সোমবার, ২৫ জুন, ২০১২

ক্ষমতা সরকারকে অহঙ্কারী করেছে : অহঙ্কার পতনের মূল



শুভবুদ্ধির উদয়কে মনীষীরা তুলনা করেছেন তমসাবৃত রজনীর পর সকালের ঝলমলে সূর্যোদয়ের সঙ্গে। আমাদের শাসকরা জাতির ভাগ্যাকাশ থেকে সেই সৌন্দর্য উধাও করেছেন বহু আগে। বিগত সাড়ে তিন বছরে দেশের মানুষ সাড়ে তিনটি দিনও শঙ্কামুক্ত থাকতে পারেনি। তাদের চারদিকে ক্ষমতাসীনদের অপ্রতিরোধ্য দাম্ভিক তাণ্ডব তছনছ করে দিয়েছে অনেক কিছু। আর সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত নিক্ষিপ্ত হয়েছে হতাশায়, ভীতি আর আতঙ্কে। এ নিয়ে মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন হয়েছে বিস্তর। লেখালেখির তো অন্ত নেই! কিন্তু ক্ষমতার দর্পে অন্ধ শাসকগোষ্ঠী সেসবকে সামান্য পাত্তা দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি। তারপরও সূর্য ওঠে, পাখি ডাকে, ফুল ফোটে। এমনি ভালো কিছুর আভাস পাওয়া গেল গত পরশুর জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রদত্ত মহাজোট সরকারের এমপি সাহেবদের বক্তৃতা থেকে। অনেক দেরিতে হলেও তারা অবশেষে অনুধাবন করার সময় পেয়েছেন যে, ক্ষমতা তাদের অহঙ্কারী করেছে। দাম্ভিক করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে করেছে অন্ধ। আর এই ফাঁকে তাদের অন্যায্য কর্মের ছায়ায় বসে সরকারি কর্মকর্তারা জাঁকিয়ে রাজনীতি করছেন। দেরিতে হলেও তরী ডুবে যাওয়ার আগে যে তাদের মধ্যে এই শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, সেজন্য ধন্যবাদ জানাতে হয়।
মহাজোট সরকারের সংসদ সদস্যরা যেসব কথা বলেছেন তার সারাংশ হলো, ক্ষমতা তাদের অহঙ্কারী করে তুলেছে। এই অহঙ্কারই তাদের পতন ডেকে আনবে। দেশের আইন, থানা ও পুলিশ বিত্তশালীনির্ভর হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য আইন অধরা। পুলিশ বিত্তের মোহে জড়িয়ে পড়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেদার রাজনীতি করছেন; কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা তাদের কিছু বলতে পারছেন না। যোগাযোগ ব্যবস্থা বেহাল। তারা একটা রাস্তাও করতে পারেনি সাড়ে তিন বছরে। এই সরকার একটা ফুটপাতও পরিষ্কার করতে পারে না। দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা পুলিশের প্রয়োজন নেই। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণহীন। এরকম আরও অনেক কথা। এখন দেখার বিষয়, এই সত্য উচ্চারণ করার জন্য তৌফিক-ইমামের মতো উপদেষ্টারা তাদের ঘরভেদী বিভীষণ কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী বিশেষণে বিভূষিত করে কি-না। যদিও মূল সত্য এর চেয়ে শতগুণ কালিমামলিন। তারপরও কূলকিনারা হারিয়ে ফেলা একটি সরকারের অংশ হয়েও তারা পর্দা সরিয়ে রঙ্গমঞ্চের খানিকটা দেখার সুযোগ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এর ভেতর দিয়ে সরকারের দিশাহীনতা, অযোগ্যতা, অদক্ষতার পাশাপাশি বাইরে বেরিয়ে এসেছে তাদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও সঙ্কট।
নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের কাজে আইন, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও পুলিশকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে এই সরকার জাতীয় জীবনে ডেকে এনেছে ভয়াবহ বিপর্যয়। জনজীবন থেকে উধাও করেছে নিরাপত্তা। গুম, খুন, হাইজ্যাকিং, চাঁদাবাজি, জমি দখল, বাড়ি দখল, নদী দখল—এসব শাসক দলের নৈমিত্তিক কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নয়—আপাদমস্তক দেশকে ডুবিয়ে দিয়েছে সরকার। নিজেদের নির্বাচনী ওয়াদা শিকায় তুলে দুর্নীতিতে মনপ্রাণ ঢেলে দেয়ার ফলে তাদের অঙ্গদলের ক্যাডার ও নেতাকর্মীদের হাতে জেলা প্রশাসক, বিচারক থেকে শুরু করে ওসি-কনস্টেবলরা পর্যন্ত প্রতিনিয়ত হচ্ছেন লাঞ্ছিত। সাধারণ মানুষ তো আরও বিপদে। বিরোধী দল ও সংবাদপত্র দলনে চলছে মহোত্সব। পানি, বিদ্যুত্, গ্যাস, দ্রব্যমূল্য—এগুলো নিয়ন্ত্রণের কোথাও কেউ নেই। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে গেছে। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরোপুরি বিপন্ন। শুকিয়ে যাচ্ছে সমাজজীবন। শুধু মোটাতাজা হচ্ছে শাসক দলের নেতাকর্মীরা। ডাণ্ডা দিয়ে সবকিছু ঠাণ্ডা করার নোংরা মানসিকতার বিস্তারের ফলে সরকারি কর্মকর্তারা মাথায় উঠেছে। তারাও আজ কে কত বড় বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, তা প্রমাণের জন্য ব্যাকুল। তাছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তাদের মাধ্যমে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। উন্মাদ দলীয়করণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সেসব উপকারী শ্রেণী তো সরকারের পিঠে চাপবেই। কিন্তু রক্তকরবীর আত্মবিমোহিত রাজার মতো মহাজোট সরকার মত্ত হয়ে আছে লুণ্ঠনে। ক্ষমতা কত প্রকার ও কী কী, সেসব সবিস্তারে দেখানোর ক্ষেত্রে তাদের জুড়ি বিশ্ব চরাচরে মিলবে না।
সবকিছুরই একটা শেষ আছে। ক্ষমতার দাপট দিয়ে একটা সময় পর্যন্ত টিকে থাকা যায়। তারপর ধস নামতে থাকে। সেই ধস ডেকে আনে পতন। এর উদাহরণ আমাদের ধারে-কাছেই অজস্র। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। সেজন্য সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা, যাদের মধ্যে কিঞ্চিত শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, তাদের কথায় কান দিন। নিজেদের শুধরে নিন। এখনও হাতে দেড় বছর সময়। নইলে পরে পস্তাবেন। কারণ যে গতিতে এই সরকার অধঃপতিত হচ্ছে, তার শেষ অসম্মানে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads