মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০১৬

চুপ না থেকে কথা বলুন আতিউর


আগের দিনে যারা নিয়মিত ঢাকাই বাংলা সিনেমা দেখেছেন, তারা বেশ কিছু জনপ্রিয় ডায়ালগের সঙ্গে পরিচিত। আবার পরিচিত অনেক ঘটনার সঙ্গে। কোনো একটা কাহিনী হিট করলে সঙ্গে সঙ্গে একই ধরনের কাহিনীর হিড়িক পড়ে যেতো সিনেমায়। সে রকম একটি সিকোয়েন্স হলো এ রকম : নায়িকাকে অপমান-অপদস্থ করেছে কোনো ভিলেন। এতে লজ্জায় অপমানে মরমে মরে যাচ্ছে নায়িকা। নায়িকার ভাই কিংবা হিরো নিজে এসে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছে নায়িকার সামনে। নায়িকা সরবে বা নীরবে কেবলই অশ্রুপাত করে যাচ্ছে। তখন নায়ক বা নায়িকার ভাই জানতে চাইছে, কে সেই বদমাশ। কিন্তু নায়িকা জবাব দিতে পারছে না। তখন নায়ক বা নায়িকার ভাই ডায়লগ মারছে, ‘পাথরের মূর্তির মতো চুপ করে থেকো না মর্জিনা, কথা বলো, জবাব দাও।’ নায়িকা তখন ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে সেই কালপ্রিটের নাম। তারপর নায়ক বা নায়িকার ভাইয়ের রা রা করতে করতে দৌড়। শেষে ভিলেনের সঙ্গে দেখা ও ফাইটিং। এভাবে সাধারণত শুরু হতো ঢাকাই সিনেমা।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের উত্থান এক লড়াইয়ের কাহিনী। অতি দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। পড়াশোনা করেছেন। অভাবের তাড়নায় গ্রামেই তিনি রাখালের চাকরি করেছেন। পরীক্ষার ফি যুগিয়েছেন অন্যরা। একথা আতিউর নিজেই বলেছেন। সাবাস আতিউর। কিন্তু ধারাবাহিক লড়াই সংগ্রাম নিষ্ঠা অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি শেখ হাসিনা সরকারের প্রিয়ভাজন হন। তারপর শেখ হাসিনা তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের গবর্নর পদে নিয়োজিত করেন। সেসময় ড. আতিউরকে অভিনন্দন জানানোর জন্য টেলিফোনে চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি।
আতিউরের সঙ্গে আমার পরিচয়ও বিরোধিতা দিয়ে। আমার গবেষণামূলক রাজনৈতিক বই ‘কথামালার রাজনীতি ১৯৭২-৭৯’ প্রকাশিত হলে আতিউর এক ক্ষুব্ধ সমালোচনা লেখেন সাপ্তাহিত বিচিত্রায়। সে বইয়ে ঐ সময়কালে আওয়ামী লীগের কথা ও কাজের অসঙ্গতি প্রতিটি বিষয়ে তথ্য-প্রমাণসহ আমি তুলে ধরি। এটি সংক্ষিপ্ত আকারে সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রচ্ছদ কাহিনী হিসেবেও প্রকাশিত হয়। আতিউরের সমালোচনার আমিও জবাব দেই। আতিউরের অভিযোগ ছিল, আমি কেন এই গবেষণার জন্য ঐ সময়কাল স্থির করলাম। জবাবে আমি লিখেছিলাম, কোন সময়কালের ওপর গবেষণা করব, সেটা গবেষকের বিষয়। তার পরেও কোনো গবেষণা জরুরি হলে সেটি আতিউর করুন। আমি তাকে অভিনন্দন জানাবো। আতিউর সে রকম গবেষণা করেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে, এই জবাব আর পাল্টা জবাবের মধ্য দিয়ে আমাদের পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। সেই আতিউর বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর হওয়ায় খুশি হয়েছিলাম। আমরা ভিন্ন মত-পথের অনুসারী হয়েও একসঙ্গে অনুষ্ঠানাদি করেছি। অবিরাম তার সাফল্য কামনা করেছি।
কিন্তু সেই আতিউর এ কী করলেন! দেশের সকল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক ব্যাংক এই বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হয়ে গেছে ৮০০ কোটি টাকা। সামান্য একটি বানান ভুলের জন্য চুরি হতে পারেনি আরও আট হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা তুলতে হলে বা ট্র্যান্সফার করতে হলে ১২ ধাপে তা চেক করতে হয়। কিন্তু এমন কীভাবে সম্ভব হলো যে এই সকল ধাপ পেরিয়ে হ্যাকাররা ৮০০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেল। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের  বেশ কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে দীর্ঘ পরিকল্পনায় এই টাকা লুট করার ফন্দি আঁটা হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের দিবাগত মধ্য রাতে ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে বসেই নিউইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংক থেকে টাকাগুলো শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপিন্সের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করার আদেশ দেয়া হয়। ঠিক সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট রুমের সিসি ক্যামেরা বন্ধ রাখা হয়। আবার ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কার  যে ব্যাংক শাখায় এ টাকা পাঠানো হয়, তাদেরও সিসি ক্যামেরা বন্ধ ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা এই লুটের সঙ্গে জড়িত তারা তাদের কম্পিউটার থেকে এসব আদেশের কপি মুছে ফেলে। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের আদেশ পেলে নিউইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা ছাড় করবে কি না তার অনুমোদন চায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সে অনুমোদনও পাঠানো হয়।
প্রথমে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায় যে, এর সঙ্গে তারা জড়িত নয়। এর জন্য জড়িত নিউইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংক। অর্থমন্ত্রী তো বলেই বসেন যে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে। ঘটনার রহস্য এখানে নয়, রহস্য হলো এই যে, ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে এই টাকা লুট হওয়ার পরেও মার্চের ৯ তারিখ পর্যন্ত ১ মাস ৪ দিন বাংলাদেশ ব্যাংক ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে রাখে। না অর্থমন্ত্রী, না অর্থসচিব কাউকেই বিষয়টি অবহিত করেননি তারা। ফিলিপিন্সে যে টাকা পাঠানো হয় তার ৪টি অনুরোধ ক্লিয়ার করা হয়। তাতেই চলে যায় ৮০০ কোটি টাকা। আর একটি  অ্যাকাউন্টে ফাউন্ডেশন বানান ভুল থাকায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়, তারা টাকাটি আটকে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ঘটনাটি প্রকাশ করে। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারাবাহিক অনুমোদন ছাড়া এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এই টাকা ছাড় করা সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসাবে তারা বলেছেন যে, সামান্য এটিএম বুথ থেকে টাকা জালিয়াতি করতে গেলেও যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তাতের যোগসাজশের প্রয়োজন হয়, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা চুরির পেছনে ব্যাংকের কেউ জড়িত নয় এটা হতে পারে না। এমনকি কোনো গ্রাহক এখন কাউকে কোনো চেক দিলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জেনে নেয়, সত্যি সত্যি সংশ্লিষ্ট গ্রাহক চেকটি দিয়েছেন কি না এবং তা তারা ক্লিয়ার করবেন কি না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো কিছুরই সাথে জবাব দিতে পারছেন না। এদিকে আবার বাংলাদেশ ব্যাংক নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বিষয়টি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে বলেন, তদন্তের স্বার্থে বেশি কিছু বলা যাবে না। আর সম্প্রতি যে ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানাকে বাংলাদেশ ব্যাংক-এর আইটি বিশেষজ্ঞ হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তিনিও এই ৮০০ কোটি টাকা চুরি ধামাচাপা দেয়ার জন্য নানা বাহানা করছেন। আর বিষয়টি তদন্তের জন্য নিয়োগ দিয়েছেন তারই প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান ফায়ার আইকে। ফলে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর কেন মাসাধিককাল ধরে বিষয়টি গোপন রাখলেন? বিষয়টিকে অর্থমন্ত্রী চরম ঔদ্ধত্য বলে অবিহিত করেছেন। তিনি খবর পাঠিয়েছিলেন যে, ড. আতিউর যেন বিমানবন্দর থেকে নেমেই তার সাথে দেখা করেন। কিন্তু আতিউর তাকে পাত্তা দেননি। গতকাল দুপুরে তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন এবং তার কাছেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। পদত্যাগপত্র জমা দিতে গিয়ে নানা নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছিল। পরে বিকেলে নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ৮০০ কোটি টাকা চুরির ব্যাপারে যত না কথা বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কথা বলেছেন তার সাফল্যগাথা নিয়ে। তা নিয়ে অনেকটা কাব্যই যেন করেছেন। জিডিপির প্রবৃদ্ধি যদি হয়ে থাকে তবে তার দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। সেটা এদেশের কৃষক-শ্রমিক-ব্যবসায়ীদের। তার সবচেয়ে বড় অবদান সম্ভবত তিনি প্রতিটি ব্যাংক নোটে এবং প্রতিটি কয়েনে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সংযুক্ত করেছেন। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে ড. আতিউরের গর্ব করার মতো কিছু নেই। ফিলিপিন্সে যে বিপুল অংকের টাকা গিয়েছিল তা যদি তারা প্রকাশ না করতেন, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনোদিনই চুরির কথা প্রকাশ করতো বলে মনে হয় না। কারণ, এ দেশের সাধারণ মানুষ নিউইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশের কত টাকা আছে না আছে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা নিজেদের আয়-রোজগারের চিন্তা নিয়ে থাকে। ফলে একদিন এটি নিঃশব্দে হারিয়েই যেত। আমি এমন অসঙ্গত কথা বলতে চাই না যে, এই চুরির ঘটনার সঙ্গে ড. আতিউর জড়িত। কিন্তু এর সবকিছু জেনেও তিনি চেপে গেছেন। যাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। আর কথা যা বলেছেন, সেটি ভাসা ভাসা। কেন তিনি প্রকাশ করেননি এর যুক্তি হিসেবে বলেছেন, তিনি একাই এই টাকা উদ্ধার করবেন। সামান্য যে ৬৮ হাজার ডলার শ্রীলঙ্কা থেকে নাকি ফেরত এসেছে, তিনি বলেছেন, এ কথা প্রকাশ করলে সেটাও ফেরত আসত না। ড. আতিউর বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখালেন!
আমি প্রথমেই যে বাংলা সিনেমার ডায়লগ দিয়ে শুরু করেছিলাম সেটি এখন বোধহয় আর খাটে না। আতিউর কথা বলেছেন, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক-এর এই ৮০০ কোটি টাকা লোপাটের রহস্য তিনি কিছুই বলেননি। একটি মামলা করেননি, একটি তদন্ত কমিটিও করেননি। বসে বসে শেখ মুজিবের নাম জপ করলেই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকাগুলো উড়াল দিয়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ অ্যাকাউন্টে ফেরত আসবে, সম্ভবত এমন ধারণাই তিনি করেছিলেন। তবে এই ৮০০ কোটি টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ পুরো টাকাটাই জালিয়াত চক্রের পকেটে চলে গেছে। ফিলিপিন্স সরকারের পক্ষেও তা উদ্ধার করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। জালিয়াতচক্র অতি সতর্ক। তারা টাকাটা ২২ দিন ব্যাংকে বসিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তথা আতিউর যদি সতর্ক হতেন তাহলে এই ২২ দিনে টাকাগুলোর একটা হিল্লে হতে পারত। কিন্তু ২২ দিন ফিলিপিন্সের টাকা পড়ে থাকায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, এই টাকা উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা আতিউর গং-এর উদ্যোগই ছিল না। ২২ দিন পর জালিয়াতচক্র ওই টাকা জুয়ার আসরের মাধ্যমে বিভিন্ন হাতে বের করে নিয়ে চলে যায়।
ড. আতিউর রহমান এ পর্যন্ত যা বলেছেন, তাতে সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সেখানে কোনো ভূমিকাই নেই। তাই ফের তাকে বলতে চাই ‘পাথরের মূর্তির মতো চুপ করে থাকবেন না আতিউর, কথা বলুন জবাব দিন।’
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads