বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০১৪

একটা লড়াই অনিবার্য


মানুষ ক্ষমতা ছাড়ে না, ক্ষমতা মানুষকে ছেড়ে যায়। যেমন এক সময় নিশ্চিতভাবে প্রাণ ছেড়ে যায় দেহকে। জনসমর্থনহীন ক্ষমতার কতকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সংযমহীনতা, ঔদ্ধত্য, আস্ফালন, বেপরোয়াভাব, জবাবদিহিতার ঊর্ধে উঠে যাওয়া, বিনয়কে দুর্বলতা ভাবা, প্রতিপক্ষকে তুচ্ছজ্ঞান করা, আইনের সীমা অতিক্রম করা, সর্বোপরি ধরাকে সরাজ্ঞান করা। বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা এসব বৈশিষ্ট্য থেকেও খানিকটা মুক্ত নন।
ক্ষমতা মানুষকে এতটা অসংযমী করে, একজন ক্ষমতাবান নিজেকে খোদা ভাবতে শুরু করার নজিরও আছে। মিসরীয় শাসকেরা এমনটি করে অভিসম্পাত কুড়িয়ে ইতিহাসে ঘৃণিত হয়ে আছে। যেসব রাজা বলতেন তিনিই প্রভু এবং তিনিই রাষ্ট্র, তাদেরকেও ইতিহাস ঘৃণার উপমা করে রেখেছে। সেই রাজারাও ঘৃণা কুড়িয়ে ইতিহাস হয়ে আছেন, যারা ভাবতেন ক্ষমতার শেষ নেই। পৃথিবীর কোনো একনায়ক ও স্বৈরশাসক নন্দিত হননি। এক সময় ক্ষমতাই তাদের লাথি মেরে অধঃপতনের দিকে ছুড়ে মেরেছে। জনগণ যখন কাউকে চায় না, তখনো যারা জনগণের সেবাকরার জন্য জোর জবরদস্তির আশ্রয় নেন, তারা শাসক নন, ডাকাত। নৈতিকভাবে তারা ভ্রষ্ট। গণতন্ত্রের ভাষায় তারা গণদুষমন। ক্ষমতাপাগল এমন শাসকদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের ভাষা অর্থহীন। নিয়মতান্ত্রিকতার দোহাই অকার্যকর।
আমাদের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যারা ক্ষমতা উপভোগ করছেন তারা ক্ষমতাকে ভাবছেন অধিকার, আমানত নয়। মানসম্মান যে আল্লাহ দেন, আল্লাহ আবার কেড়ে নেন সেটাও তারা ভুলে গেছেন। ক্ষমতা জনগণের পক্ষ থেকে দেয়া একটি দায়িত্ব, গায়ের জোরে পাওয়া কিংবা অর্জিত বিষয় নয়। ক্ষমতা বিধাতাপ্রদত্ত একধরনের পরীক্ষাও। এটাও বিধাতা কেড়ে নেন। কাউকে আবার পাপের বোঝা বাড়িয়ে তোলার জন্য ক্ষমতার মগডাল স্পর্শ করার মতো সুযোগ করে দেন। সেই সাথে নাহক ক্ষমতা দীর্ঘ করার জন্য রশিটাও শিথিল করে দেন। কারণ, সময়মতো পাকড়াও করে মানুষের জন্য শিক্ষণীয় নজির করে রাখতে এটা একটা ভালো ব্যবস্থা।
তবে ক্ষমতা নামের দায়িত্বশীলতা অর্জন করতে হয়। যেমন মৌলিক গুণাবলি আহরণ করতে হয়। তা ছাড়া খোদায়ি নিয়মে ভাঙা-গড়া ও ক্ষমতা বদলের একটি চিরায়ত নিয়ম রয়েছে। সেটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যেমন সৌভাগ্য আসে পরিশ্রমে। অর্জন ধরা দেয় অনুশীলনে। প্রাপ্যটা হাতে আসে চেষ্টার বিনিময়ে। জোর করে যে ক্ষমতা আনতে হয় কিংবা উপভোগ করতে হয় সেই ক্ষমতাবানেরা কোনো কালেই আকাশ ছেদ করে নিঃসীম নীলিমায় হারিয়ে যেতে পারেননি। মাটি ভেদ করে অতলে গিয়েও নিজেকে আড়াল করতে পারেননি। বর্তমানে যারা ভাবছেন সময়কেও তারা অতিক্রম করে ফেলেছেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
ক্ষমতা সম্পর্কে এতটুকু গৌরচন্দ্রিকা দেয়ার মাজেজা একটাই, আল্লাহ স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কুদরত সব সময় দেখাতে পারেন। নবী-রাসূলগণ কখনো কখনো মাজেজা বা অতিলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়েছেন, যা নবী-রাসূলের অনুপস্থিতিতে আর ঘটবার নয়। অলি-আল্লাহরা কারামত দেখাতে পারেন বলে মনে করা হয়। এর সীমা সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা মেনে নেয়া ভালো মনে করি। কারণ, এ ছিদ্রপথটি অপব্যবহার করে তথাকথিত ও এক ধরনের ভণ্ড পীর সিদ্ধ ডিমে বাচ্চা ফুটানোর কথা বলেন। স্বামী ছাড়াও বন্ধ্যা নারীর গর্ভে সন্তান পয়দা করার মতো আজগুবি গল্প শোনান। এখন আমাদের ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদেরা একই সাথে খোদায়ি বৈশিষ্ট্য এবং নবী-রাসূলদের মতো অতিলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শনের মতো শক্তি-সামর্থ্য রাখেন বলে মনে করেন। অথচ তাদের কর্মকাণ্ড ভণ্ড পীরের মতো। তাদের আচরণ নিয়ে এমন একটি কঠিন পর্যবেক্ষণধর্মী মন্তব্য লিখতে হলো বলে দুঃখিত।
ঈদের পর কী হবেÑ এ প্রশ্ন এখন সবার মনে। এক ধরনের অনিশ্চয়তার টান টান উত্তেজনা নিয়ে জনগণ ঈদের ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়ি যাবেন। রাজনৈতিক কর্মীদের মনেও এক ধরনের অজানা রোমাঞ্চকর অবস্থা তৈরি হচ্ছে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের সাথে যারা জড়িত তারা অরাজক পরিস্থিতির আতঙ্কে আছেন কী হবে! সরকারের একগুঁয়েমির কারণে স্থিতিহীন পরিস্থিতি তো সৃষ্টি হবেই। বিরোধী জোট ঈদের পর ওয়ার্মআপহওয়ার প্রস্তুতি যে নিচ্ছেন তা তো নিশ্চিত। গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য তাদের শবযাত্রা হলেও করতে হবে। ফলে একটি রাজনৈতিক সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তা বোঝার জন্য রাজনৈতিক বিষয়ক পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই। সরকার কূটনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। কাউকে পরোয়া না করার মতো বুদ্ধিহীন কূটনীতি হয় দুঃসময় সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখবে, নয়তো দুঃসময়কে গভীর করতে উৎসাহ জোগাবে।
প্রশাসনযন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি দলের সব বাজিকর, কায়েমি স্বার্থবাদী ও সুবিধাভোগী হিসেবে একপক্ষ প্রতিহত করার দোহাইতে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক-এগারোর সরকার থেকে ৫ জানুয়ারির ভোটারহীন নির্বাচনে গঠিত সরকার পর্যন্ত, দেশের সব শ্রেণীর ভেতর প্রচুর কায়েমি স্বার্থবাদী ও সুবিধাভোগী ছদ্মবেশী ও দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠীর জন্ম নিয়েছে। ওরাও জান বাজি রেখে সরকারের পক্ষে অবস্থান নেবে। অনুগত বামপন্থী মিত্ররা সেই কায়েমি স্বার্থবাদের পক্ষের দৃশ্যমান শক্তি। সুবিধাভোগী এবং ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগীরাও কোনোভাবেই ক্ষমতার পরিবর্তন মেনে নিতে চাইবে না। তারা ধরেই নিয়েছে, সরকার পরিবর্তন হওয়া মানে তাদের বাড়া ভাতে ছাই পড়া, ভাগ্যবিপর্যয় অনিবার্য হওয়া। তাই সব ধরনের চাঁদাবাজ, লুটেরা ও দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী পরিবর্তন চাইতেই পারে না। তারা পরিবর্তন ঠেকানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। লুণ্ঠিত সম্পদ, দুর্নীতির মাল ও ক্ষমতার মোহ এবার গণতন্ত্র ঠেকাতে জানবাজ হয়ে যাবে।
একটা মহল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ডুগডুগিবাজ সাজবেই। বামপন্থীদের লাল-নীল-হলুদ রঙধারীরাও তাদের সাথে যোগ দেবে। ক্ষমতাবানদের সাথে বর্ণচোরা কিন্তু সুবিধাভোগী শ্রেণী চরিত্রের এ লোকদেরও কুৎসিত দিকটি এবার সবাই উদোম করা অবস্থায় দেখতে পাবেন। বর্তমানে যারা ভাবছেন সময়কেও তারা অতিক্রম করে ফেলছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সনদ জালিয়াতরা কেন চাইবেÑ এ সরকার বিদায় নিক। দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং দলবাজ পুলিশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইন-আদালত পাড়া সর্বত্র গণতন্ত্র ঠেকানোর মহড়া প্রত্যক্ষ করা যাবে একই কারণে। অযোগ্য লোক ভালো পদায়ন পেয়েছেন, তারা মরণ কামড় বসিয়েও চাইবেন ক্ষমতা যেন জনগণের প্রত্যাশার ধারেকাছেও না যায়। তারাই টেন্ডারবাজ থেকে ঝুট ব্যবসায়ী, তারাই ভেজাল-নকল ও জাল-জালিয়াতির সাথে জড়িত। ব্যবসায়-বাণিজ্যের পারমিট লাইসেন্স তাদের হাতে। রেলের কালো বিড়াল, ব্যাংক ডাকাত, নতুন ব্যাংকের মালিক, শেয়ারবাজার তস্কর, স্বর্ণের চোরাকারবারি, মিডিয়ার নতুন মালিক, সরকারের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা গডফাদারকে সুবিধাভোগী বানিয়েছে এ সরকার, ক্ষমতার পরিবর্তনে যাদের রিজিক নষ্ট হওয়ার ভয়, অন্যায়ভাবে পাওয়া চাকরিটা খোয়ানোর দুশ্চিন্তা; এ কারণেই তারা জনগণের বিজয় চাইবেন না, গণতন্ত্র মুক্তিপাক তা বরদাশত করবেন না। অস্ত্রবাজ, চেনাজানা দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজ-চাঁদাবাজরা মাঠ না ছাড়তে শেষ চেষ্টা চালাবেন।
বিগত কবছরে সরকার অসংখ্য মানুষকে সুবিধাবঞ্চিত করেছে। শত শত মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় নিপীড়নের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জেল-জুলুম, পুলিশি নির্যাতন সীমা ছেড়েছে। মজলুম হয়ে বুকে ছেপে রেখেছে অজস্র কান্না। এমন মানুষ মুক্তির পথ খুঁজবেই। তাই জালেম-মজলুমের একটা অদৃশ্য লড়াইও বেধে যাবে।
আগামী দিনে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সাথে জনগণের একটি যুক্তিসঙ্গত গণতন্ত্রের জন্য লড়াই অনিবার্য। এ লড়াইয়ে সরকার রক্ষায় মাঠে নামবে সব সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। সাথে যোগ দেবে দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাওয়া গোষ্ঠীটি। এরাই অর্থবিত্ত দিয়েও জনগণকে রুখবে। এই অনিবার্য লড়াইয়ে মেরুকরণ এখন স্পষ্ট। এখন যে নীরবতা সেটি ঝড়ের পূর্বাভাস মাত্র। অচিরেই এক দিকে মেরুবদ্ধ নিপীড়িত, বঞ্চিত ও ভাগ্যহত নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। অন্য দিকে মেরুবদ্ধ হবে জুলুমবাজ সুবিধাভোগী শ্রেণী। সরকার এভাবেই মাঠ সাজাচ্ছে। সুযোগও নেবে সঙ্ঘাতের নৈরাজ্য থেকে। রাষ্ট্রশক্তিরও অপব্যবহার হবে। বিরোধী জোটকে এ লড়াইয়ে কোথায় কতটা পাওয়া যাবে তার ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। 

মাসুদ মজুমদার


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads