মাদারীপুরে কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর উপর কথিত হামলার ঘটনায় প্রথমে স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক, পরে পুলিশ রিমান্ডে থাকা কলেজছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে সাজানো ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করায় সারাদেশে তীব্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। পুলিশের প্রতি সকলের সন্দেহের দৃষ্টি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ ও পাঠক মতামতে এ ঘটনার প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। ফাহিমকে হত্যা করার বিষয়ে যে বিবরণ পুলিশের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে তাতে নতুন কিছু নেই। অতি পুরনো, অতিকথিত কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। দেশের সচেতন মানুষ পুলিশের এই ক্রসফায়ারের গল্প বিশ্বাস করে না। মানুষ মনে করে, এটা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের টার্গেট কিলিংয়ের মতোই পুলিশের এক ধরনের ‘টার্গেট কিলিং’ বা ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’। ফাহিমের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ২০ দলীয় জোট, সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী সমাজ, আইন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিমান্ডে থাকা আসামী হ্যান্ডকাফ বাঁধা অবস্থায় এভাবে নিহত হতে পারে এটা কী করে বিশ্বাসযোগ্য হয়?
পুলিশের নিরাপদ হেফাজতে এবং নিñিদ্র পাহারার মধ্যে থাকার পরও যদি দেশের কোন নাগরিক হত্যার শিকার হয় তবে তার দায় পুলিশ এড়াতে পারে কি? ফাহিম ছিল রিপন চক্রবর্তীর উপর কথিত হামলার ঘটনায় একমাত্র আসামী। তার গ্রেফতার করার কৃতিত্ব কিন্তু পুলিশের নয়, আশপাশের কিছু লোক তাকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। গত কয়েক দিনে পুলিশের পক্ষ থেকে তার সম্পর্কে নানা সাজানো-গোছানো কথা বলা হয়েছে। তার কাছ থেকে হামলার উদ্দেশ্য, হামলায় আরো কারা কারা জড়িত ছিল, নেপথ্যে কারা ছিল এসব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেত। অথচ প্রকৃত অপরাধী ও কুশীলবদের আড়াল করতেই হয়তো তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হলো।
দেশের অনেকেই শর্ষের ভেতর ভূতের প্রতিচ্ছবি দেখছেন। টিভির টকশোগুলোতে এ হত্যাকা- নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুগত কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরীক দলের নেতা এবং ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগীদের অনেকেই ‘পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ’ এবং ‘ক্রসফায়ার করে হত্যাকা-’ ঘটনো নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী অটো সরকারের বন্ধু স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল স্পষ্টভাবেই বলেছেন, রাষ্ট্র আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের প্রশ্নÑ পুলিশ কাকে আড়াল করতে এই কথিত বন্দুকযুদ্ধ করেছে? ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরীক জাসদ নেতা মাইনুদ্দিন খান বাদলও কথিত বন্দুকযুদ্ধের তীব্র প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছেন। পুলিশ রিমান্ডে থাকা কলেজছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম পুলিশেরই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা মিডিয়ায় যখন তোলপাড় চলছে, তখনই ঢাকার খিলগাঁও মেরাদিয়া বাঁশপট্টিতে ব্লগার অভিজিত হত্যা মামলার আসামী শরিফুল ভেবে যে যুবককে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়, পরে জানা যায় তার নাম মুকুল রানা।
পুলিশের রিমান্ডের আসামীর ক্রসফায়ারে হত্যা করা বা মেরে ফেলার ঘটনা নাৎসী বাহিনীর বর্বর হত্যাকা-ের ভয়াবহ ঘটনাকেই মনে করিয়ে দেয়। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, রাষ্ট্রের হেফাজতে যখন আসামী থাকে তখন সকল দায় রাষ্ট্রের। একজন শিক্ষকের উপর কথিত হামলা করতে গিয়ে সে স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক হলো। পরে পুলিশ বলেছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এরপর পুলিশী রিমান্ডে হ্যান্ডকাফ বাঁধা অবস্থায় কিভাবে এটা হলো তা সাধারণ বুদ্ধিতে ধরে না। বলা বাহুল্য, সাধারণ বুদ্ধিতে না ধরার কিছু নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেছেন, বড় কোন ঘটনাকে আড়াল করতেই এ ঘটনা ঘটানো হলো কিনা এ ধরনের প্রশ্ন জনগণের মধ্যে আসতে পারে। কোন প্রশ্ন নয়, বিএনপির পক্ষ থেকে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতেই ক্রসফায়ারে ফাহিমকে হত্যা করা হয়েছে।
জানা যায়, সারা দেশে গত সাড়ে তিন বছরে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার এবং পুলিশী হেফাজতে ৪৫৬ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৭২ জন, ২০১৪ সালে ১২৮ জন, ২০১৫ সালে ১৮৩ জন এবং চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৭৩ জন কথিত বন্দুকযুুদ্ধে বা পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সব কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের সাজানো গোছানো কাহিনী ছিল প্রায় অভিন্ন। পুলিশের রিমান্ডে থাকাবস্থায় মাদারীপুরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে কলেজছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বিবিসি বাংলাকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশী রিমান্ডের সময় আইনজীবী এবং নিকট আত্মীয় ও পরিচিত কারো উপস্থিতির বিধান থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। দেশে কারো কোন সন্দেহ নেই যে, পুলিশ তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ মেরে ফেলছে। ২০০৪-০৫ সালে হয়তো কেউ কেউ পুলিশের ক্রসফায়ারের কিচ্ছা বিশ্বাস করতো, এখন কেউ বিশ্বাস করে না। তিনি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মেনে নিম্ন আদালতের রিমান্ডে মঞ্জুরের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বাংলা ভিশনের টকশোতে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার গত ১৫ থেকে ২০ বছরের পুলিশের একটি ধারাবাহিক গল্প। যে গল্পের কাহিনী, দৃশ্য, চরিত্র, অংক কোন কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। ক্রসফায়ার বিষয়টা হচ্ছে একটি বিশেষ অভিযানে কখনো কখনো কথিত অপরাধীর পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ হয়, যে যুদ্ধে পুলিশ নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য গুলী করে। তখন ঐ গুলীতে অপরাধীর কেউ মারা যায়। এমন একটি গল্প আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন তদন্তে পুলিশকে অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়নি। এমনকি আজ পর্যন্ত কোন পুলিশ বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে মারা গেছে এ রকম দেখিনি। এক অপরাধ বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমেরিকায় প্রতিবছর ক্রসফায়ারে অপরাধীরা মারা যায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যও মারা যায়। অথচ বাংলাদেশে শুধু একপক্ষ মারা যায়, অন্যপক্ষের গায়ে আঁচড়ও লাগে না।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে ফাহিম নিহতের ঘটনাকে আষাঢ়ে গল্প হিসেবে অভিহিত করে ফেসবুকে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট থাকার পরও ফাহিম বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। পুলিশ বলছে, তার বুকের বাঁ পাশে দু’টি গুলীর চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই আশংকাটাই করছিলাম। শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর উপর কথিত হামলাকারী ফাহিমকে রিমান্ডে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন করা হলো। এখন আর কোনো প্রমাণ নেই, সুতরাং নানা কাহিনী চালিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। কেউ ধরা না পড়লে যথারীতি অনেক গল্প শুনতাম। কিন্তু গোল বাঁধিয়েছে এলাকার মানুষ ফাহিমকে ধরে পুলিশে দিয়েছে। ফাহিম কিছুটা সূত্র দিতে পারতো নিশ্চয়ই। যারা ফাহিমের মতো কিশোর-তরুণদের গুম করে এসব অপারেশনে যেতে বাধ্য করে, তাদের পক্ষে এ রকম অবস্থায় বসে থাকলে চলে না। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ফেসবুকে লেখেন, একদিকে সরকার নিজদলীয় সিরিয়াল খুনিদের ফাঁসিসহ সকল সাজা মওকুফ করে দিয়ে জেল থেকে মুক্ত করছে। অন্যদিকে জনতার হাতে ধরাপড়া কথিত হামলাকারী, টার্গেট কিলারদের খুন করে সব প্রমাণ আড়াল করছে। তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? এর নাম কি ন্যায়বিচার? কথিত বন্দুকযুদ্ধের তীব্র সমালোচনা করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বন্দুক তুমি যুদ্ধ চেন, তদন্ত চেন না।’ সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ফাহিম হত্যকা-ই উত্তর, কারা দেশে জঙ্গি টিকিয়ে রেখে সুবিধা পেতে চায়।’ আওয়ামী অটো সরকারের একান্ত অনুগত প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী ফেসবুকে লিখেছেন, আমাদের ভালো ইচ্ছেগুলোকে করে দেয়া হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। ফাহিম ছেলেটির রিপোর্টে পড়ছিলাম আদালতে বিচারককে সে চিৎকার করে বলে এই ঘটনার সাথে সে জড়িত না। স্থানীয় এক নেতা তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। সাধারণত কোনো জঙ্গি এভাবে কোর্টে বলে না। কিন্তু পুলিশ তাকে রিমান্ডে এনে মেরে ফেললো ক্রসফায়ারে? স্থানীয় যে নেতার কথা ফাহিম বলেছিল, সে কি পুলিশের জন্য বিব্রতকর ছিল? ফাহিমের পরিবারের সদস্যরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ফাহিমের নিহত হওয়ার খবরে তার বাবা-মা আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের সন্তান যদি কথিত সন্ত্রাসী কিংবা কোনো জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকে তার বিচার চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মতো নাটক সাজিয়ে হত্যা করতে হবে। এখন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে যে, এ ব্যাপারে কেউ যেন গণমাধ্যমের কাছে কোনো মন্তব্য না করে। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেছেন, যারা অপরাধী তাদেরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ক্রসফায়ার সম্পর্কে বলেছেন, পুলিশ প্রথমে কথিত অপরাধীদের ধরে কোর্ট হাজতে থানায় নিয়ে যায়। এরপর সেই অপরাধীরা পুলিশের রিমান্ড থেকে আর জেলখানায় বা তাদের মা-বাবার কাছে ফিরে যায় না। সাজা চলে যায় ক্রসফায়ারে। হয়তো অপরাধী এমন কিছু তথ্য দেয়, যার ফলে সরকারই জড়িয়ে যাবে। এ জন্য তখন তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে সবারই ধারণা, এমন কোনো কারণ হয়তো থাকতে পারে, যে জন্য ক্রসফায়ারে কলেজ ছাত্র ফাহিমকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ঐ কথিত হামলা ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনই নয়, আরো অনেক কিছু জানার জন্য তাকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি ছিল। প্রতিটি ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে যে কাহিনী শোনানো হয় তা একই রকম হওয়ায় গভীর সন্দেহ জাগায়।
সারাদেশের লাখ লাখ পাঠক, বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া ও জাতীয় দৈনিক সমূহের অনলাইন সংস্করণের কথিত বন্দুক যুদ্ধে ফাহিমের নিহতের খবরে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বলতে গেলে, গোটা দেশবাসী পুলিশের বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য এবং সাজানো নাটক হিসেবে অভিহিত করছেন। কেউ কেউ বলেছেন, প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের পর একইভাবে বক্তব্য দেয় পুলিশ। অথচ সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না কোথায় ক্রসফায়ারের গোলাগুলি হলো। আমজনতা আশ্বস্ত হতে পারছে না পুলিশের কথায়। শুধু দেশের মানুষ নয়, ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগী এবং তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী, সুশীল এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতারাও কথিত বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান ক্রসফায়ার ও কথিত বন্দুকযুদ্ধকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন। সারাদেশের পরিস্থিতি যে খুবই খারাপ তা বুঝতে পেরে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আড়াল করার উদ্দেশ্যে রাজধানী ঢাকা শহরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।
কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের মতো মানবাতাবিরোধী অপরাধ জনগণ সমর্থন করে না, করতে পারে না। আমাদের এই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সাফল্য রয়েছে। র্যাবের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে জঙ্গিনেতা বাংলাভাই ধরা পড়ে এবং তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। শায়খ আব্দুর রহমানকে গ্রেফতার করে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, র্যাব-পুলিশের সম্মুখ যুদ্ধে জেএমবি’র অনেক রাঘব-বোয়াল গ্রেফতার হন। তাদের কারো বিচার হয়েছে। কেউ এখনো বিচারের মুখোমুখি। গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার না থাকায় দেশে আইনশৃঙ্খলাজনিত সংকট, সন্ত্রাসী তাণ্ডব এখন চরম পর্যায়ে। বিদেশি আধিপত্যবাদী আগ্রাসী অপশক্তি ও তাদের এ দেশীয় প্রভাবশালী দোসরদের চক্রান্তে সন্ত্রাস ও কথিত জঙ্গি অপতৎপরতা বেড়ে চলেছে এবং একের পর এক অপহরণ, গুম, খুন এবং গুপ্ত হত্যার ঘটনা ঘটছে। অথচ দেশের শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি মানুষ সন্ত্রাস, কথিত জঙ্গিবিরোধী এবং এ ধরনের হত্যা-গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করে না। মূলত হত্যা কিংবা গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ার কিংবা কথিত বন্দুকযুদ্ধ, কোনোভাবেই চলমান সমস্যা আর সংকটের আদৌ সমাধান দিতে পারবে কী? আমাদের সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং প্রচলিত বিধিবদ্ধ আইনকে কেউ উপেক্ষা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে অপহরণ, খুন, গুম, হত্যা, গুপ্তহত্যা, গ্রেফতার, গণগ্রেফতার, রিমান্ডের নামে বর্বর নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত বন্দুকযুদ্ধ এবং ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের পথ বেছে নিলে তার পরিণাম ভবিষ্যতের জন্য আরো কোনো ভয়াবহ সংকট ডেকে আনবে না তো? জনগণের ভোটের অধিকারের পাশাপাশি বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই আজ বড় বেশি প্রয়োজন। অন্যথায় গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা কেবল বেড়েই যাবে। বর্তমানে দেশে কথিত জঙ্গি শুধু আইনশৃঙ্খলাজনিত সংকট নয়। এটা রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিকভাবেই এই সংকটের সমাধান করতে হবে বলেই আমরা মনে করি।
পুলিশের নিরাপদ হেফাজতে এবং নিñিদ্র পাহারার মধ্যে থাকার পরও যদি দেশের কোন নাগরিক হত্যার শিকার হয় তবে তার দায় পুলিশ এড়াতে পারে কি? ফাহিম ছিল রিপন চক্রবর্তীর উপর কথিত হামলার ঘটনায় একমাত্র আসামী। তার গ্রেফতার করার কৃতিত্ব কিন্তু পুলিশের নয়, আশপাশের কিছু লোক তাকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। গত কয়েক দিনে পুলিশের পক্ষ থেকে তার সম্পর্কে নানা সাজানো-গোছানো কথা বলা হয়েছে। তার কাছ থেকে হামলার উদ্দেশ্য, হামলায় আরো কারা কারা জড়িত ছিল, নেপথ্যে কারা ছিল এসব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেত। অথচ প্রকৃত অপরাধী ও কুশীলবদের আড়াল করতেই হয়তো তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হলো।
দেশের অনেকেই শর্ষের ভেতর ভূতের প্রতিচ্ছবি দেখছেন। টিভির টকশোগুলোতে এ হত্যাকা- নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুগত কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরীক দলের নেতা এবং ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগীদের অনেকেই ‘পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ’ এবং ‘ক্রসফায়ার করে হত্যাকা-’ ঘটনো নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী অটো সরকারের বন্ধু স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল স্পষ্টভাবেই বলেছেন, রাষ্ট্র আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের প্রশ্নÑ পুলিশ কাকে আড়াল করতে এই কথিত বন্দুকযুদ্ধ করেছে? ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরীক জাসদ নেতা মাইনুদ্দিন খান বাদলও কথিত বন্দুকযুদ্ধের তীব্র প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছেন। পুলিশ রিমান্ডে থাকা কলেজছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম পুলিশেরই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা মিডিয়ায় যখন তোলপাড় চলছে, তখনই ঢাকার খিলগাঁও মেরাদিয়া বাঁশপট্টিতে ব্লগার অভিজিত হত্যা মামলার আসামী শরিফুল ভেবে যে যুবককে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়, পরে জানা যায় তার নাম মুকুল রানা।
পুলিশের রিমান্ডের আসামীর ক্রসফায়ারে হত্যা করা বা মেরে ফেলার ঘটনা নাৎসী বাহিনীর বর্বর হত্যাকা-ের ভয়াবহ ঘটনাকেই মনে করিয়ে দেয়। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, রাষ্ট্রের হেফাজতে যখন আসামী থাকে তখন সকল দায় রাষ্ট্রের। একজন শিক্ষকের উপর কথিত হামলা করতে গিয়ে সে স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক হলো। পরে পুলিশ বলেছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এরপর পুলিশী রিমান্ডে হ্যান্ডকাফ বাঁধা অবস্থায় কিভাবে এটা হলো তা সাধারণ বুদ্ধিতে ধরে না। বলা বাহুল্য, সাধারণ বুদ্ধিতে না ধরার কিছু নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেছেন, বড় কোন ঘটনাকে আড়াল করতেই এ ঘটনা ঘটানো হলো কিনা এ ধরনের প্রশ্ন জনগণের মধ্যে আসতে পারে। কোন প্রশ্ন নয়, বিএনপির পক্ষ থেকে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতেই ক্রসফায়ারে ফাহিমকে হত্যা করা হয়েছে।
জানা যায়, সারা দেশে গত সাড়ে তিন বছরে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার এবং পুলিশী হেফাজতে ৪৫৬ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৭২ জন, ২০১৪ সালে ১২৮ জন, ২০১৫ সালে ১৮৩ জন এবং চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৭৩ জন কথিত বন্দুকযুুদ্ধে বা পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সব কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের সাজানো গোছানো কাহিনী ছিল প্রায় অভিন্ন। পুলিশের রিমান্ডে থাকাবস্থায় মাদারীপুরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে কলেজছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বিবিসি বাংলাকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশী রিমান্ডের সময় আইনজীবী এবং নিকট আত্মীয় ও পরিচিত কারো উপস্থিতির বিধান থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। দেশে কারো কোন সন্দেহ নেই যে, পুলিশ তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ মেরে ফেলছে। ২০০৪-০৫ সালে হয়তো কেউ কেউ পুলিশের ক্রসফায়ারের কিচ্ছা বিশ্বাস করতো, এখন কেউ বিশ্বাস করে না। তিনি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মেনে নিম্ন আদালতের রিমান্ডে মঞ্জুরের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বাংলা ভিশনের টকশোতে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার গত ১৫ থেকে ২০ বছরের পুলিশের একটি ধারাবাহিক গল্প। যে গল্পের কাহিনী, দৃশ্য, চরিত্র, অংক কোন কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। ক্রসফায়ার বিষয়টা হচ্ছে একটি বিশেষ অভিযানে কখনো কখনো কথিত অপরাধীর পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ হয়, যে যুদ্ধে পুলিশ নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য গুলী করে। তখন ঐ গুলীতে অপরাধীর কেউ মারা যায়। এমন একটি গল্প আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন তদন্তে পুলিশকে অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়নি। এমনকি আজ পর্যন্ত কোন পুলিশ বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে মারা গেছে এ রকম দেখিনি। এক অপরাধ বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমেরিকায় প্রতিবছর ক্রসফায়ারে অপরাধীরা মারা যায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যও মারা যায়। অথচ বাংলাদেশে শুধু একপক্ষ মারা যায়, অন্যপক্ষের গায়ে আঁচড়ও লাগে না।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে ফাহিম নিহতের ঘটনাকে আষাঢ়ে গল্প হিসেবে অভিহিত করে ফেসবুকে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট থাকার পরও ফাহিম বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। পুলিশ বলছে, তার বুকের বাঁ পাশে দু’টি গুলীর চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই আশংকাটাই করছিলাম। শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর উপর কথিত হামলাকারী ফাহিমকে রিমান্ডে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন করা হলো। এখন আর কোনো প্রমাণ নেই, সুতরাং নানা কাহিনী চালিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। কেউ ধরা না পড়লে যথারীতি অনেক গল্প শুনতাম। কিন্তু গোল বাঁধিয়েছে এলাকার মানুষ ফাহিমকে ধরে পুলিশে দিয়েছে। ফাহিম কিছুটা সূত্র দিতে পারতো নিশ্চয়ই। যারা ফাহিমের মতো কিশোর-তরুণদের গুম করে এসব অপারেশনে যেতে বাধ্য করে, তাদের পক্ষে এ রকম অবস্থায় বসে থাকলে চলে না। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ফেসবুকে লেখেন, একদিকে সরকার নিজদলীয় সিরিয়াল খুনিদের ফাঁসিসহ সকল সাজা মওকুফ করে দিয়ে জেল থেকে মুক্ত করছে। অন্যদিকে জনতার হাতে ধরাপড়া কথিত হামলাকারী, টার্গেট কিলারদের খুন করে সব প্রমাণ আড়াল করছে। তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? এর নাম কি ন্যায়বিচার? কথিত বন্দুকযুদ্ধের তীব্র সমালোচনা করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বন্দুক তুমি যুদ্ধ চেন, তদন্ত চেন না।’ সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ফাহিম হত্যকা-ই উত্তর, কারা দেশে জঙ্গি টিকিয়ে রেখে সুবিধা পেতে চায়।’ আওয়ামী অটো সরকারের একান্ত অনুগত প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী ফেসবুকে লিখেছেন, আমাদের ভালো ইচ্ছেগুলোকে করে দেয়া হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। ফাহিম ছেলেটির রিপোর্টে পড়ছিলাম আদালতে বিচারককে সে চিৎকার করে বলে এই ঘটনার সাথে সে জড়িত না। স্থানীয় এক নেতা তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। সাধারণত কোনো জঙ্গি এভাবে কোর্টে বলে না। কিন্তু পুলিশ তাকে রিমান্ডে এনে মেরে ফেললো ক্রসফায়ারে? স্থানীয় যে নেতার কথা ফাহিম বলেছিল, সে কি পুলিশের জন্য বিব্রতকর ছিল? ফাহিমের পরিবারের সদস্যরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ফাহিমের নিহত হওয়ার খবরে তার বাবা-মা আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের সন্তান যদি কথিত সন্ত্রাসী কিংবা কোনো জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকে তার বিচার চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মতো নাটক সাজিয়ে হত্যা করতে হবে। এখন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে যে, এ ব্যাপারে কেউ যেন গণমাধ্যমের কাছে কোনো মন্তব্য না করে। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেছেন, যারা অপরাধী তাদেরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ক্রসফায়ার সম্পর্কে বলেছেন, পুলিশ প্রথমে কথিত অপরাধীদের ধরে কোর্ট হাজতে থানায় নিয়ে যায়। এরপর সেই অপরাধীরা পুলিশের রিমান্ড থেকে আর জেলখানায় বা তাদের মা-বাবার কাছে ফিরে যায় না। সাজা চলে যায় ক্রসফায়ারে। হয়তো অপরাধী এমন কিছু তথ্য দেয়, যার ফলে সরকারই জড়িয়ে যাবে। এ জন্য তখন তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে সবারই ধারণা, এমন কোনো কারণ হয়তো থাকতে পারে, যে জন্য ক্রসফায়ারে কলেজ ছাত্র ফাহিমকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ঐ কথিত হামলা ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনই নয়, আরো অনেক কিছু জানার জন্য তাকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি ছিল। প্রতিটি ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে যে কাহিনী শোনানো হয় তা একই রকম হওয়ায় গভীর সন্দেহ জাগায়।
সারাদেশের লাখ লাখ পাঠক, বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া ও জাতীয় দৈনিক সমূহের অনলাইন সংস্করণের কথিত বন্দুক যুদ্ধে ফাহিমের নিহতের খবরে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বলতে গেলে, গোটা দেশবাসী পুলিশের বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য এবং সাজানো নাটক হিসেবে অভিহিত করছেন। কেউ কেউ বলেছেন, প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের পর একইভাবে বক্তব্য দেয় পুলিশ। অথচ সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না কোথায় ক্রসফায়ারের গোলাগুলি হলো। আমজনতা আশ্বস্ত হতে পারছে না পুলিশের কথায়। শুধু দেশের মানুষ নয়, ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগী এবং তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী, সুশীল এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতারাও কথিত বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান ক্রসফায়ার ও কথিত বন্দুকযুদ্ধকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন। সারাদেশের পরিস্থিতি যে খুবই খারাপ তা বুঝতে পেরে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আড়াল করার উদ্দেশ্যে রাজধানী ঢাকা শহরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।
কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের মতো মানবাতাবিরোধী অপরাধ জনগণ সমর্থন করে না, করতে পারে না। আমাদের এই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সাফল্য রয়েছে। র্যাবের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে জঙ্গিনেতা বাংলাভাই ধরা পড়ে এবং তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। শায়খ আব্দুর রহমানকে গ্রেফতার করে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, র্যাব-পুলিশের সম্মুখ যুদ্ধে জেএমবি’র অনেক রাঘব-বোয়াল গ্রেফতার হন। তাদের কারো বিচার হয়েছে। কেউ এখনো বিচারের মুখোমুখি। গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার না থাকায় দেশে আইনশৃঙ্খলাজনিত সংকট, সন্ত্রাসী তাণ্ডব এখন চরম পর্যায়ে। বিদেশি আধিপত্যবাদী আগ্রাসী অপশক্তি ও তাদের এ দেশীয় প্রভাবশালী দোসরদের চক্রান্তে সন্ত্রাস ও কথিত জঙ্গি অপতৎপরতা বেড়ে চলেছে এবং একের পর এক অপহরণ, গুম, খুন এবং গুপ্ত হত্যার ঘটনা ঘটছে। অথচ দেশের শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি মানুষ সন্ত্রাস, কথিত জঙ্গিবিরোধী এবং এ ধরনের হত্যা-গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করে না। মূলত হত্যা কিংবা গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ার কিংবা কথিত বন্দুকযুদ্ধ, কোনোভাবেই চলমান সমস্যা আর সংকটের আদৌ সমাধান দিতে পারবে কী? আমাদের সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং প্রচলিত বিধিবদ্ধ আইনকে কেউ উপেক্ষা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে অপহরণ, খুন, গুম, হত্যা, গুপ্তহত্যা, গ্রেফতার, গণগ্রেফতার, রিমান্ডের নামে বর্বর নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত বন্দুকযুদ্ধ এবং ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের পথ বেছে নিলে তার পরিণাম ভবিষ্যতের জন্য আরো কোনো ভয়াবহ সংকট ডেকে আনবে না তো? জনগণের ভোটের অধিকারের পাশাপাশি বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই আজ বড় বেশি প্রয়োজন। অন্যথায় গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা কেবল বেড়েই যাবে। বর্তমানে দেশে কথিত জঙ্গি শুধু আইনশৃঙ্খলাজনিত সংকট নয়। এটা রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিকভাবেই এই সংকটের সমাধান করতে হবে বলেই আমরা মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন