শনিবার, ২ জুলাই, ২০১৬

বাংলার মানুষ গুলশানের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না


পাঠক ভাইয়েরা ব্যাকুল প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছেন, গুলশানের ঐ স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে হামলা এবং অতঃপর যৌথ বাহিনীর কমান্ডো অপারেশনের সর্বশেষ খবর জানার জন্য। আপনারা আজকের খবরের কাগজের সর্বশেষ সংবাদে হয়তো সেটা পেয়ে যাবেন অথবা ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছেন। কিন্তু আমি আপনাদেরকে এই কলামে সেই সর্বশেষ সংবাদ দিতে পারছি না। কারণ টেলিভিশনে ঘোষণা করা হলো যে, আইএসপিআর নামক সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ দপ্তর থেকে আজ (শনিবার) বিকাল ৩.৩০ মিনিটে একটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠান করা হবে। ঐ সংবাদ সম্মেলনে সর্বশেষ পরিস্থিতি বলা হবে। ঐ সংবাদ সম্মেলন দেখে এবং শুনে এই কলামে খবর দেয়া এবং মন্তব্য দেয়ার সময় আর থাকবে না। তাই আপনাদেরকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে পারছি না। তবে ইতোমধ্যেই কিছু কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে, যেগুলো আর পরিবর্তিত হবে না। তবে এই ঘোষণা দেওয়ার পরবর্তী ঘোষণায় বলা হয় যে, বেলা সাড়ে ১২ টায় আইএসপিআরের প্রেস ব্রিফিং হবে। সাড়ে ১২ টায় প্রেস ব্রিফিং হয়নি।
বেলা দেড়টার দিকে সেনা সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশন্সের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী জানান, রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জিম্মিদের মধ্যে গতকাল শুক্রবার রাতেই ২০ জন বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। তবে এঁরা কে কোন দেশের তা আজ দুপুর পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি আইএসপিআর। এই ২০ বিদেশি নাগরিকের মধ্যে পাঁচজন নারী ছিলেন। নাঈম আশফাক বলেন, অভিযানের মাধ্যমে তিনজন বিদেশি, যাদের মধ্যে একজন জাপানি ও দুজন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযানে সাতজন সন্ত্রাসীর মধ্যে ছয়জন নিহত হয় এবং এক সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া অভিযান শেষে তল্লাশিকালে ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। যাদের সবাইকে গতরাতেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়।
॥দুই॥
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই নাঈম আশফাক চৌধুরী ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারি নামের একটি রেস্তোরাঁয় দুষ্কৃতকারীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ভেতরে প্রবেশ করে। রেস্তোরাঁর সবাইকে জিম্মি করে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরবর্তীতে পুলিশ কর্ডন করে সন্ত্রাসীদের যথেচ্ছ কর্মকাণ্ড থেকে নির্বৃত্ত করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-র‌্যাব ও বিজিবি যে সাহসিকতা, আন্তরিকতা ও পেশাদারি প্রদর্শন করেছে, তা অনন্য।’
আইএসপিআরের সংবাদ সম্মেলনে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘এই অভিযানকালে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা শাহাদত বরণ করেন এবং ২০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য আহত হন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে সরকার প্রধান কর্তৃক আদেশ প্রদান করা হয়। সে মোতাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাবাহিনী গতকাল রাত থেকেই ঘটনাস্থলে অবস্থানরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সম্মিলিতভাবে অপারেশন থান্ডারবোল্ট পরিচালনা করে।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এয়ার কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে অপারেশনের অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে সকাল আটটায় অপারেশনের সব কার্য সম্পন্ন করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে প্রাথমিকভাবে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত পিস্তল, ফোল্ডেট বাঁট একে ২২ রাইফেল, বিস্ফোরিত আইইডি, ওয়াকি টকি সেট ও অনেক ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, অভিযানে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের কেউ হতাহত হয়নি।
গতকাল রাতে অপারেশনে অংশ নেয়া পুলিশের নিহত দুজন কর্মকর্তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে এই সেনা কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সার্বিক কৌশলের মাধ্যমে অতি দ্রুততার সঙ্গে অভিযান সফল করার জন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সরকার প্রধানের সময়োচিত, সাহসী, দৃঢ় ও সঠিক দিক-নির্দেশনার জন্য এই অভিযান সফল হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে এই ঘটনার বিষয়াবলি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আপনাদের জানানো হবে।’
শুক্রবার রাত ১২ টার পর র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের বলেন যে, এখানে যা ঘটছে তার প্রতি মুহূর্তের আপডেট প্রকাশ বা সম্প্রচার করবেন না। তার ভাষায়, বৃহত্তর জনস্বার্থেই তিনি সাংবাদিকদের এই অনুরাধ করছেন। দেখা গেল, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদের এই অনুরোধের পর টিভির সরাসরি সম্প্রচারে আহত বা নিহতদের খবর এবং গোলাগুলির দৃশ্য আর সম্প্রচার করা হয়নি।
পরদিন অর্থাৎ শনিবার সকাল ৭.৪০ মিনিটে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে অংশগ্রহণ করেন সেনাবাহিনী। তাদের সাথে ছিল ১০ টি সাজোয়া যান (আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার)। আরো ছিল নৌ বাহিনীর কমান্ডো ইউনিট, বিডিআর, পুলিশের বোমা বিশেষজ্ঞ এবং কমান্ডো অপারেশনে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সোয়াত বাহিনী, পুলিশ এবং র‌্যাব। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, হামলাকারীদেরকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল।
সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ধ্যার পর জাতির উদ্দেশ্যে রডিও ও টেলিভিশনে ভাষণ দেবেন। হতে পারে এই ভয়াবহ ঘটনার এখনো যেসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে হয়তো সেসব প্রশ্নের উত্তর থাকবে। তবে আমার এই লেখা সেই ভাষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না। তার আগেই এটা প্রেসে পাঠাতে হবে।
এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’। এই অপারেশন থান্ডার বোল্টের আগে পুলিশ বাহিনীর যেসব অফিসার শাহাদাত বরণ করেছেন আমরা তাদের সাহসিকতার প্রশংসা করছি এবং তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। একই সাথে তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। অপারেশন শুরুর আগে রাতে যে ২০ জন জিম্মিকে হত্যা করা হয়েছে সেই বীভৎস এবং নারকীয় হত্যাকাণ্ডের আমরা তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছি। এই লেখার সময় পর্যন্ত এই ২০ জনের জাতি, ধর্ম এবং বর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়নি। জাতি, ধর্ম মোতাবেক আমরা তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাদের প্রত্যেকের পরিবারের ব্যথায় আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে অদম্য সাহস, ক্ষিপ্রতা এবং যোগ্যতার সাথে মাত্র ১৩ মিনিটের মধ্যে এত বড় এবং ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করা হলো তার জন্য আমরা অপারেশন লিডার আর্মি, নেভি এবং অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিক প্রশংসা করছি এবং তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এই অপারেশনের মাধ্যমে একটি জিনিস প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন একটি যোগ্য, প্রশিক্ষিত এবং দুর্ধর্ষ সেনা বাহিনী। জাতির সামনে যখনি কোন অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবে তখনই সেই সংকট সাফল্যের সাথে আমাদের সেনাবাহিনী মোকাবেলা করতে পারবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
॥তিন॥
আমি আগেই বলেছি যে, যে ২০ জন জিম্মি মারা গেছেন তাদের সকলের নাম ধাম এবং জাতি ধর্ম সহ পরিচয় প্রকাশিত হওয়া দরকার। হয়তো সেটি হবেও। সেই সাথে এটিও জানা দরকার যে কারা এই জঙ্গি হামলা চালালো। টেলিভিশন সংবাদে দেখলাম, তিনটি দল এই হামলার দায় দায়িত্ব স্বীকার করেছে। এরা হলো, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট বা আইএস। বিগত ৪৫ বছরে আমাদের পুলিশ এবং গোয়েন্দা বাহিনীও দক্ষতা অর্জন করেছে। আমাদের বিশ্বাস, কারা এই হামলা করেছে তাদেরকে ঠিকই সনাক্ত করতে পারবে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
একই সাথে বৃহত্তর পরিসরে একটি কথা না বললেই নয়। আমরা যারা কিছুটা বয়স্ক তারা দেখেছি, অতীতে এই দেশে অভূতপূর্ব সামাজিক সম্প্রীতি নিয়ে বাস করেছে দুইটি বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়। তারা হলো মুসলমান এবং হিন্দু। সেই অপূর্ব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাই ফুটে উঠেছে সেই পল্লী সংগীতে, “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”। আমরা গ্রামেও বাস করেছি, মফস্বল শহরেও বাস করেছি। আগে তো হিন্দুদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে, বিশেষ করে পঞ্চাশ দশকে সেদিনের পূর্ব বাংলা এবং আজকের বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৩০ ভাগ। অথচ তার পরেও হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রদায়গত মিল ছিল। আমাদের অনেকেরই ব্যক্তি জীবনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন হিন্দু। অথচ আজ যখন হিন্দু জনসংখ্যা ১০ শতাংশেরও নিচে তখন সমাজে দেখা দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা। একমাত্র ১৯৬৪ সাল ছাড়া এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। অথচ প্রতিবেশী ভারতে শত শত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছে। গুজরাটের গোধরায় একটি ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। তারপরেও সেই মাত্রায় সেই স্কেলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি।
অতীতকে আমাদের পটভূমিতে রেখে আজ সরকারকে খুব সিরিয়াসলি ভাবতে হবে, কেন এই সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। যেভাবে একের পর এক গুপ্ত হত্যা হচ্ছে সেগুলো তো অতীতে এদেশে ছিল না। আজ কেন সেগুলো ঘটছে? গুলশানে যে বীভৎস হত্যাকা- ঘটে গেল সেটি কিন্তু ইতঃপূর্বে ঘটেছে ইরাকে, ঘটেছে আফগানিস্তানে, ঘটেছে সিরিয়ায়, ঘটেছে পাকিস্তানে এবং সাম্প্রতিককালে ঘটছে তুরস্কে। বাংলাদেশ তো এসব দেশের তুলনায় শিশুর মতো শান্ত ছিল। সেই দেশে এক রাতের ঘটনায় জিম্মি, পুলিশ এবং জঙ্গিসহ অন্তত ২৮ ব্যক্তি নিহত হলেন। এই নিহতের তালিকায় পুলিশের ওসি এবং পুলিশের সহকারী কমিশনারও রয়েছেন। এই ধরনের হত্যাকা-ের লোমহর্ষক ঘটনা আমরা অতীতে কখনো শুনিনি। কিন্তু আজ আমরা সেই সব ঘটনা শুধু শুনছি না, চর্ম চক্ষে দেখছিও। কেন ঘটছে এইসব ভয়াবহ, ভয়ংকর, বীভৎস ও লোমহর্ষক ঘটনা? সরকারকে সেটি গভীরভাবে ভাবতে হবে। সেনাবাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়তো এই ধরনের অপরাধ দমন করা যাবে। কিন্তু তাই বলে তার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবে না। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি একজন সমাজ বিজ্ঞানীর দৃষ্টি নিয়েও সরকারকে বিষয়গুলো ভাবতে হবে। ভাবার পর একটি সুষ্ঠু সমাধান বের করতে হবে। সেই সমাধানে রাজনৈতিক দল সহ সমাজের সব শ্রেণী এবং পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। শুধু আমরা নই, এদেশের মানুষ গুলশানের নারকীয় হত্যা যজ্ঞের পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চায় না। 
আসিফ আরসালান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads