বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০১৬

ইতিহাসের বার্তা কখনো ভুলতে নেই


অন্য বিষয়ে না হলেও একটি বিষয়ে মানুষের মধ্যে মিল রয়েছে। মানুষ কথা বলে। কখনো ঠিক কথা বলে, কখনো বলে ভুল কথা। মানুষ চাপে পড়েও কথা বলে, আবার কখনো-বা বলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এ কারণে মানুষের সব কথা সরলভাবে বিবেচনা করা যায় না। কথার মর্মকথা উপলব্ধি করতে হলে চিন্তাভাবনার যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনি কখনো কখনো প্রয়োজন হয় গবেষণারও। তাই কথা বলা সহজ হলেও বোঝার কাজটা সবসময় সহজ হয়ে ওঠে না। এরপরও মানুষের সমাজে কথা বলা চলতেই থাকবে এবং সেই কথা শোনার মতো মানুষেরও অভাব হবে না।
প্রসঙ্গত, হিন্দুস্তান টাইমস-এর একটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা যায়। গত ১৭ মার্চ নয়াদিল্লীতে বিশ্ব সুফি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আল্লাহর ৯৯টি নামের মধ্যে একটারও অর্থ হিংসা নয়। ইসলামের বৈচিত্র্য হলো ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অথচ বিজেপি সরকারের একাধিক মন্ত্রী বহুবার বলেছেন, ইসলাম মানেই সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘর। কেউ গরুর গোশত খেলে তিনি যেন পাকিস্তানে চলে যান- এমন হুমকিও এসেছে কারও কারও পক্ষ থেকে। তবে সম্মেলনে মোদি বললেন, ‘সন্ত্রাসের নানা উদ্দেশ্য থাকে। যার পেছনে কোনো যুক্তিই খাটে না। আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোনো বিশেষ ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয় কিন্তু। তা কখনো হতেই পারে না।’ সুুফি সম্মেলনে এসে সর্বধর্ম-সমন্বয় নিয়ে কথা বলেছেন মোদি। বলেছেন, ‘হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পারসি, আস্তিক, নাস্তিকসহ সকলেই ভারতের অংশ।’ এরপর পবিত্র কুরআনের প্রসঙ্গ টেনে এনে মোদি বলেছেন, ‘কুরআনে বলা হয়েছে, কেউ যদি একজন মানুষকে হত্যা করে, তাহলে তা গোটা মানবতাকে হত্যা করার শামিল।’ মোদির মতে, বর্তমান বিশ্বে মানবতাই সংকটের মুখে।
সুফি সম্মেলনে এসে নরেন্দ্র মোদি যে বক্তব্য পেশ করেছেন তা বেশ উদার। তবে তার সব বক্তব্যের সাথে সবাই যে একমত হবেন, তেমনটি না-ও হতে পারে। তবে ‘বর্তমান বিশ্বে মানবতাই সংকটের মুখে’, মোদির এই বক্তব্যের সাথে কারো দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। ফিলিস্তিনে, ইরাকে, আফগানিস্তানে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায় মানবতার সংকটের কথা আমরা জানি। তবে ভারতে এবং বিশেষ বিশেষ রাজ্যে কেন কী কারণে মানবতার সংকট চলছে, তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারেরই ভালো জানার কথা। এখন তারা মানবতার সংকট সমাধানে কী কী যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন- সেটাই দেখার বিষয়। তবে হিন্দুস্তান টাইমস-এর রিপোর্টে শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, গরুর গোশত আর মুসলিমবিদ্বেষ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার। ভারতের ভেতর থেকেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছে। দেশের প্রথম সারির লেখক-লেখিকা থেকে শুরু করে বলিউডের অভিনেতারাও প্রতিবাদ করেছেন। কেউ কেউ পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। কেউ আবার দাবি করেছেন, এদেশে মুসলমানদের থাকার মতো পরিস্থিতি নেই। মুসলিমবিরোধী মন্তব্য করে খবরের শিরোনামে এসেছেন নরেন্দ্র মোদির দলের একাধিক নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রী। মোদি নীরব থেকে কার্যত তাতে সমর্থন জুগিয়েছেন বলে মনে করেন অনেকেই। এমন ধারণা দূর করার দায়িত্বটা এখন বর্তেছে মোদির কাঁধেই। সুফি সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যের আলোকে তিনি কাক্সিক্ষত পথে এগুতে পারেন।
নরেন্দ্র মোদি ঠিকই বলেছেন, চলমান বিশ্বে মানবতাই সংকটের মুখে; তবে এ ব্যাপারে বলবান বিশ্বনেতারা কোনো দায় স্বীকার কতে চান না। প্রচারযন্ত্রও নানাভাবে তাদের সমর্থন করে যাচ্ছে। বর্তমান সভ্যতায় প্রচারযন্ত্রের চরম বিকাশ ঘটেছে। তবে এই বিকাশকে কখনো কখনো দৌরাত্ম্য বলেও মনে হয় এবং এমনটি মনে করার বাস্তব কারণও রয়েছে। গত শতাব্দীতে আমরা সামরিক ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কিছু আওয়াজ শুনেছি। তবে সাম্রাজ্যবাদের পেছনে মিডিয়া-মাফিয়াদের সমর্থনের কথা তেমনভাবে উল্লেখিত হয়নি। কিন্তু বর্তমান সময়ে ভদ্রবেশী মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদের দৌরাত্ম্য হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। সভ্যতার শাসকদের ইশারায় মিডিয়া-মাফিয়ারা বেশ সফলভাবেই পৃথিবীতে এমন একটি বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে, যার একপক্ষে তথাকথিত উদার-গণতন্ত্র এবং অপরপক্ষে রয়েছে সন্ত্রাস ও মৌলবাদ। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। শক্তিমানরা নিজেদের স্বার্থে যখন যেটা প্রয়োজন হয়, সেটাই করেন এবং তার গায়ে যুক্ত করে দেন গণতন্ত্রের নামাবলী। প্রসঙ্গত এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়Ñ মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি কি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছিলেন না? কিন্তু তাকে কেন উৎখাত করা হলো এবং কারা করলো?
মুরসিকে উৎখাতের ব্যাপারে সম্প্রতি মিডলইস্ট মনিটর-এ একটি লেখা মুদ্রিত হয়েছে। লেখাটিতে উল্লেখ করা হয়, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালন এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে স্বীকার করেছেন যে, মিসরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত ও জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসিকে ক্ষমতায় বসানো কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না, পরিকল্পিতভাবেই এটি ঘটানো হয়েছিল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের সমর্থক সবচেয়ে বড় ইহুদি লবি এআইপিএসির বার্ষিক সম্মেলনে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বক্তব্য রাখছিলেন। সম্মেলনে ইয়ালন আরো বলেন, মিসর ও উপসাগরীয় দেশগুলোর জেনারেলদের এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় মুরসিকে উৎখাত করা হয়। আরব বিশ্ব; বিশেষ করে মিসরে সামরিক সরকার থাকলেই ইসরাইলের স্বার্থ সবসময় সবচেয়ে ভালোভাবে সুরক্ষিত থাকে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, সামরিক সরকারগুলো মিসরে গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা করলেও এআইপিএসির উচিত হবে আল সিসির প্রতি সমর্থন জোরদার করার চেষ্টা করা। তিনি স্পষ্ট ভাষায় আরো স্বীকার করেন, ‘ওই সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনরত জেনারেল সিসিকে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমরা। কৌশলগত স্বার্থ থাকার কারণে পশ্চিমারাও এটি মেনে নয়।’ ইসরাইলী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এমন স্বীকারোক্তিতে উপলব্ধি করা যায়, বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্র নিয়ে কারা খেলা করছে এবং সন্ত্রাস ও মৌলবাদ শব্দগুলো ব্যবহারের পেছনে কাদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে।
বর্তমান সময়ে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রনেতা এবং শক্তিশালী মিডিয়াগুলোর কণ্ঠে প্রায়ই ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কথা শোনা যায়। কিন্তু এই স্বাভাবিকীকরণ বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে? ন্যায় ও সঙ্গত অধিকারের ভিত্তিতে কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কথা বলা হচ্ছে, নাকি এখানে অন্য কিছু রয়েছে? লক্ষণীয় বিষয় হলো, সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ বলতে তারা আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সহযোগিতা, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিনিময় এবং রাজনৈতিক বৈরিতার প্রেক্ষাপটেও শত্রুকে গ্রহণ করার সংস্কৃতির বিস্তারকে বোঝাতে চাইছেন। এক্ষেত্রে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ বলতে শুধু ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি এবং আধিপত্যবাদ ও বসতি স্থাপনের মধ্যে অত্যাচারীর সাথে মজলুমের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক উন্নয়নকেই বোঝানো হয়নি; উপরন্তু এ কথাও বলা হচ্ছে যে, যারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তারা স্বেচ্ছায়ই ইসরাইলের শরীর থেকে শত্রুর তকমা মুছে ফেলছে। আর যারা ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, তারা তাদের গায়েই শত্রুর তকমা জুড়ে দিচ্ছে। যে সভ্যতায় এসব বিষয় বাস্তবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, সেই সভ্যতাকে মানুষের সভ্যতা বলে বিবেচনা করা যায় কিনা- সেই প্রশ্নটা এখন বড় হয়ে উঠেছে।
তাই বর্তমান সভ্যতার শাসকরা যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে নসিহত করেন, তখন মনে হয় আমরা বোধহয় পরিহাসপূর্ণ এক পৃথিবীতে বসবাস করছি। জানি না, ন্যায়বঞ্চিত মজলুম মানুষগুলো কখন শঠতাপূর্ণ এই সভ্যতার দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে। আমাদের চারপাশে কিংবা বিশ্ববাতাবরণে তেমন কোনো বাতিঘর লক্ষ করা যাচ্ছে না। তবে মজলুম মানুষ তো পৃথিবীর সব জনপদেই আছে। মানবিক মর্যাদার চেতনায় এবার বাতিঘর তাদেরই নির্মাণ করতে হবে। নিজেদের ছোট ভাবলে চলবে না। শাসকরা তাদের ছোট করে রাখলেও তারা আসলে ছোট নয়। ছোটরা ঐক্যবদ্ধ হলে অনেক বড় হয়ে যায়- শাসকদের চাইতেও বড়। ইতিহাসের এই বার্তা কখনো ভুলতে নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads