সৃষ্টি জগতের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ। তবে এখানে বলার মতো একটি বিষয় রয়েছে। মানুষ স্বতই শ্রেষ্ঠ নয়, শ্রেষ্ঠ হওয়ার মতো সম্ভাবনা মানুষের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে। কাক্সিক্ষত গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে মানুষ শ্রেষ্ঠ হতে পারে। মানুষ যেমন তার সম্ভাবনার কথা জানে, তেমনি জানে সীমাবদ্ধতার কথাও। তাই তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে একে অপরের সহযোগিতায় উন্নত জীবন যাপনের লক্ষ্যে। কালক্রমে মানুষ রাষ্ট্র গঠন করেছে, সংবিধান রচনা করেছে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের মাধ্যমে প্রগতির অভিযাত্রাকে আরো সমুন্নত করতে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, মানুষ কিংবা মানুষের রাষ্ট্র সব সময় কাক্সিক্ষত অভিযাত্রায় চলতে পারেনি। কখনো মানুষ, কখনো রাষ্ট্র হয়েছে পথচ্যুত ও পথভ্রষ্ট। বর্তমান সময়েও আমরা তেমন চিত্র লক্ষ্য করছি। সন্ত্রাসবাদের দানব ক্রমশই তার থাবা বিস্তার করছে এবং বর্তমান সভ্যতায় মানুষের জনপদ পরিণত হয়েছে আতঙ্কের জনপদে। কখন যে কে কোনদিক থেকে হামলা করবে এবং মানুষের জীবন ঝলসে যাবে তার কোনো তথ্য নেই। মানুষের হাতে মানুষ এভাবে নিহত হবে, সমাজ বিপর্যস্ত হবে- এজন্য তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়নি কিংবা রাষ্ট্র গঠন করেনি।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে মনে হয়, সন্ত্রাসবাদই যেন বর্তমান সময়ের সবচাইতে বড় সমস্যা। সবাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথাও বলছে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। তারপর আমরা ইরাক ও আফানিস্তানে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি, ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি লিবিয়া ও সিরিয়ায়। বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের ফলে সন্ত্রাস কমেনি বরং বেড়েছে। এক সময় আমরা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে আল কায়েদার নাম বেশি শুনতাম। এখন শুনছি আইএস-এর কথা। আইএস-এর সন্ত্রাস এবং ধ্বংসযজ্ঞ বর্তমান সময়ে মানুষের জনপদগুলোকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সবাই যখন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এবং পরাশক্তিগুলো যখন সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তখন সন্ত্রাসবাদ পরাজিত হচ্ছে না কেন? এখানে কোনো রহস্য বা গোমড় আছে কি না সেই প্রশ্ন পুরানো। এখন তো স্বয়ং যুক্তরাজ্যের সরকার মহল থেকেও বলা হচ্ছে, আমেরিকার কারণেই আইএস সৃষ্টি হয়েছে। আর ইরাক যুদ্ধবিষয়ক বৃটিশ তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান জন চিলকোট তো বলেছেন, ভুল গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে ইরাক যুদ্ধে জড়িয়েছিল বৃটেন। ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের তথ্য ছিল ভিত্তিহীন। ইরাকের বিরুদ্ধে বৃটেনের আগ্রাসী যুদ্ধকে ত্রুটিপূর্ণ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির রিপোর্টটিও সঠিক ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন জন চিলকোট। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, যুদ্ধের কারণে যে ঝুঁকি তৈরি হবে তা যথাযথভাবে নির্ধারণ করতে সমর্থ হয়নি বৃটেন। ইরাক যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই তো আজকের এই আইএস এবং সন্ত্রাস-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এরপরও কি সন্ত্রাসবাদের জন্য ইসলাম, মুসলিম কিংবা অন্য কাউকে অভিযুক্ত করা যায়?
আমাদের প্রিয় স্বদেশও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে। গুলশান হামলায় কেঁপে উঠেছে পুরো দেশ। আমরা জানি, বাংলাদেশের মানুষ এবং তাদের ধর্মীয় চেতনা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। ফলে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালালে এ দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ পালাতে বাধ্য হবে। তবে এই লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালাতে হবে দুইভাবে। দেশের ভেতরে সন্ত্রাসের মানসিকতা দূর করার লক্ষ্যে রাজনীতিতে পেশিশক্তির বদলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তথা সহিষ্ণুতার প্রসার ঘটাতে হবে। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করার লক্ষ্যে সর্বস্তরে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এছাড়া উন্নত মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে নৈতিক চেতনার প্রসার ঘটাতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে এভাবে পরিগঠিত করা গেলে বাইরের কোনো শক্তি বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে না। ভেতরের এই কাজকে গুরুত্ব না দিয়ে যদি যাথারীতি ব্লেমগেমে উৎসাহ দেখানো হয় তাহলে সন্ত্রাসবাদ পরাজিত হবে কেমন করে? সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ভুল পথ গ্রহণ করা হলে সন্ত্রাসবাদের সংকট আরো বেড়ে যাবে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বড় বড় শক্তিগুলোর মদদ কেমন পরিণতি ডেকে এনেছে? ওই দেশগুলোর উদাহরণ থেকেও কি আমরা কোনো শিক্ষা নেব না? বাস্তবতা হলো কাছের বা দূরের কোনো বড় দেশকেই বাংলাদেশে সন্ত্রাস নির্মূলে নাক গলাতে দেওয়া যাবে না। বড় বড় দেশগুলোর স্বার্থও বড়। ওদের স্বার্থের চাপ বহন করার মত সামর্থ্য ছোটদেশগুলোর নেই, বাংলাদেশেরও নেই। আমাদের বুঝতে হবে বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির ফসল এই সন্ত্রাসবাদ। তাই বড় দেশগুলোর লক্ষ্য ও কৌশল সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বাইরের বিপদ মোকাবিলা তখনই সহজ হবে, যখন আমরা ভেতরের দুর্বলতাগুলো দূর করতে পারবো। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে শুধু চাতুর্য ও কথামালা দিয়ে সন্ত্রাসবাদের মহাবিপদ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন