সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০১৬

মন্ত্রীদের জরিমানা ও কলিকালের বৈশিষ্ট্য


বিষয়টি বাংলাদেশ কেন উপ-মহাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এই বারই প্রথম ঘটেছেঃ মন্ত্রিসভার দু’জন মন্ত্রী আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ৭ দিনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। দণ্ডপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের দু’জনই পূর্ণমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী নন।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ এই রায় দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি এবং বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় তাদের এই শাস্তি প্রদান করা হয়। আদালত বলেছেন যে, তারা সংবিধানও লংঘন করেছেন। ইতোপূর্বে সংবিধান লংঘন ও আদালত অবমাননার দায়ে কোনও মন্ত্রীকে শাস্তি দেয়া না হলেও অন্য অপরাধে পাকিস্তান আমলে একজন মন্ত্রীকে ১০ টাকা জরিমানা এবং বাংলাদেশ আমলে একজন প্রধানমন্ত্রীকে আদালত সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় Wrong headed বলে আখ্যায়িত করে মামলার নিষ্পত্তি করা হয়েছিল। এখন যে দু’জন মন্ত্রীকে শাস্তি দেয়া হলো তারা হচ্ছেন খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এদের উভয়েই প্রবীণ এবং তাদের এই শাস্তি ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে অনেকে মনে করেন।
বিষয়টি শুধু আমি নই, সারা জাতির জন্যই দুঃখজনক ও লজ্জাকর। কেবিনেটের দু’জন মন্ত্রী (একজনের নামের আগে এডভোকেট শব্দটি জড়িত আছে, অর্থাৎ তিনি আইন পেশার সাথেও জড়িত) আদালতের মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত নন এটা বিশ্বাস করা যায় না। মন্ত্রী নির্বাসিত হবার পর শপথবাক্য পাঠ করে তারা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, মন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন। তারা শপথ নিয়ে বলেছেন যে, দেশের সংবিধান রক্ষা করবেন, কিন্তু মন্ত্রী হয়ে তা ভুলে গেছেন এবং শপথ ভঙ্গ করে সংবিধান লংঘন করেছেন এটা যেমন বিস্ময়কর তেমনি মন্ত্রী সভার জন্যও কলংকজনক। আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু শাস্তিপ্রাপ্ত এই দুইজন কেবিনেট সদস্য নন পুরো কেবিনেটেরই এখন পদত্যাগ করা উচিত। এই কেবিনেটে এমন আরো মন্ত্রী আছেন যারা শপথ এবং সংবিধান দু’টোই যথাক্রমে ভংগ ও লংঘন করে যাচ্ছেন। অনেকের আচার আচরণ ও কথাবার্তা শুধু যে মন্ত্রীর মতো নয় তা নয় বরং মন্ত্রণালয়ের পিয়ন চাপরাশিদের আচরণ থেকেও নিকৃষ্ট বলে কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন। কালপরিক্রমায় আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, শিষ্টাচারী ভদ্রলোক ও মার্জিতমনা লোকের সংখ্যাও কম নয়। তথাপিও কেবিনেটের সদস্য বা এমপি নির্বাচনের বেলায় আমাদের এই দৈন্যদশা কেন? সম্রাট আকবর একবার একজন তবলাবাদককে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন, এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তার নবরত্ন সভার সদস্যরা রাজ সিংহাসন যমুনায় বিসর্জন দেয়ার লক্ষ্যে শব মিছিল বের করেছিলেন। আমরা আমাদের পার্লামেন্ট ও কেবিনেটে নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, নর্তক-নর্তকী, সকলকেই অন্তর্ভুক্ত করেছি। এতে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বাড়েনি, বরং কমেছে। যে শ্রেণীর লোকদের কথা আমি উল্লেখ করেছি দেশের কোনো কোনো মানুষ তাদের পেশাদার চিত্তবিনোদক হিসেবে পছন্দ করতে পারেন, কিন্তু মন্ত্রী, পরামর্শদাতা বা আইন প্রণেতা হিসেবে নয়। দেখা যাচ্ছে যে আমরা এই সাধারণ বাস্তবতাটুকুও ভুলে যাই। আর মন্ত্রী এমপিরা যা বলেন তা যদি তারা রেকর্ড করে নিজেরাই শোনেন, যাদের লজ্জা আছে তারা নিশ্চয়ই লজ্জিত না হয়ে পারবেন না।
আগের দিনে সরকারি চাকরি অথবা মন্ত্রীত্ব কিংবা জনগুরুত্বসম্পন্ন পদে প্রার্থী বাছাইয়ের বেলায় খান্দান ও পারিবারিক মর্যাদা দেখা হতো। এর কারণ ছিল খান্দানি কোনও লোক শিষ্টাচার বহির্ভূত কোনও কাজে সংশ্লিষ্ট হবার আগে নিজের, খান্দানের এবং দেশের কথা চিন্তা করতেন। এখন তা আর নেই। আমরা এখন অধঃপতনের এতো নিম্নস্তরে পৌঁছে গেছি যে আমি কে, কাকে কি বলছি তাও ভুলে যাচ্ছি। এই তো দু’দিন আগে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী একজন মন্ত্রী প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি দেশে বোমা হামলার জন্য স্বচ্ছন্দে জামায়াত-বিএনপি নেতা-কর্মীদের দায়ী করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিলেন। তার ডিগ্রি তাকে জংলি আচরণ থেকে বিরত রাখতে পারছে না। নোংরা অতীতের অনেকেই উচ্চ পদের বর্তমানের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেন না। আমি এই স্তম্ভে একবার ভারতের একটি সম্প্রদায়ের কথা বলেছিলাম, এরা রাজপুতদের উত্তরসুরি। অনেকেই অবগত আছেন যে, রাজপুতরা এক সময় ভারতের অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম অবস্থানে ছিলেন। এদের বেশির ভাগই ছিলেন যোদ্ধা। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে ২৭ বছর দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে এদের পুরুষদের অনেকেই নিহত হয়েছিলেন। ফলে এই সম্প্রদায়টির অবস্থা এমন হয়ে পড়ে যে তারা তাদের মেয়েদের বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র সংকটে নিপতিত হয়। এই অবস্থায় এদের বৃহত্তর অংশ চাকরবাকরদের সাথে বিবাহযোগ্য মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। চাকররা আবার মনিব কন্যাদের বিয়ে করার সুযোগ পেলেও নিজেদের অতীতকে ভুলতে পারেনি। তারা এক অদ্ভূত কালচারের সৃষ্টি করে এবং সেটা হচ্ছে স্ত্রীদের সাথে রাত্রিযাপনকালে তারা তাদের সাথে পালঙ্কে না শুয়ে স্ত্রীদের (মনিব কন্যা) পালঙ্কে শোয়ায়ে নিজেরা মেঝেতে ঘুমানো শুরু করে। আবার স্ত্রীরাও তা মেনে নেয়। রাজপুতদের এই সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো এই কালচার চালু আছে বলে জানা যায়।
আমাদের সমাজে বর্ণপ্রথা নেই, কিন্তু অভ্যাস ও অবস্থানগত পরিমণ্ডলের কারণে কিছু লোক আছেন যারা পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে নিজেদের নীচু অবস্থান থেকে উপরে উঠাতে পারেননি। অভ্যাস আচার আচরণ ও শিষ্টাচারের দিক থেকে তারা নীচুই রয়ে গেছেন। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বদৌলতে ‘কৌলিন্যের’ পজিশনে এসে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছেন। তাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তারা নিজেরা ছাড়া অন্য কাউকে মানুষই মনে করতে চান না। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মানুষ খুনের মাধ্যমে যাদের উত্থান, বন্দুকের নলে যারা ক্ষমতার স্বপ্ন দেখতেন, জাতীয় নির্বাচনে যারা কখনো জামানত রক্ষা করতে পারতেন না, আওয়ামী লীগের লেজ ধরে বিনা ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে তারা এখন যেভাবে কথা বলেন তার ধরন দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। বিশেষ একটা প্রাণী লেজ নাড়ে, না লেজ প্রাণীটাকে নাড়ায় তা বুঝা যায় না।
দেশ এখন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রীরা যেমন আইন আদালত ও সংবিধানের তোয়াক্কা করেন না, তেমনি ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও দেশকে নিজেদের জমিদারী বলে গণ্য করে চলছেন। জমিদারী আমলে প্রজারা খাজনা দিতে না পারলে তাদের জমিজমা জমিদাররা কেড়ে নিতেন। আবার কোনো কোনো জমিদার দয়াপরবশ হয়ে খাজনা পরিশোধের অবকাশও দিতেন। জমিদারী প্রথা এখন নেই, এখন আওয়ামী লীগ শাসনামলে তাদের থেকেও দোর্দণ্ড প্রতাপ চাঁদাবাজ কাউন্সিলরের জন্ম হয়েছে যারা প্রকাশ্য দিবালোকে অন্যের সম্পত্তি দখল করে বুক ফুলিয়ে তা ভোগ করছে। ভোগের অর্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে দলীয় নেতৃত্ব ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে তারা এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে যে, আপনি বিক্ষুব্ধ অধিকার বঞ্চিত ব্যক্তি হিসেবে আইন আদালত, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনার, আইজি কারোর কাছ থেকেই কোনও সাহায্য পাবেন না। থানা আপনার জিডি গ্রহণ করবে না। পুলিশ পয়সা ছাড়া আপনার সঙ্গে কথা বলবে না। আপনি প্রতিবাদ করতে গেলে জঙ্গী সন্ত্রাসী হিসেবে জেলে যাবেন। পয়সার শ্রাদ্ধ হবে। পয়সা না দিতে পারলে হয়তো লাশ হয়ে বাড়িও ফিরতে পারবেন না। বিশ্বাস না হলে মতিঝিল ৯নং ওয়ার্ডের আরামবাগের ৮৯, ৮৯/১নং হোল্ডিং এ অবস্থিত বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স-এর ৯ তলা বিশিষ্ট একটি এবং ৪ তলা বিশিষ্ট দু’টি ভবনের অবস্থা দেখতে পারেন। ২০০৮ সাল থেকে ক্রয় সূত্রে ভবনগুলোর মালিকানা গ্রহণ করে বিপিএল এগুলো ভোগ দখল করে আসছে। বিপিএল হচ্ছে সাড়ে তিন হাজার শেয়ার হোল্ডারের মালিকানাধীন একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি। আওয়ামী লীগ দলীয় স্থানীয় একজন কাউন্সিলর তার দলবল নিয়ে ভবনগুলো জবর দখল করে গত জুলাই থেকে মাসে প্রায় দশ লক্ষ টাকা ভাড়া আদায় করে নিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, সরকারের মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবাইকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে কিন্তু প্রতিকার নেই। রাজধানীর বুকে এতো বড় জবর দখল ও অবিচার চলছে। সরকার নির্বিকার। তারা আইনের শাসনের কথা বলেন, কিন্তু তাদের জুলুম অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পরের সম্পত্তি দখলের এই জঘন্য অপরাধ তারা ঢাকবেন কিভাবে? চোর, গু-া, বদমাশ ও তাদের পৃষ্ঠপোষক ছাড়া কি সরকার চলতে পারেন না? এই বিষয়টি তাদের জন্য ভবিষ্যতে যে বুমেরাং হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
এসব ঘটনা কেন ঘটছে তার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন দলে কি যোগ্য ও সৎ এবং ভদ্র লোক নেই; আমি মনে করি আছে। কিন্তু তারা এখন কোণঠাসা হয়ে আছেন।
শেষ করার আগে হিন্দু শাস্ত্রের কিছু কথা মনে পড়লো। এই শাস্ত্র পৃথিবীর স্থিতিকালকে চারটি যুগে বিভক্ত করেছে। যুগগুলো হচ্ছে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি। কলি যুগের একটি বৈশিষ্ট্য তারা বলেছেন। এই যুগে নাকি, ‘অমানুষ মানুষ হবে, তেলি হবে পাল। নাপিত বৈদ্য হবে কে কাটিবে .....’ল। শেষের শব্দটি আমাদের সমাজে অশ্লীল হিসেবে গণ্য করায় আমি তা লিখলাম না। এর বাংলা অর্থ চুল। শ্লোকে চুলের হিন্দি বা উর্দু প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যারা কলি কালের বৈশিষ্ট্যে বিশ্বাস করেন তারা এই শ্লোকে মনের খোরাক পেতে পারেন বলে আমি মনে করি। তবে আমার বিশ্বাস শ্লোকের উপর ছেড়ে না দিয়ে অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য। তা হলে অন্তত চেয়ারের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকবে।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads