বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই, ২০১৪

মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কিত রিপোর্ট


রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ জানানো সত্ত্বেও দেশের অভ্যন্তরে গুম,খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির মতো সব অপরাধই বেড়ে চলেছে। গতকাল দৈনিক সংগ্রামের এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, জুন পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে খুন ও রাজনৈতিক হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে এক হাজার ৯৯১ জন। এ সময়ে রাজনৈতিক সংঘাতে মৃত্যু ঘটেছে ১৩২ জনের আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ে মারা গেছেন ১০৮ জন। এদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ২১ জন। ছিনতাই-ডাকাতি তো বটেই, একযোগে বেড়েছে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাও। বিভিন্ন সংগঠনৈর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শুধু সদ্য সমাপ্ত জুন মাসেই দু’ হাজার ৭৩৩টি মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে। আগের মাস মে-তে এই সংখ্যা ছিল এক হাজার ৭৪৬টি। অর্থাৎ এক মাসেই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বেড়েছে ৯৮৭টি। ওদিকে অন্য কিছূ ঘটনায় দেশের বিভিন্নস্থানে মারা গেছে আরো ১৭৪ জন। যৌতুকের জন্য জীবন দিতে হয়েছে ১৪ জন নারীকে। গৃহকর্মীসহ নিষ্ঠূর নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৮৩ জন। এ ধরনের নির্যাতনে ৪৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে এবং আহত হয়েছে ১৩৯ জন। এসবের পাশাপাশি চিকিৎসকের অবহেলায় ১৩ জন রোগীর, গণপিটুনিতে কথিত নয়জন ছিনতাইকারীসহ ৬৩ জনের এবং ক্রসফায়ারে পাঁচজনের মৃত্যু ঘটেছে। ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসীদের হাতে মারা গেছে ৮৯ জন আর আহত হয়েছে ১৯৩ জন। এ সময়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১ জন, যাদের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে দু’জনকে।
বলা দরকার, তথ্য-পরিসংখ্যানগুলো জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয়মাসের অপরাধ ও মানবাধিকার পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে সংস্থা দুটি জানিয়েছে, পরিস্থিতির শুধু ক্রমাগত অবনতি ঘটেনি, বিশেষ করে রাজনৈতিক দমন-নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের মতো ঘটনাগুলো জনমনে প্রবল ভীতিরও সঞ্চার করেছে। ওপরে সংক্ষেপে উল্লেখিত ঘটনা ও সংখ্যার বাইরে এমন আরো অনেক তথ্যই সংস্থা দুটির রিপোর্টে রয়েছে সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতি ও কর্মকা- সম্পর্কে জানার জন্য যেগুলোর পৃথকভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না। আপত্তি ও প্রতিবাদ উঠেছে বিশেষ কিছূ কারণে। এরকম একটি প্রধান কারণ হলো, ২০০৮ সালের নির্বাচন উপলক্ষে শুধু নয়, গত ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের নামে আয়োজিত হাস্যকর কর্মকা- উপলক্ষে প্রকাশিত ইশতেহারেও আওয়ামী লীগ বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা, পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার না করা এবং বিচার বিভাগের ‘প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার’ অঙ্গীকার করেছিল। মানবাধিকার লংঘনও কঠোরভাবে বন্ধ করার ঘোষণা ছিল ইশতেহারে। অন্যদিকে প্রথম থেকে অর্থাৎ ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকেই ঘটে চলেছে উল্টো রকম। শেখ হাসিনার এবারের দুই দফায় এমন কোনো বছর বা মাসের কথা বলা যাবে না যখন আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কেউ না কেউ বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার না হয়েছে। কারা হেফাজতেও বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এখনো ঘটেই চলেছে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভীতিকর গুপ্তহত্যা যা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে গঠিত প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। সাংবাদিক, সম্পাদকসহ সংবাদকর্মীরাও যে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন তার বড় প্রমাণ দেয়ার জন্য  দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রপ্ত সম্পাদক  মাহমুদুর রহমানের এবং সেই সঙ্গে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়াই সম্ভবত যথেষ্ট। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন উইকিলিকসের মতো সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সংস্থাও সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের তথ্য ফাঁস না করে পারেনি। উল্লেখ্য, উইকিলিকস ২০১০ সাল থেকেই বাংলাদেশের বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কিত তথ্য-পরিসংখ্যান ও ঘটনার কথা প্রকাশ করে চলেছে যা এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ‘ওপেন সিক্রেট’-এ পরিণত হয়েছে। স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার, বিভিন্ন সময়ে দেশী-বিদেশী অনেক সংস্থার তদন্তেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের প্রমাণ মিলেছে। ২০১১ সালে তদন্ত করতে গিয়ে বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করতে হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও। সেই থেকে সরকার অবশ্য তদন্ত চালানোর ঝুঁকি আর কোনো নেয়নি। তাছাড়া নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনই যেহেতু লক্ষ্য সেহেতু সরকারের পক্ষে যেসব বাহিনী কাজ করে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও কল্পনা করা যায় না।
বস্তুত প্রথম থেকে প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আসলেও খুনের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। খুন এবং পাল্টা খুন চলছে এমনকি ক্ষমতাসীনদের ভেতরেও। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যেন মানুষের জীবন কোনো ছেলেখেলার বিষয়! বলার অপেক্ষা রাখে না, অপহরণ, গুপ্তহত্যা ও ক্রসফায়ারের মতো ভয়ঙ্কর কোনো কর্মকা-ের বিচার হচ্ছে না বলেই দেশে হত্যা-সন্ত্রাসসহ সব ধরনের অপরাধ বেড়ে চলেছে। সরকারের গোপন আনুকূল্য এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ রয়েছে বলে কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না। অথচ কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন অবস্থা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অন্যদিকে বিভিন্ন হত্যার পেছনে সরকারের ভূমিকা গোপন থাকছে না। বিরোধী দলসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। সরকার বিচার বিভাগের কার্যক্রমেও ন্যক্কারজনকভাবে হস্তক্ষেপ করছে। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সব মিলিয়েই দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে চরমভাবে। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ ১৯৭২-৭৫ সময়ের কথা স্মরণ না করে পারছে না, যখন বিরোধী দলের ৩৭ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল বলে অনস্বীকার্য অভিযোগ রয়েছে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads