মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০১৪

পার পেয়ে যাবে বিহারি ক্যাম্পের হত্যাকারীরা!


এ  দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নাটোরের বিএনপি নেতা সানাউল্ল্যাহ নূর বাবুর হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। নরসিংদীর জনপ্রিয় তরুণ আওয়ামী লীগ মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডেরও কোনো বিচার হয়নি। সবচেয়ে নির্মম ও হৃদয়বিদারক দৃশ্যটি দেশবাসী দেখেছে গত ১৪ জুন রাজধানীর পল্লবীর বিহারি ক্যাম্পে। একই পরিবারের ৯ জনকে ঘুমন্ত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো। বিহারিরা ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগে ভারতের বিহারে থাকত এবং ভারত বিভাগের ভয়াবহ দাঙ্গার শিকার হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) অভিবাসী হয়ে এসেছে। তারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপন করছে। কিছুৃ দিন আগে তাদের কিছু অংশকে এ দেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। তারা যদি কোনো অপরাধের সাথে জড়িত থাকে প্রচলিত নিয়মেই বিচার হওয়া স্বাভাবিক! কিন্তু এ হত্যাযজ্ঞের পেছনে যে ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা আঁতকে ওঠার মতো! 

স্থানীয় সংসদ সদস্যের ইচ্ছেমতো বিহারি ক্যাম্পের বিদ্যুৎ সংযোগ অন্য বস্তিতে দিতে ক্যাম্পের অধিবাসীরা রাজি না হওয়ায় তিনি তাদের দেখে নেয়ার হুমকি দেয়ার পরপরই এই নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। বিহারি ক্যাম্পের জায়গা দখলের প্রাথমিক প্রক্রিয়াও এই আগুন লাগানোর পেছনের কারণ বলে জানিয়েছেন ক্যাম্পের অধিবাসীরা। আরো উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হামলাকারীদের ঘটনার সময় সহযোগিতা করেছে! অর্থাৎ পুলিশের সহযোগিতায় ক্যাম্পে বর্বরোচিত হামলা করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায়ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত বলে আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। অথচ আমাদের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের ২ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘সব সময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা রাষ্ট্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।জনগণের রক্ষক হয়ে এখন ভক্ষকের ভূমিকায় তারা অবতীর্ণ হয়েছে। একটি ঘরে আগুন লাগিয়ে নারী ও পুরুষসহ সবাইকে পুড়িয়ে মারা হবে আর তার বিচার হবে না! বিহারি ক্যাম্পের ঘটনা চোখে আঙুল লাগিয়ে দেখিয়ে দেয় কতটুকু বর্বর ও অসভ্য জাতি আমরা! শুধু আগুন নয়, বিচার করা তো দূরের কথা ওই ঘটনায় মামলার আসামিও করা হয়েছে নির্যাতিতদেরই! হয়তো মূল খুনিরা পার পেয়ে যাবে, কিছুই হবে না। কারণ ওই সন্ত্রাসীদের মদদদাতা একজন প্রতাপশালী পার্লামেন্ট মেম্বার। তাদের ক্ষমতা আছে, প্রশাসন আছে, মন্ত্রী আছে, কিন্তু অসহায় বিহারিদের কিছুই নেই! সংবাদ কাভার করতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ষাটোর্ধ্ব এক বিহারিকে, নিজেদের রক্ষা করতে পারলেন না কেন? তিনি বললেন, বাপু, দিনে এনে দিন খাই, দুই দিন কাজ করতে পারিনি। খেতেও পারিনি। ওরা এতগুলো মানুষ অস্ত্রশস্ত্রসহ এসেছে, সাথে পুলিশ; নিজেদের রক্ষা করি কিভাবে! শুধু বিহারি ক্যাম্প নয়, এভাবে দেশে যত বস্তি রয়েছে সবেরই নিয়ন্ত্রক কিন্তু মহান জাতীয় সংসদের সুমহান আইন প্রণেতারাই! ব্যতিক্রম কিছু থাকলেও থাকতে পারে। এখানে দল মুখ্য বিষয় নয়, এসব কাজে সবাই যেন একই সূত্রে গাঁথা। আমাদের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের ১ উপধারায় বলা হয়েছে- ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী ও পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইন অনুযায়ী ও শুধু আইন অনুযায়ী আচরণ লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের অবিচ্ছেদ্য অধিকার।এটি সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অন্যান্য ব্যক্তিরও অবিচ্ছেদ্য অধিকার। কিন্তু এসব ঘটনায় আমরা দেখেছি কিভাবে আইনের আশ্রয়লাভ করা থেকে ব্যর্থ হচ্ছে সাধারণ মানুষ! মানুষের যেন এ দেশে কোনো মূল্য নেই! কয়েক দিন আগে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে স্বজনহারা প্রায় ৩০-৩৫টি পরিবার দেখা করতে এসেছিল। প্রত্যেকেরই অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে। তাদের কারো স্বামী চিরতরে হারিয়ে গেছেন, কেউ বা ফিরছেন লাশ হয়ে। আদালত কিংবা থানায় গিয়েও বিচার পাননি। অনেক ক্ষেত্রে মামলার এজাহারও গ্রহণ করা হয়নি। স্বজন হারানো মানুষের স্ত্রী, ভাই, বোন কিংবা সন্তানদের গগনবিদারী চিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছিল সেখানকার পরিবেশ। এসব হাহাকার, গগনবিদারী আর্তনাদ, গলিত কিংবা অগ্নিদগ্ধ লাশের সারিই বলে দেয় কী রকম বর্বরতার কবলে পড়েছি আমরা! মানবতাবোধ, মনুষ্যত্ব যেন ডুকরে কাঁদছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও আমরা কি তবে মানুষ হইনি

হেদায়েত হোসেন


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads