এই সময়ে লেখার বিষয়বস্তু হিসেবে যা বেছে নেয়া দরকার সেদিকে যাওয়ার উপায় নেই। কেন, তার উত্তর জানতে হলে ক্ষমতাসীনদের দিকে লক্ষ্য করাই যথেষ্ট। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের প্রত্যেকে যেন যুদ্ধে নেমে পড়েছেন! তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কথা তো বলাই বাহুল্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জাসদ বিরোধী কঠোর আক্রমণের মুখে মিস্টার ইনুর যখন যাই যাই অবস্থা হওয়ার কথা, ঠিক তখনই একের পর এক ঘটেছে হামলা ও হত্যাকাণ্ডের নৃশংস ঘটনা। গুলশানের অবরোধ বা জিম্মি নাটক থেকে শোলাকিয়ার হামলা ও হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনাই বিশেষ করে তার এবং জাসদের জন্য এসেছে ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি সচেতন সকল মহলও জাসদকেন্দ্রিক বিতর্কের কথা ভুলে গেছেন। সেই সাথে বেঁচে গেছেন ইনু সাহেবরাও! ওদিকে সবাইকে স্তম্ভিত করে গত ১৭ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, দেশে বিরাজমান সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে নাকি জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে! এই ঐক্য কাদের সঙ্গে হয়েছেÑ তারও জবাব দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, যাদের সঙ্গে ঐক্য হওয়া প্রয়োজন তাদের সঙ্গেই জাতীয় ঐক্য হয়েছে! প্রধানমন্ত্রী একই সাথে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধেও যথারীতি সমালোচনা করেছেন। হত্যা-সন্ত্রাসের জন্য সব দোষ চাপাতে চেয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে যথেষ্টই বলা হয়েছে। সেদিকে যাওয়ার আগে জানিয়ে রাখি, এখানে কোনো ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে না। তবে একটি কথা মানতেই হবে। কথাটা হলো, ঘটনাপ্রবাহকে এমনভাবে এগিয়ে নেয়া হয়েছে ও হচ্ছে যে, এসবের সঙ্গে কারো পক্ষেই তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। ‘কৃতিত্ব’ কাকে বা কোন গোষ্ঠীকে দিতে হবে- সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। মানুষের দৃষ্টি ও মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য এ ধরনের ঘটনার আসলে তুলনা হয় না। ফলে ধরেই নেয়া যায়, পেছনে তৎপর রয়েছে এমন কোনো গোষ্ঠী, যারা ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছুর পরিকল্পনা করছে। সে অনুযায়ী ময়দানে হাজির করা হচ্ছে সেই সব লোকজনকে, যাদের আগে থেকেই ‘জঙ্গি’ বা সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি দেয়া হয়েছে। গুলশানের কথাই ধরা যাক। সেখানে পাঁচ-পাঁচজন ‘ওয়ান্টেড’ জঙ্গির লাশ পাওয়া গেলো, পুলিশ যাদের বহুদিন ধরে ‘খুঁজছিল’ বলে জানিয়েছেন স্বয়ং পুলিশের আইজি। ঠোঁট কাটারা বলেছেন, ওই পাঁচজনের ভাগ্য ভালো। কারণ, তাদের অন্তত বনে-জঙ্গলে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ প্রাণ হারাতে হয়নি। তারা মারা গেছে গুলশানের মতো অভিজাত একটি এলাকায়, যেখানে রয়েছে ‘নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা’! বলা দরকার, টিভি ক্যামেরার সামনে এই ‘ওয়ান্টেড’ জঙ্গিদের সম্পর্কে বলার জন্য আইজি সাহেবকে নাকি ধমক খেতে হয়েছে। কারণ, তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটি প্রচারণা জোরদার হয়েছে যে, ‘ওয়ান্টেড’ পাঁচজনকে অনেক আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। সুযোগ খোঁজা হচ্ছিল ‘বন্দুক যুদ্ধ’ কিংবা ‘ক্রস ফায়ারের’ জন্য কোনো উপলক্ষের। গুলশানের জিম্মি নাটকের আড়ালে সে সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করা হয়েছে! এটা অবশ্য আমাদের কথা নয়, লোকমুখে শোনা গেছে।
জঙ্গিদের তৎপরতা এবং হত্যাকাণ্ড দিয়ে শুরু করলেও এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য শুধু এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা নয়। আমরা বেশি উদ্বিগ্ন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ বা ভাবমর্যাদা নিয়ে। দেশ আসলে বহুদিন ধরেই ইমেজ সংকটে ভুগছে। জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড একটি বড় ফ্যাক্টর সন্দেহ নেই, কিন্তু বাংলাদেশের ইমেজ সংকট শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে। বড় কথা, সেখানে কথিত জঙ্গিদের সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একটি উদাহরণ হিসেবে ঢাকার হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে যাওয়া কার্গো ফ্লাইটের ওপর বিভিন্ন দেশের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করতেই হবে। এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ খবর হলো, অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনের পর জার্মানিও বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এটা গত মাস জুনের শেষ সপ্তাহের ঘটনা। এর ফলে হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই করে সরাসরি কোনো বিমানই জার্মানিতে যেতে পারবে না। এমনকি জার্মানির রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা লুফথান্সার কোনো বিমানও ঢাকা থেকে ওঠানো পণ্য নিয়ে সে দেশে ঢুকতে পারবে না। লুফথান্সাকেও জার্মানির অনুমোদিত তৃতীয় কোনো দেশের বিমান বন্দরে পণ্যগুলো রি-স্ক্যানিং করাতে হবে। সেখানে অনাপত্তিপত্র পাওয়া গেলেই ঢাকা থেকে নেয়া পণ্যসহ লুফথান্সার বিমান দেশটিতে ঢুকতে ও পণ্য খালাস করতে পারবে। নিষেধাজ্ঞার কারণ জানাতে গিয়ে খবরে বলা হয়েছে, বিমান বন্দরের রফতানি টার্মিনালে যারা কাজ করে তাদের বেশিরভাগই বহিরাগত। নামমাত্র স্ক্যানিং করেই তারা টার্মিনালে ঢুকে পড়ে এবং যখন-তখন বাইরে যাতায়াত করে। তারা যে পণ্যের সঙ্গে বোমা বা অন্য কোনো বিস্ফোরক এবং ধ্বংসাত্মক কিছু পাঠাবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একই কারণে অনেকদিন ধরে সতর্ক করার পর চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে জার্মানি বলেছিল, এর মধ্যে বহিরাগতদের বিদায় করে নিজস্ব কর্মচারী নিযুক্তি না দেয়া হলে দেশটি বাংলাদেশ বিমান এবং বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অন্য কোনো দেশের বিমানকে কার্গো পরিবহন করতে দেবে না।
উল্লেখ্য, মূলত নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গত বছর, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নিষেধাজ্ঞা প্রথম চাপিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এর ফলে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকার লোকসান গুণতে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার পর গত মার্চে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিটেন। এজন্যও বিপুল ক্ষতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশের রফতানি। এ দুটি দেশের পাশাপাশি জার্মানির নিষেধাজ্ঞা ক্ষতির পরিমাণকে কেবল বাড়াবেই। তাছাড়া একযোগে বহির্বিশ্বে ক্ষুণœ হবে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা। উদ্বেগের কারণ হলো, বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ব্রিটেনে বছরে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার বা ৮৮ হাজার কোটি টাকার পণ্য রফতানি করা হয়। দেশ তিনটির মধ্যে আমদানির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পর জার্মানি রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এতদিন শুধু লুফথান্সার মাধ্যমেই মাসে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতো বিমান। নিষেধাজ্ঞার ফলে ওই নিশ্চিত আয় বন্ধ হয়ে যাবে। ওদিকে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, গার্মেন্ট পণ্যের নমুনাসহ তৈরি পোশাক খাতের বড় অংশই আকাশ পথে শুল্কমুক্ত সুবিধায় জার্মানিতে যেতো। এ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।
এদিকে অনুসন্ধানেও কেবল অভিযোগের সত্যতাই পাওয়া যায়নি, বেরিয়ে এসেছে ভীতিকর বিভিন্ন তথ্যও। যেমন হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পুরো কার্গো রফতানি টার্মিনালই বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ড অ্যাসোসিয়েশন- ‘বাপা’ নামের একটি সংগঠনের দখলে রয়েছে। বাপা কর্মীদের অধিকাংশই চোরাচালানসহ বিভিন্ন মামলার আসামী, রাজনৈতিক দলের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ক্যাডার এবং স্থানীয় সন্ত্রাসী। তারা নামমাত্র স্ক্যানিং করিয়েই কার্গো টার্মিনালে ঢুকে পড়ে এবং সর্বত্র অবাধে তৎপরতা চালায়। যখন-তখন টার্মিনালের বাইরে যাতায়াত তো করেই, তাদের নানা ধরনের পণ্যও আনা নেয়া করতে দেখা যায়। বাপার এসব কর্মির মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের বিমানে রফতানি পণ্য ওঠানো বা লোড করা হয়। বিমান থেকে পণ্য খালাসও তারাই করে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্যটি হলো, কার্গো টার্মিনালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ রেডলাইন নামের যে ব্রিটিশ সিকিউরিটি কোম্পানিকে নিযুক্তি দিয়েছে সে কোম্পানির সঙ্গেও বাপা কর্মীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উভয়পক্ষের মধ্যে গোপন লেনদেনের তথ্যও বিভিন্ন উপলক্ষে ফাঁস হয়েছে। বিষয়টি বিভিন্ন দেশ অবশ্যই লক্ষ্য করেছে আর সে কারণেই দেশগুলো বিমান কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছে। নিজস্ব জনবল নিয়োগ দেয়ার দাবিও জানিয়েছে তারা। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সরকারের কানেও পানি ঢোকেনি। মূলত সেজন্যই পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিমানের কার্গো পরিবহনের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অর্থনৈতিক দিক থেকেই শুধু ক্ষতিকর নয়, দেশের ভাবমর্যাদার জন্যও অত্যন্ত লজ্জাকর। অথচ বিমান কর্তৃপক্ষ যদি দেশগুলোর আপত্তি সম্পর্কে জানার পর থেকেই বহিরাগতদের বিদায় করে কার্গো টার্মিনালে নিজস্ব জনবল বাড়ানোর পদক্ষেপ নিত তাহলে অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের পর জার্মানির জন্য এতটা কঠোর ও অসম্মানজনক পদক্ষেপ নেয়ার অজুহাত তৈরি হতো না। কথাটা বলার কারণ, পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বহিরাগতদের ব্যাপারে কোনো দেশের অভিযোগই অসত্য বা অমূলক নয়। আসলেও জনা কয়েক নিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া টার্মিনালে কর্মরতরা সবাই বহিরাগত। তারা দফায় দফায় বাইরে যাতায়াত করে। অনেকে নানা পণ্যও বহন করে। কিন্তু কোনোবারই আর স্ক্যানিং বা সার্চ করা হয় না। এর ফলে তাদের পক্ষে বোমা, বিস্ফোরক বা অন্য যে কোনো ধ্বংসাত্মক বস্তু পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়। বিষয়টি ধীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করেই বিভিন্ন দেশ বিমান কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছে। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ বা সরকার গুরুত্ব দেয়নি। সেজন্যই পরিস্থিতি এতটা বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কার্গো টার্মিনালকেন্দ্রিক সমস্যার অবশ্যই আশু সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কারণ, দেশের ভাবমর্যাদার প্রশ্ন তো রয়েছেই, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এসেছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। নিষেধাজ্ঞার ফলে রফতানি খাতে হাজার কোটি টাকার অংকে ক্ষতির শিকার হবে দেশ। বাস্তবে এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরুও করেছেন রফতানিকারকরা। এভাবে চলতে থাকলে ইইউভুক্ত অন্য দেশগুলোও নিষেধাজ্ঞা চাপাতে পারে। তেমন অবস্থায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। ফলে গার্মেন্ট শিল্প শুধু নয়, কৃষি খাতও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, বাংলাদেশ থেকে শাক-সবজিও কার্গোর মাধ্যমেই রফতানি করা হয়। অর্থাৎ কার্গো নিষিদ্ধ হলে ক্ষয়ক্ষতি হবে সর্বাত্মক। এজন্যই টার্মিনাল থেকে বহিরাগতদের বিদায় করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে এমনভাবে নেয়া দরকার, যাতে অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ও জার্মানির মতো দেশগুলো তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্য কোনো দেশ যাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে।
পাঠকরা সম্ভবত এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার এবং বাংলাদেশের ভাবমর্যাদার সংকটের জন্য ক্ষমতাসীনরা প্রধানত কথিত জঙ্গিদের তৎপরতাকেই দায়ী করে থাকেন। সশস্ত্র হামলা ও হত্যাকান্ডের কথা বলতেও ভুল হয় না তাদের। অন্যদিকে এসব কর্মকাণ্ড কিন্তু অতি সাম্প্রতিক সময়ের। বাস্তবে বাংলাদেশ তার ভাবমর্যাদার সংকটে পড়েছে সরকারের নানামুখী ব্যর্থতা ও অক্ষমতার কারণে। হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপদজনক অব্যবস্থাপনা সেসবের একটি উদাহরণ মাত্র। দেশের ভাবমর্যাদার সংকটের পেছনে একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলে নেতাকর্মীদের ওপর চলমান নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনও বিরাট ভ’মিকা পালন করে চলেছে। বহুবার আলোচিত বিষয়টি নিয়ে এই মুহূর্তে কথা না বাড়ানোই ভালো। তবে একটি কথা জানিয়ে রাখা দরকার। সাজানো নাটকের মাধ্যমে সব সময় সংকট লুকিয়ে রাখা বা সমস্যা আড়াল করা যায় না। কারণ, সত্যের ঢোল আপনা-আপনিই বেজে ওঠে। যেমনটি আইজিপির বদৌলতে বেজে উঠি-উঠি অবস্থায় এসে গিয়েছিল গুলশানের জিম্মি নাটক। অন্তরালের পরিকল্পনাকারীরাও অবশ্য জবরই দেখিয়েছেন। গুলশানকে দিয়ে তারা জাসদকেন্দ্রিক সংকটকে আড়াল করেছেন। এরপর এসেছে শোলাকিয়ার ঘটনা। কিন্তু এরকম প্রশ্নসাপেক্ষ পন্থায় কি সবকিছু অনির্দিষ্টকাল ধরে লুকিয়ে রাখা বা আড়াল করা যাবে? আমরা তো মনে করি, কৎসিত ও প্রশ্নসাপেক্ষ নানা পন্থায় দফায় দফায় দেশকে ডোবানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসা। সে কথাটাই বলা হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে। বিএনপি বলেছে, জাতীয় ঐক্যের নামে প্রধানমন্ত্রী আসলে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের ঐক্যের কথাই বুঝিয়েছেন, যা মোটেও সমগ্র জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে না। বিএনপি চেয়ারপারসনের আহ্বানে সাড়া দেয়া হয়নি বলেই দেশে প্রতিদিন ২০/২২ জন পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি ১৪ দলীয় জোটের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এজন্যই দেশপ্রেমিক জাতীয় নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার এখনো দোষারোপের রাজনীতিকেই এগিয়ে নিয়ে চলেছে। বিএনপি মনে করে, ঐক্য করতে হবে সকলকে নিয়ে। এমনকি কেবল সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্য হলেও চলমান সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব হবে না। বিএনপি সরকারের দোষারোপের রাজনীতিরও তীব্র সমালোচনা করেছে। বলেছে, কিছু ঘটলেই তার দায় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর চাপানো হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত ঘাতক-সন্ত্রাসীরা পার তো পেয়ে যাচ্ছেই, প্রশ্রয়ও পাচ্ছে। সে জন্যই নতুন নতুন হত্যা-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটতে পারছে। অন্যদিকে এসবের দায় সরকার শুধু বিরোধী দলের ওপর চাপাচ্ছে না, মিথ্যা অভিযোগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করছে। তাদের নামে মিথ্যা অভিযোগে মামলাও চাপাচ্ছে। বিএনপি নেতারা সরকারের এই কর্মকা- বন্ধ করার এবং অবিলম্বে কার্যকর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে’ বলে প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন তা একেবারেই অন্যায্য ও অর্থহীন। প্রধানমন্ত্রী যদি ১৪ দলীয় জোটের কথা বুঝিয়ে থাকেন তাহলে তার বক্তব্য ঠিক আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষও এখন বুঝতে পারে যে, এটা জাতীয় ঐক্য নয়। বরং ঐক্য সৃষ্টির পরিবর্তে দোষারোপের রাজনীতির মাধ্যমে সরকার জাতিকে বিভক্তির দিকেই ঠেলে দিয়েছে। জঙ্গি দমনের নামে নাটকীয়তা সৃষ্টি করে জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অব্যাহতভাবে খুন করা হচ্ছে। অনেকেই গুম হয়ে যাচ্ছেন। অনেকের ওপর সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে বিভিন্ন ঘটনার দায় স্বীকার করার জন্য মিথ্যা জবানবন্দী আদায় করা হচ্ছে। এ সমস্ত কার্যক্রম প্রকারান্তরে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদেরকেই আড়াল করার এবং আস্কারা দেয়ার শামিল। হত্যা-সন্ত্রাসের এই দুর্যোগ থেকে জাতিকে মুক্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ সৃষ্টির করতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই দলীয় একচোখা রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল অনুরোধ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যাতে দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ করেন এবং দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে কার্যকর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সরকারী ও বিরোধী দল নির্বিশেষে চিন্তাশীল, বিবেকবান এবং সকল পর্যায়ের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিএনপি ও জামায়াতের পরামর্শ ও আহ্বানের মধ্যেই রয়েছে কথিত জঙ্গিদের উৎখাত করার পাশাপাশি দেশের ভাবমর্যাদার সংকট কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা। নাহলে অযথাই বারবার নাটক সাজানোর ঝুঁকি নিতে হবে। কথিত জাতীয় ঐক্য নিয়েও নাটকীয়তা গ্রহণযোগ্য হবে না। বড় কথা, এত বেশি ঝুঁকি নেয়াটাও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ!
জঙ্গিদের তৎপরতা এবং হত্যাকাণ্ড দিয়ে শুরু করলেও এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য শুধু এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা নয়। আমরা বেশি উদ্বিগ্ন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ বা ভাবমর্যাদা নিয়ে। দেশ আসলে বহুদিন ধরেই ইমেজ সংকটে ভুগছে। জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড একটি বড় ফ্যাক্টর সন্দেহ নেই, কিন্তু বাংলাদেশের ইমেজ সংকট শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে। বড় কথা, সেখানে কথিত জঙ্গিদের সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একটি উদাহরণ হিসেবে ঢাকার হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে যাওয়া কার্গো ফ্লাইটের ওপর বিভিন্ন দেশের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করতেই হবে। এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ খবর হলো, অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনের পর জার্মানিও বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এটা গত মাস জুনের শেষ সপ্তাহের ঘটনা। এর ফলে হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই করে সরাসরি কোনো বিমানই জার্মানিতে যেতে পারবে না। এমনকি জার্মানির রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা লুফথান্সার কোনো বিমানও ঢাকা থেকে ওঠানো পণ্য নিয়ে সে দেশে ঢুকতে পারবে না। লুফথান্সাকেও জার্মানির অনুমোদিত তৃতীয় কোনো দেশের বিমান বন্দরে পণ্যগুলো রি-স্ক্যানিং করাতে হবে। সেখানে অনাপত্তিপত্র পাওয়া গেলেই ঢাকা থেকে নেয়া পণ্যসহ লুফথান্সার বিমান দেশটিতে ঢুকতে ও পণ্য খালাস করতে পারবে। নিষেধাজ্ঞার কারণ জানাতে গিয়ে খবরে বলা হয়েছে, বিমান বন্দরের রফতানি টার্মিনালে যারা কাজ করে তাদের বেশিরভাগই বহিরাগত। নামমাত্র স্ক্যানিং করেই তারা টার্মিনালে ঢুকে পড়ে এবং যখন-তখন বাইরে যাতায়াত করে। তারা যে পণ্যের সঙ্গে বোমা বা অন্য কোনো বিস্ফোরক এবং ধ্বংসাত্মক কিছু পাঠাবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একই কারণে অনেকদিন ধরে সতর্ক করার পর চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে জার্মানি বলেছিল, এর মধ্যে বহিরাগতদের বিদায় করে নিজস্ব কর্মচারী নিযুক্তি না দেয়া হলে দেশটি বাংলাদেশ বিমান এবং বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অন্য কোনো দেশের বিমানকে কার্গো পরিবহন করতে দেবে না।
উল্লেখ্য, মূলত নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গত বছর, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নিষেধাজ্ঞা প্রথম চাপিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এর ফলে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকার লোকসান গুণতে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার পর গত মার্চে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিটেন। এজন্যও বিপুল ক্ষতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশের রফতানি। এ দুটি দেশের পাশাপাশি জার্মানির নিষেধাজ্ঞা ক্ষতির পরিমাণকে কেবল বাড়াবেই। তাছাড়া একযোগে বহির্বিশ্বে ক্ষুণœ হবে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা। উদ্বেগের কারণ হলো, বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ব্রিটেনে বছরে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার বা ৮৮ হাজার কোটি টাকার পণ্য রফতানি করা হয়। দেশ তিনটির মধ্যে আমদানির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পর জার্মানি রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এতদিন শুধু লুফথান্সার মাধ্যমেই মাসে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতো বিমান। নিষেধাজ্ঞার ফলে ওই নিশ্চিত আয় বন্ধ হয়ে যাবে। ওদিকে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, গার্মেন্ট পণ্যের নমুনাসহ তৈরি পোশাক খাতের বড় অংশই আকাশ পথে শুল্কমুক্ত সুবিধায় জার্মানিতে যেতো। এ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।
এদিকে অনুসন্ধানেও কেবল অভিযোগের সত্যতাই পাওয়া যায়নি, বেরিয়ে এসেছে ভীতিকর বিভিন্ন তথ্যও। যেমন হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পুরো কার্গো রফতানি টার্মিনালই বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ড অ্যাসোসিয়েশন- ‘বাপা’ নামের একটি সংগঠনের দখলে রয়েছে। বাপা কর্মীদের অধিকাংশই চোরাচালানসহ বিভিন্ন মামলার আসামী, রাজনৈতিক দলের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ক্যাডার এবং স্থানীয় সন্ত্রাসী। তারা নামমাত্র স্ক্যানিং করিয়েই কার্গো টার্মিনালে ঢুকে পড়ে এবং সর্বত্র অবাধে তৎপরতা চালায়। যখন-তখন টার্মিনালের বাইরে যাতায়াত তো করেই, তাদের নানা ধরনের পণ্যও আনা নেয়া করতে দেখা যায়। বাপার এসব কর্মির মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের বিমানে রফতানি পণ্য ওঠানো বা লোড করা হয়। বিমান থেকে পণ্য খালাসও তারাই করে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্যটি হলো, কার্গো টার্মিনালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ রেডলাইন নামের যে ব্রিটিশ সিকিউরিটি কোম্পানিকে নিযুক্তি দিয়েছে সে কোম্পানির সঙ্গেও বাপা কর্মীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উভয়পক্ষের মধ্যে গোপন লেনদেনের তথ্যও বিভিন্ন উপলক্ষে ফাঁস হয়েছে। বিষয়টি বিভিন্ন দেশ অবশ্যই লক্ষ্য করেছে আর সে কারণেই দেশগুলো বিমান কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছে। নিজস্ব জনবল নিয়োগ দেয়ার দাবিও জানিয়েছে তারা। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সরকারের কানেও পানি ঢোকেনি। মূলত সেজন্যই পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিমানের কার্গো পরিবহনের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অর্থনৈতিক দিক থেকেই শুধু ক্ষতিকর নয়, দেশের ভাবমর্যাদার জন্যও অত্যন্ত লজ্জাকর। অথচ বিমান কর্তৃপক্ষ যদি দেশগুলোর আপত্তি সম্পর্কে জানার পর থেকেই বহিরাগতদের বিদায় করে কার্গো টার্মিনালে নিজস্ব জনবল বাড়ানোর পদক্ষেপ নিত তাহলে অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের পর জার্মানির জন্য এতটা কঠোর ও অসম্মানজনক পদক্ষেপ নেয়ার অজুহাত তৈরি হতো না। কথাটা বলার কারণ, পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বহিরাগতদের ব্যাপারে কোনো দেশের অভিযোগই অসত্য বা অমূলক নয়। আসলেও জনা কয়েক নিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া টার্মিনালে কর্মরতরা সবাই বহিরাগত। তারা দফায় দফায় বাইরে যাতায়াত করে। অনেকে নানা পণ্যও বহন করে। কিন্তু কোনোবারই আর স্ক্যানিং বা সার্চ করা হয় না। এর ফলে তাদের পক্ষে বোমা, বিস্ফোরক বা অন্য যে কোনো ধ্বংসাত্মক বস্তু পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়। বিষয়টি ধীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করেই বিভিন্ন দেশ বিমান কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছে। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ বা সরকার গুরুত্ব দেয়নি। সেজন্যই পরিস্থিতি এতটা বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কার্গো টার্মিনালকেন্দ্রিক সমস্যার অবশ্যই আশু সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কারণ, দেশের ভাবমর্যাদার প্রশ্ন তো রয়েছেই, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এসেছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। নিষেধাজ্ঞার ফলে রফতানি খাতে হাজার কোটি টাকার অংকে ক্ষতির শিকার হবে দেশ। বাস্তবে এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরুও করেছেন রফতানিকারকরা। এভাবে চলতে থাকলে ইইউভুক্ত অন্য দেশগুলোও নিষেধাজ্ঞা চাপাতে পারে। তেমন অবস্থায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। ফলে গার্মেন্ট শিল্প শুধু নয়, কৃষি খাতও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, বাংলাদেশ থেকে শাক-সবজিও কার্গোর মাধ্যমেই রফতানি করা হয়। অর্থাৎ কার্গো নিষিদ্ধ হলে ক্ষয়ক্ষতি হবে সর্বাত্মক। এজন্যই টার্মিনাল থেকে বহিরাগতদের বিদায় করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে এমনভাবে নেয়া দরকার, যাতে অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ও জার্মানির মতো দেশগুলো তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্য কোনো দেশ যাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে।
পাঠকরা সম্ভবত এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার এবং বাংলাদেশের ভাবমর্যাদার সংকটের জন্য ক্ষমতাসীনরা প্রধানত কথিত জঙ্গিদের তৎপরতাকেই দায়ী করে থাকেন। সশস্ত্র হামলা ও হত্যাকান্ডের কথা বলতেও ভুল হয় না তাদের। অন্যদিকে এসব কর্মকাণ্ড কিন্তু অতি সাম্প্রতিক সময়ের। বাস্তবে বাংলাদেশ তার ভাবমর্যাদার সংকটে পড়েছে সরকারের নানামুখী ব্যর্থতা ও অক্ষমতার কারণে। হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপদজনক অব্যবস্থাপনা সেসবের একটি উদাহরণ মাত্র। দেশের ভাবমর্যাদার সংকটের পেছনে একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলে নেতাকর্মীদের ওপর চলমান নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনও বিরাট ভ’মিকা পালন করে চলেছে। বহুবার আলোচিত বিষয়টি নিয়ে এই মুহূর্তে কথা না বাড়ানোই ভালো। তবে একটি কথা জানিয়ে রাখা দরকার। সাজানো নাটকের মাধ্যমে সব সময় সংকট লুকিয়ে রাখা বা সমস্যা আড়াল করা যায় না। কারণ, সত্যের ঢোল আপনা-আপনিই বেজে ওঠে। যেমনটি আইজিপির বদৌলতে বেজে উঠি-উঠি অবস্থায় এসে গিয়েছিল গুলশানের জিম্মি নাটক। অন্তরালের পরিকল্পনাকারীরাও অবশ্য জবরই দেখিয়েছেন। গুলশানকে দিয়ে তারা জাসদকেন্দ্রিক সংকটকে আড়াল করেছেন। এরপর এসেছে শোলাকিয়ার ঘটনা। কিন্তু এরকম প্রশ্নসাপেক্ষ পন্থায় কি সবকিছু অনির্দিষ্টকাল ধরে লুকিয়ে রাখা বা আড়াল করা যাবে? আমরা তো মনে করি, কৎসিত ও প্রশ্নসাপেক্ষ নানা পন্থায় দফায় দফায় দেশকে ডোবানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসা। সে কথাটাই বলা হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে। বিএনপি বলেছে, জাতীয় ঐক্যের নামে প্রধানমন্ত্রী আসলে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের ঐক্যের কথাই বুঝিয়েছেন, যা মোটেও সমগ্র জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে না। বিএনপি চেয়ারপারসনের আহ্বানে সাড়া দেয়া হয়নি বলেই দেশে প্রতিদিন ২০/২২ জন পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি ১৪ দলীয় জোটের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এজন্যই দেশপ্রেমিক জাতীয় নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার এখনো দোষারোপের রাজনীতিকেই এগিয়ে নিয়ে চলেছে। বিএনপি মনে করে, ঐক্য করতে হবে সকলকে নিয়ে। এমনকি কেবল সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্য হলেও চলমান সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব হবে না। বিএনপি সরকারের দোষারোপের রাজনীতিরও তীব্র সমালোচনা করেছে। বলেছে, কিছু ঘটলেই তার দায় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর চাপানো হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত ঘাতক-সন্ত্রাসীরা পার তো পেয়ে যাচ্ছেই, প্রশ্রয়ও পাচ্ছে। সে জন্যই নতুন নতুন হত্যা-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটতে পারছে। অন্যদিকে এসবের দায় সরকার শুধু বিরোধী দলের ওপর চাপাচ্ছে না, মিথ্যা অভিযোগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করছে। তাদের নামে মিথ্যা অভিযোগে মামলাও চাপাচ্ছে। বিএনপি নেতারা সরকারের এই কর্মকা- বন্ধ করার এবং অবিলম্বে কার্যকর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে’ বলে প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন তা একেবারেই অন্যায্য ও অর্থহীন। প্রধানমন্ত্রী যদি ১৪ দলীয় জোটের কথা বুঝিয়ে থাকেন তাহলে তার বক্তব্য ঠিক আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষও এখন বুঝতে পারে যে, এটা জাতীয় ঐক্য নয়। বরং ঐক্য সৃষ্টির পরিবর্তে দোষারোপের রাজনীতির মাধ্যমে সরকার জাতিকে বিভক্তির দিকেই ঠেলে দিয়েছে। জঙ্গি দমনের নামে নাটকীয়তা সৃষ্টি করে জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অব্যাহতভাবে খুন করা হচ্ছে। অনেকেই গুম হয়ে যাচ্ছেন। অনেকের ওপর সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে বিভিন্ন ঘটনার দায় স্বীকার করার জন্য মিথ্যা জবানবন্দী আদায় করা হচ্ছে। এ সমস্ত কার্যক্রম প্রকারান্তরে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদেরকেই আড়াল করার এবং আস্কারা দেয়ার শামিল। হত্যা-সন্ত্রাসের এই দুর্যোগ থেকে জাতিকে মুক্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ সৃষ্টির করতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই দলীয় একচোখা রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল অনুরোধ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যাতে দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ করেন এবং দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে কার্যকর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সরকারী ও বিরোধী দল নির্বিশেষে চিন্তাশীল, বিবেকবান এবং সকল পর্যায়ের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিএনপি ও জামায়াতের পরামর্শ ও আহ্বানের মধ্যেই রয়েছে কথিত জঙ্গিদের উৎখাত করার পাশাপাশি দেশের ভাবমর্যাদার সংকট কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা। নাহলে অযথাই বারবার নাটক সাজানোর ঝুঁকি নিতে হবে। কথিত জাতীয় ঐক্য নিয়েও নাটকীয়তা গ্রহণযোগ্য হবে না। বড় কথা, এত বেশি ঝুঁকি নেয়াটাও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ!
আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন