বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

জানি না এই অন্ধকার কখন কীভাবে দূর হবে


ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিয়ে এতসব ন্যক্কারজনক খবর পত্রিকার পাতায় কেন মুদ্রিত হবে? ছাত্ররা তো আমাদের সন্তান সমতুল্য। সংবাদপত্রে আমরা তাদের উজ্জ্বল খবর পড়তে চাই। তাছাড়া আমরা যারা প্রবীণ, অভিভাবক, তারা তো দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য ছাত্র ও ছাত্রনেতাদের ওপর নির্ভর করতে চাই। কিন্তু একের পর এক দেশের অন্যতম প্রধান ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের যেসব কর্মকাণ্ড সংবাদপত্রে মুদ্রিত হচ্ছে, তাতে আমাদের আশাবাদের ভিত নড়ে উঠছে। মনে প্রশ্ন জাগে, বর্তমান রাজনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে ভবিষ্যতের আশাবাদ আমাদের মানস জগতে যে স্বস্তির ভাব আনতে পারতো, সেটাও কি এখন আর সম্ভব নয়? কিন্তু সবকিছুই এত অসম্ভব হয়ে উঠবে কেন? ছাত্রলীগের কি কোনো অভিভাবক নেই? বক্তৃতা-বিবৃতি ও সভা-সমাবেশের জৌলুসপূর্ণ মঞ্চে তো ছাত্রলীগের অজস্র অভিভাবক লক্ষ্য করা যায়। তাই প্রশ্ন জাগে, এত অভিভাবকের পরেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ভ্রষ্টপথের অভিযাত্রী হয় কেমন করে? নাকি অভিভাবকদের স্বার্থরক্ষায় এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ভ্রষ্টপথের অভিযাত্রী হয়েছে? এমনটি হলে তো জাতির সঙ্কট বেশ গভীর স্তরে পৌঁছে গেছে। ফলে শুধু ছাত্রলীগের ওপর দোষারোপ করে কোনো ভালো ফল লাভ করা যাবে না।
ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে এখন প্রায়ই পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। ১০ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের নৈরাজ্য’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। খবরটিতে বলা হয়, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের সহিংসতায় ফের অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই, উপরন্তু ভেঙে পড়েছে নিয়ম-শৃঙ্খলা। ক্যাম্পাসগুলোতে শোনা যাচ্ছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। বেপরোয়া ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না সরকার। হলের সিট-বাণিজ্য, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডার, অপহরণ, নারী লাঞ্ছনা, সন্ত্রাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। আধিপত্য বিস্তারে নিজ সংগঠনের কর্মীদের হত্যা করতেও কুণ্ঠিত নয় তারা। সাংবাদিক, শিক্ষক কেউই রেহাই পাচ্ছেন না তাদের হাত থেকে। ছাত্রলীগের নাম শুনলে মানুষ এখন আঁতকে ওঠেন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, ঐতিহ্যবাহী একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার আলোকিত ভুবন ছেড়ে এতসব অপকর্মে জড়িয়ে পড়লো কীভাবে? এ বিষয়ে ভাবার মতো সময় কি এখনও হয়নি?
মাঝেমাঝে তো সংবাদপত্রে এমন কিছু খবর মুদ্রিত হয়, যাতে চমকে উঠতে হয়! এমন একটি খবরের শিরোনাম, ‘ইবি ছাত্রলীগ নেতাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।’ ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, অস্ত্রবাজ হিসেবে পরিচিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সজিবুল ইসলাম সজিবের বিরুদ্ধে এবার অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার অভিযোগ উঠেছে। সজিবের সেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিসিএস ক্যাডার থেকে শুরু করে স্থানীয় সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের পেছনের নির্জন স্থানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার ছবি প্রকাশ হয়ে গেলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
তোলপাড় হওয়ার মতোই ঘটনা বটে! বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রনেতা লেখাপড়ার দায়িত্ব পালনের বদলে এখন অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। আরো অবাক ব্যাপার হলো- দলীয় ক্যাডারদের বাইরেও সে স্থানীয় সন্ত্রাসী, চরমপন্থী, এমনকি বিশ্ববিদ্যালরে শিক্ষক ও বিসিএস ক্যাডারদেরও অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিসিএস ক্যাডারদের পথভ্রষ্ট একজন ছাত্রের কাছে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়ার রুচি হলো কেমন করে? প্রতিবেদনের সাথে মুদ্রিত ছবিতে লক্ষ্য করা গেছে, সজিবের কাছ থেকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক মতিয়ার রহমান এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও বিসিএস ক্যাডার আজিজুল হক মামুন। এই যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিসিএস ক্যাডারদের বিবেচনাবোধ, তাহলে কাদের ওপর ভর করে দেশ এগিয়ে যাবে?
সজিবের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ এখন সবার মুখে মুখে। ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন নির্জন স্থানসহ কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তুলেছে সজিবুল ইসলাম সজিব। অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার পাশাপাশি অস্ত্র প্রশিক্ষণের দায়িত্বও পালন করে যাচ্ছে সে। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতা হওয়ার কারণে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও তার কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে! এমন একজন যুবক ছাত্র সংগঠনের নেতা হয় কেমন করে? সজিব যে ছাত্র কম ও ক্যাডার বেশি তা উপলব্ধি করা যায় তার লেখাপড়ার ফলাফল দেখে। সজিব ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও মুসলিম বিধান বিভাগে ভর্তি হয়। বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৮ বছর আগে ওই বিভাগে ভর্তি হলেও বারবার ফেল করার কারণে সজিব এখনও দ্বিতীয় বর্ষের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগী এমন একজন ছাত্র কী করে ছাত্রনেতা হয়? তাকে নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করতে ছাত্রলীগ ও তাদের মুরুব্বী সংগঠনের নেতাদের বিবেকে কি একটুও বাধেনি? আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, কোনো মহৎ কর্ম করে সজিব নেতা হয়নি। পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সিনেমার নায়কদের মতো ছাত্রদল কর্মীদের ওপর গুলি ছুঁড়ে প্রথম পত্রিকার শিরোনাম হয় এই সজিব। এরপর হঠাৎ করেই ক্যাডার থেকে নেতা বনে যায় সে। সন্ত্রাসী ঘটনার কারণে তিরস্কৃত হওয়ার বদলে পুরস্কৃত হওয়ায় ক্যাম্পাসের সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যারা পুরস্কৃত করলেন তারা সজিবের ভালো করলেন, না ক্ষতি করলেন? বিষয়টি ভেবে দেখার মতো বিবেচনাবোধ তাদের মধ্যে আছে কিনা, জানি না। তবে এতদিনে সজিবের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। সে এখন আর শুধু অস্ত্রবাজ ক্যাডার নয়, অস্ত্রবাজদের প্রশিক্ষকও বটে! বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ভর্তি হয়েছিল লেখাপড়া করার জন্য। কিন্তু বিগত ৮ বছরে বারবার ফেল করে সে এখনও দ্বিতীয় বর্ষে স্থবির হয়ে আছে। বিদ্যা অর্জনে তার কোনো উন্নতি নেই। হয়তো সে ভেবেছে, নেতা হয়ে গেলে লেখাপড়ার আর প্রয়োজন কি, আয়-রোজগার তো কম হচ্ছে না। এভাবেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লেখাপড়ার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে এবং ভ্রষ্টপথে চলছে ছাত্র-রাজনীতি। আর আলোচ্য ঘটনায় তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিসিএস ক্যাডার ও ভ্রষ্টতার পতাকা উড্ডীন করেছেন। সব মিলিয়ে এ যেন অবক্ষয়ের এক মহাকাব্য। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি উপলব্ধি করলেই মঙ্গল। তবে তারা উপলব্ধি করবেন কিনা- সেটাই বড় প্রশ্ন। কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) অস্ত্র প্রশিক্ষণের ঘটনায় ইবি শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সজিবুল ইসলাম সজিব ও তার সহযোগী আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সালাউদ্দিনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় অস্ত্র প্রশিক্ষণের সচিত্র সংবাদ মুদ্রিত হওয়ার পর গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক জরুরি বৈঠকে উক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এছাড়া ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে ইবি প্রশাসন ক্যাম্পাসের ভেতরে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। অতীতেও আমরা লক্ষ্য করেছি, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসী কিংবা অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা ঘটেছে, তখনও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে, ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি। সাময়িকভাবে বহিষ্কৃত নেতাকর্মীরা আবার ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে এবং তারা অব্যাহত রেখেছে তাদের প্রতাপ ও অস্ত্রের রাজনীতি। অবস্থা এখন এমন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতারা এখন অস্ত্র প্রশিক্ষণের মতো তৎপরতাও চালাতে পারছে। তাই প্রশ্ন জাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কোনো প্রশাসন নেই? ওই এলাকায় কি পুলিশ কিংবা প্রশাসনের কোনো লোকজন নেই? আওয়ামী লীগ তথা সরকারি দলের নেতাদের চোখে কি ঘটনাগুলো ধরা পড়ছে না? তবে আমরা একথা বেশ ভালোভাবেই জানি যে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন আছে এবং সরকারি ঘরানার লোকজন সেখানে বেশ ভালোভাবেই অবস্থান করছেন। ওই এলাকায় পুলিশ এবং প্রশাসনও আছে, তারা সরকারের বেশ অনুগত। আর সরকারি ঘরানার লোকজনের অবগতির মধ্যেই ওইসব ঘটনা প্রবাহ ঘটে চলেছে। তাহলে কি আমরা এ কথাই ধরে নেব যে, সবকিছুই সরকার ও প্রশাসনের অনুমোদনক্রমেই ঘটে চলেছে? এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের ব্যাখ্যা পেলে ভালো হয়। রাজনৈতিক মঞ্চে তো আমাদের নেতা-নেত্রীদের বেশ জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, ব্যক্তি থেকে দল বড়, দল থেকে দেশ বড়। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে চমৎকার ওই বক্তব্যের প্রতিফলন তেমন লক্ষ্য করা যায় না। রাজনৈতিক অঙ্গনের কর্মকাণ্ড দেখে তো মনে হয়, দেশ থেকে দল বড় এবং দল থেকে ব্যক্তি বড়। কথা-কাজে এমন গরমিলের জন্য আমাদের রাজনীতিতে গণতন্ত্র নেই, দেশের কাক্সিক্ষত উন্নতিও নেই। ছাত্র-রাজনীতির অবক্ষয়ের পেছনেও ওই কারণটি জড়িত। জানি না, রাজনৈতিক অঙ্গনের এই অন্ধকার কখন, কীভাবে দূর হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads