সোমবার, ১৮ জুন, ২০১২

তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করে খায়রুল হকের লেখা রায় প্রসঙ্গে টিএইচ খান : অবসরে যাওয়ার পর লেখা রায় বৈধ নয়



সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠতম আইনজীবী সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান বলেছেন, চাকরির মেয়াদ শেষে অবসরে যাওয়ার পর কোনো বিচারপতির রায় লেখা বা রায়ে স্বাক্ষর করার আইনগত এখতিয়ার ও ভিত্তি নেই। তিনি বলেন, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরের ১৩ মাস পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেয়া রায় লিখেছেন বলে যে মন্তব্য করেছেন তা খুবই দুঃখজনক। অবসরে যাওয়ার পর তিনি এই রায় লেখার এখতিয়ার রাখেন না। তার লেখা রায়ের সঙ্গে অন্য বিচারপতিরা একমত বা স্বাক্ষর করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। কারণ, তিনি অবসরে চলে গেছেন এক বছরেরও বেশি সময় আগে। অবসরে যাওয়ার পর খায়রুল হক একজন সাধারণ নাগরিকে পরিণত হয়েছেন। গতকাল সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে আপিল বিভাগের রায় দেয়া হয়েছিল ২০১১ সালের ২ মে। এ রায়ের আলোকে ২০১১ সালের জুন মাসে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মুছে ফেলা হয়েছে। অথচ গত ২৯ মার্চ বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রায় লিখে সুপ্রিমকোর্টে জমা দিয়েছেন। রায়টি ঘোষণার ১৫ দিনের মাথায় ২০১১ সালের ১৭ মে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরে যান। এখনও এ মামলার লিখিত রায় প্রকাশ হয়নি। এরই মধ্যে গতকাল বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক গত ২৯ মার্চ রায় লেখা শেষ করে আপিল বিভাগে জমা দিয়েছেন। এখনও রায়টি প্রকাশিত না হওয়ায় তিনি বিস্মিত হয়েছেন বলে প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে গতকাল সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান সাংবাদিকদের বলেন, খায়রুল হকের এ বক্তব্যে আইনজীবী হিসেবে আমরা বিস্মিত হয়েছি। কারণ, সাংবিধানিক পদে যারা দায়িত্ব পালন করেন, পদে বসার আগে তাদের একটি শপথ নিতে হয়। দায়িত্ব পালনকালীন তারা শপথ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য। পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর আর শপথের বাধ্যবাধকতা থাকে না। অবসরে যাওয়ার পর সাধারণ নাগরিকের কাতারে চলে আসেন। শপথের আওতা থেকে বের হয়ে সাধারণ নাগরিকে পরিণত হওয়া কোনো ব্যক্তি রায় লিখতে পারেন না। বিচরপতি এবিএম খায়রুল হক যেদিন চাকরি থেকে অবসরে গেছেন সেদিন থেকে সাধারণ নাগরিক। তিনি আর শপথের মধ্যে নেই। এ অবস্থায় এক বছর ধরে নিজের মতো করে রায় লিখেছেন। এ রায় কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তার লেখা রায়ের সঙ্গে অন্য কোনো কর্মরত বিচারপতি একমত বা দ্বিমত করেও স্বাক্ষর দিতে পারেন না। বিচারপতি টিএইচ খান বলেন, আমাদের সংবিধান, আপিল বিভাগের রুলস কোথায়ও বলা নেই অবসরের পর বিচারপতিরা রায় লিখতে পারবেন এবং রায়ে স্বাক্ষর করতে পারবেন। অবসরের পর কেউ রায় লিখলে বা রায়ে স্বাক্ষর করলে সেটা বৈধ হবে না। তিনি বলেন, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবসরের পর ১৩ মাস ধরে রায় লিখলেন, রায়ের বিষয়বস্তু কী এখনও প্রকাশিত হলো না। অথচ তিনি বলে দিলেন রায়টি প্রকাশ হলে রাজনৈতিক বিতর্ক আর থাকবে না। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় খায়রুল হক সংক্ষিপ্ত একটি লিখিত আদেশের মাধ্যমে রায় ঘোষণা করেছিলেন। এতে বলা হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ রায় দেয়া হয়েছে। এতে বোঝা যায় আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতির কেউ কেউ ভিন্নমত দিয়েছিলেন। কী ছিল তাদের ভিন্নমত এবং কারা এ ভিন্নমত দিয়েছিলেন তা এখনও জানা যায়নি। তিনি বলেন, সবচেয়ে দুঃখজনক এবং লজ্জার বিষয় হলো, খায়রুল হকের বক্তব্য অনুযায়ী একটি রায় লিখতে এক বছর ২৫ দিন সময় লাগল।
বিচারপতি টিএইচ খান বলেন, খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত রয়েছে এমন কয়েকটি মামলা স্বউদ্যোগে শুনানির জন্য তালিকায় নিয়ে এলেন। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে হাইকোর্ট বিভাগে এর আগে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলটিও শুনানির জন্য তালিকায় আনা হলো। হাইকোর্ট বিভাগের ৩ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ বেঞ্চ রায় দিয়ে বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ এবং সংবিধানের সঙ্গে কোনো সাংঘর্ষিক বিষয় নয়। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে আরও বলা হয়েছিল, দেশের জন্য এটি একটি ভালো আইন এবং বৈধ একটি জাতীয় সংসদ এ আইন করার এখতিয়ার রয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে তখন আপিল করা হয়। বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর নিজের উদ্যোগে আপিলটি শুনানির জন্য তালিকায় নিয়ে আসেন এবং রায় ঘোষণা করেন। কিন্তু অবসরে যাওয়ার এক বছর পর রায় লিখে জমা দিলেন। এটা আইনসম্মত হতে পারে না। শপথের বাইরে চলে যাওয়ার পর তিনি নিজের মতো জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রায় লিখে দেবেন তা মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন, শুধু এ মামলাটি নয়, সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত আরও কয়েকটি মামলায় রায় দিয়েছিলেন। সেগুলো এখনও লেখা হয়নি। এর মধ্যে ফতোয়া বিষয়ক রায়টি অন্যতম। এটিরও রায় এখনও লেখা হয়নি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads