বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সমঝোতার আহ্বান খালেদা জিয়ার


গত মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় ২০ দলীয় জোটের নেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, গ্রেফতারের হুমকিতে ভয় পান না তিনি। প্রধানমন্ত্রীকে উল্টো সতর্ক করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, হুমকি দেয়ার আগে তাদেরই বরং যার যার পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে নেয়া উচিত। কারণ, তাকে গ্রেফতার করা হলে আলেম-ওলামাসহ সাধারণ মানুষ এমনভাবে রাজপথে নেমে আসবে যে, ক্ষমতাসীনরা তখন পালানোরও পথ পাবেন না। অমন অশুভ পরিণতি এড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বেগম জিয়া বলেছেন, সরকারকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী এবং জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা বাতিল করতে হবে। গুম-খুন ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার বন্ধ এবং সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। বর্তমান সরকার ও সংসদকে অবৈধ বলে উল্লেখ করে দ্রুত নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যও দাবি জানিয়েছেন বেগম জিয়া। বলেছেন, সে নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। এসব দাবি না মানা হলে একের পর এক হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনসভায় সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট এবং দলীয়করণের মতো আরো কিছু বিষয়ে বক্তব্য রাখলেও ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে বেগম জিয়ার উচ্চারিত হুশিয়ারিই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারেও উস্কানি এসেছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। জাতিসংঘের উদ্দেশে দেশত্যাগের আগেরদিন, গত ২১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করার হুমকি দিয়েছেন। এরপর থেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং দলের অন্য নেতারাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুর মেলাতে শুরু করেছেন। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার দাবি জানাচ্ছেন তারা। এসবের জবাবেই পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বেগম জিয়া। শুনতে কঠোর মনে হলেও তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না। কারণ, রাজনৈতিক সংকটকে ক্রমাগত ঘনীভূত করার মাধ্যমে এই হুশিয়ারির প্রেক্ষাপট আসলে ক্ষমতাসীনরাই তৈরি করেছেন। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, গুম-খুনসহ বিরোধী দলের ওপর প্রচন্ড দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা এবং সবশেষে ৫ জানুয়ারি একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ক্ষমতায় ফিরে এসেই তারা থেমে যাননি, দেশে-বিদেশে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত সংসদকে দিয়ে ষোড়শ সংশোধনীও পাস করিয়ে নিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করার হুমকি। বলা দরকার, এই হুমকি দেয়ারও অনেক আগে থেকে বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার প্রচ- মারমুখী ভূমিকা পালন করে চলেছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জামায়াতের আমীর এবং সেক্রেটারি জেনারেলসহ অন্য শীর্ষ নেতাদেরও সরকার ফাঁসির মঞ্চে ওঠানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। অথচ দেশের রাজনৈতিক নেতারা তো বটেই, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইন বিশেষজ্ঞরাও প্রথম থেকে বলে এসেছেন, সব মামলাই সাজানো এবং জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর কারণে, সরকারের দিক থেকে ক্রমাগত চাপ আসা সত্ত্বেও জামায়াত দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করেনি বরং দল দুটির ঐক্য আরো মজবুত হয়েছে। উল্লেখ্য, জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথাটা বেগম জিয়ার বক্তব্যেও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনসভায় তিনি বলেছেন, সরকারের কথা না শুনে বিএনপির সঙ্গে রয়েছে বলেই জামায়াতকে জঙ্গি এবং স্বাধীনতাবিরোধী বানানো হচ্ছে।
আমরা মনে করি, কোনো একটি বিষয়েই বেগম খালেদা জিয়া সামান্য বাড়িয়ে বলেননি। জনগণের সামনে তিনি বরং সত্যই তুলে ধরেছেন। বস্তুত ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শেখ হাসিনার সরকার গণতন্ত্রকে ধ্বংসের ভয়ংকর কর্মকান্ডে মেতে রয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের মতো গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলোকে নির্মূল করার চেষ্টাও চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কিন্তু বিভিন্ন প্রশ্নে একের পর এক ছাড় দেয়া হয়েছে। প্রধান নেত্রী হিসেবে বেগম জিয়া সংঘাত, হানাহানি ও হিংস্রতার পথ পরিহার করে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি এমনকি তত্ত্বাধায়ক সরকারের প্রশ্নেও নমনীয়তা দেখিয়েছিলেন। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার হুবহু পুনর্বহালের দাবি পরিত্যাগ করে ২০১৩ সালের নবেম্বরে উপস্থাপিত রূপরেখায় বলেছিলেন, নির্বাচন হতে হবে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে কিন্তু সরকার প্রধানের পদে শেখ হাসিনাকে রাখা চলবে না। বিষয়টি নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে যে কোনো স্থানে সংলাপে বসারও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়েছিলেন একতরফা নির্বাচনের নীলনকশা অনুযায়ী। একতরফা সে নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা আবারও ক্ষমতায় এসেছেন। শুধু তা-ই নয়, প্রচন্ড দমন-নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি ক্রমাগত উস্কানি দেয়ার এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে এখনো ক্ষমতাসীনরা সমঝোতা প্রতিষ্ঠার সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছেন। সবশেষে প্রধানমন্ত্রী এমনকি বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। জবাবও তাকে যথার্থই পেতে হয়েছে।
আমরা মনে করি, এভাবে সংকটকে আরো ঘনীভূত ও দীর্ঘস্থায়ী করার মাধ্যমে আর যা-ই হোক, দেশ ও জাতির মঙ্গল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এজন্যই প্রধানমন্ত্রীর উচিত অবিলম্বে পদত্যাগ করা এবং অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত সংসদকে ভেঙে দেয়া। তাকে একই সঙ্গে নির্দলীয় সরকারের অধীনে এমন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাও করতে হবে, যে নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সব দল অংশ নিতে পারবে। আমরা মনে করি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনসভায় দেয়া ভাষণের মূলকথায় বেগম খালেদা জিয়া আসলে সমঝোতার পথে অগ্রসর হওয়ার জন্যই সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর উচিত সে আহ্বানে সাড়া দেয়া।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads