বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

সরকারের সাড়ে তিন বছর হতাশাই নিয়ে এসেছে - ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ



 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যদি পথ পরিবর্তন না করে, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে অনুকূল পদক্ষেপ না নেয় তাহলে ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কট দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রকট হয়ে উঠতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমিধস বিজয় নিয়ে যে আশা জাগিয়ে তুলেছিলেন তা এখন দুরাশায় পরিণত হয়েছে। তিনি পুনর্জাগরণের পরিবর্তে বিরোধী দলকে দমনের নীতি গ্রহণ করেছেন।  এ অবস্থায় যদি সেনাবাহিনী পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করে তাহলে তারা এবার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে পারে। ২০০৭ সালে তারা যেভাবে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিলেন, এবার তা সরাসরি করে বসতে পারেন। ব্রাসেলস ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ১৩ই জুনের রিপোর্টে এসব কথা বলেছে। ‘বাংলাদেশ: ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ শীর্ষক ওই রিপোর্টে বলা হয়- দু’ বছর সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারের অধীনে থাকার পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় পায়। এ নির্বাচনকে দেশের ইতিহাসে অধিক সুষ্ঠু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। দেশে-বিদেশে আশা করা হয়েছিল যে, এই জনরায় ব্যবহার করে শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনঃপ্রবর্তন করবেন। জাতীয় পুনর্জাগরণ ঘটাবেন। ইতি ঘটাবেন আওয়ামী লীগ ও তার প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মধ্যে বিদ্যমান শূন্য ফলাফলের রাজনীতি। সরকারের সাড়ে তিন বছর চলছে। কিন্তু আশার স্থানে ফিরে এসেছে গভীর হতাশা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য বহুল পরিচিত দু’টি হুমকি ফিরে এসেছে। তাহলো- নির্বাচন সম্পর্কিত সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে হুমকি বেড়ে ওঠার আশঙ্কা। পুরনো রাজনীতির গতিধারা পরিবর্তনের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ সরকার পর্যায়ক্রমিকভাবে ব্যবহার করছে জাতীয় সংসদ, নির্বাচনী বিভাগ ও আদালতকে। তারা বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করেছে। বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড দমিয়ে রাখতে মোতায়েন করছে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে। আওয়ামী লীগের প্রাধান্যযুক্ত জাতীয় সংসদে সংবিধানের ১৫ তম সংশোধনী। এটা বেশি উদ্বেগের। ওই বিধানে আগে সাধারণ নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা ছিল। যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের নির্বাচনী কারচুপি ঠেকানোর জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল একটি চর্চিত ও মানসিক স্বস্তির বিষয়। কিন্তু এই ব্যবস্থা বাতিল করায় বিরোধী দলের ভিতরে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ১৫তম সংশোধনীতে আরও ভয়ানক বিষয়বস্তু রয়েছে। যেমন, সংবিধানের সমালোচনা করলে যে কাউকে এখন রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচার করা যাবে। নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের জন্য শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। এটা সামরিক বাহিনীর জন্য একটি হালকা সতর্কবার্তা। কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশে ৪ বার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। এসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ফল কি হবে তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে সরকারকে বিএনপি আলটিমেটাম দিয়ে এ বছরের ১০ই জুনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে বলে। অন্যথায় তারা সরকারকে রাজপথের লড়াই মোকাবিলা করতে বলে। গত মার্চে বিএনপি ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশে ১ লাখ সমর্থক জড়ো করে, যা সহিংসতায় রূপ নেয়। এরই মধ্যে তাদের দেয়া আলটিমেটামের সময়সীমা পার হয়েছে। কিন্তু সরকার কোন পদক্ষেপ নেয় নি। ফলে বিএনপি এখন দেশজুড়ে রাজনৈতিক বিক্ষোভের আহ্বান জানাচ্ছে। তাদের ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচন বয়কটের বিষয়টি এখন ঘটনোন্মুখ। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনীতে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত ১৯শে জানুয়ারি তারা ঘোষণা করেছে যে, সেনাবাহিনীর মধ্যম স্তরের কিছু কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল। তারা সেই পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। বলা হয়েছে, অভিযুক্তরা ইসলামপন্থি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল। ২০০৯ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর মধ্য পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা জাতীয় সংসদের আওয়ামী লীগ দলীয় এক সদস্যকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। এর পরেই ওই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, আগের বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আধা সামরিক বাহিনী বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদস্যরা এক বিদ্রোহে ৫৭ জন কর্মকর্তাকে হত্যা করে। ব্যাপক হারে পদচ্যুতি, প্রেষণে অবসর গ্রহণ, রাজনীতিকরণ গভীর হওয়া ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের কঠোর হাতে দমন করা এবং জঙ্গিদের নির্র্মূল করায় সৃষ্টি হয়েছে এক অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল বাহিনী। সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদ থেকে অভ্যুত্থান হওয়ার আশঙ্কা কম হলেও মধ্য পর্যায়ের কর্মকর্তাদের চেপে রাখা ক্রোধ সহিংসতার দিকে যেতে পারে এমন আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। যদি পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যাতে সেনাবাহিনীকে ফের তাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়, তবে এবার তারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা করবে। ২০০৭ সালের মতো সামনে তদারক সরকার খাড়া করে কাজ চালাবে না। আগেরবার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এবার সরাসরি ‘মাইনাস টু’ করারই ব্যবস্থা হবে। যদি এমন দুরবস্থা ঘটে তাহলে এটা পরিষ্কার যে, নতুন যে নির্বাচনী অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে তাতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে আঘাত হানবে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads