বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

পুলিশের এ আচরণ বদলাতে হবে!



অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
সর্বত্রই নতুন করে আলোচিত হচ্ছে পুলিশের এহেন আচরণ নিয়ে। সে কারণে পুলিশ কর্তৃক সংঘটিত সাম্প্রতিক বীভত্স আরও কিছু ঘটনা আমি পাঠকের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করতে চাই। জানি, এতে তাদের আচরণের ওপর বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়বে না। তবুও বিবেকের তাড়না থেকে স্মরণ করছি।
খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের বেধড়ক পিটুনি খেয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে তিন সাংবাদিককে। বিচার চাইতে আদালত প্রাঙ্গণে যেতেই পুলিশের নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে এক তরুণীকে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে সাংবাদিকদের ‘পরামর্শ’ দিতে হয়েছে পুলিশের কাছ থেকে ‘নিরাপদ দূরত্ব’ বজায় রেখে সংবাদ সংগ্রহ করতে। একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে পরিস্থিতির কতটা অবনতি ঘটলে একজন প্রতিমন্ত্রীকে এ রকম পরামর্শ দিতে হয়, সে কথা বলাই বাহুল্য।
এবার নরসিংদীতে আদালত প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে পুলিশ কর্তৃক বিচারক লাঞ্ছিত হয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গত রোববার নরসিংদী আদালতে চাঞ্চল্যকর পৌর মেয়র লোকমান হত্যা মামলার আসামিদের হাজিরা ছিল। এজন্য আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এরই অংশ হিসেবে আদালতের মূল ফটকে সবাইকে পুলিশি তল্লাশি করে আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করানো হয়। সকাল সোয়া ৯টার দিকে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ-২ মো. ইমান আলী শেখ রিকশায় করে আদালতের মূল ফটকের সামনে আসেন। আদালতের ভেতরে রিকশা ঢুকতে না দেয়ায় সাব গেট দিয়ে হেঁটে প্রবেশ করতেই হাতে থাকা ব্যাগটি তল্লাশি করতে চায় পুলিশ। এ সময় তিনি নিজেকে বিচারক হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু পুলিশ বিচারকের পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে পুনরায় তিনি ইতস্ততবোধ করেন এবং পরিচয়পত্র না দেখিয়ে আবারও বিচারক হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই পুলিশ সদস্যরা শত শত মানুষের সামনে তাকে পরিচয়পত্র ছাড়া প্রবেশ করতে না দিলে তিনি বাধ্য হয়ে পরিচয়পত্র ব্যাগ থেকে বের করার সময়ই অন্য পুলিশ এসে (এখানে তর্ক হচ্ছে কেন বলে) বিচারককে হেলমেট দিয়ে আঘাত করে। এ সময় অভিযুক্ত ওই পুলিশদের সঙ্গে ডিউটিতে থাকা অজ্ঞাত আরও ৭/৮ জন পুলিশ বিচারকের গায়ে হাত তোলে।
বাবাকে নিয়ে ২৯ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে এসেছিলেন এক তরুণী। সেখানে মোটরসাইকেল আদালতে ঢোকা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তর্কবিতর্ক হয় মেয়েটির বাবার। ব্যস, আর যায় কোথায়! মহাপরাক্রমশালী পুলিশের কোতোয়ালী থানার দুই এসআই জামান ও জাহাঙ্গীর মেয়েটিকে টেনে নিয়ে যায় আদালতসংলগ্ন পুলিশ ক্লাবে। তারা মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে অশ্লীল আচরণ করতে থাকে। মেয়ের অপমানে ক্ষুব্ধ পিতা প্রতিবাদ করলে তাকে পেটাতে শুরু করে পুলিশ। এর মধ্যে চারদিকে অনেক লোক জড়ো হয়ে যায়। খবর পেয়ে সাকিব ও রাজু নামের দুই আইনজীবী পুলিশ ক্লাবটিতে গেলে তাদেরও লাঠিপেটা করে পুলিশ। এ ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের বেদম পিটুনি খান তিন সাংবাদিক—প্রথম আলোর প্রশান্ত কর্মকার, কালেরকণ্ঠের এমএ জলিল ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের তুহিন হাওলাদার।
সাহারা খাতুনের পুলিশ গত মাসের ২৬ তারিখে রোকেয়া সরণিতে পলিটেকনিকের ছাত্রীদের অবরোধের ছবি তোলার সময় একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ প্রথম আলোর তিন ফটো সাংবাদিককে বেধড়ক লাঠিপেটা করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। পেটানোর সময় অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার চিত্কার করে বলেছে, পেটা শালাদের, ওরাই যত নষ্টের গোড়া, এ দেশে সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না। পুলিশ কর্মকর্তার দাবির পেছনে যুক্তি আছে। সত্যিই তো, ঘরে ঢুকে সাংবাদিক খুন করলে যে দেশে কিছু হয় না, সেখানে যত্সামান্য পিটুনি তো নস্যি!
আমরা সবাই জানি, জনগণের অর্থেই লালিত-পালিত হয় পুলিশ এবং পুলিশের সমস্ত ব্যয় জনগণের অর্থেই মেটানো হয়ে থাকে। ফলে মানুষের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদেরই। অথচ রাষ্ট্রের পুলিশ জনগণের পক্ষে নয়। সম্পূূর্ণ বিপরীতমুখী ভূমিকা পালন করে থাকে। কেবল ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর পক্ষে এবং তাদেরই পেটোয়া মাস্তানরূপে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করে আসছে। যারা সমাজে আইনের প্রয়োগ ঘটাবে, তারা নিজেরাই যদি আইন না মানে তবে সমাজে আইনের শাসন নয় বরং বেআইনি শাসন প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় যেমন রোগ নিরাময়ের পূর্বশর্ত, তেমনি পুলিশের এই বেপরোয়া আচরণের যৌক্তিক কারণ খুঁজে বের করা এ থেকে উত্তরণের প্রধান উপায়। ক্ষমতায় থাকাকালে প্রত্যেক সরকারই মনে করে পুলিশ দিয়ে বিরোধী দল পেটানোর জন্য পুলিশকে অখুশি করা যাবে না। আর এ ফাঁকে পুলিশ আদায় করে নেয় গাড়ি, বাড়ি, জমি ইত্যাদি। কিন্তু তারাই যখন বিরোধী দলে যায়, তখন উল্টো পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়।
seraj.pramanik@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads