-ভাই-ছেলে কেউ ক্রসফায়ারে প্রাণ হারিয়েছেন; আবার কেউ গুম হয়েছেন। তারা হারানো প্রিয়জনকে ফিরে পেতে যে কত ব্যাকুল তা বোঝা গিয়েছিল তাদের মুখ চোখে চাহনি দেখে। সবাই ভাবলেশহীন। চোখে-মুখে ছিল বিষণœœতা। কারো চোখে পানি। কেউ হয়তো কিছুক্ষণ আগে কেঁদেছিলেন। মুখ দেখে তা বোঝা যাচ্ছিল। কারো চোখ কিছুটা লাল। গালে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর চিহ্ন। শিশুরা আনন্দ-উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। ওদের মুখের দিকে তাকালে মনে হয় সবাই এক পরিবারের সদস্য। হারানো স্বাজনদের ফিরে পেতে অসহায়ের মতো অশ্রু বিসর্জন করছেন। অথচ তারা কেউ এক পরিবারের নয়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা এসেছেন সম্মেলনে যোগ দিতে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে বক্তব্য দেন মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির অন্যতম সমন্বয়ক আইনজীবী শাহ দীন মালিক। তিনি ক্ষমতাসীন দলের উদ্দেশে বলেন, ‘র‌্যাব যদি থাকে, আর আপনারা যদি ক্ষমতায় না থাকেন, তাহলে এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আপনাদের ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়বে। ২০০৬ সালে প্রথম আলোতে লিখেছিলাম, “খালেদা জিয়া, আপনাদের এই র‌্যাব দানব হবে।” এখন খালেদা জিয়া সে বিষয়টি উপলব্ধি করছেন। আপনারা এখন ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। গুমের বিচার এ দেশে না হলে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে যাব। প্রতিটি গুমের বিচার হতেই হবে। না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরব না। এটা আমাদের দেশ। এই দেশে এভাবে মানুষকে ধরে নিয়ে যাবে, আর সবাই কান্নাকাটি করবে, এটা হবে না।’
অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ পর্যায়ে সবার পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকার অধিকার সংবিধানের ১ নম্বর অধিকার। আমরা নাগরিক হিসেবে অসহায় নই। আজ যেটা করেছি, আমরা সেটাই করতে পারি, সোচ্চার হতে পারি। আজ ভয় ভেঙে সবাই এখানে এসেছেন। এই ভয় ভাঙাটাকে সুসংহত করতে হবে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ (চলবে)
জিবলু রহমান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads