সোমবার, ১৪ মার্চ, ২০১৬

রিজার্ভ ব্যাংকের অর্থচুরি ও আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিয়ে কথা


ছোট্ট একটি প্রাণী, টিকটিকির মতো দেখতে অনেকটা মনে হলেও বেশ কর্কশ প্রকৃতির এবং অত্যন্ত দ্রুততার সাথে চলাচলে পারঙ্গম। কোনো কোনো এলাকায় তার নাম কাঁআঁল্লিশ আবার কোথাও কোথাও তাকে বলা হয় রক্তচোষা। তবে রক্তচোষা নামেই তাকে সবাই চিনে। প্রাণীটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে নাকি দূর থেকে কোনও ব্যক্তিকে টার্গেট করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং শরীরে পাম্পিং করে। এতে আপনার শরীরের রক্ত তার শরীরে চলে যায় এবং সে লাল হতে থাকে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথাটি কতটুকু সত্য আমি জানি না, তবে ঘটনাটি অনেকেই বিশ্বাস করেন। দূরে থেকে, কোনো রকম কামড় বা শারীরিক স্পর্শ ছাড়াই অন্যের রক্ত চুষে নেয়ার এই বিষয়টি বিস্ময়কর। এখন রক্তচোষা নয়, আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশে রক্তচোষাদের চেয়েও ভয়ানক প্রাণী বের হয়েছে বলে মনে হয় যারা দেশে তো বটেই হাজার হাজার মাইল দূরে একটি ব্যাংকে রক্ষিত আপনার আমানতের টাকাও লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গচ্ছিত অর্থ (১০১ মিলিয়ন ডলার) হ্যাকার গ্রুপ কর্তৃক হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা আমাদের আর্থিক খাত বিশেষ করে ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর রক্তচোষা প্রাণীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে রক্ত চোষাদের বেলায় টার্গেট বা লক্ষ্যবস্তুর নৈকট্য প্রয়োজন কিন্তু অর্থ চোষাদের বেলায় সম্ভবত সরাসরি তার কাছাকাছি না থাকলেও চলে। এটা ডিজিটাল দেশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণেও হতে পারে। ঘটনার ভয়াবহতায় আমরা আতঙ্কিত। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে এখন কারোরই নিরাপত্তা নেই। আপনার আমার জীবন, সম্পদ, মান-সম্মান, সন্তান কোনো কিছুই এখন নিরাপদ নয়, না ঘরে না বাইরে। দেশের অভ্যন্তরের ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের আমানত ও বিনিয়োগের নিরাপত্তা অনেক আগেই বিঘ্নিত হয়েছে। এখন বাইরের ব্যাংকের উপরও হাত পড়েছে। এখন আমরা যাব কোথায়?
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশ ব্যাংক তার সংরক্ষিত রিজার্ভের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ডলারের আকারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে রাখে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে এর বৃহত্তর অংশ রাখা হয়। অবশিষ্ট রিজার্ভ বন্ড, স্বর্ণ ও অন্যান্য ধাতু ও মুদ্রায় বিভিন্ন দেশে রাখা হয়। এই বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয় এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এ সম্পর্কে অবহিত নন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরানুযায়ী গত ৫ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশের ১০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ হ্যাকাররা চুরি করে ফিলিপাইন ও শ্রীলংকা নিয়ে যায়। ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি ধরে ফেলে। ঐ দেশের জনপ্রিয় পত্রিকা ডেইলি ইনকোয়ারার এর সিনিয়র রিপোর্টার ডেক্সিম এল. লুকাসের ২৯/২/১৬ তারিখের প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী সে দেশের কয়েকটি ব্যাংকে ১০ কোটি ডলার পাঠানো হয়। এই ডলার পরে কালোবাজারে বৈদেশিক মুদ্রা দালালদের কাছে বিক্রি করা হয়। এই অর্থ পরে তারা স্থানীয় তিনটি জুয়া ও নৃত্যশালায় স্থানান্তরিত করে এবং পুনরায় মানি চ্যাঞ্জারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সর্বশেষ এই অর্থ বিদেশী একাউন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টির উপর গোপন তদন্ত করে কম্পিউটার হ্যাকিং-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থচুরির বিষয়টি নিশ্চিত হয়। উল্লেখ্য যে, ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধে এই তদন্ত করেনি, তারা তদন্ত করেছে এই আশঙ্কায় যে, বিষয়টি জানতে পারলে প্যারিস-ভিত্তিক মানি লন্ডারিং-বিরোধী প্রতিষ্ঠান Financial Action Task Force (FATF) ঐ দেশটিকে কালো তালিকাভুক্ত করবে যা তাদের জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করবে। ফিলিপাইন হচ্ছে বিশ্বের স্বল্প কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি যেখানে জুয়া ও নৃত্যশালাকে মানি লন্ডারিং-বিরোধী আইনের আওতায় আনা হয়নি। জুয়া ও নৃত্যশালার সুবিধা হচ্ছে যেকেউ অর্থের পরিমাণ যত বড়ই হোক, বলতে পারে যে আমি জুয়ার মাধ্যমে তা পেয়েছি এবং এ ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং-বিরোধী আইনের শাস্তি থেকে সে বেঁচে যেতে পারে। এই সুবিধার কথা জেনেই হ্যাকাররা ঐ দেশে এই অর্থ পাঠিয়েছে বলে অনুমান করা যায়। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে ডেইলি ইনকোয়ারার ৭ মার্চ একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে এবং এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক তার তৎপরতা শুরু করে। এর আগে বিষয়টি তারা সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংকিং বিভাগ, অর্থ বিভাগ এমনকি অর্থমন্ত্রীকেও অবহিত করেনি বলে জানা যায়। এর মধ্যে রিপোর্ট বেরিয়েছে যে, এই অপকর্মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ জন কর্মকর্তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে এবং দু’জন যুগ্ম পরিচালককে চিহ্নিত করা হয়েছে। অপরাধীদের (তারা দেশী হোক অথবা বিদেশী) আদৌ চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হবে কিনা আমরা নিশ্চিত নই। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার সবগুলো খাত ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও ইমেজ বলতে কিছুই নেই। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানুষের মৌলিক মানবাধিকার শাসক দলের পদতলে পিষ্ট হচ্ছে। অর্থখাত ছিল আমাদের সমৃদ্ধির অন্যতম সোপান। এই খাতটি এখন লুণ্ঠনের শিকার। ঘরে বাইরে সর্বত্রই  নাগিনীদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস। দেশবাসী যাবে কোথায়? মোদ্দা কথা, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা না থাকলে এত বড় ঘটনা ঘটেতে পারে না।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারি ও কারচুপি ৩৫ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রকদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ না করে বিনিয়োগকারীদের জুয়া খেলার অংশীদার বানিয়ে পুঁজিবাজারকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এমনকি তাদের নিজেদের তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী যারা শাস্তি পাবার কথা তাদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের অর্থ কেলেঙ্কারি স্বল্পকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ কেলেঙ্কারি, ভল্ট ভেঙ্গে অর্থ লুট, এটিএম বুথের টাকা আত্মসাৎ, সোনালী, বেসিক, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের ভুয়া ঋণ ও অর্থলুট, কিশোরগঞ্জ, আদমদীঘি ও জয়পুরহাটে সিঁদ কেটে/সুড়ঙ্গ কেটে টাকা লুট, আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতি- আর্থিক খাতের চুরি-ডাকাতি কোনোটিরই বিচার হয়নি। এতে ডাকাত-হ্যাকাররা উৎসাহিত হয়েছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টারা এখানে অচল। অনেকে মনে করেন আমাদের নেতানেত্রীরা যদি সৎ হন, শীর্ষ নেতৃত্বের মাথা পচা যদি বন্ধ হয় তাহলেই এই মারাত্মক ধস থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি মানুষের দৃষ্টিকে সরাতে পারবে সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরকে সরাতে হবে। লাভ কি? সারা গায়ে যদি ক্ষত হয় ওষুধ কত দিবেন? তদন্ত হোক, হতে দিন। ফলাফল কী হবে সবারই জানা আছে। আসল সমস্যা গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার অভাব। তা ফিরিয়ে আনুন সব ঠিক হয়ে যাবে।
॥ দুই ॥
কয়েকদিন আগে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় সাপ্লিমেন্ট বেরিয়েছে এবং নারী অধিকার, নারী নির্যাতন প্রভৃতি নিয়ে অনেক বিশ্লেষাত্মক প্রবন্ধ-নিবন্ধ এতে প্রকাশিত হয়েছে। নারীরা আমাদের সমাজের অর্ধেক। তারা আমাদের মা, বোন, খালা, স্ত্রী, পুত্রবধূ- পৃথিবীকে তারাই ধারণ করেন। তাদের সমস্যা আমাদের সমস্যা। তারা যদি অধিকার বঞ্চিত থাকেন তাহলে সমাজব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে টিকে থাকতে পারে না। এ প্রেক্ষিতে নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দান এবং মা হিসেবে সম্মান করা আমাদেরই কর্তব্য। আবার নারীদেরও একটা কর্তব্য আছে। আর সেটা হচ্ছে আল্লাহর দেয়া গণ্ডি ও পরিসীমার মধ্যে থেকে পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা বা তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে নয় বরং সহযোগী হয়ে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করা। পুরুষ যেমন সন্তান ধারণ করতে পারেন না তেমনি সন্তান মানুষ করাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই মৌলিক কথাগুলো সামনে রেখেই তাদের শিক্ষা প্রশিক্ষণ পরিচালিত হওয়া দরকার।
আমার এক অগ্রজ এবং ওস্তাদ সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে বহু মেয়ে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের অধিকাংশই আটসাঁট পোশাক পরা। আটসাঁট পোশাক মেয়েদের শরীরকে আবৃত করতে পারে না বরং দিগম্বর থাকলে যা হয় না তার চেয়েও বেশি তার শরীরকে অনাবৃত করে দেয়। এটি বিপরীত লিঙ্গের পুরুষদের জন্য যৌন সুড়সুড়ির মতো কাজ করে। পোশাক তা যা শরীরের সংবেদনশীল অংশকে আবৃত করে, যৌন সুড়সুড়ির ভূমিকা পালন করে না এবং যা শিষ্টাচারের অনুকূল। অনেকে ওড়নাও পরেন না। সংক্ষিপ্ত পোশাক বিশেষ করে প্যান্ট, খাটো কামিজ পরা, ওড়না ছাড়া মেয়েদের অত্যন্ত বিশ্রীই শুধু দেখায় না; তারা ছেলেদের কুদৃষ্টির শিকারও হয়। তাদের কেউই ভালো চোখে দেখে না। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সংস্কৃতিতে আটসাঁট পোশাকের স্থান নেই, বাঙালি সংস্কৃতিও তা সমর্থন করে না। ফলে আমাদের সমাজে ধর্ষণ ব্যভিচার ও নারীর প্রতি অসম্মানের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি মনে করি - মাতাপিতা, আত্মীয়স্বজন, অভিভাবক, শিক্ষকশিক্ষিকা এবং যেসব রাজনৈতিক দলের মহিলা শাখা আছে তাদের সকলেরই উচিত শালীন পোশাক পরিধানে মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করা এবং অশালীন পোশাক পরা থেকে তাদের বিরত রাখা। ধর্ষণ, ব্যভিচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হলে তার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এটা অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads