বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০১৪

পণ্যের দাম নিয়ে সরকারের লোক দেখানো নাটক


পবিত্র মাস রমযানের ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো একটি পণ্যেরই দাম কমে আসার লক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায়নি, যাচ্ছেও না। এ ব্যাপারে সরকারের সব ঘোষণা ও পদক্ষেপই লোক দেখানো নাটক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তো বটেই, অন্য মন্ত্রীরাও যথেষ্টই দেখিয়েছেন, শুনিয়েছেন। সরকার প্রকৃতপক্ষে দাম কমানোর ফলপ্রসূ কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। ফলে রমযানের আগে সেই যে দাম বাড়ানোর পাল্লা ও কর্মকা- শুরু হয়েছিল সেটাও আর থামেনি। রোজাদারসহ সাধারণ মানুষের যাতে কষ্ট না হয় এবং বিশেষ করে রমযানে বেশি প্রয়োজনীয় ও ব্যবহৃত পণ্যগুলোর দাম যাতে মানুষের সাধ্যের মধ্যে থাকে এ ধরনের দাবি ও আশাও বিফলে গেছে। আলু-পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ ও শসা থেকে শুরু করে ছোলা, ডাল, চিনি ও দুধ পর্যন্ত এমন কোনো একটি পণ্যেও কথা বলা যাবে না যার দাম না বেড়েছে। শুধু বাড়েইনি, বেড়েছেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। একযোগে বেড়ে চলেছে প্রতিটি সবজির দাম। ৪০/৫০ টাকা কেজির নিচে কোনো সবজিই পাওয়া যাচ্ছে না। টমেটো,  লাউ, বরবটি ও পেঁপে থেকে গাজর, পটল ও বেগুন পর্যন্ত সব সবজিরই দাম বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এখনও দাম শুধু বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে যেন বাজারে আগুন তো লেগেছেই, সব পণ্যের দামও আকাশের দিকে ধেয়ে চলেছে। হয়ে উঠেছে আকাশচুম্বী। রমযানের মধ্যে কোনো পণ্যের দামই যে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে না সে সম্পর্কে অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে সুকৌশলে আগেই জানান দেয়া হয়েছিল। রমযান এগিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছিল ব্যবসায়ীদের ধমক দেয়ার ও হুঁশিয়ার করার পালা। মন্ত্রীরা তো বটেই, ডিএমপির কমিশনার পর্যন্ত অনেকেই ব্যবসায়ীদের ধমক দিয়েছেন, সতর্ক করেছেন এবং ভয়-ভীতি দেখিয়েছেন। অন্যদিকে মন্ত্রী ও কর্তা ব্যক্তিরা যখন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে শুরু করেছিলেন তখনই সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। কারণ তারও আগে তারা আম ও লিচুসহ বিভিন্ন ফলের ভেতরে ফরমালিন অনুসন্ধানের নামে রাজধানীর আটটি প্রবেশমুখে অভিযান শুরু করেছিলেন। এসব অভিযানের উদ্দেশ্য আজকাল শিশু-কিশোররাও বোঝে! পুলিশকে দিয়ে সরকারও বুঝিয়ে ছেড়েছে। কারণ, আম ও লিচুর সঙ্গে সবজিকেও টার্গেট বানানো হয়েছিল অনতিবিলম্বে। এখানেই ‘আকেলমন্দদের’ জন্য ‘ইশারা’ ছিল ক্ষমতাসীনদের। তারা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ফরমালিন খোঁজার অভিযান এমনভাবেই চালানো হবে যাতে কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর পক্ষেই পণ্যের দাম কমানোর কথা চিন্তা করাও সম্ভব না হয়। এই একটি বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনায় কোনো নড়চড় হয়নি। আসলেও জনগণকে তারা স্বস্তি ও শান্তিতে থাকতে দেননি। পকেট তো কেটেছেনই, তাদের জিহ্বাও বের করিয়ে ছেড়েছেন।
শুধু পণ্যমূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, অন্য কিছু বিশেষ কারণেও জনগণের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে সরকারের সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ছিনতাই-চাঁদাবাজির কথাই ধরা যাক। মন্ত্রী ও পুলিশের বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা যখন কারওয়ানবাজার, চকবাজার, আমিনবাজার ও হাতিরপুলসহ বিভিন্ন বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ব্যবসায়ীদের বলেছেন ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তখনও কাউকেই পাত্তা দেয়নি চাঁদাবাজ-ছিনতাইকারীরা। ইস্কাটন ও উত্তরাসহ খোদ রাজধানীতেই অন্তত অর্ধডজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ছিনতাইকারীদের ছোঁড়া গুলী হজম করতে হয়েছে। ওদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের বদৌলতে র‌্যাবের ‘সুনাম’ এমন পর্যায়ে নেমে এসেছে যখন চাঁদাবাজ-ছিনতাইকারীরা র‌্যাবের প্রহরাকে সামান্য তোয়াক্কা করছে না। বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা তো বটেই, ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজদের ভয়ংকর দৌরাত্ম্যের মুখে অসহায় হয়ে পড়েছেন এমনকি পাড়া-মহল্লার ক্ষুদে ব্যবসায়ীরাও। রাজধানীর কিছু এলাকায় চাকরিজীবীদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করছে গু-া-সন্ত্রাসীরা। কিন্তু কোনো একটি ক্ষেত্রেই সরকারের তৎপরতা চোখে পড়ছে না। অনেকে এমনকি ক্ষমতাসীন নেতাদের দিকেও আঙুল তুলেছেন। তারা মনে করেন, ক্ষমতাসীনদের মদদ ও যোগসাজশ না থাকলে কোনো গোষ্ঠীর পক্ষেই এভাবে ছিনতাই-চাঁদাবাজি করতে পারার কথা নয়। তারা নিশ্চয়ই পুলিশের সঙ্গে ‘রফা’ করে নিয়েছে। চাঁদার ‘ভাগ’ চলে যাচ্ছে বিশেষ কিছু নেতা ও কর্মকর্তার পকেটেও। অর্থাৎ একটা সামগ্রিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চলছে বলেই ছিনতাই-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সরকার শুধু নয়, র‌্যাব ও পুলিশও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে ছিনতাই-চাঁদাবাজি তো বাড়ছেই, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাজধানীর অলিতে-গলিতে পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ধুম পড়ে গেছে। কিন্তু এ ব্যাপারেও সরকার প্রশ্নসাপেক্ষ অবস্থানই বজায় রেখেছে। ছিনতাই প্রতিরোধে তাই র‌্যাব ও পুলিশকেও তৎপর দেখা যাচ্ছে না।
বস্তুত সব মিলিয়েই পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অবস্থা এমন হয়েছে যখন একে কেবলই সরকারের ব্যর্থতা বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ, এটা আসলেও সরকারের ব্যর্থতা নাকি পর্দার অন্তরালে পুলিশ ও র‌্যাবের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলেই পণ্যমূল্যের চাপে জনগণের জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে, তাদের জীবনও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে- এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর কিন্তু সরকারের পক্ষে যাবে না।    কারণ, পণ্যের দাম কিংবা ছিনতাই-চাঁদাবাজি শুধু নয়, খুন ও গুমের মতো ভয়ংকর অপরাধও বেড়ে আসছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। কিন্তু কোনো পর্যায়েই ধমক দেয়ার এবং লম্বা আশ্বাস শোনানোর বাইরে সরকার ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠার পরও সরকারকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নিÑ যেমনটা বর্তমান সময়েও দেখা যাচ্ছে না। এজন্যই বাজারে আগুন লাগতে পেরেছে, মানুষকেও থাকতে হচ্ছে ভীতি-আতংকের মধ্যে। আমরা মনে করি, সরকারের অন্তত পণ্যমূল্য এবং ছিনতাই-চাঁদাবাজির মতো বিষয়গুলোতে এখনই মনোযোগ দেয়া এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads