শুক্রবার, ২২ জুন, ২০১২

সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগের পর বিচারপতির উচিত আর আসনে না বসা




সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠার পর বিচার বিভাগের মর্যাদার প্রতি সম্মান দেখিয়ে উচিত আর আসনে না বসা। সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে সাধারণ অভিযোগ উঠলেও তদন্তকাল পর্যন্ত সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। খোদ জাতীয় সংসদে স্পিকার রুলিংয়ের মাধ্যমে একজন বিচারপতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। জাতীয় সংসদে স্পিকারের এ রুলিংয়ের পর বিচারবিভাগের প্রতি সম্মান দেখিয়ে উচিত ছিল ওই বিচারপতির আর আসনে না বসা। এখন প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে একটি সম্মানজনক ফয়সালা না করলে একজন বিতর্কিত বিচারপতির জন্য পুরো বিচারবিভাগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। যা বিচারব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘনের পর বিষয়টি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে না পাঠালে মানুষের এ বিচার বিভাগের ওপর আর কোনো আস্থাই থাকবে না। বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যের কোটায় নেমে এলে দেশে অরাজকতা অনিবার্য হয়ে উঠবে। এর দায় নিতে হবে প্রধান বিচারপতিকে। কারণ স্পিকার রুলিংয়ের মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বিষয়টি প্রধান বিচারপতির এখতিয়ারে দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির এখন কী করতে হবে সেটা সংবিধানেই বলে দেয়া আছে।
গতকাল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার নিজ বাসভবনে দৈনিক আমার দেশ-কে দেয়া একান্ত সাক্ষাত্কারে তিনি এসব কথা বলেন। পরপর দুইবার নির্বাচিত সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আইনজ্ঞ খন্দকার মাহবুব হোসেন এই সাক্ষাত্কারে বিচারবিভাগ নিয়ে তার অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাত্কারের বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেয়া হলো-
প্রশ্ন : বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন বলে জাতীয় সংসদে রুলিং দিয়েছেন স্পিকার। একজন প্রবীণ আইনজীবী হিসেবে এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : স্পিকার রুলিং দিয়ে একজন বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি প্রধান বিচারপতির ওপর ন্যস্ত করেছেন স্পিকার। এখন প্রধান বিচারপতি কী সিদ্ধান্ত নেন সেটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে পুরো জাতি। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় ওই বিচারপতি শুধু জাতীয় সংসদের স্পিকার সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন তা নয়। তিনি বহু সম্মানিত ব্যক্তিদের তলব করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়েছেন। এতেও বিচারকদের জন্য যে আচরণ বিধি রয়েছে তা লঙ্ঘিত হয়েছে। বহু ব্যক্তিকে গালাগাল দিয়ে তিনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। কারণ বিচারকদের জন্য যে আচরণ বিধিটি রয়েছে তাতে স্পস্ট করেই বলে দেয়া আছে বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমনকি বিচারকাজে নিয়োজিত সহকর্মীদেরও কটাক্ষ করে কিছু বলা যাবে না। কিন্তু ওই বিচারপতি এ আচরণবিধিটির কোনো তোয়াক্কাই করেননি।
প্রশ্ন : প্রধান বিচারপতির এখন এখতিয়ারে কী রয়েছে? এমন কোনো বিধান কী রয়েছে প্রধান বিচারপতি যা প্রয়োগ করার এখতিয়ার রাখেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার সংবিধানেই বলে দিয়েছে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে করণীয় কী। যেহেতু জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্ত একজন বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন তখন প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদটি প্রয়োগ করা। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদেই বলে দেয়া আছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সদস্য কারা। এখন প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার হচ্ছে বিষয়টি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে উপস্থাপন করা। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত জানাবে।
প্রশ্ন : সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সদস্য কারা?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : প্রধান বিচারপতি ও কর্মে প্রবীণ অপর দুইজন বিচারপতিকে নিয়ে সংবিধানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত রয়েছে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের কোনো বিষয় নেই। যে কোনো বিষয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান বিচারপতি। বর্তমানে সৃষ্ট ঘটনায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে একটি সম্মানজনক ফয়সালা না হলে সম্পূর্ণ দায়ভার প্রধান বিচারপতিকেই বহন করতে হবে। বিরূপ প্রভাব পড়বে পুরো বিচার বিভাগের ওপর।
প্রশ্ন : সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের জন্য একটি আচরণবিধি রয়েছে। একজন প্রবীণ আইনজীবী হিসেবে আপনি কী মনে করে বিচারকরা আচরণ বিধি পুরোপুরি মেনে চলছে?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের জন্য যে আচরণবিধি রয়েছে কোনো কোনো বিচারপতি সেটার তোয়াক্কা করছেন না। নিজেদের খেয়াল খুশিমত ভিন্ন ভিন্ন আচরণ ও মন্তব্যের মাধ্যমে শুধু বিচারপ্রার্থী জনগণ নন পুরো জাতির কাছে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নম্ন করছেন। একজন বিচারক মহান দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। মানুষের সর্বশেষ আশা-আকাঙ্ক্ষা ন্যায়বিচার প্রাপ্তির শেষ ঠিকানা হচ্ছে সুপ্রিমকোর্ট। সেখানে কোনো বিচারকের আচরণ ও অবাঞ্ছিত মন্তব্যের কারণে কারও মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিলে আর কোনো জায়গা থাকে না। মানুষের আস্থা ধরে রাখার দায়িত্ব হচ্ছে বিচারপতিদের। তারা নিজেদের আচরণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এটা ধরে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইদানীং কোনো কোনো বিচারপতি এসবের কোনোই তোয়াক্কা করছেন না। তারা নিজেদের জন্য তৈরি আচরণবিধিটা মানেন না। খেয়াল খুশিমত মন্তব্য করছেন। যখন যাকে যে কোনো উছিলায় তলব করছেন। দেশের জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে রাস্তার ট্রাফিকও বাদ যাচ্ছে না। কোনো কোনো বিচারকের এই আচরণ পুরো বিচারবিভাগের মর্যাদাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
প্রশ্ন : আপনি কী তাহলে বলতে চাচ্ছেন বিচারকদের অসদাচরণের বিরুদ্ধে বিধি-বিধান রয়েছে। এসব বিধি-বিধান প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
খন্দকার মাহবুব হোসেন : হ্যাঁ, আমি সেটাই বলতে চাচ্ছি। একজন বিচারক শপথ গ্রহণের পর দেশের আইনের প্রতি বিশেষ করে সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন। আইন অনুযায়ী বিচার করবেন সেটাই বিধান। বিচারকরা আইন ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন। সে ক্ষেত্রে যদি দেখা যায় বিচারক আসনে বসে সংবিধান লঙ্ঘন করে এমন মন্তব্য করেন যা সংবিধান পরিপন্থী, এমনকি সংবিধান তাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে তাও তিনি লঙ্ঘন করছেন। অথচ আচরণ বিধি লঙ্ঘন করলে তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য সংবিধানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে দেয়া আছে। এই বিধান থাকা সত্ত্বেও তা প্রয়োগ করা হচ্ছে না। কোনো কোনো বিচারক বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘনের পরও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখছে না।
প্রশ্ন : আপনি নিজেই অসংখ্য বক্তৃতায় বলেছেন, বিচারবিভাগ দলীয়করণ করা হয়েছে। কীভাবে দলীয়করণ হলো সেটা খোলামেলা বলবেন কী?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : বিচারবিভাগ দলীয়করণের অভিযোগটি একেবারে সত্য। নগ্ন দলীয়করণের প্রচেষ্টা মানুষের সামনে একেবারেই স্পস্ট হয়ে গেছে। দলীয় বিবেচনায় ঢালাওভাবে বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কারণ দলীয় আজ্ঞাবহ লোক ছাড়া কাউকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। অসংখ্য দক্ষ আইনজীবী থাকা সত্ত্বেও দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। আমাদের সংবিধানে একটি বিধান রয়েছে আইন পেশায় দশ বছর হলে অথবা নিম্নম্ন আদালতে দশ বছর বিচারকাজে নিয়োজিত থাকলে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। এর বাইরে কোনো নীতিমালা নেই। একটি নীতিমালা করার জন্য দীর্ঘদিন থেকে দাবি রয়েছে। বর্তমান আইনমন্ত্রী যখন সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন তখন তিনি নিজেও বারবার নীতিমালার কথা বলতেন। আইনমন্ত্রী হয়েও তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন নীতিমালা করা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই নীতিমালা হয়নি। নীতিমালা ছাড়াই প্রায় ৬০ জন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব নিয়োগ হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য যে রকম ভাবমূর্তি ও দক্ষতা দরকার সেদিকে বিবেচনাই করা হচ্ছে না।
প্রশ্ন : বিচারবিভাগ নিয়ে বিতর্ক চলছে দীর্ঘদিন থেকেই। সত্ দক্ষ বিচারক নিয়োগের জন্য কী করা দরকার?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : বিচারবিভাগ হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম স্তম্ভ। দেশের সংবিধানের রক্ষক বিচারবিভাগকে সব রকমের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা না গেলে দেশে গণতন্ত্র, মানুষের মৌলিক অধিকার কিছুই থাকবে না। বরং মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের বিচারবিভাগ গত কিছুদিন ধরে অত্যন্ত বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। কেননা দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেখানে দক্ষ, নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত বিচারক নিয়োগের কথা সেটাও কঠিনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই বিতর্ক থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বিচারক নিয়োগের জন্য অচিরেই একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নীতিমালা করা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে নিয়োগ প্রক্রিয়া ও কোনো কোনো বিচারকের আচার আচরণ শুধু উচ্চ আদালতকে বিতর্কিতই করেনি। বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির বিষয়টিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বিচারপ্রার্থীরা সব সময় একটি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন। আমরা আশা করব দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে প্রতিষ্ঠা করতে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে উচ্চ আদালতকে নিয়ে কেউ আর ছিনিমিনি খেলবেন না। এরই মধ্যে যে বিতর্ক উঠেছে তা নিরসনের জন্য প্রধান বিচারপতি দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন। বিচারপ্রার্থী মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিচারবিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে প্রধান বিচারপতি স্পিকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ত্বরিত পদক্ষেপ নেবেন সেটাই এখন সবার প্রত্যাশা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads