রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ফর্মূলার রাজনীতি


গাণিতিক সমস্যা সমাধানকল্পে ‘প্লাস’ আর ‘মাইনাস’ শব্দ দু’টি অন্যতম। বিশেষ করে বীজগণিতশাস্ত্রে এ শব্দদ্বয়ের অধিক পরিচিতিও বিদ্যমান। একদিকে গণিতশাস্ত্রে যেমন শব্দদ্বয়টির প্রয়োজনীয়তা অনেকগুণে বেশি। অন্যদিকে বাস্তব জীবনেও তেমন ওই শব্দদ্বয়টি সমাধানকল্পের হাতিয়ারও বটে। এ কারণেই সম্ভবত বহুল পরিচিত ‘প্লাস-মাইনাস’ শব্দদ্বয়টি গণিতশাস্ত্রের পরিধি অতিক্রম করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে নানাবিদ ব্যবহার। তবে রাজনীতির অঙ্গনে প্লাসের চেয়ে জয়জয়কার মাইনাসের অধিক বেশি। একারণেই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা মাইনাস ফর্মূলার দিকে সহসাই অনেকগুণে বেশি অগ্রসর হয়ে থাকেন। মাইনাসের তীর কেউ ছুঁড়ে দেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলে। আবার কেউ ছুঁড়ে দেন স্বদলে। এতে প্রয়োজনীয়তা থাক আর নাই থাক, সেটা বড় কথা নয়। কে কী ভাবে ‘প্লাস-মাইনাস’ শব্দদ্বয়ের ব্যবহার করছেন আজ সেটাই বড় ভাববার বিষয়।
ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার একপর্যায়ে ‘প্লাস’, ‘মাইনাস’ শব্দদ্বয়টি বিশেষ করে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফর্মূলায় পরিণত হয়েছে। সবদিক বিবেচনা করে নানাজনে নানাভাবে ‘প্লাস-মাইনাস’ ব্যবহার করতে প্লাসের চেয়ে মাইনাস ফর্মূলার দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখা যায় অনেকটাই বেশি। এছাড়া ফর্মূলাটির নীতি অনুযায়ী ‘প্লাস’ আর ‘প্লাস’ এ মিলে হয় ‘মাইনাস’। অন্যদিকে ‘মাইনাস’ আর ‘মাইনাস’ এ মিলে ফলাফল প্লাস হওয়ায় কৌশলগত কারণেই লীডাররা ‘মাইনাস ফর্মূলা’টিকেই অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মাইনাস ফর্মূলাটিকে ব্যবহার করতে রাজনীবিদরা অন্য সবার চেয়ে এগিয়েও বটে। যে কারণে লীডাররা ‘মাইনাস’ ফর্মূলাটি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে আসছেন। তবে কেউ কেউ স্বীয় উদ্দেশ্য হাসিল করতে ইচ্ছামাফিক থেকে শুরু করে নগ্নভাবে ‘মাইনাস’ ফর্মূলাটিকে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না।
স্বাধীনতার পর এ দেশের উন্নয়ন আর যাই হোক, বিশেষ করে গণমাধ্যমের যে বিস্তার লাভ হয়েছে এটা মোটেও অস্বীকার করার নয়। বরং বারবার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের অপচেষ্টার পরও সব বাঁধা অতিক্রম করে আজকাল গণমাধ্যমের সুফলের হাওয়া আকাশে-বাতাসে বিরাজ করছে। ফলে দেশের মফস্বল এলাকায় বসেও অনায়াসেই দেশ-বিদেশের অনেক হালতই জানা যাচ্ছে।
গণমাধ্যমে জানা যায়, আমাদের দেশে মাইনাস ফর্মূলার রাজনীতির চর্চা অতিতেও ছিল। এখনও হচ্ছে। বিশেষ করে ইদানিং মাইনাস ফর্মূলার রাজনীতিতে চরম হাড্ডাহাড্ডি লেগেছে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের থেকে আরম্ভ করে একেবার দলের শীর্ষ নেতারাও মাইনাস ফর্মূলার রাজনীতিতে বড় মশগুল। তবে মাইনাস ফর্মূলার রাজনীতিতে আজ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই থাকলেও শুরুটা অনেক পুরোনো। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকেই উৎপত্তি হয়েছিল মাইনাস ফর্মূলার রাজনীতির। স্বীয় উদ্দেশ্যপূর্ণ রাজনীতিতে মাইনাস ফর্মূলাটি বেশি গুরুত্ব পায়। এতে কতিপয় নেতার কণ্ঠে অশুভ কথাও কম শুনা যায় না। বরং আজকাল এমন হয়েছে যে, রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল এমনকি টক-শো, সাংবাদিক সমম্মেলনেও মাইনাস ফর্মূলার রাজনীতিতে ‘রাজনৈতিক শয়তান’, বিশ্ব বেঈমান’, ‘বেহায়া’, ‘জঙ্গিবাদীর মা’ ‘জামায়াতের ঘোমটাওলা আমীর’, ‘সন্ত্রাসী’, ‘মিথ্যাবাদী জননী’ ইত্তাকার অশুভ কথামালায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা হচ্ছে বিজ্ঞ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক বন্ধুদের তরফ থেকে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি মহাজোট সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রায় প্রতিদিনই মাইনাস ফর্মূলার রাজনীতিতে বেশ সজাগ থাকেন। কোনো সভা, সমাবেশ কিংবা সেমিনার হলেই তিনি মাইনাস রাজনীতির কথা অনেকটা দাপটেই ছুঁড়ে দেন। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী অনেক দিন থেকে তিনবারের নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে মাইনাস করার কথা বলছেন। আর এতে তাঁর কণ্ঠে অশুভ কথারমালা অনায়াসেই ঝরতে শুনা যায়। মাইনাস ফর্মূলার রাজনীতিতে বাস্তবায়ন করতে মন্ত্রী বাহাদুর ‘রাজনৈতিক শয়তান’, বিশ্ব বেঈমান’, ‘বেহায়া’, ‘জঙ্গিবাদীর মা’ ‘জামায়াতের ঘোমটাওলা আমীর’, ‘সন্ত্রাসী’, ‘মিথ্যাবাদী জননী’ ইত্তাকার নানা অশালীন শব্দে বেগম খালেদা জিয়াকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করেন না।
ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে আজকের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী মহোদয়েরাই জাসদের ভক্ত হিসেবে মাইনাস ফর্মূলার রাজনীতি এদেশে প্রথম চর্চা শুরু করেন। ১৯৭২-৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মাইনাস করার জন্য মনোনীত করা হয়েছিলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী অতি সফলভাবে মাইনাস ফর্মূলাটি বাস্তবানও করা হয়েছে।
চলতি শতাব্দীর শুরু থেকে এদেশের রাজনীতিতে দ্বিতীয়বার মাইনাস ফর্মূলাটি প্রয়োগের মহাপরিকল্পনার বোমা ফাটানো হয়। দুর্বল চিন্তায় ওই পরিকল্পনা অঙ্কুরেই ভঙ্গুর হয়। ফলে ভেস্তে যায় চক্রান্তকারীদের আসল উদ্দেশ্য। ওয়ান-ইলেভেন এর ক্ষমতা ধর ফকরুদ্দীন-মঈনদ্দীন সরকারের আমলে তৃতীয় বারের মতো এদেশের রজনীতিতে মাইনাস ফর্মূলাটি প্রয়োগের প্রবল আওয়াজ ওঠে। এতে রাজনীতির অঙ্গন থেকে দুই দলের দুু’জন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদকে বিদায়ের ঘন্টা বাজানোর অপকূটকৌশল গ্রহণ করে নানাবিদ ফিকির-ফন্দি আঁটা হয়। ফলে চারিদিকে সৃষ্টি হয় মাইনাসের তুমুল হৈ হুল্লা। মাইনাস ফর্মূলার টার্গেটের একজন হলেন- বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। অপরজন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। গণমাধ্যমের সুফলে আর গণবিস্ফোরণে ওই পরিকল্পনা শেষমেশ আলোর মুখ দেখেনি। ফলে ব্যর্থ হয় ১/১১ এর ক্ষমতাধর ফ-ম সরকারের যতো অপক্ষমতার কূটকৌশল।
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালী মাঠে গোল দিয়ে ‘ম্যারাডোনা’ কৃতিত্ব অজর্নকারীরা তীতৃয়বারের মতো এদেশের রাজনীতিতে আবারও মাইনাস ফর্মূলা প্রয়োগের নতুনভাবে চিন্তা-ফিকির শুরু করে নানাবিদ ফন্দি আঁটছেন বলে প্রতীয়মান। এবার পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, মাইনাস ফর্মূলাটি প্রয়োগ করতে পারলেই হয়তো আগামীতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গণতন্ত্রের ক্লাবে প্রবেশের বিকল্প কোনো পথ এবং সুযোগ উভয়ই থাকবে না। সব অধিকার আদায় হবে মাইনাস ফর্মূলা প্রয়োগকারীদের। ফলে তাদের ভাগ্যের কেল্লাও ফলবে রাজনীতিতে। এতে অন্যের অধিকার হরণ হলেও মাইনাসকারীদের তাতে নো-টেনশন, ডু-ফূর্তি।
গণতন্ত্রের হাউজে প্রবেশের ‘টিকেট’ সংগ্রহের যাবতীয় কার্যক্রমে বাঁধা প্রয়োগ করে ন্যূন্যতম রাজনৈতিক অধিকার টুকুও ছিনিয়ে নেয়ার পরপরই দশম সংসদ নির্বাচনে খালী মাঠে গোলদাতাদের পক্ষে বয়ান দেয়া হচ্ছে যে, ‘খালেদা জিয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন। তিনি দেশে অনির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে চান।’
এরপর খালেদা জিয়াকে মাইনাস বা বিয়োগ করার কথা চারদিকে চাউর হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে মাইনাস হলেই নাকি রাজনৈতিক সব প্রতিবন্ধকতা রোধ হবে। আমরা বলতে চাই,  বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক হিসাবের জাবেদায় মাইনাস ফর্মূলাটি প্রয়োগ করা নিতান্তই সহজ নয়। যদিও সময় সাপেক্ষে তাকে রাজনৈতিকভাবে মাইনাস কিংবা বিয়োগ করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের পাতা থেকে খালেদা জিয়াকে মাইনাস করা শুধু চ্যালেঞ্জিং বিষয় নয়; অসম্ভবও বটে। কারণ প্রবীণদের কিংবা নতুন প্রজন্মের যদি এদেশের প্রধানমন্ত্রীদের নামের তালিকার একটি সারণি তৈরি করতে বলা হয়। এতে বেগম খালেদা জিয়ার নাম বাদ দেয়াটা হবে শিক্ষিত মেধাহীনদের অযোগ্যতা। আর অশিক্ষিত আবাল-বৃদ্ধ কিংবা নতুনদের হবে অক্ষমতা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম সত্যকে পেছনে ফেলে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী সদাচার গলাহাঁকিয়ে বয়ান দিচ্ছেন যে, খালেদা জিয়া ‘জঙ্গিবাদী’, ‘সহিংসতার মদদ দাতা’। নির্বাচিত তিন তিনবারের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রী মহোদয় অব্যাহতভাবে প্রতিদিন ‘রাজনৈতিক শয়তান’ বলে আখ্যায়িত করে অশ্লিল ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছেন। মন্ত্রী মহোদয় খালেদা জিয়াকে ‘দুর্র্ধর্ষ সন্ত্রাসী’ ও  চোগোলখুরি নামেও অপবাদের বয়ান দিতে কোনো ধরণের দ্বিধা করছেন না।
আমরা মনে করি, তথ্যমন্ত্রী তথ্য বেশি জানবেন এটা মোটেও অস্বাবিক নয়। সেকারণে আমরা না জানলেও তথ্যমন্ত্রী হিসেবে তার কাছে হয়তো বেগম খালেদা জিয়া একজন ‘দুর্র্ধর্ষ সন্ত্রাসী’, ‘মিথ্যাবাদী’ ও ‘জঙ্গিবাদী’ এমন যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। সেকারণেই হয়তো মাননীয় বিজ্ঞ মন্ত্রীমহোদয় ওই রকম বেফাঁস অভিধায় সদাচার আক্রমণ করতে দ্বিধা করছেন না একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। তবে কথা থাকে, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জনসভায় ‘মিথাবাদী’, ‘শয়তান’, এমনকি ‘জঙ্গিবাদীদের মা’ ইত্তাকার ‘অশুভ সম্বোধন’ করা কেবল বেমাননই নয়। এসব অপ্রত্যাশিত হীনকর্ম একজন আইন প্রণেতা হিসেবে শিষ্টাচার বর্হিভূতও বটে।
বাস্তবতা হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়া ইতিহাসের পাতায় কতদিন থাকবেন বা কতটুকু স্থান দখল করবেন ওই পরিসংখ্যান এখন মিলানো না গেলেও তাঁকে অসম্মমান করাটা যে জ্ঞানীর কাজ নয় এমনটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারণ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোটের পরিধি ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে। গণতন্ত্র হাউজে প্রবেশের আন্দোলন-সংগ্রাম করারও যথেষ্ট শক্তি সামর্থও দেখা যাচ্ছে। ফলে ক্ষমতায় ফিরতে সুযোগও সৃষ্টি করে নিতে পারে। কাজেই খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে মাইনাস ফর্মূলায় হঠানো বা বিয়োগের অপকর্ম থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করাটাই হবে সাধুবীর জন্য একান্তই সাবধানতা। তাছাড়া স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতির অঙ্গন থেকে কাউকে মাইনাস করার চিন্তা-ফিকির প-শ্রমও বটে।
একজন উচ্চ আসনের সম্মানিত ব্যক্তিকে এবারই যে প্রথম এদেশে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করতে শুনা গেলো তা কিন্তু নয়। কারণ, টুঙ্গিপাড়ার মরহুম শেখ লুৎফর রহমান ও মরহুমা সায়রা খাতুনের সুনামধন্য ছেলে স্বাধীনতার অমর নায়ক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও একদিন ‘বাংলার মীরজাফর’সহ নানাবিদ তিক্ত অভিধায় সম্বোধন করতে দেখা ও শুনা গেছে খোদ রাজধানীর কোনো এক রাজনৈতিক জনসভা স্থল থেকে। এদেশের মানুষ অনেকেই নিজ কানে ওইসব হীনবচন শুনার অগৌরব অর্জন করেন। একশ্রেণির দেশপ্রেমিক নামধারী রাজনীতিবিদরা অতিতে ভুল করেননি অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করতে কালজয়ী ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুকে। অতিতের ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও মাঝেমধ্যে কুরুচিপূর্ণ শব্দমালায় বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণ করতে দেখা যায়। অপরদিকে ওইসব বেঁফাস বক্তব্য শিশুর মতো শুনে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর অগণিত অক্ষম ভক্তবৃন্দ। কিন্তু ক্ষমতাবান ভক্তদেরও যেমন কোনো প্রতিবাদ করার নজির দেখা যায়নি। তেমন বেঁফাস বক্তব্যকারীদের আদৌ বিচারের কাঠগড়ায়ও দাঁড় করানো হয়নি।
ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুকে ডিলেট করে দেয়াটা কোনো ইতিহাসবিদের ন্যূন্যতম হিম্মত আছে বলে কমপক্ষে আমার বিশ্বাস হয় না। বরং তিনি সর্বোচ্চ আসনেই আসীন থাকবেন এমনটা অসত্য নয়। তাপরও বঙ্গবন্ধুরই যখন স্বাধীন দেশের দেশপ্রেমিক নামধারী লীডারদের কাছে শেষ রক্ষা হয়নি। তাঁর চেয়ে কত যে পরের সিরিয়াল বেগম খালেদা জিয়ার এ হিসাব কেউ জানলেও আমার পক্ষে অসম্ভব। কারণ বড় সখের পেশা সাংবাদিকতার মুজেজায় নূন্যতম অধিকারের মুখ দেখার ইচ্ছা পোষণ করায় প্রায় দেড় ডজন মামলার ঘানি টানতেই কর্মকাম শেষ করে ফেলেছি। বস্তুনিষ্ঠ খবর পত্রিকায় প্রকাশের দায়ে পুলিশী গ্রেফতার থেকে শুরু করে থানা হাজতসহ জেল-হাজতে বসবাস করতে হয়েছে। কত বার যে আদালতের বারান্দায় বারান্দায় অসহায়ের মতো জামিন চাওয়া আর হাজিরা দেয়ায় আজকাল মামলার ধার্য তারিখটাও মনে না থাকায় মাঝে মধ্যেই জামিন বাতিল হয়। পুলিশী হয়রানি থেকে নিস্কৃত পেতে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। এসব নানা কারণে জ্ঞান-বুদ্ধি অনেকটাই লোপ পেয়েছে। যাক, দুখের সংলাপ বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। শুধু এতোটুকু বলতে চাই, একটি দেশের স্বাধীনতার নায়ককে অশ্রাব্য ভাষায় আঘাত করে ইতিহাসকে জর্জরিত করা হলেও যদি জাতির সম্মানের কোনো হানি না ঘটে সেদেশে একজন গৃহবধূ থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল এমন ব্যক্তিকে অশ্রাব্য ভাষায় আঘাত করা বুঝি খুব একটা বেমাননা নয়।
এছাড়া ষাট বছর দাওরা হাদিস পড়ানো অভিজ্ঞতাসম্পূর্ণ বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা হযরত আজিজুল হক আমীনির বিরেুদ্ধে দায়ের করা মামলার এজাহারে সূচনাতেই ‘চোর’, ‘ডাকাত’, ‘সন্ত্রাস’ ‘ঠকবাজি’ প্রভৃতি অরুচিপূর্ণ শব্দাবলী দ্বারা আখ্যায়িত করতে দেখো গেছে এদেশের কতিপয় রাজনৈতিক লীডারদের। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে ওই বজুর্গ ব্যক্তিকে পুলিশী গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে জেল-হাজতেও রাখা হয়েছে চোর-ডাকাতদের সঙ্গে। এতেও এদেশের রাজনীতিবিদদের তেমন কোনো টনক নড়ার নজির নেই। তবে জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমীর মুফাচ্ছিরে কুরআন আর্ন্তজাতিক ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের করা তথাকতিথ যুদ্ধাপরাধী মামলায় ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপরই দেশব্যাপী তৌহিদী জনতা গর্জে ওঠে রাজপথে নামেন। শত শত মানুষ জীবন বির্সজনও দিয়েছেন। কিন্তু যা করার তা ক্ষমতাবানরা করায় সবকিছু নিরবে সহ্য করতে হচ্ছে অক্ষমতাবানদেরসহ ভুক্তভোগিদের।
মাইনাস ফর্মূলাটি প্রয়োগ করতে জাসদ নেতারা কাজের কাজি। যেমন হুট করে জাসদ থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে প্লাস বা যোগ হয়ে প্রথমে গণতন্ত্রের হাউজে প্রবেশ। তৎপর মন্ত্রণালয়ে ভাগ বসিয়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু সাহেব। তাও আবার তথ্যমন্ত্রণালয়ে। এটা অবশ্যই বাস্তব যে, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে জাসদ ক্ষমতার বাইরে থেকে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করুক তা দলের নেতাদের কাম্য না থাকায় মন্ত্রণালয়ে ভাগবসানোটা সম্ভব হয়েছে।
জাসদ একটি বিপ্লবী দল বলে দাবি করেন দলটির নেতারা। বিপ্লব মানেই উন্নয়ন। বিপ্লব মানেই পরিবর্তন। এমনটি দাবি জাসদ নেতাদের। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও প্রতিহিংসামূলক নাশকতা উন্নয়নের বিপরীত। যা বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোতে বিরাজমান। এমন নির্লজ্জ বয়ান জাসদ নেতাদের।
দিন বদলে গেলেও ইসিহাস কখনো বদলায় না এমনটি দাবি যেমন ইতিহাসবিদদের। তেমন আমাদেরও। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাসদ বিপ্লবের জন্য বেছে নিয়েছিল। ওই দিন জাসদ নেতারা তা-ব চালায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। এতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় থানা, রক্ষীবাহিনী, বিডিআর ক্যাম্প। বাদ যায়নি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী সাহেবের বাসভবনও। ওইসব স্থাপনায় অর্তিকিতভাবে আক্রমণ চালায় বিপ্লবী নামধারী জাসদ ভক্তবৃন্দ। যার দরুণ ওইদিন সন্ধ্যার আগেই জনশূন্য হয় রাজধানীর পথ-ঘাট। এদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানম-ির বাসভবনে মস্কো যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারকে জাসদ কতটুকু অন্তর দৃষ্টিতে দেখে সে বিষয়ে সামান্যতম হলে জেনে রাখা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর জাসদ এবং গণবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে গত ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের দেয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ৬ জুলাই জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়া গণমাধ্যমে দেয়া এক যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করেন ‘১৯৭৫ সালে যখন সংসদীয় রাজনীতি অনুপস্থিত, তখন প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েই জাসদ গণবাহিনী গঠন করে। গণবাহিনী সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিল। কখনো গোপন ষড়যন্ত্র বা বেঈমানির পথে পা বাড়ায়নি। বরং সে সময় যারা চাটুকারিতার আড়ালে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, তারাই খোন্দকার মোশতাক বা কাজী ফিরোজ রশীদের মতো প্রথম সুযোগেই বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পিঠে ছোবল হানে।’
ওই বিবৃতিতে জাসদ নেতাদ্বয় গণবাহিনীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘গণবাহিনী সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিল।’ আমরা মনে করি, যে দল অন্য দলকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে পরগাছার ন্যায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভাগিদার হয় এবং অপরের অকৃত্রিম করুণায় ললাটে মন্ত্রণালয় মিলে। সেই দলের ওপরও জাসদ নেতাদের বিষেধগার করতে কুণ্ঠিতবোধ করতে দেখা যায় না।
জাসদের নোংরামি রাজনীতির সহজেই পরিসমাপ্ত নয় বরং অনেক দীর্ঘ। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু মার্চে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ওই নির্বাচনেরও জাসদ বিরোধিতা করে। আক্রোশটা মূলত বঙ্গবন্ধুর ওপর ছিল। ওই সময় জানুয়ারি মাসে তৎকালীন জাসদ সভাপতি মেজর এম এ জলিল এক বিবৃতি দেন। এতে বলা হয়- ‘আজ যখন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তখন সত্যই মর্মাহত হতে হয়। হৃদয় নিংড়ানো কান্না আসে। কারণ, যেসব বীর সৈনিকেরা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আজ তাদের দুঃখের সীমা নেই, তাদের ঘর নেই, খাবার নেই, এমনকি অনেকেই ‘রাজাকার’ বলে ধিক্কার পাচ্ছে। যুদ্ধের সময় শত্রুর ঘরে গ্রেনেড ফাঁটাতে গিয়ে সেই চার্জে আজ তারা অনবরত জেলেও যাচ্ছে। আবার সেদিনের ঘটনা, লে. কর্নেল যিয়াউদ্দিনকে ও লে. কর্নেল তাহেরকে আর্মি থেকে বিনা বিচারে (ডিসমিস) Dismiss করা হয়েছে। অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতির একটা সীমা থাকে, বঙ্গবন্ধু। হয়তো এইভাবে ধীরে ধীরে একদিন বাংলার গোটা সামরিক বাহিনী স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু কেন? এটা কি তাহলে তোমার ক্ষমতা লোভের প্রকাশ, না কোনো বন্ধু মহলের কুইঙ্গিত।’
আমরা বলতে চাই, সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করতেই মূলত উসকানিমূলক ওই বিবৃতিটি জাসদের পক্ষে দেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে নির্বাচনের ছয় মাস পরে ১৯৭৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বরে এক প্রচারপত্রে জাসদ ঘোষণা করে, ‘ভারতের পঁচাত্তরটি বিড়লা-টাটাদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী ও বর্তমান সোভিয়েতের ব্রেজনেভ কোসিগিন প্রতিক্রিয়াশীল চক্রে’র প্রতিনিধি শেখ মুজিবের ‘ফ্যাসিস্ট জাতীয় বিশ্বাসঘাতক সরকারকে উৎখাত করার জন্য, ঘুণে ধরা এই সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে নূতন সমাজের ভিৎ রচনা করার জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গ করবো।’
ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছিল- ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে একপর্যায়ে স্তব্ধ করে দিয়ে বিদেশী শক্তির সহায়তায় বর্তমান ক্ষমতাসীন চক্র যেদিন বাংলার মসনদে উড়ে এসে জুড়ে বসল, সেদিন থেকেই এ দেশের মানুষের আরেক দুঃখের রজনী শুরু হলো। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ নয় মাসের সমস্ত আশা সমস্ত স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যেতে দেখল মানুষ।’
সরকারের প্রতি যাতে সাধারণ মানুষের ঘৃণার সৃষ্টি হয় এমন লক্ষ্যকে সামনে রেখেই জাসদ ওই ধরণের হিংসাত্মক ভাষায় বিবৃতি দিতো। আর ওই রকম বিবৃতিতে রুশ বিপ্লব ও চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেয়ে জাসদ অনেকগুণে বড় এমন স্লোগানের বোমা ফাঁটানো হতো। এতে সরল ও বোকা প্রকৃতির মানুষরা মনে করত জাসদের বিপ্লবেই বুঝি মুজিবের পতন অতিআসন্ন। এছাড়া ১৯৭৪ সালে বিপ্লবী নামধারী ওই জাসদ ‘মেহনতী মানুষের সার্বিক মুক্তির’ লক্ষ্যে মুজিব সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ আখ্যায়িত করে সরকারের উৎখাত দাবি জানিয়েছিল।
আজ সহসাই প্রশ্ন ওঠে, স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধুর সরকারকেই যখন ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করার হিম্মত দেখাতে জাসদ বিন্দুমাত্রও কার্পণ্য করে নাই। সেই জায়গায় বেগম খালেদা জিয়া আর কতটুকুই খাতির বা সম্মান পেতে পারে সমাজবান্ধব রাজনৈতিক দল পরিচয় দানকারী জাসদের নিকট। তবে সময়ই হয়তো একদিন বলে দিবে বিএনপি’র চেয়ে জাসদের অর্জন কতগুণে কম না বেশি। ওই সু-দিনের অপেক্ষায় হয়তো আরও কিছুদিন সব ধরণের পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে জাতীয়তাবাদী পক্ষের শক্তি প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি’র ভক্তবৃন্দদের। সেইসাথে আমাদেরও এইদিনকে লিখে নিতে হবে ওইদিনের কাছে।
এম. কে. দোলন বিশ্বাস

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads