বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৪

ভূমিদস্যুরা বেপরোয়া


আওয়ামী লুটেরা জামানায় এদেশে অসম্ভবকেও সবকিছু সম্ভব করা কোনো ব্যাপারই নয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো-ভূমি রেকর্ড বিভাগ। সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রধান সংবাদে এমন একটি চাঞ্চল্যকর জালিয়াতি এবং দুর্নীতির ঘটনার কথা প্রকাশিত হয়েছে, যা এক কথায় অবিশ্বাস্য। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে, প্রভাবশালী জালিয়াত ভূমিদস্যুরা ২৮০০ একর বা ৮৪০০ বিঘা সরকারি জমি এবং ৪৩টি খাল দখল করে নিয়েছে। এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একটি তদন্ত রিপোর্ট থেকে। অভিযোগ করা হয়েছে যে, সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর অসাধু এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব জমির ভুয়া রেকর্ড তৈরি করে সেগুলোর অধিকাংশই নিজেদের নামে রেকর্ড করিয়ে নিয়েছে। অনেক দিন ধরে এই জরিপ কাজ পরিচালিত হয় এবং ১৫ বছর পর ২০১০ সালে সেটি ল্যান্ড রেকর্ড আকারে গেজেট নোটিশ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এটি প্রকাশিত হওয়ার পর অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে এই বিশাল পরিমাণ সরকারি খাস জমি এবং বিপুলসংখ্যক খাল উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়াও হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টের একটি ইনজাংকশনে সেই উদ্যোগও মাঝপথে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। প্রকাশিত খবরে আরো বলা হয়েছে যে, জালিয়াত সংঘবদ্ধ ভূমিদস্যুদের কবল থেকে এই বিপুল পরিমাণ খাস জমি ও খালগুলো উদ্ধারে সরকারের কোনো মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় এবং পরিদফতর এ ব্যাপারে আইনানুগ কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি মন্ত্রণালয় এবং পরিদফতরের সংঘবদ্ধ দুর্নীতিবাজ, জালিয়াত ও অসাধু এবং ভূমিদস্যু আমলা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করে। কিন্তু মন্ত্রণালয় এই নির্দেশ মানেনি কেন? অথচ অতিরিক্ত সচিব ময়েজ উদ্দিন তার রিপোর্টে বলেছেন যে, প্রজাতন্ত্রের এসব অসাধু এবং দুর্র্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঐ সব সরকারি বা খাস জমি এবং খালগুলোকে জালিয়াত ভূমিদস্যুদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে দেখিয়েছে। ভূমি রেকর্ড এবং জরিপ পরিদফতরের মহাপরিচালক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবকে একটি পত্র লেখেন। ঐ পত্রে সচিবকে অনুরোধ করা হয় যে, তিনি যেন হাইকোর্টে একটি পত্র লেখেন এবং বৃহত্তর জনস্বার্থে ঐ ইনজাংকশন প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। এরপর মন্ত্রণালয় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কি না তা আজো জানা যায়নি।
সরকারি খাস জমি জালিয়াত চক্র কর্তৃক দখলের নজির দু’একটি নয়। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ ধরনের অসংখ্য খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা মহানগরীর মহাখালী ও বনানীর মাঝখানে অবস্থিত কড়াইল এলাকায় সরকারের মূল্যবান সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা এবং সংশ্লিষ্ট দফতরের একশ্রেণীর অসাধু দুর্নীতিবাজ আমলা-কর্মচারীদের সহায়তায় জাল কাগজপত্রাদি তৈরি করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক এ জমি দখল করে নিয়েছে। আওয়ামী সরকারের (কথিত ডিজিটাল) প্রশাসনের সহযোগিতায় ও স্থানীয় নেতা-কর্মী-ক্যাডার নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের পাহারায় দিন-রাত চলেছে জবরদখলকৃত জমির একাংশে সীমানা দেয়াল নির্মাণ। এই চাঞ্চল্যকর জালিয়াতি ঘটনার সাথে মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিটিসিএল, পিডব্লিউডি এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক লুটেরা নেতা এমনকি তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও জড়িত রয়েছে বলে প্রকাশিত ঐ খবরে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু এতো বড় জালিয়াতি এবং জবরদখলের ঘটনার পরেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আইনানুগ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কোন্ গোপন স্বার্থে? বর্তমান আওয়ামী সরকারের আমলে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত রিপোর্টেও যেমন সরকারি খাস জমি দখলের নানা ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, তেমনি অতীত অভিজ্ঞতার আলোকেও বলা যায়, সরকারি সম্পত্তি বেদখল হওয়ার অসংখ্য নজির রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে রয়েছে। সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের নাকের ডগায় সরকারি জমির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো নির্বাধায় বেদখল হয়ে গেছে। পার্ক, শিশু পার্ক, মন্দির, মসজিদ, কবরস্থান, খেলার মাঠ, ঈদগাহ মাঠ, বিনোদনের অধিকাংশ স্থানেরই এখন কোনো হদিস মেলে না। এমনকি কাগজপত্র ঘেঁটেও জায়গা-জমির সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছিল রাজধানী জুড়ে চলছে দখলদারিত্বের মহোৎসব। সরকারি দলের নামে প্রভাব খাটিয়ে সরকারি জায়গা-জমি দখল করে চলেছে একশ্রেণীর জালিয়াত সুবিধাভোগী নেতা-কর্মী-ক্যাডার। তাদের এই জালিয়াতি অপকর্মে দলের সাধারণ নেতা-কর্মীরাও বিব্রত। স্থানীয় থানা পুলিশ এবং এমপিদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো ফল হয়নি। কোনো কোনো এলাকায় খোদ এমপির ঘনিষ্ঠ লোকজনই দখলের রাজত্ব কায়েম করেছে। অপর একটি প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল যে, মূল রেকর্ড ভলিয়ম থেকে মূল কাগজ সরিয়ে জালিয়াতচক্র বাইরে থেকে ছাপানো খতিয়ানের পাতা সংযুক্ত করে তেজগাঁও মৌজার ৩২ একর জমি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড করে  নিয়েছে।
আওয়ামী স্বৈরশাসনামলে সরকারি সম্পত্তি আওয়ামী জালিয়াতচক্র কর্তৃক দখল করে নেয়ায়ই এখন সবচেয়ে জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। দিন দিন এ সংকট আরো ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসের মাধ্যমে কিংবা ক্ষমতাসীন আওয়ামী আনুকূল্যে কখনো লিজ নিয়ে, কখনো বা জাল রেকর্ডপত্র তৈরি করে, আবার কখনো বা মামলা রুজুর  মাধ্যমে আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা নিয়ে দখল করে রেখেছে এসব মূল্যবান সম্পত্তি। দেশের আদালতগুলোতে প্রায় ৮০ শতাংশ মামলাই জমি-জমা সংক্রান্ত এবং এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলাই সরকারি সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কিত। অবৈধ দখলে চলে যাওয়া রাজধানী ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর অস্তিত্ব রক্ষা এবং নদীগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য হাইকোর্ট বেশ কয়েকবার সরকারের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নদী তীরবর্তী ভূমি উদ্ধার ছাড়াও ঢাকার প্রাণ এই চার নদীর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নদী ও খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও নদীগুলোর সাথে খালগুলো সংযোগের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই ধরনের অসংখ্য জালিয়াতি ও দখলবাজি অপরাধী ঘটনার খবরের ধারাবাহিকতায় এই ৮৪০০ বিঘা খাস জমি এবং ৪৩টি খাল আওয়ামী ভূমিদস্যুরা গিলে খাওয়া হলো সর্বশেষ সংযোজন। কিন্তু র‌্যাব-পুলিশ, দুদক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই ভূমিদস্যু অপরাধীদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণ কী? না-কি এসব ভূমিদস্যু জালিয়াতদের ধারে-কাছে ঘেঁষতেও দায়িত্বশীলদের বুক কাঁপে! প্রশাসনযন্ত্রের দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতার কারণে এসব ভূমিদস্যুরা যে একদিন গোটা ঢাকা মহানগরীকেই গিলে খেয়ে ফেলবে, তখন কী উপায় হবে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads