শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী প্রসঙ্গে


জনমতের প্রতি সম্মান দেখানোর ধারেকাছে যাওয়ার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের জেদই পূরণ করেছেন। গত বুধবার জাতীয় সংসদকে দিয়ে তারা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করিয়ে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিদের ইম্পিচমেন্ট বা অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রমের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ঘটনাপ্রবাহে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল সরকারি দলের তাড়াহুড়ো। ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত বিলটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছিল গত ১৮ আগস্ট। আইনমন্ত্রী বিলটি সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর। এরপর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত । সে বিলটিই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পাস করা হয়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ মন্ত্রিসভায়  অনুমোদন পাওয়া থেকে সংসদে পাস হওয়া পর্যন্ত সময় লেগেছে এক মাসেরও কম। এত বড় একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও সংসদে বিতর্ক দূরে থাকুক, তেমন আলোচনা হয়নি বললেই চলে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল নামে চিহ্নিত জাতীয় পার্টির ভূমিকা। বিরোধী দলের নেত্রী তো বটেই, দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও বিলটি পাসের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। মূলত লোক দেখানোর কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগ, জাপা ও জাসদের জনাকয়েক এমপি বিলটির ওপর জনমত যাচাই করার প্রস্তাব এনেছিলেন। কিন্তু সে প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেছে কণ্ঠভোটে। শেষ পর্যন্ত প্রথমে কণ্ঠভোটে পাস করিয়ে তারপর বিষয়টিকে আরো মজবুত করার উদ্দেশ্যে গোপন ব্যালটে ভোট নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন মাননীয় স্পীকার। এই ভোটাভুটির ফলাফল হয়েছে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। সংশোধনীর পক্ষে ভোট পড়েছে ৩২৭টি, কিন্তু বিপক্ষে একটি ভোটও পড়েনি! সুতরাং তিনবার ‘জয়যুক্ত হয়েছে’ বলে ঘোষণা দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি স্পীকারের! সবই যে সুচিন্তিতভাবে আগে থেকেই আয়োজিত ছিল সে কথা সাধারণ মানুষও বুঝতে পেরেছে।
বর্তমান পর্যায়ে অন্য একটি বিষয় নিয়ে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা চলছে। সেটা হলো, বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানও একই জাতীয় সংসদকে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ওই সংসদে শেখ মুজিবের মতো প্রতাপশালী স্বৈরশাসকের আনা চতুর্থ সংশোধনীর বিরুদ্ধেও বক্তব্য রেখেছিলেন কেউ কেউ। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী এবং ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তো সংসদ থেকেই পদত্যাগ করেছিলেন। অন্যদিকে এবার কিন্তু তেমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও সাহসী কাউকেই পাওয়া যায়নি। সবাই শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদেশ পালন করেছেন। সে কারণেই একটি ভোটও পড়েনি প্রস্তাবের বিপক্ষে। যে কোনো দেশের সংসদের জন্য এ এক অভাবনীয় ঘটনাই বটে! এখানে ক্ষমতাসীনদের একটি অসত্য প্রচারণা ও প্রতারণাপূর্ণ কৌশল সম্পর্কেও জানানো দরকার। ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে একদিকে তারা ১৯৭২ সালের সংবিধানকে টেনে এনেছেন, অন্যদিকে বলেছেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই নাকি সংসদের হাত থেকে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন এবং সংসদের পরিবর্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে অভিশংসনের ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। বাস্তবে এই প্রচারণা কিন্তু সত্য নয়। কারণ, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল গঠনকালে সংসদের হাত থেকে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা প্রথম ছিনিয়ে নিয়েছিলেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা তিনি রাষ্ট্রপতির তথা নিজের একার হাতে নিয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান সে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। এর ফলে অভিশংসনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির হাতে নিরংকুশ ক্ষমতা ও এখতিয়ার থাকেনি। তাছাড়া কাগজেপত্রে রাষ্ট্রপতির হাতে থাকলেও বাস্তবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের অঘোষিত প্রধান ছিলেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি। সব কর্তৃত্বও ছিল তারই হাতে। সুতরাং সংসদের হাত থেকে অভিশংসনের ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার কথাই যদি ওঠে তাহলে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের নামই বলা দরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনরা সে সত্যের ধারেকাছেই যেতে চান না। এবারও যাননি।
ষোড়শ সংশোধনী পাস করাটাই অবশ্য আমাদের আপত্তি ও প্রতিবাদের একমাত্র কারণ নয়, আসল কারণ অন্তরালের উদ্দেশ্য। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দেশের প্রবীণ আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞরাও প্রথম থেকে বলে এসেছেন, এই সংশোধনীর ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তো ক্ষুণœ হবেই, উচ্চ আদালতও সরকারের অধীনস্থ হয়ে পড়বে। কারণ, সংসদের আড়াল নিয়ে ক্ষমতাসীনরা মাননীয় বিচারপতিদের সব সময় অভিশংসনের মাধ্যমে অসম্মানিত ও চাকরিচ্যুত করার ভয়-ভীতির মধ্যে রাখবেন। তেমন অবস্থায় মাননীয় বিচারপতিদের পক্ষে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কোনো মামলায় নিরপেক্ষভাবে রায় দেয়া সম্ভব হবে না। অন্যদের ক্ষেত্রেও রায় দিতে হবে সরকারের ইচ্ছানুসারে। সংশোধনীতে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এবং সে জনগণের পক্ষে ‘ক্ষমতা প্রয়োগের’ কথা বলা হলেও আপত্তির প্রধান কারণ হলো, দশম নামের বর্তমান জাতীয় সংসদ কোনোদিক থেকেই ‘মালিক’ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। সংসদের অর্ধেকের বেশি সদস্যই তো বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’- ভোটার জনগণ যাদের চেনেও না! অন্যদিকে সেসব সদস্যকে দিয়েই তড়িঘড়ি করে সংবিধানে ষোড়শ তথা বিচারপতিদের অভিশংসন সংক্রান্ত সংশোধনী পাস করানো হলো! একই কারণে এই অভিযোগ গুরুত্ব অর্জন করেছে যে, ষোড়শ সংশোধনীর পেছনে দেশকে বাকশালের মতো একদলীয় শাসনের অধীনস্থ করে ফেলার দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য রয়েছে। অভিযোগটি ওঠার পেছনে একটি বড় কারণ হলো, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমে এরই মধ্যে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এরপর এসেছে সংসদের হাতে অভিশংসনের ক্ষমতা দেয়ার চিন্তা ও সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিচার বিভাগকেও সরকার চাপের মুখে রাখতে  চাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটেই আমরা ষোড়শ সংশোধনীকে অগ্রহণযোগ্য মনে করা হচ্ছে। এ সত্বেও সংবিধান সংশোধন হয়েই গেছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads