শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

এ কে খন্দকারও যদি পাকিস্তানী এজেন্ট হন তাহলে দেশপ্রেমিক কে?


বেশ কিছুদিন হলো দেশে সংবাদের আকাল পড়েছিল। লিখতে বসে ভাবতে হতো, আজ কোন বিষয়ে লিখবো। কিন্তু আজ (শুক্রবার) পত্রিকায় দেখি, খবরের ছড়াছড়ি। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব। সমগ্র পৃথিবী কাঁপিয়ে তোলা সংগঠন আল- কায়েদার প্রধান আইমান আল-জাওয়াহিরি ঘোষণা করেছেন যে, ভারত, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারে আল-কায়েদার শাখা খোলা হবে। আর একটি ভূমিকম্পের মতো সংবাদ হলো, আমেরিকা নাকি শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতের চক্রান্ত করছে। তার সাথে আছে অন্যান্য শক্তি। আর একটি অবিশ্বাস্য খবর হলো, মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদে তীব্র বিষোদগার করেছেন আওয়ামী লীগেরই মন্ত্রী এবং এমপিরা। আর একটি বিদেশী খবর হলো এই যে, সিরিয়া এবং ইরাকের সুন্নি মুসলিম সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস ইরাক এবং সিরিয়ার যতখানি ভূখ- দখল করেছে তার সামগ্রিক আয়তন নাকি ইংল্যান্ডের সমান। এসব বিষয় নিয়েই আজকে আলোচনা করতে চাই। কিন্তু যেহেতু কলেবর সংক্ষিপ্ত তাই সবগুলো বিষয় সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করব। জানি না, এই সংক্ষিপ্ত কলেবরে সবগুলো পয়েন্ট টাচ্ করা সম্ভব হবে কিনা।
প্রথমে একে খন্দকার । তিন-চারদিন আগে খন্দকারের লেখা একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। বইটি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের সাবেক উপ-প্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার। বইটির নাম ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’। প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশনী। জাতীয় সংসদের সোমবারের অধিবেশন থেকে জানা যায় যে, এ বইটি লেখার জন্য খন্দকার সাহেবকে আওয়ামী লীগের এমপি এবং মন্ত্রীরা ইচ্ছামতো গালাগালি করেছেন। কারণ ঐ বইয়ে তিনি নাকি শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক আপত্তিকর কথা লিখেছেন। কিন্তু কি কি আপত্তিকর কথা লিখেছেন সেগুলো বিস্তারিতভাবে তাদের বক্তৃতায় উল্লেখ করেননি। ফলে খন্দকার সাহেবের বিরুদ্ধে তাদের বিষোদগার সঠিক না বেঠিক সেটি বোঝার সম্পূর্ণ সুযোগ হয়নি।
খন্দকারের পুস্তকে নাকি লেখা হয়েছে যে, শেখ মুজিব ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চের ভাষণ নাকি শেষ করেছিলেন দু’টি স্লোগান দিয়ে। স্লোগান দু’টি হলো- ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় পাকিস্তান’।  মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন যে, ঐ ভাষণের সময় তিনি মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন যে, শেখ মুজিব জয় পাকিস্তান বলেননি। আমরা দৈনিক সংগ্রামের তরফ থেকে এ ব্যাপারে নিজস্ব কোন বক্তব্য দেবো না। শেখ মুজিবের জয় বাংলা এবং জয় পাকিস্তান স্লোগান দেয়া নিয়ে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। এ ব্যাপারে অনেকেই অনেক রকম কথা বলেছেন। আমরা মনে করি, এ সম্পর্কে খন্দকার সাহেবকে এভাবে গালাগালি না দিয়ে তাকে বরং তার বক্তব্য পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিতে হবে।
কারণ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল এমএজি ওসমানী। তিনি আজ পরলোকে। শেখ মুজিব পরপারে। জিয়াউর রহমান অন্যজগতে। মেজর জলিল মৃত। তাজউদ্দিন, কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীও মৃত। খন্দকার সাহেব মুক্তিবাহিনীর শুধুমাত্র উপ -প্রধানই ছিলেন না, তিনি রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানেও ওসমানীর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের তথা মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এমন অসাধারণ গুরুত্ব ছিল তার মুক্তিযুদ্ধে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতায়।
দুই
একে খন্দকারের ইতিহাসবিষয়ক বই নিয়ে সংসদে দারুণ তোলপাড় হয়ে গেল। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের মতে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ও অসত্য তথ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, তিনি কেন এমন বই লিখেছেন এবং কেন এই সময় বেছে নিয়েছেন, তা জানি না। বঙ্গবন্ধু কন্যা যখন শোকে পাথর, তখন তিনি মোশ্তাককে সমর্থন করতে গিয়েছিলেন। এ ধরনের বই লিখে অন্যদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হচ্ছে। উনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের যুদ্ধ করার প্রস্তুতি ছিল না। এখানে অনেকে আছেন, আমরা ট্রেনিং নিয়েছি। হাওয়ার ওপর দেশ স্বাধীন হয়নি। প্রস্তুতি ছিল বলেই হয়েছে।
একে খন্দকারের বইটি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, এক শ্রেণীর লোক পাকিস্তানের আইএসআইয়ের এজেন্ট। খন্দকার সাহেব পাকিস্তানের বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কোনো এজেন্সির কাছ থেকে মোটা টাকা পেয়েছেন। সে জন্য এ বই লিখেছেন। খন্দকার সাহেব আইএসআইয়ের পয়সা খেয়েছেন কিনা, সেটাও দেখতে হবে। তিনি তো বাংলাদেশে ছিলেন না। তিনি এরশাদের সময় সুবিধা নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সময় শেখ হাসিনাকে ধরে মন্ত্রিত্ব নিয়েছেন। এদের চরিত্র সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, উনার সঙ্গে পাক বাহিনী ভালো ব্যবহার করেছে। কিন্তু বাঙালি জাতির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। এ সমস্ত কুলাঙ্গার এসব ইতিহাস কোথায় পায়?
এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকার তার পুস্তকে লিখেছেন, পরিকল্পানায় আমাদের ত্রুটি ছিল। আজও আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা দেখেছি যে, গৃহীত পরিকল্পনার সঙ্গে সব বিষয় খাপ খায়নি। ছোট একটি উদাহরণ দেয়া যাক। মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলাযুদ্ধের জন্য যুবকদের নির্বাচন করা হচ্ছিল। তখন প্রথমদিকে শুধু একটি বিশেষ দলের সমর্থকদেরই নির্বাচন করা হতো। ফলে অন্যান্য বহু যুবক, যারা সবদিক দিয়েই ছিলেন উপযুক্ত, তাদের নির্বাচন করা হতো না। যাদের নির্বাচন করা হতো, তাদের বেশির ভাগের পারফরম্যান্স ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। এর ফলে শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা নয়। সমগ্র জাতিকে এর দায় বহন করতে হয়েছে।
তিনি আরো লিখেছেন, আজ জীবনসায়াহ্নে এসে মনটা কিছুটা বিচলিত। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমরা বাংলাদেশকে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলাম, জাতির ক্রান্তিকালে যেসব মহান ব্যক্তি এ দেশের হাল ধরেছিলেন, জাতি তাদের  অনেকের মৃত্যু রোধ করতে পারেনি। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পেশাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে মানুষের প্রবঞ্চনার চিত্র আজ মনকে বিষিয়ে তোলে। একে খন্দকার বইয়ে লিখেছেন, ১৯৫১ থেকে ৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে থাকার সময় পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ও সেখানকার সাধারণ মানুষ তাকে খুব ভালোবাসতেন। সেখানে তার নাকি অনেক ভালো বন্ধুও ছিল।
তিন
জাতীয় সংসদে বইটি বাজেয়াপ্ত করে একে খন্দকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার দাবি জানানো হয়। সংসদে নিন্দা প্রস্তাবেরও দাবি ওঠে। ডেপুটি স্পিকার অভিযোগ করেন, ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যারা মোশ্তাককে সমর্থন করেন, তাদের বইয়ে কী লেখা থাকে তাতে জাতির কিছু যায় আসে না।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আমির হোসেন আমু বলেন, ‘১৯৪৭ সাল থেকেই মানসিকভাবে বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিল। উনাকে শেখ হাসিনা পরিকল্পনামন্ত্রী করেছিলেন। মানুষের মধ্যে কেন কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবে না? আপনি তো রেডিও স্টেশনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোশ্তাককে সমর্থন করেছেন। শেখ ফজলুল করিম সেলিম অভিযোগ করেন, গোয়েন্দা সংস্থার টাকা পেয়ে তিনি এ কাজ করতে পারেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র টাকায় বইটি লেখা হয়েছে কি-না, তা তদন্তের দাবি জানান তিনি। বইটি বাজেয়াপ্তের দাবি করে তিনি বলেন, কারও ইন্ধনে কোনো এজেন্সির পয়সা পেয়ে এ বই লেখা হয়েছে। ইতিহাস বিকৃতির এই বই বাজারে থাকতে পারে না। লেখককে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের দাবি জানান। তিনি বলেন, এই লোক যখন যেমন, তখন তেমন। এরশাদের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কান্নাকাটি করে মনোনয়ন পেয়েছেন। মন্ত্রী হয়েছেন।
বিভিন্ন পত্রিকায় বিক্ষিপ্তভাবে খন্দকার সাহেব সম্পর্কে আওয়ামী লীগের যেসব এমপি ও মন্ত্রীদের নিন্দাবাদ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো সংকলন করে এই কলামে সন্নিবেশ করলাম। এখন আওয়ামী লীগারদের প্রতি কয়েকটি প্রশ্ন:
একে খন্দকার মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান সেনাপতি ছিলেন। শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের বিমানবাহিনী গড়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার ওপর। শেখ হাসিনা তাকে এমপি এবং মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। এখন মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান সেনাপতিও যদি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর টাকা খেয়ে থাকেন তাহলে এদেশে খাঁটি মানুষটিকে? বীরমুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের জেড ফোর্সের অধিনায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমানও ছিলেন পাকিস্তানের চর। আর একজন সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ছিলেন ছদ্মবেশী রাজাকার। তাহলে খাঁটি বাংলাদেশী কে? আওয়ামী লীগের ভাবসাব এবং কথাবার্তায় মনে হয় যে, একমাত্র তারা ছাড়া আর সকলে পাকিস্তানের এজেন্ট। সমগ্র বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীও পাকিস্তানের এজেন্ট এবং তাদের টাকা খায়। আওয়ামী লীগের মতো যদি এভাবে লোম বাছা শুরু হয় তাহলে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগ দাবি করেছে যে, এই বইটি বাজেয়াপ্ত করে একে খন্দকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হোক। এখানেও দেখছি ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার জোগাড়। বিএনপি’র হালি হালি এবং জামায়াতের ডজন ডজন নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রুজু করা হয়েছে অথবা হচ্ছে। একটি দেশে যদি এত রাষ্ট্রদ্রোহী থাকে তাহলে দেশপ্রেমিক খুঁজে পাওয়া ভার।
একে খন্দকার যদি খন্দকার মোশ্তাকের অনুরক্ত হয়ে থাকেন তাহলে শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রী বানালেন কেন? সেক্ষেত্রে অনেকে একটি অভিযোগ করছেন। সেই অভিযোগটি হলো এই যে, শেখ হাসিনার বর্তমান মন্ত্রিসভাতেও একাধিক সদস্য রয়েছেন যারা খন্দকার মোশ্তাকের সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাদের কথা বেমালুম চেপে গিয়ে একে খন্দকারকে নিয়ে টানাটানি কেন?
প্রিয় পাঠক, এই ধরনের অনেক প্রশ্ন আছে যেগুলো আগামীতে উত্থাপিত হবে। আজ আর আল-কায়েদার শাখা খোলা বা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশের ষড়যন্ত্র নিয়ে আলোচনা সম্ভব হলো না। বারান্তরে সেগুলো নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে রইল।
আসিফ আরসালান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads