শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

দাম নেই শুধু মানুষের জীবনের


পাঠকদের অনেকেও সম্ভবত ‘গুম-খুনের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে : চোখের পানিতে বুক ভাসছে স্বজনদের’ শিরোনামে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টটি পড়ে থাকবেন। গত ১০ সেপ্টেম্বরের এ রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সময়ে গুম হয়ে যাওয়া বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের সম্পর্কে জানানোর পাশাপাশি তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতাসহ স্বজনদের দুঃখ-কষ্ট আর প্রতিক্রিয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। উপলক্ষ ছিল বিশ্ব গুম প্রতিরোধ দিবস। বিশ্বের সব দেশে দিবসটি ৩০ আগস্ট পালিত হলেও আওয়ামী লীগ সরকার সেদিন এমনকি মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও পালন করতে দেয়নি। সে কারণে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটকে ২ সেপ্টেম্বর কর্মসূচি পালন করতে হয়েছে। এর আগে-পরে অন্য কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠনও দিবসটি পালন করেছে। এসব অনুষ্ঠানেই হাজির হয়েছিলেন গুম হয়ে যাওয়াদের স্বজনরা। বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদির লুনা, ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আক্তারসহ আগত সকলেই বক্তব্য রেখেছেন, গুম-খুনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। গুম-খুনের  জন্য সরাসরি সরকারকেও দায়ী করেছেন তারা। গত বছরের ১৭ এপ্রিল রাতে গুম হওয়া ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তার দুঃখের কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও এখনো তার স্বামীর কোনো খোঁজ মেলেনি। অন্য স্বজনরাও সাধারণভাবে একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন। সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, তাদের কাছে যেন গুম হওয়াদের লাশ অন্তত পৌঁছে দেয়া হয়। অনুষ্ঠানগুলোতে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে একটি জিজ্ঞাসা- এজন্যই কি দেশ স্বাধীন হয়েছিল?
বলা দরকার, বিশ্বের সব দেশেই গুম ও গুপ্তহত্যার মতো বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে শুধু নয়, অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গেও দেখা হয়। গণতান্ত্রিক কোনো দেশে রাজনৈতিক দলের কোনো নেতা বা কর্মীকে গুম করা হবে এবং পরে এখানে-সেখানে তার লাশ পাওয়া যাবে এমনটা কল্পনা করা যায় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন বাংলাদেশে গুম ও খুনের কোনো হিসাবই রাখা সম্ভব হচ্ছে না। গুম হওয়া অনেকের এমনকি খোঁজ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলছে ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-নির্যাতন তো বটেই, হত্যার নিষ্ঠুর অভিযানও ক্রমাগত শুধু বেড়েই চলেছে। জাতি হিসেবে আমাদের মাথা নত হয়ে যায়, যখন বিদেশের গণমাধ্যমে এসব বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাাশিত হয় এবং যখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ ধরনের অনেক রিপোর্টই প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, এমনকি কিছুদিন আগেও। পরিসংখ্যানের উল্লেখ করতে গিয়ে এসব সংস্থা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে নারী, শিশু ও পথচারীসহ সাধারণ মানুষ পর্যন্ত রয়েছে। এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যদের কাছ থেকে জবাবদিহিতা আদায়ের কোনো অর্থপূর্ণ উদ্যোগ নেয়নি সরকার। সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, সরকার যদি নিরাপত্তা বাহিনীর লাগাম টেনে না ধরে তাহলে বাংলাদেশে আরো রক্তপাত ঘটবে। নিরাপত্তা বাহিনীর এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন এবং সে কমিশনের রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবিও জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
আরো অনেক তথ্যই মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রিপোর্টে রয়েছেÑ সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতি ও কর্মকা- সম্পর্কে জানার জন্য যেগুলোর পৃথক উল্লেখ প্রয়োজন পড়ে না। প্রসঙ্গক্রমে জানানো ও স্মরণ করা দরকার যে, ২০০৮ সালের নির্বাচন উপলক্ষে তো বটেই, গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একদলীয় ও একতরফা নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রকাশিত ইশতেহারেও  আওয়ামী লীগ বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা, পুলিশকে দলীয় কর্মির মতো ব্যবহার না করা এবং বিচার বিভাগের ‘প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার’ অঙ্গিকার করেছিল। মানবাধিকার লংঘনও কঠোরভাবে বন্ধ করার ঘোষণা ছিল ইশতেহারে। অন্যদিকে বাস্তবে ঘটে চলেছে সম্পূর্ণ উল্টো রকম। শেখ হাসিনার এবারের আমলে এমন কোনো বছর বা মাসের কথা বলা যাবে না যখন আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কেউ না কেউ বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার না হয়েছে। কারা হেফাজতেও বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এখনো ঘটেই চলেছে। এসবের সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে গুপ্তহত্যা- যা ছিল প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। সাংবাদিক, সম্পাদকসহ গণমাধ্যম কর্মিরাও হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন। ২০১০ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যে সরকারের বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের বিষয়টি উঠে এসেছে। এখন তো বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেটই’! দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে শুধু নয়, এমনকি ২০১১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ মিলেছিল। সেই থেকে সরকার তদন্ত চালানোর ঝুঁকি আর নেয়নি। তাছাড়া নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনই যেহেতু লক্ষ্য সেহেতু সরকারের পক্ষে যেসব বাহিনী কাজ করে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা কল্পনা করা যায় না।
এমন অবস্থার সৃষ্টি কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বিশেষ কিছু কারণ- রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া যেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এই সরকারের আমলে রাজনৈতিক মামলার পাশাপাশি খুনের মামলা প্রত্যাহারেরও হিড়িক পড়ে গেছে। ঢালাওভাবে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে এমনকি চিহ্নিত ও প্রমাণিত খুনি-ঘাতকরাও। সংবাদপত্রের রিপোর্টে জানা গেছে, মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি একবার মাত্র ৩০টি বৈঠকেই ৭, ১৭৩টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। এসবের মধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি মামলা ছিল ফৌজদারি অপরাধের। খুুনের মামলা ছিল পাঁচশ’র বেশি। ছিল রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ হত্যার অনেক চাঞ্চল্যকর মামলাও। মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে খুনি-ঘাতকদের রেহাই দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে। প্রথমেই রেহাই দেয়া হয়েছিল ২০০৬ সালের অক্টোবরে লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসে জড়িত ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মিদের। এরপর বহুল আলোচিত মালিবাগ হত্যা মামলা থেকে লক্ষীপুরের বিএনপি নেতা নূরুল ইসলাম হত্যা মামলাসহ অসংখ্য মামলার আসামীকে রেহাই দেয়া হয়েছে। পার পেয়ে গেছে এমনকি দণ্ডিত অনেক আসামীও। যেমন ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে লক্ষীপুরের বিএনপি নেতাকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগে পাঁচ আসামীকে ২০০৩ সালে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। হাইকোর্ট সে রায় বহাল রেখেছিল। কিন্তু আপিল বিভাগে দণ্ডিতদের আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ারও আগে তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন তখনকার রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। বলা হয়েছে, দণ্ডিতদের কারো কারো পিতা আওয়ামী লীগের নেতা বলেই রাষ্ট্রপতি এই ‘মহানুভবতা’ দেখিয়েছিলেন। কিছু মামলার ক্ষেত্রে আট থেকে ১১ সেকেন্ডের মধ্যে প্রত্যাহার করার রেকর্ডও করেছে সরকার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রধান্য পেয়েছে। অর্থাৎ অভিযুক্তরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত বলেই তাদের ছাড় দেয়া হয়েছে। এখনও সে প্রক্রিয়াই অনুসরণ করা হচ্ছে। এভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় খুনিরা পর্যন্ত পার পেয়ে যাওয়ায় সচেতন সকল মহলে উদ্বেগ-আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। আইনজীবীসহ বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, এর ফলে দেশে অপরাধ কেবল বাড়তেই থাকবে। অন্যদিকে ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে ক্ষতিগ্রস্তরা। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিপ্রাপ্ত আসামীরা প্রতিহিংসাও চরিতার্থ করতে পারে, যার ফলে স্বজনহারা ও ক্ষতিগ্রস্তরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। তারা এমনকি এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে। না হলে মুক্ত আসামীরাই তাদের এলাকাছাড়া করে ছাড়বে। এ ধরনের বিভিন্ন আশংকার পাশাপাশি আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও মামলা প্রত্যাহারের বিরোধিতা করেছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা মনে করেন, আইনকে নিজস্ব নিয়মে ও গতিতে চলতে দেয়া দরকার। না হলে এক সময় দেশে আইন বলে যেমন কিছু থাকবে না তেমনি অপরাধীরাও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। সব মিলিয়েই দেশে সৃষ্টি হবে ভয়ংকর নৈরাজ্যের। বিপন্ন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আসলেও দেশে এক ভীতিকর পরিস্থি’তির সৃষ্টি করেছে। খুনের মামলা সংক্রান্ত খবর পরে প্রকাশিত হলেও সত্য হলো, রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে শুরু থেকেই বর্তমান সরকার রেকর্ড তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা ডজন দেড়েক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে তিনি ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই। আওয়ামী লীগের অন্য সব নেতার মামলাও প্রত্যাহার করেছে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। এ প্রসঙ্গে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্যটি হলো, শত শত নামের দীর্ঘ তালিকায় কখনো বিরোধী দলের কোনো নেতার নাম পাওয়া যায়নি। মামলা থেকে রেহাই পেয়েছেন কেবলই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। কারণ, সরকার ‘যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন’ করে তালিকা তৈরি করেছে। এখনো সেভাবেই দলীয় লোকজনকে রেহাই দেয়া হচ্ছে। সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয় লোকজনের বিরুদ্ধে আদালতে পড়ে থাকা বাকি সব মামলাও প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। এসব মামলার মধ্যে হত্যা-সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি থেকে দুদকের দায়ের করা অসংখ্য দুর্নীতির মামলাও রয়েছে।
বলা দরকার, যথেষ্ট ‘সতর্কতার সঙ্গে’ সরকার যেভাবে খুনি-ঘাতক থেকে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ পর্যন্ত অপরাধীদের দণ্ড মওকুফ করেছে এবং বাকিদের মামলা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে তার ফলে অপরাধীরাই উল্টো প্রশ্রয় পাবে। বাস্তবে প্রশ্রয় পেয়েছে বলেই দেশে এখনো অপরাধ শুধু বেড়েই চলেছে। আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমতসহ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানানো হয়েছে, খুনিদের দণ্ড। মওকুফের কোনো কোনো ক্ষেত্রে জেল কোড মানা হচ্ছে না, নেয়া হচ্ছে না আইন মন্ত্রণালয়ের অভিমতও। সংসদে আওয়ামী লীগের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলের ক্ষেত্রে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান পলাতক অবস্থাতেই দণ্ডিতকে ক্ষমা করেছিলেন। অথচ আইনের বিধান হলো, দণ্ডিত ব্যক্তিকে প্রথমে আদালতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে এবং দণ্ড মওকুফ করার আবেদন তাকে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠাতে হবে। কিন্তু সাজেদা চৌধুরীর পুত্রের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি একজন পলাতক দণ্ডিত অপরাধীর বেআইনী পন্থায় পাঠানো আবেদনের ভিত্তিতে দণ্ড মওকুফ করেছিলেন। এটা ২০১১ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। লক্ষীপুরের বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের ক্ষেত্রেও একই বেআইনি পন্থায় ক্ষমা করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। এভাবেই এখনো একইভাবে চলছে রাজনৈতিক বিবেচনায় দণ্ড মওকুফ করার এবং মামলা প্রত্যাহার করিয়ে নেয়ার কর্মকাণ্ড। নারয়ণগঞ্জের সাত খুনের অন্যতম আসামী নূর হোসেনকে সরকার যে নাটক সাজাচ্ছে তা দেখে স্তম্ভিত হয়েছেন এমনকি সাধারণ মানুষও। শেষ পর্যন্ত আসামের স্বাধীনতা সংগ্রামী অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে এই নূর হোসেনকে একই পাল্লায় ওঠানো হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনো মূল্যায়নেই সমর্থনযোগ্য নয়। অন্য একটি বিষয়ও বিবেচনায় রাখা দরকার। সেটা হলো, দণ্ডিত আসামীরা মুক্তি পাওয়ার পর আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে, তারা এমনকি প্রতিশোধ নেয়ার জন্যও উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে নতুন করে বিপদে পড়বেন নিহতের স্বজনরা। এর অনেক প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। অন্য একটি বিষয় হলো, মৃত্যুদ- পাওয়ার পরও যেখানে কেবলই রাজনৈতিক কারণে রেহাই পাওয়া যায় সেখানে সব ধরনের অপরাধীরাই বেপরোয়া হয়ে উঠবে। বাস্তবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলেই দেশে অপরাধ কমছে না বরং বাড়ছে। বিশিষ্টজনেরা যথার্থই বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে দেশে আইনশৃংখলা বলে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না এবং দেশে সৃষ্টি হবে ভয়ংকর নৈরাজ্যের। এজন্যই দলীয় বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের পথ থেকে সরকারের সরে আসা উচিত- তা সে মামলা খুনের বা অন্য যা কিছুরই হোক না কেন।
এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, এবার পরপর দুই দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে আসলেও খুনের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। খুন এবং পাল্টা খুন চলছে এমনকি ক্ষমতাসীনদের ভেতরেও। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যেন মানুষের জীবন কোনো ছেলেখেলার বিষয়! বলার অপেক্ষা রাখে না, অপহরণ, গুপ্তহত্যা ও ক্রসফায়ারের মতো ভয়ঙ্কর কোনো কর্মকাণ্ডেরই বিচার হচ্ছে না বলেই দেশে হত্যা-সন্ত্রাসসহ সব ধরনের অপরাধ বেড়ে চলেছে। সরকারের গোপন আনুকূল্য এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ রয়েছে বলে কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অথচ কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন অবস্থা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অন্যদিকে বিভিন্ন হত্যার পেছনে সরকারের ভূমিকাও গোপন থাকছে না। বিরোধী দলসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। সরকার বিচার বিভাগের কার্যক্রমেও ন্যক্কারজনকভাবেই হস্তক্ষেপ করছে। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সব মিলিয়েই দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে চরমভাবে। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ ১৯৭২-৭৫ সময়ের কথা স্মরণ না করে পারছে না- যখন বিরোধী দলের ৩৭ হাজার নেতা-কর্মিকে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে সরকারের নীতি-মনোভাব ও কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় জীবনের ক্ষেত্রগুলোকে একটি একটি করে পর্যালোচনা করলেও কিন্তু ভীত ও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যাবে না। কারণ, কোনো একটি ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনার সরকার জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করার ধারে-কাছে যেতে পারেনি। আসলে যায়নি। এর কারণ, নির্বাচনের আগে দেয়া বিভিন্ন ভাষণে ও মেনিফেস্টোতে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তেমন ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যই তাদের ছিল না। ভেতরে ভেতরে তারা অন্য কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে আর যা-ই থাকুক, গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চিন্তা বা সদিচ্ছা অন্তত ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে। সে প্রমাণ এখনো পাওয়া যাচ্ছে। শুধু গুপ্তহত্যার কথাই বা বলা কেন, সাধারণভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও কি সরকার কখনো, কোনো পর্যায়ে গণতন্ত্রসম্মত আচরণ করেছে? সরকারের বেআইনী পদক্ষেপ এবং র‌্যাব-পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসী-ক্যাডারদের হামলায় বিরোধী কোনো দল মিছিল-সমাবেশ পর্যন্ত করতে পারছে না। গ্রেফতার, শ্যোন অ্যারেস্ট, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি বাড়ছে মিথ্যা মামলার সংখ্যা। ওদিকে গণতন্ত্রের প্রধান কেন্দ্র জাতীয় সংসদকে পঙ্গু করা হয়েছে। সুচিন্তিত কৌশলের ভিত্তিতে বিরোধী দলের এমপিদের বাইরে ঠেলে দেয়ার ফলে এর আগের অর্থাৎ নবম সংসদ তবু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। এবার তো সে অবস্থাও নেই। অর্ধেকের বেশি এমপি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হলে আর সংসদ থাকে কিভাবে? এসবের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে, জাতীয় সংসদের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহ নেই ক্ষমতাসীনদের। সংসদকে শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্যসব ক্ষেত্রকেও একেবারে তছনছ করে ফেলেছে সরকার। জনপ্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রই দলীয়করণ নীতির অসহায় শিকার হয়েছে। বিচার বিভাগ তথা আইন-আদালতকে তো ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ারই বানিয়ে ফেলেছে সরকার। গণতন্ত্রকে তারা নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। এভাবেই চূড়ান্ত স্বৈরশাসনের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা অবশ্য শেখ হাসিনার নিজের এবং আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডে মোটেও বিস্মিত হচ্ছেন না। কারণ ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘সংগ্রামী’ দল হিসেবে পরিচিতি থাকলেও ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এ ধরনের পন্থাই অবলম্বন করেছে। জনগণের সঙ্গে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল নিয়ে এগিয়েছে। প্রতিটি উপলক্ষে প্রমাণিত হয়েছে, গণতন্ত্র বা জনগণের অধিকার আদায়ের আড়ালে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দলগত স্বার্থ উদ্ধার করার বাইরে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে আর কিছু নেই। জনগণের সচেতন অংশকে তাই প্রধানমন্ত্রীর মরহুম পিতার কথা স্মরণ করতে হচ্ছে। কারণ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রথম কবর তিনিই দিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সবদিক থেকে নিজের পিতাকে অনুসরণ করে চলেছেন মাত্র। তিনি সেই সাথে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, বাকশাল আসলে কতটা ভয়ংকর ছিল। হাতে ক্ষমতা এবং পেছনে সশস্ত্র বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থা রয়েছে বলে যা খুশি তা তিনি বুঝিয়ে দিতে চাইতেই পারেন। তিনি লক্ষ্য করছেন না, তার এই শাসনকাল সম্পর্কে পরবর্তীকালের ইতিহাসে একটি কথাই শুধু লেখা হবে। সে কথাটা হলো, এটা ছিল এমন এক সময়- যেখানে দাম ছিল না শুধু মানুষের জীবনের।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads