সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সরকারের শান্তির মডেল ও বাস্তবতা


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশকে শান্তি রক্ষার মডেল হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে, তার দেশ শুধু বাংলাদেশ নয়, অশান্ত ও ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ২৮ হাজারেরও বেশি সেনা সদস্যকে বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করেছে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, তার সরকার সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ, সহিংস চরম পন্থা, উগ্রবাদ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি জিরোটলারেন্স নীতি অবলম্বন করে আসছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, সন্ত্রাস ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ নির্মূলে তিনি ভারতসহ বিশ্বের যে কোনও দেশের সাথে সহযোগিতায় প্রস্তুত রয়েছেন, একই সাথে তিনি যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার কাজে সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবন নাশের ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, তাকে হত্যার জন্য একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করছে। এর আগে একই ধরনের কথা বলেছেন সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও তোফায়েল আহমেদসহ ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা। অনেকে প্রশ্ন করেছেন, যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর জীবনের নিরাপত্তা নেই, সে দেশ শান্তির মডেল হয় কিভাবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই সরকারের গত পৌনে সাত বছরের রেকর্ড উল্লেখ করে বলেছেন যে, জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি সেখানে গিয়ে যে সত্য কথাটি বলেছেন- তা হচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি উচ্ছেদে তার সরকারের সাফল্য। সন্ত্রাসবাদ, সহিংস চরমপন্থা ও উগ্রবাদ দমন করেননি বরং নতুন করে সৃষ্টি করেছেন। তার দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহিংস উগ্রবাদ-সন্ত্রাস, হত্যা, গুমের নতুন প্রতিভু ////হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৮ সালের পাতানো নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের চারদিকে শুধু শত্রুই দেখতে পাচ্ছিলেন। ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই তারা সর্বত্র স্বাধীনতা বিরোধীদের পদধ্বনি শুনতে পান। অনেকে অভিযোগ করেছেন যে, পিলখানা হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর চৌকস ও প্রতিভাবান কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়ার পর তারা সর্বপ্রথম আঘাত হানেন জাতীয় জীবনের সর্বত্র সক্রিয় আদর্শভিত্তিক প্রতিশ্রুতিশীল দল জামায়াত-শিবিরের উপর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র লীগ কর্তৃক সৃষ্ট একটি ঘটনায় একজন ছাত্রলীগ কর্মীর রহস্যজনক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মহাজোটের পরাক্রমশালী সরকার সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযানের নামে হাজার হাজার নিরীহ লোকের উপর হামলা, মামলা ও নির্যাতনের স্টীমরোলার চালান এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যখন সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় তখন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব শামসুল হক টুকু ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক সমাবেশে ঘোষণা করেন যে, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নির্ভর করে জামায়াত-শিবিরকে দমন করা যাবে না। তিনি এ ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতা-কর্মীদের আহ্বান জানান। দেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ন্যায় দায়িত্বশীল পদে বসে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেয়ার সরকারি এই ঘোষণা দেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে শুধু জামাযাত-শিবির নয়, দেশের ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করার জন্য সরকার প্রাণান্তকর চেষ্টা শুরু করেন। কওমী মাদ্রাসাগুলোকে তারা জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং কোথাও সন্ত্রাস বা জঙ্গিপনার ঘটনা ঘটলে তার জন্য ইসলামপন্থীদের দায়ী করতে শুরু করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো যখন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তখন তারা ইসলামপন্থী তথা জামায়াত-শিবিরের উপর দোষ চাপিয়ে দেন এবং বলতে শুরু করেন যে, জামায়াত-শিবিরের লোকেরা তাদের দলে অনুপ্রবেশ করে এই অপরাধমূলক কাজগুলো করছে। ঐ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেছিলেন যে, পাহাড়ে, সমতলে সর্বত্র স্বাধীনতা বিরোধীরা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা তাদের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্রের অনুঘটক হিসেবে শুধু ইসলামপন্থী নন, পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকেও সম্পৃক্ত করে নেন। এই প্রক্রিয়ায় বিএনপি ও তার শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীসহ সকল পর্যায়ের সক্রিয় এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরও শত্রু তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। বিএনপি’র চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার দুই ছেলে, পুত্রবধূ এবং জিয়া পরিবারের আত্মীয়-স্বজন ও দেশের অন্যতম বৃহত্তম এ রাজনৈতিক দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাও শাসকদলের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, শত্রু তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। এ উন্মত্ততা এখনও চলছে। এবং সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতা সম্পর্কে যখন শুধু বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র- জুনিয়র নেতানেত্রী এবং থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সদস্যরা বিক্ষুব্ধ হয়ে সমালোচনামুখর হয়ে উঠছেন তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় মন্ত্রী এবং দলীয় মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একাধিকবার এর মধ্যে শেখ হাসিনার হত্যার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। সারাদেশ ও জাতি এখন তার সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনায় মুখর। তার শরিক দল জাতীয় পার্টি নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ পদ-পদবী পাবার আগে বলেছিলেন, মন্ত্রীরা অথর্ব, সরকার দেউলিয়া, অপর শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা, নিয়ন্ত্রণহীন নিত্যপণ্যের বাজার, উদাসীন ও বিপর্যস্ত পুলিশ প্রশাসন এবং শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারীর মতো মহা দুরবস্থার দায় তারা নেবেন না। এর দায়িত্ব আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এবং কর্মকর্তাদের। মহাজোটের অন্যতম শরিফ ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা রাশেদ খান মেননও এই দফা মন্ত্রী হবার পূর্বে যোগাযোগমন্ত্রীকে নির্লজ্জ, বেহায়া আখ্যায়িত করে বলেছেন যে, প্রশাসন চলছে সমন্বয়হীনভাবে এবং সরকারের মন্ত্রীরা বিদেশীদের স্বার্থ রক্ষা করছেন। ক্ষমতাসীন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের মন্ত্রীদের অতিকথনকে ব্যর্থতার চেয়েও ভয়ঙ্কর আখ্যায়িত করে বলতেন যে, মন্ত্রীরা যদি নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা স্বীকার করে সঙ্কট সমাধানে আন্তরিক হন তাহলে জনগণ অন্তত: ধৈর্য ধরতে পারে। তিনি স্বরাষ্ট্র, বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করেন। একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতা ও বর্তমানে মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ বহু নবীন-প্রবীণ এমপি। তাদের বেশির ভাগই গণবিস্ফোরণের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সুরঞ্জিত বাবু অবশ্য সরকারকে একটি হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। তিনি বলেছন যে, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণে নুতন আইন না হলে সংখ্যালঘু হিন্দুরা সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনে নামবে। তার দলের সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরো বলেছেন যে, তাদের ধৈর্যের সীমা আছে। এ দেশের সংখ্যালঘুরা আজীবন আপনাদের ভোটব্যাংক হয়ে থাকবে না। বস্তুত: লাগামহীন দ্রব্যমূল্য ও জনদুর্ভোগ, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, বেহাল যোগাযোগ ব্যবস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ-সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট, শেয়ার কেলেঙ্কারী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন-নিপীড়ন এবং ক্ষমতালিপ্সা বর্তমানে দেশে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যার ফলে ১৫ কোটি মানুষের জীবন এখন পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার কোনও পথ তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। এই পরিত্রাণের পন্থা হিসেবে অনেকেই মন্ত্রীদের অপসারণ দাবি করেছেন; কোন কোন দল সরকারের পদত্যাগ দাবি করে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বলেছেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ যোগাযোগ মন্ত্রীর অপসারণের সময় বেঁধে দিয়ে বলেছেন যে, এর মধ্যে তাকে অপসারণ করা না হলে তারা ঈদের দিনে ঈদ না করে শহীদ মিনারে অবস্থান ধর্মঘট করবেন। বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও আওয়ামী লীগ এমপি তারানা হালিম একই দাবিতে অনশনের হুমকি দিয়েছেন।
অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও অদক্ষতা যখন সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে তখন প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই হস্তক্ষেপ করবেন এবং দায় স্বীকার করে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনদুর্ভোগ লাঘব করবেন। কিন্তু হাহতম্বি মন্দ ভাগ্য! তিনি ব্যর্থতা স্বীকার করা দূরের কথা বরং মন্ত্রীদের দক্ষতার বিরাট সার্টিফিকেট দিয়ে বললেন যে, তারা খুবই ভাল কাজ করছেন। তার দৃষ্টিতে দলীয় সমালোচকরাই বড় অপরাধী। তারা ছোটখাট বিচ্যুতির সমালোচনা করে শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। 
এদিকে বিশ্লেষকরা আওয়ামী লীগের বিগত পেছনের সাত বছরের শাসনামলকে শূন্যগর্ভ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অতীতের স্মৃতিচারণ করে তারা বলেছেন যে, ক্ষমতার মদমত্ততা, নির্ভুল পদক্ষেপ ও শতভাগ সাফল্যের দাবির ন্যায় কিছু উপসর্গ আদতেই বালখিল্যতা যা সরকার বা ক্ষমতাসীনদের পতনের পূর্ব লক্ষণ। আওয়ামী শাসনের শুরু থেকে এই লক্ষণগুলো অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে দেখা দেয়। তবে দলটি নিজেদের সংশোধনী না করে ফ্যাসিবাদী ও অত্যাচার-নির্যাতনের আশ্রয় নেয় এবং ভোটারবিহীন ৫ জানুয়ারির ছলচাতুরির নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তারা ক্ষমতা লিপ্সা, অত্যাচার-নির্যাতন ও বেহায়াপনার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
লক্ষ্য করুন, কী অবলীলায় প্রধানমন্ত্রী শুধু হিল্লী-দিল্লী নয়, ওয়াশিংটন, জাতিসংঘ, টোকিও কোপেন হেগেনসহ সারা দুনিয়া তিনি মাত করেন। তবে সংশয় জন্মে শুধু এক জায়গায়ই। যখন তিনি সর্বতই সুপারলেটিভ ডিগ্রিতে কথা বলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, না কেউ তাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে তা বলা মুশকিল। তবে একটা বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ স্পৃহা তার আপাদমস্তক গ্রাস করে ফেলেছে, দেশের উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণচিন্তা এখন গৌণ হয়ে পড়েছে। পিতৃ হত্যার বিচার তিনি করেছেন, এখন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও হত্যার সহযোগীদের বিচারের অঙ্গীকার তাকে পেয়ে বেসেছে। সম্ভবত এ কারণেই মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও দলীয় নেতা-কর্মীদের অপকর্ম তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে না। বিবিসির খ্যাতনামা সাংবাদিক সিরাজুর রহমান তার এক নিবন্ধে একবার আমাদের প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতিতে আসার পটভূমি সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, এই সাক্ষাৎকারে তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন যে, দেশ ও জাতির জন্য নয়, নিরেট পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই শেখ হাসিনা রাজনীতিতে এসেছেন। তার দৃষ্টিতে তার পিতাকে হত্যা করার পর এ দেশের মানুষ উল্লসিত হয়েছেন, তারা তার প্রতিবাদ করেননি। এ প্রেক্ষিতে শাস্তিই তাদের পাওনা। কথা রূঢ় শুনালেও প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তা, অঙ্গীকার ও তার সরকারের কর্মকান্ডে সাক্ষাৎকারটির বক্তব্যকেই সমর্থন করছে বলে মনে হয়।
পাঠকরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের সূচনা হয়েছিল পিলখানা হত্যাযজ্ঞ ও বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে এবং এর যৌক্তিক সুরাহা এবং পেছনের শক্তিকে চিহ্নিত না করেই বিচারের কাজ প্রায় সমাপ্ত করা হয়েছে। অথচ সেনা তদন্ত টিম এবং সরকারি তদন্ত কমিটি উভয়েই বলেছে যে, সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিসমূহের কর্মকর্তা এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সহযোগিতার অভাবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের বেঁধে দেয়া টিওআর-এর সীমাবদ্ধতার কারণে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের মূল নায়কদের চিহ্নিত করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। তারা এদের চিহ্নিত করার জন্য সম্প্রসারিত তদন্তের সুপারিশ করেছিলেন। জাতিরও প্রত্যাশা ছিল যে, সেনাবাহিনীর চৌকস ৫৭ জন মেধাবী কর্মকর্তা হত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের পরিচয় উন্মোচিত হোক এবং তারা শাস্তি পাক। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আওয়ামী লীগ সরকার এ পথে আর অগ্রসর হয়নি; হয়তো অজানা কোনও ভয়ে। এক্ষেত্রে সেনা হত্যার সাথে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে অনীহা এবং নিজের পিতার হত্যাকারীদের সহযোগিতা করার অসত্য অভিযোগে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিচারের প্রত্যয়-প্রধানমন্ত্রীর এই দুই অবস্থানের মধ্যে দেশবাসী কোনও সামঞ্জস্য খুঁজে পান না।
অসলে পতনোন্মুখ যে কোন সরকারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক ফন্দি-ফিকির আঁটতে হয়। তবে এ কথাও ঠিক যে, এসব করে পতন ঠেকানো যায় না। সমস্যা হচ্ছে যখন কোনও সরকার প্রচুর ভোটাধিক্যে ক্ষমতারোহণ করে তখন সরকারের সুস্থ চিন্তাধারা বিগড়ে যায়। আর নির্বাচনের ভূমিধস বিজয় যদি ভোটারবিহীন ও কারচুপির হয় তাহলে তো তারা পাগলই হয়ে যায়। দলটি তখন নিজেদের সম্পর্কে অনেক কথাই ভুলে যায়। ক্ষমতাসীন দলের জন্য এটাই কাল হয়। আওয়ামী লীগের অবস্থা এখন অনেকটাই এ পর্যায়ে ‘খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দেশ শাসনের পৌনে তিন বছর পার করার পরও তারা সর্বদা সর্বত্র ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাদের ব্যর্থতা মানেই প্রথমত অজ্ঞাত মহল, এখন জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-আইএসআই থেকে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এই অভিযোগের সত্যতা কখনও যাচাই হয়নি। ১৯৭৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে এবং পার্লামেন্টে ক্ষমা ঘোষণা করে ৩৮ বছর পর তথাকথিত আইনের শাসনের নামে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বেআইনীভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি এবং আইন-কানুন লঙ্ঘনের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে ও হচ্ছে। এদের কাউকে শূলে চড়ানো হয়েছে ও অন্যরা অপেক্ষায় আছেন। এদিকে সারা দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন-বেআইনী হত্যা, গুম এবং রাস্তায় পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা স্মরণাতীতকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সরকার শুধু ষড়যন্ত্র খুঁজেই বেড়াচ্ছেন।
খ্যাতনামা নিরাপত্তা বিশ্লেষক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিজের সাবেক মহাপরিচালক এম আবদুল হাফিজের মতে, শাসকরা কদাচিত অভিযোগ করে। তারা বরং অভিযোগ খ-ন করে এবং সেগুলোর উত্তর দেয়, কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই শুধু অভিযোগ করে যাচ্ছে। এই অভিযোগ ও ষড়যন্ত্রের ভূত দলটির কার্যক্রমকে এতই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, অনিবার্যভাবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের পাল্লা হালকা থেকে হালকাতর হচ্ছে। প্রতিশ্রুতি পূরণের কথা তারা ভুলে গেছেন। তাদের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগে জননিরাপত্তার ক্রমাবনতির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুটপাট, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিবাণিজ্য এবং সন্ত্রাস-নৈরাজ্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। অবশ্য সরকারের মধ্যে এখানে কোথাও হতাশা দেখা যায় না। সরকারের জিদ এখানে সুস্পষ্ট। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে প্রতিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তিকে তারা নির্মূল করতে পারবেন। জয়নাল আবদীন ফারুকের ওপর নির্মম পুলিশী নির্যাতন, পুলিশী হেফাজতে এডভোকেট এম ইউ আহমেদের হত্যা, জামায়াত, বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলা ও নির্যাতন এ লক্ষ্যেই পরিচালিত বলে দেশবাসী বিশ্বাস করেন। আওয়ামী লীগের বিশ্বাস, বিএনপির মাথা ও মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে, জামায়াতকে পঙ্গু করা হয়েছে। আন্দোলন করার ক্ষমতা ও সামর্থ্য দল দুটি হারিয়ে ফেলেছে। পুলিশ, র‌্যাব ও দলীয় ঠ্যাঙ্গানো বাহিনী তো সরকারের পক্ষেই আছে। র‌্যাবের সদস্যদের অনেকেই ভাড়ায় খেটে মানুষ হত্যার ঘটনা চোখের সামনেই ঘটছে। আবার ‘অদৃশ্য আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংবিধান থেকে উৎখাত করে দেয়া হলেও দৃশ্যমান প্রতিবেশী ভারতের ওপর আস্থা বিশ্বাস তো আছেই। বিপদে-আপদে তারা যে সাহায্য করবেন দলটি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। কাজেই ক্ষমতা যে পাকাপোক্ত আছে এবং থাকবে তাতে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। বিশ্বের উন্নয়শীল দেশসমূহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় মূল্যবান ও ব্যয়বহুল প্রধানমন্ত্রী বিরল। ক্ষমতায় এসে তিনি আইন করে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার সামগ্রিক সুবিধা নিয়েছেন। ঐ আইনের অধীনে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে এবং এ বাহিনী ও তার সহযোগী এবং লজিস্টিকসের পেছনে আমাদের দৈনিক কত কোটি টাকা খরচ হচ্ছে সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জানা নেই। এছাড়াও তিনি দেশে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার পাওনা নিরাপত্তা সুবিধাও ভোগ করছেন। এত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে যখন তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের প্রশ্ন ওঠে তখন আমরা শুধু স্তম্ভিত নই আতঙ্কিতও হয়ে পড়ি। তার জীবনের যদি আশঙ্কা থাকে তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads