বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬

কেলেঙ্কারির ওই অর্থে পদ্মাসেতু করা যেত


দুর্নীতি ও আত্মসাতের ঘটনা কমছে না বরং বাড়ছে। ‘সাত বছরে আত্মসাৎ ৩০ হাজার কোটি টাকা’- শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে প্রথম আলো পত্রিকায়। ২৭ মার্চ তারিখে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, গত সাত বছরে ঘটেছে ছয়টি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা। এসব কেলেঙ্কারিতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি চুরি বা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ অর্থ দিয়েই অনায়াসে একটি পদ্মা সেতু তৈরি করা যেত। এসব বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি লাখ লাখ ক্ষুদ বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের একটি অংশ ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতা করেছে, নিজেরাও লাভবান হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছাড় দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, একটি কেলেঙ্কারিরও বিচার হয়নি। সাজা পাননি অভিযুক্তদের কেউ। প্রাথমিক তদন্ত হয়েছে। বছরের পর বছর মামলা চলছে। অভিযুক্তদের কেউ জেলে আছেন, কেউ চিকিৎসার নামে হাসপাতালে আরাম-আয়েশে আছেন। অনেকে জামিন পেয়েছেন।
আর্থিক কেলেঙ্কারির এমন চিত্র জনমনে হতাশার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহ্উদ্দিন আহমেদ এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন মূলত সুশাসনের অভাব থেকেই একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেছে। আর ব্যবস্থা না নেয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, হলমার্ক থেকে শুরু করে বেসিক ব্যাংক বা বিস্মিল্লাহ্ গ্রুপ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত লোকজন জড়িত ছিলেন বলেই কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দেশের সর্বশেষ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকা রিজার্ভ চুরি। ৫ ফেব্রুয়ারি চুরি করা হয় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, টাকার অংকে যা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। স্বয়ংক্রিয় লেনদেন ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ বা হ্যাক করে এই রিজার্ভ চুরির ঘটনা বিশ্বজুড়ে এক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে এর দায়দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। সরিয়ে দেয়া হয়েছে দুই ডেপুটি গবর্নরকেও।
দেশের জনগণ আর্থিক কেলেঙ্কারির এইসব ঘটনা মেনে নিতে পারছে না। তারা এইসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চায়। ভবিষ্যতে যাতে এসব ঘটনা আর ঘটতে না পারে তারও নিশ্চয়তা চায় সরকার ও প্রশাসনের কাছে। আর্থিক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতি কমাতে তিনটি পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহ্উদ্দিন আহমেদ। ১. যারা অপরাধী তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু বিভাগীয় শাস্তি হিসেবে বরখাস্ত বা বদলি নয়, অপরাধের দায়ে শাস্তি দিতে হবে। ২. সৎ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সঠিক জায়গায় বসাতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে যেসব সদস্য নিয়োগ দেয়া হয় তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ রয়েছে। ৩. ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে, এ প্রতিষ্ঠানটিকে মূল ব্যাংকিং এর দিকে নজর দিতে হবে। তিনি আরো মনে করেন, ব্যাংক খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ দেয়া উচিত। আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ন্ত্রণে সাবেক গবর্নর সালেহ্উদ্দিন আহমেদ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এর আগেও কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশের স্বার্থে পরামশের্র যথাযথ বাস্তবায়ন। কিন্তু দলীয় স্বার্থ এবং শৃঙ্খলা ও সুশাসনের অভাবে উত্তম পরামশের্র বাস্তবায়নও লক্ষ্য করা যায় না। দুষ্টের দমনে শাস্তি প্রদানের আগ্রহও তেমন দেখা যায় না। কিন্তু অন্যান্য দেশে শাস্তি প্রদানের নজির রয়েছে বলেই সেখানে কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাসডাকের সাবেক চেয়ারম্যান বার্নার্ড মেডফের শেয়ারবাজারে আর্থিক কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস হয়। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৯ সালের জুন মাসে বিচারে ৭১ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ীকে ১৫০ বছর জেল দেয়ার পাশাপাশি ১৭০ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়। দল ও স্বজনপ্রীতি পরিহার করে যদি শাস্তির এমন নজির স্থাপন করা হয়, তাহলে আমাদের দেশেও আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা হ্রাস পেতে পারে, হতে পারে কাক্সিক্ষত উন্নয়নও তবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে সঙ্গত ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। এক্ষেত্রে সাফল্য পেতে হলে ক্ষমতার রাজনীতি ত্যাগ করে আমাদের রাজনীতিবিদদের আবার ফিরে আসতে হবে আদর্শের রাজনীতিতে। কারণ একমাত্র আদর্শের রাজনীতিতেই নিহিত রয়েছে দেশ ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণ। এমন রাজনীতিতে ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় জ্ঞানচর্চা ও নিষ্ঠার। এইসব গুণাবলী আমাদের রাজনৈতিক বাতাবরণে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে। এমনটি হলে আমাদের ছাত্ররাজনীতির চেহারাও পাল্টে যাবে।
বর্তমান সময়ে বহুলশ্রুত একটি বিষয় হলো উন্নয়ন।
উন্নয়ন প্রসঙ্গে অনেক কথাবার্তা শোনা যায়। ‘উন্নয়ন’ বিষয়টি শুনতেও ভাল লাগে, ভাবতেও আনন্দ হয়। তবে বাস্তব কারণেই এমন প্রশ্নও জাগে যে, দৃশ্যমান সব উন্নয়ন কি আসলেই উন্নয়ন? দেশের উন্নয়ন বলতে তো আমরা দেশের জনগণের উন্নয়নকেই বুঝি। কিন্তু সব উন্নয়নেই কি জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয়? আর বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছি যে, যে উন্নয়নে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয় না, সেই উন্নয়নে দেশও সমৃদ্ধ হয় না। বরং এ ধরনের উন্নয়নের রকমফেরে আখেরে দেশ ও জনগণের স্বার্থই বিপন্ন হয়। আমরা জানি, উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের বিদ্যুতের অভাব রয়েছে। তাই বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই বলে সুন্দরবনের ক্ষতি করে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান করতে হবে- এমন উদ্যোগকে মেনে নেয়া যায় না। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তো প্রবোধ দিয়ে আসছেন যে, এমনভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ করা হবে, যাতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা তাদের এমন প্রবোধ মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু এখন তো সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও স্বীকার করে নিলেন যে, সুন্দরবনের ক্ষতি হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে ঠিকই, কিন্তু এ স্থান পরিবর্তন করা যাবে না। এমন কথায় শুধু অবাক নয়, বিস্মিত হতে হয়। উল্লেখ্য যে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতীয় হেভি ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর সাথে চুক্তির ব্যাপারে জোর আয়োজন চলছে।
আমরা জানি, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র-প্রকল্পের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ধরেই দেশের পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রেখে আসছেন। এখন তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের এই অতুলনীয় সম্পদ ও আশ্রয় ধ্বংস হবে জেনেও কেন সরকার এই বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে?
কোথায় তাদের হাত-পা বাঁধা? কেউ কেউ তো বলছেন- অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, যাদের হাত-পা বাঁধা নেই তাঁদের এই সর্বনাশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাই দায়িত্ব। সেজন্যই সুন্দরবন বিনাশী এই প্রকল্প বাতিলসহ সাত দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ২৪ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে সুন্দরবন অভিমুখে লংমার্চ সংঘটিত করেছিল তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। দাবি পূরণ না হওয়ায় এই কমিটি থেকে আবারও ১০ থেকে ১৫ মার্চ জনযাত্রা তথা বৃহত্তর লংমাচের্র কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এছাড়া গত কয়েক বছরে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ ও সংগঠন বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য, যুক্তিসহ সরকারের কাছে সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক এসব প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। প্রবল জনমতও তৈরি হয়েছে এসব প্রকল্পের বিরুদ্ধে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, মহাপ্রাণ সুন্দরবনের আঙ্গিনায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রকল্পটি অস্বচ্ছ ও অসম। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে যে সুন্দরবন বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করে, অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে যা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে, সেই সুন্দরবনকে এই প্রকল্প ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। সুন্দরবন আছে বলে প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের লাখ-লাখ মানুষের জীবন বাঁচে। সুন্দরবন বিনষ্ট হওয়া মানে বহু মানুষের জীবিকা হারানো, উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষকে মৃত্যু ও ধ্বংসের হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বন, এক অতুলনীয় ইকোসিস্টেম, পরিবেশ শোধনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা অনন্য সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা আমাদের বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান চাই। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সুন্দরবনকে বিপন্ন করে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান করতে হবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে আমাদের যথাযথ রোডম্যাপে অগ্রসর হতে হবে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়েছে- সর্বজনের সম্পদে শতভাগ জাতীয় মালিকানা ও শতভাগ সম্পদ দেশের কাজে ব্যবহার, দুর্নীতি করার দায়মুক্তি আইন বাতিল করে ‘খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধকরণ আইন’ প্রণয়ন, পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল করে স্থলভাগে ও সমুদ্রে নতুন নতুন গ্যাসকেন্দ্র অনুসন্ধানে জাতীয় সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ, ক্ষমতা ও বরাদ্দ প্রদান; রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মেরামত ও নবায়ন, উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নিষিদ্ধসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ, নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের সর্বোত্তম মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি জ্বালানি নীতি প্রণয়ন, দীর্ঘমেয়াদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর গুরুত্ব প্রদান। এই রোডম্যাপে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই, সুলভ, নিরাপদ ও জনবান্ধব উন্নয়ন ধারা তৈরি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। সরকার এসব প্রস্তাব ভেবে দেখতে পারেন।
সবশেষে আমরা বলতে চাই, বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সরকারের যথাযথ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাবো। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট সমাধান করতে গিয়ে কোনোভাবেই যেন সুন্দরবনের ক্ষতি করা না হয়। এমনটি হলে শুধু উন্নয়ন নয়, আরও অনেক কিছুর ক্ষতি হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads