বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৪

ঈদের পর বিএনপির রাজনীতি


গত ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট আবার সরকার গঠন করেছে। এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা পরপর দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এবারের শপথ গ্রহণ করার মধ্যে শেখ হাসিনার জন্য গৌরবের কিছু নেই। তিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকারি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য নানা ধরনের অসুস্থ ধারার রাজনীতি ও কৌশল গ্রহণ করেছেন। অসত্যের রাজনীতিকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছেন। নিজে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তার এ নীলনকশা বাস্তবায়ন হয়েছে। এর আগে নজিরবিহীন তামাশার মধ্য দিয়ে ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জনকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করানো হয়। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকারের এমন আজ্ঞাবহ কমিশন এর আগে কখনো গঠিত হয়নি। ভোটারদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আওয়ামী লীগের সব সময়ের মিত্র একমাত্র ভারত ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রও এ নির্বাচনে আশাব্যঞ্জক কিছু খুঁজে পায়নি। এসব রাষ্ট্র বরং যথাসম্ভব দ্রুত সব দলের অংশগ্রহণে আবার নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি ও তার শরিক দলগুলো অবিলম্বে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। বিগত ছয় মাসে সরকার এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে কিছু বলছে না। বরং সরকারের কয়েক মন্ত্রী বর্তমান সরকার সাংবিধানিকভাবে মেয়াদের পাঁচ বছরই পূরণ করার কথা বলছেন। এমতাবস্থায় বিএনপি ঈদের পর নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দাবিতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যে তুমুল আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে, তার প্রতি জনসমর্থন আছে। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের বিজয় দলটির প্রতি ব্যাপক জনসমর্থনের প্রমাণ মেলে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল দাবি করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অসাংবিধানিক। সরকারের দাবি অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু এটাও স্বীকার্য যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটি সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি আদালতের অজুহাত দেখিয়ে রদ করেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান আর নেই; কিন্তু সংবিধান সব সময়ই সংশোধনযোগ্য। প্রয়োজনে আবারো নির্বাচনকালীন সরকার নামে তা যে নামেই তাকে ডাকা হোক, একটা নিরপেক্ষ ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা গেলে তা হবে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। আওয়ামী লীগ এক সময় যেসব যুক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছিল, বর্তমানেও সেগুলো বিদ্যমান। জনসাধারণ বিশ্বাস করে, নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের পরিবর্তে নির্দলীয় সরকার নিয়ে আলোচনা শুরু হলে বিএনপি তুমুল আন্দোলন থেকে বিরত থাকতে পারে। এতে সরকারি বা বিরোধী দল কারোরই পরাজয় বা হারানোর কিছু নেই। বরং এতে  উপকৃত হবে গণতন্ত্র, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ। প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলনে কান্ত, বিপর্যস্ত। জনসাধারণের মনে শান্তি ও  সামাজিক সুস্থিরতা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব, বিশেষত আওয়ামী সরকারের ওপর এ দায়িত্ব বেশি। কারণ তারাই জনসাধারণের অধিকার হরণের কালাকানুন করেছে ও নিজেদের প্রয়োজনে সংবিধান পরিবর্তন করেছে। এমন অবস্থা নিশ্চিত করতে  সরকার এবং বিরোধী দল উভয়ের মধ্যে সফল সংলাপ জরুরি। সবার আগে দেশটাকে চিন্তা করলে  ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বার্থচিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। 

এ কথা তো অস্বীকার করা যায় না যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ক্ষমতাসীন জোটের নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচিত সরকারের তকমা গায়ে মেখে শেখ হাসিনা পুনর্বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের নেতাকর্মীরা এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একাট্টা ছিল। এ নির্বাচনের বিরোধিতা ও বর্জনের ডাক দিয়েছিল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় জোট। বিরোধী জোটের নির্বাচন বর্জন বা প্রতিরোধের চেষ্টায় নির্বাচন বন্ধ হয়নি; কিন্তু এ নির্বাচনে রাজনৈতিক বৈধতা ও নৈতিকতা বলতে যে বিষয় আছে, তা সরকার ও সরকারি দলের বিবেচনার মধ্যে ছিল বলে মনে হয় না। 

৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর বাংলাদেশ যে অনিয়মের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে তা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী বিএনপিকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। সংসদে এখন বিরোধী দল নেই। শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক সৃষ্ট সংসদে বিরোধী দল নামে জাতীয় পার্টি সরকারের সাথে যুক্ত হয়ে ভাগবাটোয়ারায় অংশীদার হয়ে সরকারের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। 

ঈদের পরই সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলা নিমিত্তে বিএনপি চেয়ারপারসন বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দকে প্রস্তুত হতে বলেছেন। দলীয় চেয়ারপারসনের এ  ঘোষণার বাস্তবায়নের জন্য শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ থেকে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। প্রায় দুই বছর ধরে বিএনপির আন্দোলন সরকারের দমনপীড়ন ও অন্য নানাবিধ কারণে সফলতা অর্জন করতে পারেনি। সরকারের জন্য এটা স্বস্তিদায়ক বিষয় হলেও জনসাধারণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি এখানে ঘটেনি। এ কারণে বিএনপির আন্দোলনের হুমকি কিংবা আন্দোলনের কর্মসূচি সরকারকে ভাবিত করে না। বিএনপির আবারো আন্দোলন নিয়ে জনসাধারণ কিছুটা দ্বিধা সঙ্কোচে আছে, আন্দোলন সফল হয় কি না। ঈদের পর বিএনপি আন্দোলন সফল হয় কি না ও এতে জনসাধারণের আস্থা ফিরে আসে কি না, তা দেখার বিষয়। গত বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন হলেও ঢাকার চিত্র ছিল ভিন্ন। ওই আন্দোলন সফল না হওয়ার পেছনে অনেকেই ঢাকা মহানগর বিএনপির ব্যর্থতাকেই দায়ী করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি মাসে মহানগর নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করে তরুণ ও যোগ্যদের নেতৃত্বে দ্রুত নতুন কমিটি দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান খালেদা জিয়া। এ জন্য প্রয়োজনীয় তৎপরতাও চালানো হয়; কিন্তু এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি নতুন কমিটি। নতুন কমিটি কবে হবে, তারও কোনো হাল হকিকত দেখা যায়নি।

আন্দোলনের জন্য বিএনপিকে মূলত তৃণমূলপর্যায়ের নেতাকর্মীদের ওপর নির্ভর করতে হবে। গত বছর বিএনপির আন্দোলনে যতটুকু গতি এসেছিল তা মূলত তাদের কারণে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের গা বাঁচিয়ে চলার মনোভাবের কারণে কেন্দ্রীয়পর্যায়ে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। বিএনপির আন্দোলনে যাওয়ার হুমকিকে আমলে নিতে নারাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এগুলো বিএনপির ফাঁকা আওয়াজ। এ মুহূর্তে আন্দোলনে যাওয়ার মতো শক্তি বিএনপির নেই। এটা শুধু আওয়ামী লীগ নেতাদের সন্দেহ নয়, এমন সন্দেহ অনেক বিএনপি নেতার মধ্যেও রয়েছে। তাদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আন্দোলনের সফলতা নিয়ে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিএনপি আন্দোলনের আগে বর্তমানে কূটনৈতিক লবিং জোরদার করা হয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সাথে বেগম জিয়ার বৈঠকের সময় চেষ্টা করা হয়েছে বিএনপিকে বন্ধুভাবাপন্ন হিসেবে তুলে ধরতে। তাকে কিছু ডকুমেন্ট দেয়া হয়েছে যাতে নির্বাচন এবং সরকারের নিপীড়নের চিত্র ছিল। বেগম জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের সাথে বৈঠকে বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গেলে ভারত ছাড়া সবাই সমর্থন করবে।

সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা বলে বেড়াচ্ছেন, তারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছেন। সুতরাং তারা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। ২০১৯ সালের আগে বিএনপির সাথে আলোচনা বা সংসদ নির্বাচন নয়; কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন অভিমত সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং জনগণের আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় হতাশা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল। তারা সরকারের সাথে কাজ করে যাওয়ার কথা বললেও একই সাথে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপিসহ সব দলের সাথে জরুরি ভিত্তিতে অর্থবহ আলোচনা শুরুর তাগিদ দিয়েছে সরকারকে। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে সংলাপে বসতে সরকারকে সর্বশেষ তাগিদ প্রদান করেছেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুন। ১৯ জুন নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বান কি মুন এ তাগিদ দেন। 

ঈদের পর বিএনপির আন্দোলন মোকাবেলায় সরকারও সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বলে সংবাদপত্রে রিপোর্ট বেরিয়েছে। আমরা লক্ষ করছি সরকারের পুলিশ, বিজিবি ও প্রশাসন থেকে শুরু করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য সহযোগী সংঠনের ক্যাডাররা বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হামলা চালাচ্ছে। হামলা ও মামলায় বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে সরকার যেভাবে দেশ শাসন করছে, তা আমাদের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। বাস্তবতা অনুধাবন করা সবার জন্যই জরুরি। ক্ষমতা ভোগের নেশায় মত্ত সরকারি দলের শুভ চিন্তা জাগবে এবং দেশে শান্তি-স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে, এটা দেখতে সবাই প্রত্যাশী।

ড. মো: শামছুল আলম


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads