মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০১৪

বড় দুর্নীতিবাজ বেশি প্রিয়


ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্রে যা ঘটে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এখন ঠিকঠিক তাই ঘটতে শুরু করেছে। সাধারণত এই নিয়মে ফ্যাসিবাদী শাসকরা তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা করে। তার প্রথম পদক্ষেপ হলো, কোনো একটি বিশেষ আবেগী সেøাগানকে তরুণ সমাজের মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদ দেয়া। আর পরবর্তী পদক্ষেপ হলো, সব জায়গাই অনেকটা ছকে বাঁধা। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা অথবা নিয়ন্ত্রণে নেয়া। আর মিথ্যার আশ্রয় তো অতি তুচ্ছ ও স্বাভাবিক কৌশল। এর ফাঁকেই দলীয় লোকদের নানাভাবে প্রণোদনা দেয়া এই কৌশলের অংশ। এসব প্রণোদনার ক্ষেত্রে লজ্জা কিংবা যৌক্তিকতা কোনো যুক্তি হিসেবে দাঁড়ায় না। ফলে তা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে।
এখন বাংলাদেশে তেমনই এক দুঃসহ কাল। মিথ্যা, প্রতারণা, শঠতা যেন গোটা সমাজকেই গ্রাস করে বসেছে। সরকারে যারা রয়েছেন তারা চোখে-মুখে অবিরাম মিথ্যার বেসাতি করছেন। কখনও কখনও এমন সব কথা বলছেন, যার সঙ্গে যুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এক ধরনের সিনাজুরি চলছে। কে কী বলছে ধুলায় অন্ধকার। কে কী করছে তার কোনো হিসেব নেই। হিসেব একটাই তা হলো দুর্নীতিবাজ, লুঠেরা, অত্যাচারী, নিপীড়ক সরকারের কতটা তল্পিবাহক তার ওপর। যে সরকারের যত বড় কীর্তক সে তত সুবিধাভোগী, সে তত কাছের মানুষ। সমাজ এখন এরকম একটি ভয়াবহ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। মিত্যাচার, ভ-ামি, আর লুণ্ঠনই হয়ে উঠেছে সরকারের নিয়ামক।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দলীয়করণের যাঁতাকলে পিষ্ট। ফলে জনগণের অধিকার রক্ষায় তাদের ক্ষমতা ক্রমেই সঙ্কুচিত। আইন, প্রশাসন, বিচার কোনো কিছুই আর জনআকাক্সক্ষার অনুকূলে নেই। প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সরকারি তাঁবেদার ও মোশাহেবে ভরে গেছে। ফলে সবাই লা-জওয়াব। দুর্নীতি এখন লাগামছাড়া। এদিকে মনোযোগ দেবার কোনো অবকাশ সরকারের নেই। কখনও কখনও এমন মনে হয় যে, সরকারই বোধকরি এসব দুর্নীতির ভাগিদার। যে কোনো বড় কাজে ৩০-৪০ শতাংশ ঘুষ, দুর্নীতিতেই যায়। সরকারি লোকদের লুণ্ঠনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ফোকলা হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগও নেই। রুই-কাতলারা বুক ফুলিয়ে সমাজে চলছে-ফিরছে। দু-একটা চুনোপুঁটি গ্রেফতার করে সরকার দেখাতে চায় যে, তারা খুব তৎপর।
২০০৮ সালের আঁতাতের নির্বাচনের মাধ্যমে এই সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। তারপর থেকেই চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। আর তখন থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ঐ সরকারের বড় বড় দুর্নীতিবাজকে প্রধানমন্ত্রী সাদরে বুকে টেনে নিয়েছেন। কাজেই দুর্নীতি নিয়ে যারা কথা বলেছেন, তাদের চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করেছে। এমনকি বড় বড় দুর্নীতিবাজকে তিনি সেরা দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যায়িত করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাতে দেশ বা জনগণের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হলো কিংবা কী মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হলোÑ সেটা দেখার অবকাশও তার হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক মহলে, বিশ্বের অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠনগুলোতে বাংলাদেশ এখন এক বিরাট দুর্নীতিবাজ হিসেব চিহ্নিত। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী হবেÑ সে বিষয়ে ভাবতে চায়নি সরকার। এই প্রভাব যে কত বহুমুখী হতে পারে সে সম্পর্কেও সরকারের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। কিংবা সেসব প্রভাবকে তারা পরোয়াও করতে চাচ্ছে না। ফলে দীর্ঘমেয়াদে এর মাশুল গুনতে হবে জনগণকে।
সরকারি লোকদের দুর্নীতির খবর প্রতিনিয়ত পত্র-পত্রিকায়, মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। যদিও মিডিয়া নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে কখনও কখনও এসব খবর প্রকাশ করে। তাতেও ক্ষুব্ধ হন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। ফ্যাসিবাদের ধর্মানুযায়ী তখন তারা এসব মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তার পরিণতিতে একাধিক পত্রিকার সম্পাদক জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। এখনও কার্যত বিনা বিচারে কারাবন্দি আছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। সে পত্রিকা বন্ধ আছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন। হুমকির মুখে আছে অনেকেই।
এদিকে আবার সরকারি ব্যাংক থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে, সে সম্পর্কেও অর্থমন্ত্রী মহোদয় জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছেন। সোনালী ব্যাংক থেকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার মধ্যস্থতায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লুটের পর অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা কোনো টাকাই নয়। অর্থাৎ সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লুট বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যে নিতে চায়নি সরকার। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্যান্য ব্যাংকের অবস্থাও একই। সর্বশেষ খবর সরকার নিয়ন্ত্রিত বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার কোটি টাকার বেশি লুট হয়ে গেছে। আর এই লুটের হোতা সরকার নিয়োজিত পরিচালনা পরিষদ ও চেয়ারম্যান। ‘শেখ বাচ্চু’ শুধু তার নির্দেশেই ১৬শ’ কোটি টাকার বেশি অন্যায্য ঋণ মঞ্জুর করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল যে, ঐ পরিচালনা পরিষদ ভেঙে দেয়া হোক। অর্থ মন্ত্রণালয় তার জন্য দীর্ঘ সময় পার করে। শেষে পরিচালকদের সরিয়ে দেয়া হলেও থেকে যান চেয়ারম্যান বাচ্চু। তাকে সরাতে নাকি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন লাগবে। তারও বেশ পরে বাচ্চুকে সরানো হয়েছে। কিন্তু এদের কাউকে দোষী করা হয়নি। তারা আছেন বহাল তবিয়তে।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাশালীরা কী পরিমাণ লুট করেছেন, ঘুষ খেয়েছেন এবং অবৈধ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তা প্রকাশ হয়ে পড়ে ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রদত্ত তাদের নিজেদেরই হলফনামা থেকে। সে খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। কিছুদিন শোরগোল চলে। তারপর সবকিছু থিতিয়ে আসে। এদিকে আবার এই হলফনামায় মন্ত্রী-এমপিরা তাদের সম্পদের যে হিসাব দিয়েছেন, তা যাতে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তার তদবিরে গিয়েছিল সরকারের একটি প্রতনিধি দল এবং আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, ‘স্বাধীন’ নির্বাচন কমিশন একবারে সরকারের বশংবদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে থাকে। সে তথ্য ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলে।
গত ২০ জুলাই দৈনিক যুগান্তর সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট মাহবুবুর রহমানের সম্পদ স্থিতির এক হিসাব প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, পাঁচ বছর আগে ঐ প্রতিমন্ত্রী ২০ একর জমির মালিক ছিলেন। পাঁচ বছর পরে তার জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮৬৫ একর। হলফনামায় এই বিপুল সম্পত্তি আয়ের সাতটি উৎস তিনি দেখিয়েছেন। বাস্তবে সেসব উৎসের কোনো অস্তিত্বই নেই। রিপোর্টে বলা হয়েছে, তার ও তার স্ত্রীর নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার নাম ‘আন্ধার মানিক’ ও ‘গঙ্গামতি’। এর মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সকল ঠিকাদারি কাজ তিনি বাগিয়ে নেন। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরি, অর্থ বরাদ্দ, ড্রেজিং না করেই বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন, কার্যাদেশ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেয়া। নদীর নাব্য আনয়নের নামে কোনো কাজ না করেই বিল উত্তোলন প্রভৃতি বিষয়ের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকও অবশ্য এক আজব প্রতিষ্ঠান। লোক দেখানোর জন্য তারা সরকারের চিহ্নিত বড় বড় দুর্নীতিবাজকে মাঝেমধ্যে চিঠি দেয়। কেউ কেউ আসেন। কেউ কেউ আসেন না। নানাভাবে গড়িমসি করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত এলেও ফল শূন্যই থেকে যায়। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন এখন কার্যত দুর্নীতি ধোঁয়ার মেশিনে পরিণত হয়েছে। তারা চট্টগ্রামে ইয়াবা ব্যবসায়ীখ্যাত বদিকে ডেকেছিলেন। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়রকে ডেকেছিলেন। বাঘা দুর্নীতিবাজ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আফম রুহুল হককে ডেকেছিলেন। কিন্তু ফল সেই শূন্যই; বরং শেষ পর্যন্ত তারা এসব দুর্নীতিবাজকে একেবারে নির্ভেজাল সৎ মানুষের সার্টিফিকেট দিয়ে বিদায় দিয়েছে।
আর ছাত্রলীগ তো বরাবরই সরকারের আপদ। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এই ছাত্রলীগকে সরকার একেবারে মাথায় তুলে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। কী করছে না ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতাই বলেছেন, ছাত্রলীগকে থামাতে হবে। কিন্তু এগুলো বাতকে বাত। ছাত্রলীগ প্রতিদিন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। আর শাস্তির বদলে তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনন্যোপায় হয়ে তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থায় নেয়নি। তাহলে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়তো। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, খুন-ধর্ষণ তো আছেই। এখন ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে তুলকালাম কারবার চলছে। তাদের দাবি হলো পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছে কি হয়নি সেটি মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হলো, তারা যাদের বলবে তাদেরই ভর্তি করে নিতে হবে। এ বাবদ ভর্তি পিছু তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২০-২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন করেছে। সেসবের দিকে নজর দেবার ফুরসত সরকারের নেই। ফলে বর্তমান তো বটেই, দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। এই বাণিজ্যে বাধা পেলে তারা শিক্ষক, অধ্যাপক কাউকেই বেদম প্রহার করতে ছাড়ছে না। এরকম হাঙ্গামার ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। সরকার তাদের এতবড় মদদ দানকারী যে, পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগের অধ্যক্ষ পেটানোর দৃশ্য দেখছে।
এ সম্পর্কে সাম্প্রতিক ঘটনা কক্সবাজারের এক ছাত্রলীগ নেতা কোনো কাগজপত্র ও রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। তাকে থামায় এক পুলিশ। রুটিন চেক হিসেবে পুলিশ কাগজপত্র দাবি করে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয়। তার এক পর্যায়ে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ মিলে কক্সবাজারে পুলিশ ব্যারাকে হামলা চালায়। আওয়ামী লীগ নেতারা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দুই ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগ নেতাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। এর আগেও একাধিক স্থানে এমন ঘটনা ঘটেছে। এর পরিণতি যা দাঁড়িয়েছে তা হলোÑ সংশ্লিষ্ট থানার ১৪ পুলিশকে সাময়িক বরখাস্ত ও ক্লোজড করা হয়েছে। অভিযোগ, তারা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করেছে। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যেদিন এসব দানব সরকারেরই ঘাড় মটকে দেবে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads