মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০১৬

অব্যাহত সেই পুরানো খেলা


মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিয়ে এক প্রতিবেশী দেশ যে খেলা শুরু করেছিল, তা এবার মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সফরে আসেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী রিচার্ড রিয়ট আনেক জায়েম। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রফতানি নিয়ে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তাতে অত্যন্ত হঠকারিভাবে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি বলে বসলেন যে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে ১৫ লক্ষ শ্রমিক নেবে। আর তখনই সক্রিয় হয়ে উঠল সে দেশটির চক্রান্তকারীরা। মালয়েশিয়ায় তারা নানা অনলাইন নিউজ পোর্টালে খবর ছড়িয়ে দিল যে, এক বাংলাদেশী তরুণ একজন মালয় তরুণীকে বাথরুমে ধর্ষণ করেছে।
ব্যস, সব আশার গুড়ে বালি পড়ল। পরদিনই মালয়েশিয়া ঘোষণা করে দিল যে, বাংলাদেশসহ আর কোনো দেশ থেকেই তারা আপাতত আর কোনো শ্রমিক নেবে না। অর্থাৎ আমাদের জন্য বন্ধ হয়ে গেল একটি সম্ভাবনার দ্বার। এই একই পরিস্থিতি দেশটির  গোয়ন্দা সংস্থাগুলা তৈরি করেছিল মধ্যপ্রাচ্যে। এখন কাতারসহ মাত্র দু’একটি দেশে বাংলাদেশের শ্রমিক রফতানি হয়। বাকি সব দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে তারা। সে সময় আমরা লক্ষ্য করেছি, ওসব দেশে কোনো রকম অপরাধের ঘটনা ঘটলেই দেশটির নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টালগুলো একযোগে প্রচার করেছে যে, ঐ অপরাধের জন্য দায়ী বাংলাদেশী শ্রমিকরা। বহু ক্ষেত্রে তা শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। এমনকি ঐ দেশটির শ্রমিকরা অপরাধ করলেও তাদের বাংলাদেশী শ্রমিক সাজিয়ে ওসব পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে নানা কল্পকাহিনী প্রচার করা হয়েছে। তাদের এই ধারাবাহিক প্রচারণার ফলে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল শ্রমবাজার। তারা বাংলাদেশের শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। যার ফলে আমাদের অর্থনৈতিক গতিধারা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। এর জন্য অনেক ক্ষেত্রে আবার আনাড়ি পররাষ্ট্রনীতিও দায়ী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার এখানকার অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকার এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনো কোনো দেশ শ্রমিক নেওয়া তো দূরের কথা, বাংলাদেশীদের জন্য ট্র্যানজিট ভিসা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে।
আমরা প্রথম থেকেই সরকারকে সতর্ক করার চেষ্টা করছিলাম যে, প্রতিবেশীর এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক পদক্ষেপ যেমন জরুরি, তেমনি দরকার পাল্টা প্রচার-প্রোপাগান্ডার ব্যবস্থা। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে সেটি কোনো কঠিন ও ব্যয়সাপেক্ষ ছিল না। সামান্য ব্যয়ে ও দু’ একজন লোকবল নিয়োগ করেই এ কাজটি করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সরকার বিষয়টির প্রতি কখনও মনোযোগ দেয়নি। বরং সময়ে সময়ে নাগরিকদের কেবল মূলা ঝুলিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করেছে। মাঝেমধ্যেই তারা নানা ধরনের আজগুবি ঘোষণা দিয়ে নাগরিকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। কখনও কখনও বলেছে সৌদি শ্রমবাজার খুলে যাচ্ছে। কখনও কখনও বলেছে খুলে যাচ্ছে আমীরাতের শ্রমবাজার। প্রকৃত পক্ষে পরে প্রমাণিত হয়েছে, এর সবই ছিল ধোকা। সর্বশেষ আমাদের জানানো হলো, সৌদি আরব নিচ্ছে নারী শ্রমিকসহ লাখ লাখ শ্রমিক। কিন্তু তাও ধোকায় পর্যবসিত হলো। সেখানে গিয়েছে মাত্র কয়েক শ’ নারী শ্রমিক। এখন সৌদি সরকার বলছে যে, নারী শ্রমিকের সঙ্গে যেতে পারবে তাদের কোনো পুরুষ আত্মীয়। তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার হারিয়েছে বাংলাদেশ।
শেষ পর্যন্ত আশার টিমটিমে আলো জ্বলে উঠলো মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রফতানির। মালয়েশিয়া সরকার প্রথমে ঘোষণা দিল, তারা বাংলাদেশ থেকে পাঁচ লাখ শ্রমিক নেবে। কিন্তু সে জনশক্তি রফতানিতেও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিল সরকার। এ নিয়ে শুরু হলো নানা ধরনের রশি টানাটানি। বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান বায়রা বললো যে, এই শ্রমিক পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হোক তাদের ওপর। এ নিয়ে টানাপোড়েন চলতে থাকলো। যথাসময়ে শ্রমিক পাঠানো শুরু করা গেল না। তখন মালয়েশিয়া সরকার বললো, তাহলে বাংলাদেশ শ্রমিক পাঠাক সরকার-টু-সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে। তাতে শ্রমিকদের বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। বিষয়টি নিয়ে আর এক দফা আলাপ আলোচনা শুরু হয়ে গেল। আবার এলা জি-টু-জি প্লাস প্রস্তাব। তাতেও কোনো কাজ হলো না। ততোদিনে পাঁচ লাখ শ্রমিক রফতানি হয়ে যাবার কথা। কিন্তু হলো না তার কিছুই।
মালয়েশিয়া সরকার আরও একটা বিষয় খুব পরিষ্কার করে জানিয়ে দিল যে, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশীসহ বিদেশীদের জন্য যে চাকরি তা অত্যন্ত বিপজ্জনক, কষ্টসাধ্য ও দুর্গম অঞ্চলে। অনেক সময় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশী শ্রমিকদের যে কাজের জন্য নেওয়া হয়, তারা সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো সহজ পথে উপার্জনের জন্য পালিয়ে যায়। ফলে যে কাজের জন্য তাদের নেওয়া হয়েছিল, সে কাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এটা নিয়োগকারীদের কঠিন সমস্যায় ফেলে। মালয়েশিয়া জনশক্তি আমদানি করে প্রধানত কৃষি ও নির্মাণ খাতের জন্য। কৃষি খাত মানে দুর্গম বন পরিষ্কার করে তাতে পাম ও রাবার চাষ করা। সন্দেহ নেই, এ কাজ খুবই কষ্টসাধ্য। তাছাড়া থাকতেও হয় দুর্গম অঞ্চলে। সেখানে সাপসহ নানা ধরনের বন্যপ্রাণীর উপদ্রব আছে। ফলে জীবনের ঝুঁকিও আছে। এ রকম ঝুঁকি আছে নির্মাণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও। মালয়েশিয়ায় কাজ করতে গেলে এটা মেনে নিয়েই যেতে হবে। মালয়েশিয়া সরকার সেটা বারবার জানিয়েছে।
তারপরও চাকরি প্রার্থীর কমতি কখনও হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যখন ঘোষণা করলো যে, মালয়েশিয়া সরকার আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লক্ষ শ্রমিক নেবে, ঠিক সেদিনই বাংলাদেশী শ্রমিকের নারী ধর্ষণের খবর ফলাও করে প্রচার করা হলো প্রতিবেশী দেশ প্রভাবিত সংবাদপত্রগুলোতে। এই খবরের সত্যাসত্য আমরা জানি না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার বাংলাদেশের হাতছাড়া হওয়ার পেছনে যে তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাত ছিল, তা সে সময়েই প্রমাণিত হয়েছে। এবারও তাই সন্দেহ ঘনীভূত হলো।
এখানে আরও একটি বিষয় কাজ করেছে। আর তা হলো, মালয়েশিয়া কখনও বলেনি যে তারা আগামি পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক নেবে। আমরা আমাদের ফুটানি জাহির করার জন্য এই সংখ্যা বাড়িয়ে বলেছে। প্রকৃত ঘটনা হলো শতাধিক দেশে বাংলাদেশি শ্রমিক যায়। সরকার বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিকদের একটি তালিকা করেছে। যার সংখ্যা ১৫ লাখ। তার সবাই মালয়েশিয়ায় চাকরি পাচ্ছে, এমন খবর প্রচার করার ফলে মালয়েশিয়া সরকারের ক্ষোভের কারণ ঘটতে পারে। আর তাই মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মালয়েশিয়া সরকার ঘোষণা করে যে, তারা আপাতত বাংলাদেশসহ বিদেশ থেকে কোনো শ্রমিক নেবে না। এর আগে আমাদের এই বলে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, মালয়েশিয়ায় যেসব বাংলাদেশী শ্রমিক অবৈধভাবে বসবাস করছে, তাদের ঐ দেশের সরকার বৈধতা দেবে। কিন্তু শ্রমিক না নেয়ার ঘোষণার সঙ্গে তারা এই ঘোষণাও দেয় যে, মালয়েশিয়ায় যেসব শ্রমিক অবৈধভাবে বসবাস করছে, তাদেরও শিগগির আটক করে বহিষ্কার করা হবে। মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী ড. হামিদি বলেছেন, সে দেশের শিল্প-কারখানার জন্য ঠিক কতো সংখ্যক শ্রমিক দরকার, তা নিরূপণের আগে আর কোনো শ্রমিক নেওয়া হবে না।
আবার একই দিন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী রিচার্ড বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় ১৫ লাখ শ্রমিক আসবে, এ তথ্য সঠিক নয়। রিচার্ড মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় ১৫ লাখ শ্রমিক আসবে এ খবরে দেশে যে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, তা এখন দূর হবে।’ আসলে বাংলাদেশ ১৩৯টি দেশে জনশক্তি রফতানির জন্য ঐ ১৫ লাখ লোকের তালিকা তৈরি করেছে। রিচার্ড আরও বলেন, গত ডিসেম্বরে মালয়েশিয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশী শ্রমিক রয়েছে দুই লাখ ৮২ হাজার ২৮৭ জন।
এখানে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রীর কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি কেন বললেন যে, বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক আমদানির খবরে তার দেশে ‘উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি’র সৃষ্টি হয়েছে? মালয়েশিয়ায় শ্রমিক আমদানির ঘটনা নতুন নয়। সে দেশের মানুষ বিদেশি শ্রমিক দেখে ও তাদের সঙ্গে কাজ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু বাংলাদেশী শ্রমিক আসছে শুনে তাদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হবে কেন? প্রশ্ন এখানেই।
একটি দেশ প্রভাবিত সংবাদপত্রগুলো দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশী শ্রমিকবিরোধী অপপ্রচার চালিয়ে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আর বাংলাদেশের সরকার তার প্রতিকার বা প্রতিরোধের চেষ্টা না করে কেবল বাগাড়ম্বরই করে যাচ্ছে। এই দুরবস্থা থেকে মুক্তির পথ প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে এই উদ্বেগের নিরসন। আপাতত এর কোনো বিকল্প নেই বলেই মনে হয়।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads