শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০১৪

ভিনদেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা


৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ হলেও বাংলাদেশের মুসলমানরা এবারের ঈদুল ফিতরে স্বাভাবিক আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে প্রবল সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। পণ্যের আকাশমুখী মূল্য ও বিদ্যুতের লোডশেডিং থেকে শুরু করে ঈদের ছুটিতে অনেক কুস্তি ও ভোগান্তির পর বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্রেই মানুষ খুশি-আনন্দে নেচে-গেয়ে উঠতে পারেনি যতোটা সুখের কথা ক্ষমতাসীনরা প্রচার করে থাকেন। খুশি-আনন্দ দূরে  থাকুক, কষ্ট আর ভোগান্তির সঙ্গে সম্প্রতি আবারও যুক্ত হয়েছে সরকারের প্রচ- দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতারের অভিযান। বেগম খালেদা জিয়া ঈদের পরে আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়ার পরই র‌্যাব ও পুলিশকে তৎপর করেছে সরকার। সারা দেশেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা রয়েছেন ধাওয়ার মুখে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা-কর্মীকে কোনো মামলা না থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জামিনে থাকা অনেককেও নতুন করে জেলের ভাত খাওয়ানো শুরু হয়েছে। অনেক নেতা-কর্মীর বাসভবনে তল্লাশি চালাচ্ছে গোয়েন্দারা। সব মিলিয়েই সরকার এবার ঈদের সময় দেশজুড়ে আতংকের রাজত্ব কায়েম করতে চলেছে।
দেশের রাজনৈতিক সংকট ও সামনের অনিশ্চয়তা নিয়ে মানুষের মধ্যে জোর আলোচনাও চলছে একই কারণে। হঠাৎ শুনতে বিস্ময়কর মনে হতে পারে কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সবকিছুর পেছনে একটি মাত্র সত্যই রয়েছে আর সেটাই সংকটের আসল কারণ। সে কারণটি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। পাঠকরা অবাক হতে পারেন, কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন, জামায়াত তথা এদেশের ইসলামী শক্তিকে উৎখাতের প্রধান উদ্দেশ নিয়েই বছরের পর বছর ধরে নানামুখী কর্মকা- চালানো হচ্ছে। সরকার তাই বলে একা চালাচ্ছে না, অতটা সাহস ও শক্তি কোনো ফ্যাসিস্ট এবং ‘অবৈধ’ হিসেবে চিহ্নিত সরকারের থাকার কথা নয়। নেইও। সরকার সাহস পেয়েছে আসলে ভারতের বদৌলতে। অর্থাৎ সবকিছু করা হচ্ছে ভারতের পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুসারে। খুবই কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পরিচালক হিসেবে সঠিকভাবে চিহ্নিত কংগ্রেস সরকারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে ভারতে যে বিজেপি সরকার এসেছে সে সরকারও কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় নেতাদের নীতিই অনুসরণ করে চলেছে। এদেশের বেশি আশাবাদী সবাইকে এরই মধ্যে নিরাশ করে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তিনি এমন এক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং-এর অঘোষিত নেতৃত্বে ঢাকায় এসেছিলেন, যার সম্পর্কে প্রচারণা রয়েছে, তিনিই আসলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করিয়েছেন। আওয়ামী লীগকেও ক্ষমতায় সুজাতাই এনেছেন। তার ‘চাপেই’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নিতে হয়েছিল। তিনি এমনকি বেগম খালেদা জিয়ার ওপরও চাপ সৃষ্টি করার সাহস দেখিয়েছিলেন। সুজাতা সিং-এর সঙ্গে আসার কারণে শুধু নয়, পূর্বসূরীদের সুরে ও ভাষায় কথা বলে যাওয়ার কারণেও পরিষ্কার হয়েছে, বিজেপি সরকারের কাছেও বাংলাদেশের আশা করার কিছু নেই।
এটা অবশ্য ভিন্নভাবে আলোচিত হওয়ার বিষয়। বর্তমান পর্যায়ে আলোচনার প্রাধান্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে ভারত ও আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তেও নানাদিক। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টা সম্পর্কে নিশ্চয়ই নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এই তো, গত ১৭ সেপ্টেম্বরও একজন ‘নামকরা’ মন্ত্রী জামায়াতকে বাদ দিয়ে আন্দোলনে নামার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছেন। ভাবখানা এমন ক’দিনের মধ্যে যে দলটির অস্তিত্বই থাকবে না, বিএনপির উচিত সে দলটিকে আগেভাগেই বিদায় করা। দেখে-শুনে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জন্য আরো একবার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। উদ্দেশটি হাসিল করার জন্য ক্ষমতাসীনরা আগেই ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইন সংশোধন করেছেন, শাহবাগে নাটক সাজিয়ে জাতীয় সংসদে বিল পাসও করিয়ে নিয়েছেন। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিটিও প্রথমে ওঠানো হয়েছে শাহবাগের নাস্তিক-মুরতাদ ও ইসলাম বিদ্বেষীদের দিয়ে। চাতুরিপুর্ণ হলেও তাদের উদ্দেশ ও কৌশল অবশ্য ধরা পড়ে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষমতাসীনরা বেছে বেছে কেবল জামায়াতে ইসলামীকেই প্রধান টার্গেট বানিয়েছেন কেন? উত্তরের পর্যালোচনায় ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা ও অক্ষমতার দিকগুলো সামনে এসেছে। বহু বছর ধরে বহু ধরনের কসরত করেও জামায়াতকে ঠিক ‘ম্যানেজ’ করতে পারেননি তারা। এজন্যই নানা অজুহাতে দলটিকে নির্মূল করার অভিযান শুরু হয়েছে। প্রধান উদ্দেশ একটিই বাংলাদেশকে ভারতের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা। ভারতের এই এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েই ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছেন তারা। এরপর আবারও ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। সমগ্র সে ঘটনাপ্রবাহে জামায়াত শুধু ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের রিরুদ্ধেই কঠোর ভূমিকা পালন করেনি, আওয়ামী লীগের কথিত বিজয়ের পর থেকে এখন পর্যন্তও প্রবলভাবেই প্রতিবন্ধকের অবস্থানে রয়েছে।
এমন অবস্থা চলছে আসলে দীর্ঘদিন ধরে। জামায়াতকে ‘ম্যানেজ’ করার এবং পক্ষে টেনে নেয়ার চেষ্টাও তারা চালিয়ে দেখেছেন। কিন্তুু আওয়ামী ফাঁদে কখনো পা দেয়নি জামায়াত। উদাহরণ দেয়ার জন্য ১৯৯১ সালের নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখ করা যায়। ওই নির্বাচনে সমমনাদের নিয়ে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪২টি আসন। অন্যদিকে বিএনপির আসন সংখ্যা ছিল ১৩৯টি। সরকার গঠন করার জন্য আওয়ামী লীগের দরকার ছিল ৯ জন এমপির সমর্থন। অন্যদিকে বিএনপির দরকার ছিল ১১ জন এমপির সমর্থন। জামায়াত সেবার ১৮টি আসনে জিতেছিল। অর্থাৎ জামায়াত যাকে সমর্থন দেবে সে দলই সরকার গঠন করতে পারবে। অমন এক অবস্থায় সমর্থনের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে চারজন মন্ত্রীর পদ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কয়েকটি মহিলা আসনের প্রলোভনও দেখিয়েছিল দলটি। আওয়ামী লীগের পক্ষে দুতিয়ালি করেছিলেন বর্তমান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। অন্য এক নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু দেশপ্রেমিক জামায়াত আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে রাজি হয়নি বরং মন্ত্রিত্বসহ কোনো রকম লাভ বা ফায়দা ছাড়াই শর্তহীন সমর্থন দিয়েছিল বিএনপিকে। সে কারণেই বিএনপি সরকার গঠন করতে পেরেছিল, বেগম খালেদা জিয়া প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ওই সময় থেকেই আওয়ামী লীগ জামায়াতের বিরুদ্ধে লেগে আছে। মাঝখানে কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে একযোগে আন্দোলন করলেও ‘রাগ’ পড়েনি আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে মূলত জামায়াতের দেশপ্রেমিক অবস্থান ও ভূমিকার কারণে বিএনপি আবারও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা চারদলীয় জোটের কাছেই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। দলটির আসন নেমে এসেছিল মাত্র ৫৮টিতে। জোট সরকারের আমলে প্রধান বিরোধী দল হিসেবেও জনগণের স্বার্থে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সে কারণে একদিকে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন নিচের দিকে নেমে গিয়েছিল অন্যদিকে জনপ্রিয়তা বেড়েছিল বিএনপি ও জামায়াতসহ চারদলীয় জোটের। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সার্ভে বা অনুসন্ধানেই দেখা গিয়েছিল, ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটবে। এই ভরাডুবি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, ভারতের জন্যও হজম করা সম্ভব ছিল না। কারণ, জোট সরকার প্রথম থেকেই ভারতের সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলেছিল। এজন্যই দেশটি এগিয়েছিল ষড়যন্ত্রের পথে। বিশেষ করে জামায়াতবিরোধী সুচিন্তিত পরিকল্পনার বিষয়টিকে গোপন রাখা যায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জামায়াতসহ ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকায় ভারতের নেতৃত্বে আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যথেচ্ছভাবে ইচ্ছা পূরণ করতে পারছিল না বলেই ১/১১-এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়নের চেষ্টা চালানো হয়েছিল যার প্রধান উদ্দেশ ছিল দেশপ্রেমিক ও ইসলামী দলগুলোকে, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে উৎখাত করা। কিন্তু চেষ্টায় ত্রুটি না থাকলেও সেটা সম্ভব হয়নি।
এই ব্যর্থতার পরই এসেছিল নতুন ষড়যন্ত্রের পালা। এর শুরুটা করে গিয়েছিল সেনা সমর্থিত অবৈধ সরকার। ভারতের ইন্ধনে যুদ্ধাপরাধের মতো রাজনৈতিক উদ্দেশে সৃষ্ট ইস্যুতে জড়িয়ে জামায়াতে ইসলামীকে নিন্দিত ও উৎখাত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন জেনারেল মইন উ’রা। আওয়ামী লীগ সরকারও ওই সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য রীতিমতো দৌড়ে চলেছে। এ ষড়যন্ত্রের কারণেই ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভ-ুল হয়ে গেছে। লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের পেছনেও আওয়ামী লীগ এবং ভারতই প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। জেনারেল মইন উ’কে দিয়ে ক্ষমতা দখল করানো থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো পর্যন্ত সবকিছু ঘটেছে সে ষড়যন্ত্রের ভিত্তিতে। কিন্তু এত কিছু করা সত্ত্বেও ভারতের পক্ষে সম্পূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক দলগুলোর প্রতিরোধ বরং অনেক কঠিন ও প্রত্যক্ষ হয়েছিল। এই প্রতিরোধ ভেঙে দেয়ার উদ্দেশ থেকেই ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে দিয়ে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে সামনে আনিয়েছে। অর্থাৎ ভারতের উস্কানিতেই ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশী জাতিকে বিভক্ত করার এবং দেশে রাজনৈতিক সংঘাত বাধানোর জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে জামায়াতবিরোধী অভিযান মারাত্মক হয়ে ওঠার পর ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের কথা বলে জাতিকে হানাহানির দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতার পরপর প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছিল মুজিব সরকার। সে সরকার স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমা করে দিয়েছিল। আজ প্রায় চার দশক পর আরেক আওয়ামী লীগ সরকার বিচারের নামে জাতিকে হানাহানির দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
বস্তুত খালেদা জিয়ার বক্তব্যে সত্যেরই প্রকাশ ঘটেছিল। ইতিহাসের পর্যালোচনায়ও দেখা যাবে, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী ছিল পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনী। কিন্তু তাদের ব্যাপারে কোনো কর্তৃত্বই ছিল না বাংলাদেশ সরকারের। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সকল সেনাকে ভারতে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৩ সালে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভারত থেকেই তাদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সবই করেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সরকার। দেশের ভেতরে যাদের বিরুদ্ধে পাক বাহিনীকে সহযোগিতা করার অভিযোগ ছিল তাদের প্রতিও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। বিভেদ জিইয়ে রাখার পরিবর্তে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন। অন্যদিকে দীর্ঘ ৩৮ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সেই সিদ্ধান্তবিরোধী ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছিল এমন এক সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন শেখ মুজিবেরই সুকন্যা শেখ হাসিনা। এজন্যই পদক্ষেপের প্রকৃত উদ্দেশ নিয়ে শুধু নয়, এর পেছনে ঠিক কোন শক্তি সক্রিয় রয়েছে সে প্রশ্নও প্রাধান্যে এসেছে। কারণ, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আগেও একবার ক্ষমতায় থেকেছে (১৯৯৬-২০০১)। তখন কিন্তু ওই সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তৎপরতা চালাতে দেখা যায়নি। তাছাড়া প্রধানত যে দলটির নেতাদের ফাঁসানোর অপচেষ্টা চলছে সে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ বছরের পর বছর একযোগে আন্দোলন করেছে। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা জামায়াত নেতাদের সঙ্গে গোপনে-প্রকাশ্যে বহুবার বৈঠক করেছেন। সেসব ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ স্বাভাবিক দলগত রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও জামায়াত ও আওয়ামী লীগ ১৯৮০’র দশকের শুরু থেকে একযোগে কাজ করে এসেছে। এজন্যই প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনা এবার ক্ষমতায় আসার পর হঠাৎ এমন কি হয়ে গেছে যে, সব কাজ ফেলে আওয়ামী লীগ সরকারকে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেই উঠে-পড়ে লাগতে হয়েছে?
ভারতের উদ্দেশও গোপন রাখা যায়নি। নিজের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে তথা মূল ভারত থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে যাতায়াত করার জন্য ভারতের দরকার বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর। দেশটি চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে চায়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপরও দখল প্রতিষ্ঠা করতে চায় ভারত। সব মিলিয়ে ভারত বাংলাদেশকে ইচ্ছাধীন রাষ্ট্র বানাতে চায়। এই চেষ্টা দেশটি বহু বছর ধরেই চালিয়ে আসছে। এজন্যই দেশটির দরকার প্রথমে জামায়াতে ইসলামীকে বিপন্ন ও পর্যায়ক্রমে নির্মূল করে ফেলা। আওয়ামী লীগ সরকারও সে কারণে জামায়াতের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছে। জামায়াতবিরোধী এ অভিযানের কারণ বুঝতে হলে নির্বাচনে দলটির সাফল্য উল্লেখ করা দরকার। ১৯৯১ সালের কথা আগেই বলা হয়েছে। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনে জামায়াতের সফলতার পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বিএনপির মতো প্রধান দলকেও যেখানে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেখানে ভোটের দিক থেকে জামায়াতকে কিন্তু কুপোকাত করা সম্ভব হয়নি। জামায়াতের ভোট বরং অনেক বেড়েছেÑবিভিন্ন রিপোর্টে যার সংখ্যা অন্তত ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮২ জন বলা হয়েছে। জামানত বাজেয়াপ্ত না হওয়াসহ সামগ্রিক অর্জনেও জামায়াত যথেষ্ট সম্মানজনক অবস্থানে ছিল।
জামায়াতের এ সাফল্যেই আওয়ামী লীগ সরকারের শুধু নয়, ভারতেরও মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি ছিল জামায়াতের অব্যাহত দেশপ্রেমিক অবস্থান ও ভূমিকা। ভারতের নীতি নির্ধারকদের বুদ্ধিতে ক্ষমতাসীনরা ভেবেছিলেন, সেনা সমর্থিত সরকারের দমন-নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত হয়তো বিএনপির ‘সঙ্গ’ ত্যাগ করবে। অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও জামায়াত বরং বিএনপির পাশেই গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০০৮ সালের পর খালেদা জিয়া জামায়াত নেতাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেছিলেন ২০১০ সালের ৫ জুন। বিএনপির ডাকা ২৭ জুনের হরতালের প্রতি জামায়াত সমর্থন জানিয়েছিল। এটাই ছিল নতুন পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূচনা। এরপর ১৭ জুন অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। ২৭ জুন পালিত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। প্রতিটি বিষয়েই বিএনপির প্রতি সমর্থন দিয়েছিল জামায়াত। এসব দেখেই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। হরতালের একদিন পর, ২৯ জুনই জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেই থেকে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকেন্দ্রিক নাটকীয়তাই শুধু চলছে। শাহবাগের সাজানো নাটকের পাশাপাশি জামায়াত নেতা ও সাংবাদিক আবদুল কাদের মোল্লার মতো নিরীহ অনেকের ব্যাপারে নিষ্ঠুরতাও কম দেখানো হচ্ছে না।
প্রসঙ্গক্রমে জামায়াতের ব্যাপারে ভারতীয়দের মনোভাব সম্পর্কে কিছু তথ্য স্মরণ করা দরকার। ২০১১ সালের ২৯ জুন নয়াদিল্লীতে সিনিয়র সম্পাদকদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর একটি মন্তব্য এ রকম একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। বাংলাদেশ সফরে আসার প্রাক্কালে ওই বৈঠকে মনমোহন সিং বলেছিলেন, বাংলাদেশের ‘অন্তত ২৫ শতাংশ’ মানুষ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এবং তারা তীব্র ভারতবিরোধী। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকেও টেনে এনেছিলেন মনমোহন সিং। বোঝাতে চেয়েছিলেন যেন আইএসআই-এর সহযোগিতায় জামায়াতে ইসলামী ‘পটপরিবর্তন’ করার তথা শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে! অন্যদিকে অমন অনুমান মোটেও সত্য ছিল না। কারণ, জামায়াতের প্রতি সত্যিই ২৫ শতাংশ মানুষের সমর্থন থাকলে যতো ‘ডিজিটালই’ হোক না কেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অন্তত ক্ষমতায় আসতে পারতো না। তাছাড়া জামায়াতের সঙ্গে দেশের প্রধান দল বিএনপিও ছিল। এই বাস্তবতা সত্ত্বেও মনমোহন সিং যেহেতু বাংলাদেশে আসার ঠিক প্রাক্কালে বলেছিলেন সেহেতু তার কথাটা নিয়ে পর্যালোচনাও যথেষ্টই হয়েছিল। মূলকথার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি ‘ধমক’ দিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, কথা না শুনলে কিংবা ঘাড় বাঁকাতে চাইলে শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।
এখানেই ছিল প্রকৃত হিসাব-নিকাশের ব্যাপার। কারণ, লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের অজুহাতে ১/১১ ঘটানো থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো এবং শেখ হাসিনার সরকারকে দিয়ে একের পর এক নিজের দাবি ও ইচ্ছা পূরণ করিয়ে নেয়া পর্যন্ত সবকিছুর পেছনে ভারতই প্রধান ভূমিকা পালন করে এসেছে। এ প্রচারণাও রয়েছে যে, ভারতের ইচ্ছা ও পছন্দের বাইরে অন্য কোনো দল বা নেতার পক্ষে বাংলাদেশের ক্ষমতায় যাওয়া সহজে সম্ভব নয়। অর্থাৎ ‘পটপরিবর্তন’ যদি ঘটেও যায় তাহলে তার পেছনেও প্রধান নির্ধারকের ভূমিকা থাকবে ভারতেরই। সে কারণে মনমোহন সিং-এর কথার অর্থ দাঁড়িয়েছিল, শেখ হাসিনা যদি ভারতের কথামতো জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেন তাহলে ভারত আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে। প্রয়োজনে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের মধ্যকার ভারতপন্থীদের দিয়ে নতুন একটি সরকার গঠন করাবে। এভাবে একটি মাত্র কথার মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভয় দেখিয়েছিলেন মনমোহন সিং। এতেই কাজ হয়েছিল। তিস্তা চুক্তি না করাসহ বাংলাদেশের দাবি ও অনুরোধ না রাখা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা সেবার টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। তিনি বরং আরো জোরেশোরে নেমে পড়েছিলেন জামায়াতের বিরুদ্ধে। এজন্য বিচারের নামে পাড়া মাতিয়েই তিনি বসে থাকেননি বা থাকছেন না, সম্ভাব্য অন্য সব পন্থাতেও জামায়াতকে বিপন্ন করতে চাচ্ছেন। সে উদ্দেশের অংশ হিসেবেই সবশেষে তারা জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছেন। লাফিয়ে এসেছে নির্বাচন কমিশনও। ফলে ধরে নেয়া যায়, জামায়াতে ইসলামীকে হয়তো সত্যিই নিষিদ্ধ করা হবে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় লাগলেও জামায়াতকে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হবে না। বর্তমান পর্যায়ে একের পর এক দেয়া ফাঁসির রায়ের ওপর ভর করে ভয়ংকর এ খেলাতেই মেতে থাকবেন ক্ষমতাসীনরা। সেটা তারা থাকতেই পারেন। কিন্তু তাদের কথা ও ইচ্ছাই সব নয়। মাঝখানে বিএনপিসহ দলগুলো ও জনগণ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে জাতিসংঘ এবং ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাও। সুতরাং জামায়াতের ব্যাপারে ভারত এবং আওয়ামী লীগ সরকারের এচ্ছাই চূড়ান্ত হতে পারে না। কে জানে,  রাজনৈতিক এই খেলা একসময় আওয়ামী লীগের জন্যই বুমেরাং হয়ে উঠবে কি না!
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads