রবিবার, ১০ জুন, ২০১২

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিকল্প নেই : আর কত ছলচাতুরী



তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিরোধী দলের ৯০ দিনের আলটিমেটাম শেষে আজ রাজধানীতে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই ইস্যুতে সরকারের অনড় ভূমিকা দেশবাসীর মনে কী গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে সেটা পথে-ঘাটে কান পাতলেই শোনা যায়। শেষপর্যন্ত কী হবে, কী হতে যাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত—এ প্রশ্ন এখন সর্বত্রই।
সর্বগ্রাসী অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটে জর্জরিত সাধারণ মানুষ নতুন করে কোনো সঙ্কট চায় না। তাই রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার পক্ষে বেশিরভাগ মানুষ। কট্টরপন্থী ছাড়া সরকার সমর্থকদের মধ্যেও এ ব্যাপারে নমনীয়তা লক্ষ করা যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এক কথা, ‘সরকার কোনোভাবেই কোনো অনির্বাচিত সরকার বা তৃতীয় শক্তির হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে না। আলোচনা হতে পারে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে।’ তড়িঘড়ি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি কেন জরুরি হয়ে উঠেছিল সেটা প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান ভূমিকা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। এজন্য উচ্চ আদালতের রায়ের একটি অংশের ভিত্তিতে যেভাবে বিরোধী দলবিহীন সংসদে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে সে নিয়ে বিতর্ক থামছে না। এই রায় প্রদানকারী সাবেক প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক মন্তব্য এখন বিতর্কটিকে আরও জোরালো ও যৌক্তিক করেছে।
তিনি পরিষ্কারভাবেই বলেছেন, ‘আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার যে কথা আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছিল, সেটা সুপ্রিমকোর্টের আদেশ। এটি কোনো পর্যবেক্ষণ নয়। জনগণের প্রত্যাশার কথা বিবেচনা করেই পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছে।’ অথচ সরকার পূর্ণ রায় আসার আগেই সংক্ষিপ্ত আদেশের এই অংশটি আদালতের পর্যবেক্ষণ হিসেবে তুলে ধরেছিল এবং এই অপব্যাখ্যার ভিত্তিতেই জাতীয় সংসদে তড়িঘড়ি সংবিধান সংশোধন ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে। এখন এই ভুল সংশোধন করে রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের পথ সৃষ্টি করার দায়িত্ব যে সরকারেরই সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু সরকার সে পথ এড়িয়ে নানাভাবে পানি ঘোলা করছে। সুযোগ পেলেই প্রধানমন্ত্রী বিগত জরুরি অবস্থার দু’বছরের সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তুলে ধরে এই দানবের পুনরায় ফিরে আসার বিপদের কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন। সে সরকার যে মোটেই সংবিধানসম্মত ছিল না এই ঐতিহাসিক সত্যও তিনি ভুলে গেছেন। তার আগে আওয়ামী লীগ দু’বার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। বলতে গেলে তাদের দাবিতেই এ ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই। সর্বশেষ ২০০৬ সালেও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নির্বাচনে তারা অংশ নিয়ে প্রার্থী মনোনয়নও চূড়ান্ত করেছিল। কিন্তু জেনারেল এরশাদের মনোনয়নপত্র বাতিল হলে সবকিছু পাল্টে যায়। মুখে অবশ্য ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটারের অভিযোগ তোলা হয় বিরোধী আওয়ামী জোটের পক্ষ থেকে। কিন্তু এর পেছনেও তাদের হাত ছিল। তত্কালীন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নতুন ভোটার তালিকা তৈরির বিরোধিতা করে তারাই হালনাগাদের দাবিতে হাইকোর্টে আবেদন করেছিল। আবার কিছুদিন পরই এই হালনাগাদ ভোটার তালিকার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিল তারা। এখানেই শেষ নয়। মজার ব্যাপার হলো, এরপর জরুরি অবস্থা জারি করে ক্ষমতাসীন সেনাসমর্থিত সরকার ও তাদের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করতে যেয়ে যে পরিস্থিতির জন্ম হয়, আওয়ামী লীগকে তার বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি। দুই বছরের এই অসাংবিধানিক সরকারকে যে তারা নিজেদের আন্দোলনের ফসল বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল সেটা মানুষ এখনও ভুলে যায়নি। আজকে যাকে দানব বলা হচ্ছে, তার ক্ষমতায় আসার পথ আওয়ামী লীগই তৈরি করেছিল। সেটা কোনোভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। এই সরকারের অপকর্মের দায়ভার অন্য কারও ওপর চাপানোর সুযোগ নেই।
গায়ের জোরে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে সরকার যে সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে তা দূর করতে এখন সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতায় কেউই পিছিয়ে থাকবে না। বিরোধী দলও সংলাপে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু সরকার অপব্যাখ্যা, অপপ্রচার চালিয়ে শুধু পরিস্থিতি জটিলই করছে না, বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চরম দমনপীড়ন চালাচ্ছে। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার করে পানি ঘোলা করছে। এভাবে সরকারই গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার পথে বাধার প্রাচীর গড়ে তুলছে। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট যেভাবে গভীর হয়ে উঠছে, তার দায় শেষ পর্যন্ত সরকারকেই বহন করতে হবে। আমরা যে কোনো মূল্যে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার পক্ষপাতী। এ জন্য অবশ্যই উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। যত দ্রুত এ পদক্ষেপ নেয়া হবে, দেশ ও জনগণের জন্য সেটা ততই মঙ্গলজনক হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads