শনিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৬

অর্থ কেলেঙ্কারি ॥ আতিউরের পদত্যাগ প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে অমিল


বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ঘটনা দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহার অপহরণ বা গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে। ইতোমধ্যে সকলেই জেনে গেছেন যে, তানভীর জোহার অন্তর্ধানের বিষয়টি একদিকে আতঙ্ক ও অন্যদিকে রহস্যের সৃষ্টি করেছে। এ সম্পর্কে তানভীরের চিকিৎসক স্ত্রী কামরুন্নাহার বলেছেন যে, তার স্বামী বুধবার রাত থেকে নিখোঁজ। স্বামীর ব্যাপারে ডায়েরি করার জন্য তিনি রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট, কাফরুল, কলাবাগান ও ভাষানটেক থানায় যান। কিন্তু কেউ তার ডায়েরি গ্রহণ করেনি। এটি অত্যন্ত রহস্যজনক। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে রাজধানীর কচুক্ষেত নামক স্থান থেকে। তার সাথে ছিল তার বন্ধু ইয়ামির আহমেদ। বন্ধুর সাথে বাড়ি ফেরার জন্য তিনি একটি সিএনজি ডাকেন। তখন সেখানে ৩টি মোটরগাড়ি এসে সিএনজিকে ঘিরে ফেলে। একটি গাড়ি থেকে মুখোশধারী কয়েক ব্যক্তি নামে। ওরা তানভীরকে একটি গাড়িতে তোলে এবং তার বন্ধুকে অন্য গাড়িতে তোলে। কিছুদূর যাওয়ার পর তানভীরের বন্ধু ইয়ামিরকে মানিক মিয়া এভিনিউতে ছেড়ে দেয়া হয়। তখন আনুমানিক রাত ১টা থেকে দেড়টা। কিন্তু যে গাড়িটি তানভীরকে বহন করছিল সেই গাড়ি আর ফেরত আসেনি। গতকাল শনিবার পর্যন্ত পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক তানভীর জোহার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
আমরা এ সম্পর্কে কিছুই জানি না এবং এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে যে প্রশ্নটি এসে দাঁড়ায় সেটি হলো- তানভীর জোহা সাইবার বিশারদ হিসেবে সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিমের সদস্য হিসেবে কাজ করছিলেন। এই বিষয়টি মোটেও আমাদের বোধগম্য নয় যে, যিনি এই বিশাল অর্থ কেলেঙ্কারির তদন্ত টিমের সাথে জড়িত ছিলেন তাকে অপহরণ করা হয়েছে কেন? তার স্ত্রী ৪টি থানায় ঘুরেছেন। কিন্তু কোনো থানা তার জিডি গ্রহণ করেনি কেন? যিনি অন্যতম হাকিম তাকেই যদি আসামী করা হয়, তাহলে সেই জট খোলে, কার সাধ্য? ঐদিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে যে, তানভীর জোহা কোনোকালেই ঐ মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কোনো বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না এবং এখনো নেই। পক্ষান্তরে তানভীর জোহা বলেছেন যে, তিনি ঐ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি বিভাগের পরিচালক এবং সেই সুবাদে এ সম্পর্কে গঠিত অন্যতম তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি ইতোমধ্যেই কিছু তদন্ত কাজ করেছেন। সরকার এবং তানভীর জোহার বক্তব্য পড়লে মনে হয় এরা যেন শুধু দু’টি পক্ষই নয়, যেন তারা ২টি বিপরীত মেরু। একটি উত্তর মেরু এবং আরেকটি দক্ষিণ মেরু। সুমেরু এবং কুমেরুর এই গোলক ধাঁধাঁ থেকে জনগণকে বের করে আনার উদ্দেশ্যে সরকার বিষয়টি আরো স্বচ্ছ করবেন বলে মানুষের প্রত্যাশা।
॥ দুই ॥
এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী আব্দুল মুহিতের একটি সাক্ষাৎকার নতুন কতগুলো গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তার এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে গত শুক্রবার দৈনিক ‘প্রথম আলোর’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান সংবাদ হিসেবে। তিনি বলেছেন, রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্যই জড়িত। তার কথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এই কা- ঘটতে পারতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবেক গবর্নর আতিউর রহমানের পদত্যাগকে এই বলে প্রশংসা করেছেন যে, আতিউর রহমান বীরের বেশে চলে গেছেন। পক্ষান্তরে ঐ সাক্ষাৎকারে আব্দুল মুহিত বলেছেন যে, আতিউর রহমান পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আতিউর রহমান তার পদত্যাগপত্রে এবং পদত্যাগ পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলনে তার সাফল্যের এক লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছেন। ঐ ফিরিস্তির এক জায়গায় তিনি বলেছেন যে, ৭ বছর আগে তিনি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকে গবর্নর হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬ বিলিয়ন ডলার বা ৬০০ কোটি ডলার। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে সেই রিজার্ভ আজ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২৬ বিলিয়ন ডলার বা ২৬০ কোটি ডলার। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আব্দুল মুহিত ব্যাংকের সাবেক গবর্নরের এই দাবিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আতিউর রহমানের অবদান প্রায় শূন্য। রিজার্ভ বৃদ্ধির কৃতিত্ব মোটেই আতিউর রহমানের নয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, রিজার্ভ বৃদ্ধির কৃতিত্ব আতিউর রহমানের নয়, এই কৃতিত্ব প্রবাসী শ্রমিকদের। এখানে আতিউর রহমান যেটুকু করেছেন, সেটি হলো জনসংযোগ। যেখানে আতিউর রহমানসহ অনেকেই বিরাট আশা করছেন যে, লুণ্ঠিত অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে, সেখানে অর্থমন্ত্রী বলছেন যে, লোপাট হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে কিনা সেটি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তিনি আরো বলেন, আতিউর রহমান সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। তিনি একটুও লজ্জিত হননি। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন বাড়িতে এবং দুই দফা। একবার পদত্যাগের আগে, আরেকবার পদত্যাগের পর। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথা বলেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, দু’জন ডেপুটি গবর্নরের চাকরি গেছে আতিউরের কারণে। আতিউর বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি একা দায়ী নন। দু’জনের বাইরে আরও কয়েকজনের চাকরি খাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তা আর হয়নি, হবেও না। মন্ত্রী আরো বলেন, টাকা আসলে উদ্ধার হবে কিনা, আমি নিশ্চিত না।
অর্থমন্ত্রী বলেন, কিছু টাকা পাওয়া গেছে বরং শ্রীলঙ্কার কল্যাণে। আতিউর রহমান সংকটটির গভীরতাই বুঝতে পারেননি। আমার মনে হয়, তিনি চিন্তাই করতে পারেননি যে, এই ঘটনাটি এত বড়। খবর পাওয়ার পরেও তিনি দেশের বাইরে বাইরে ঘুরেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আতিউরের অবদান প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, আতিউরের অবদান প্রায় শূন্য (অলমোস্ট জিরো)। তিনি শুধু পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন আর লোকজনকে অনুরোধ করেছেন বক্তৃতা দেয়ার জন্য তাকে সুযোগ দিতে ও দাওয়াত দিতে। এখন বেরোচ্ছে এগুলো। আতিউর রহমান বলার চেষ্টা করেছেন যে, বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, এগুলো ইতোমধ্যে বহুল আলোচিত বিষয়। বেসিক ব্যাংক পুরনো বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকই তো বেসিক ব্যাংকের সব কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিল।
বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার সব আলাপ করা যায় না। তবে ব্যবস্থা ঠিকই নেয়া হবে।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকারি উকিলরা বিষয়টিতে খুব একটা মনোযোগী নন। দুই দিন আগেও তিনি বলেছেন, প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের কৃতিত্ব তার। রিজার্ভের কৃতিত্ব মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের।
মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয় যে, রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছে ছুটির দিন শুক্রবারে, তাই পদক্ষেপ নিতে দেরি হয়েছে, আতিউর রহমানের এমন ব্যাখ্যাকে তিনি কীভাবে দেখবেন, উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, এটি সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা। শুক্রবারেও লোক থাকবে না কেন? ফোন ধরা ও তথ্য দেয়ার জন্য ছুটির দিনেও লোক থাকা উচিত।
মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয় যে, আপনার কি মনে হয়, এই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও কি যোগসাজশ রয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই। শতভাগ জড়িত। স্থানীয়দের ছাড়া এটা হতেই পারে না। ছয়জন লোকের হাতের ছাপ ও বায়োমেট্রিকস ফেডারেল রিজার্ভে আছে। নিয়ম হলো- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে ষষ্ঠ ব্যক্তি পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্লেটে হাত রাখার পর লেনদেনের আদেশ কার্যকর হবে।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, আতিউর আমার নিয়োগ করা গবর্নর, অথচ তিনি সবসময়ই বলে এসেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। এমনকি পদত্যাগপত্রও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়েছেন। এটা তিনি পারেন না। তার পদত্যাগপত্রটিও হয়নি। আমাদের দেশে তো ওইভাবে নিয়ম-কানুন মানা হয় না, অন্য দেশ হলে তো আমার অনুমতি ছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাই করতে পারতেন না।
অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, এটা কি ‘চেইন অব কমান্ড’ সমস্যা? উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘অবশ্যই। তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেননি, আমি নিয়োগ দিয়েছি। আমার কাছেই পদত্যাগপত্র দিতে হবে’’।
রিজার্ভে অর্থ চুরির বিষয়টি নিয়ে সরকারকে যতটা সোচ্চার হতে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতের টাকা লুটপাটের সময় সেগুলোর ক্ষেত্রে অতটা সোচ্চার হতে দেখা যায়নি, কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘আসলে অন্য লুটপাট ধরার বিষয়ে কোনো নির্দেশক (ইনডিকেটর) নেই, যার মাধ্যমে তথ্য পেতে পারি।’’
এনবিআরের চেয়ারম্যান সঠিকভাবে কাজকর্ম করছেন না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এনবিআর চেয়ারম্যান এত বক্তৃতা দেন যে তাকে আসলে তথ্য সচিব বানিয়ে দেয়া উচিত। সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর একান্ত সচিব ছিলেন তো, তাই তারই প্রভাব পড়েছে এনবিআর চেয়ারম্যানের ওপর। এনবিআর চেয়ারম্যানের সাথে আছেন শক্তিশালী আমলা। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, তাকে নিয়ে কাজ করা মুশকিল। তিনি রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।
॥তিন॥
বিষয়টি কত দিন ধরে ঝুলবে সেটা আমরা জানি না। কিন্তু একটা দেশের অর্থমন্ত্রী যখন দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসাররা অবশ্যই জড়িত এবং যখন দেখা যায় যে, তার কথাটি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হচ্ছে না, তখন তখন বুঝতে হবে যে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
তাই যদি না হবে তাহলে এতগুলো ঘটনা ঘটলো, এত হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলো, অথচ কোনো ব্যক্তির সাজা হলো না কেন? জেএসডি নেতা আ স ম আব্দুর রব বলেছেন যে, হলমার্ক, ডেসটিনি, সোনালী ব্যাংক এবং বেসিক ব্যাংকের কথা মানুষ ভুলে গেছে। বড় সাহেবরা কি চাচ্ছেন যে, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক প্রভৃতি ব্যাংকের মতো আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পুকুর চুরির কথাও ধীরে ধীরে ভুলে যাই?
আসিফ আরসালান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads